পশ্চিমা বিশ্বে উপেক্ষিত ফিলিস্তিনের গণহত্যা, ইহুদি তোষণ ও বিশ্বশান্তির বিপদ
মানুষের পৃথিবীতে আবারও মানবতার মৃত্যু ঘটলো। যুদ্ধের নামে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে বধ্যভূমিতে পরিণত করা হয়েছে গাজা নামক খুবই ছোট্ট জনপদ। গাজা উপত্যকা অবরুদ্ধ করে সেখানে টানা বোমাবর্ষণ করছে ইসরায়েলি বাহিনী। জাতিসংঘ বলছে, গাজার ৫০ হাজার অন্তঃসত্ত্বা নারী প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ও সুপেয় পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে কয়েক হাজার ছাড়িয়েছে। সেখানে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ৩ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ, যারা জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে ঊধ্বশ্বাসে পালাচ্ছে।
এই মর্মন্তুদ পরিসংখ্যানকে যুদ্ধের বিবরণী বলা যায় না। সাফ কথায় বলতে হয়, গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ, যাতে মানবতার মৃত্যু হয়েছে। গাজার সবচেয়ে বড় আল শিফা হাসপাতাল। এর মর্গ উপচে পড়ছে ফিলিস্তিনিদের লাশে। করিডোরেও স্থান নেই। সেই লাশের সারি এখন পার্কিং এলাকায়। আত্মীয়রা লাশ শনাক্ত করার আগেই দ্রুততার সঙ্গে আসছে আরও লাশ। খোলা স্থানে সারি সারি লাশ জমছে। গাজা উপত্যকার ২৩ লাখ মানুষের ওপর ইসরাইলের তীব্র থেকে তীব্রতর বোমা হামলায় এই লাশের সংখ্যা দ্রুতই বেড়ে যাচ্ছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বেচ্ছাসেবকরা পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠতে পারছেন না। এ খবর দিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম।
ধ্বংসস্তুপে পরিণত গাজা জনপদে খাবার, পানি, বিদ্যুৎ ও প্রয়োজনীয় জিনিসের সংকট চলছে। এমনকি, রাতেও সেখানে নির্বিচারে বিমান হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল। গাজা উপত্যকা অবরুদ্ধ করে সেখানে টানা বোমাবর্ষণের ঘটনায় বিশ্ববিবেক মানবিকতার পক্ষে যে প্রতিক্রিয়া দেথাতে পারতো, তা দেখায় নি। বরং একতরফা ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানাতে ইসরায়েল সফরে যাবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন এরই মাঝে ইসরায়েল যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনও ইসরায়েল যাবেন বলে জানা গেছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বৃহস্পতিবার ইসরায়েল সফরে গিয়ে দেশটির প্রতি অব্যাহত সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মার্কিন সামরিক ও কৌশলগত সাহায্য অব্যাহত রয়েছে ইসরায়েলের প্রতি। ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেনসহ পশ্চিমা বিশ্ব িইসরায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনের সমর্থনে সব ধরনের বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করেছে।
দৃশ্যত ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন যুদ্ধে বৈশ্বিক মেরুকরণ হয়েছে একতরফা। ইসরায়েলে যে সাহায্য ও সহানুভূতি পাচ্ছে, তার বিন্দুমাত্রও পাচ্ছে না আক্রান্ত ফিলিস্তিনিরা। ফলে পশ্চিমা বিশ্বে উপেক্ষিত ফিলিস্তিনের গণহত্যা ও চলছে ইহুদি তোষণ। যার পরিণতিতে শান্তি ও ভারসাম্যের পরিবেশ আরও বিঘ্নিত হবে। চরম ইসরায়েলি আক্রমণ ও তোষণের পরিপ্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনিরাও মরণ আঘাত হানতে বাধ্য হবে। এমন পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ও শান্তি থেকে যাবে অধরা।
অথচ ইতিহাসের পাঠ থেকে জানা যায় যে,প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন নামটা এসেছে বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন থেকে। তবে প্যালেস্টাইন দেশটি কিন্তু বাইবেলের থেকেও পুরনো। আর এই বিষয়টিকেই জোর দিয়ে দেখিয়েছেন গবেষকগণ। ফিলিস্তিন জাতি এবং তাদের সংস্কৃতির আদি উৎসের খোঁজ করলে দেখা যায়, বাইবেলেরও বহু আগে থেকেই ফিলিস্তিনি জাতির একটি নিজস্ব সংস্কৃতি এবং পরিচয় রয়েছে। সুপ্রাচীন ব্রোঞ্জ যুগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে দেখা যায়, বিভিন্ন ঘটনার কারনে আসলে ফিলিস্তিনের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। ইসরায়েলের সাথে কণফ্লিক্টও এর একটি বড় কারণ। তবে ফিলিস্তিনের ইতিহাস আসলে খুবই রোমাঞ্চকর এবং অনেক জটিল, যা একতরফা মনোভাবের মাধ্যমে সুরাহা করা সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, মানব ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীনকালে যেসব অঞ্চলে মানুষ বসতি স্থাপন করেছিল তার মধ্যে একটি হলো বর্তমান প্যালেস্টাইন অঞ্চল। কিন্তু এই অঞ্চলের দখল নিয়ে ইতিহাসের প্রথম থেকেই চলছে একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ভেবে অবাক হতে হয়, কয়েক হাজার বছরের পুরনো সেই লড়াই এখনো পর্যন্ত চলছে। তার অবশ্য কারণও রয়েছে। একদিকে থেকে বিবেচনা করলে এই অঞ্চলটি হলো তিনটি মহাদেশের মিলনস্থল, তাই ভূ-রাজনৈতিক কারণে অঞ্চলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কালে কালে বিভিন্ন সাম্রাজ্য এই অঞ্চলকে দখলে রাখতে চেয়েছে। বিভিন্ন জাতি ও ধর্ম সেখানে আবাস গড়েছে, যাদের সকলেই এক আল্লাহ বা একেশ্বরবাদের অনুসারী হলেও ঐক্য বা সম্প্রীতির বদলে বিভিদের মধ্যে জড়িয়েছে।
প্রাচীন মিশরীয়রা, প্রাচীন পার্সিয়ানরা, আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, রোমান সাম্রাজ্য, মধ্যযুগীয় মুসলিম রাজবংশ, ক্রুসেডাররা, অটোম্যান সাম্রাজ্য, আর একদম হাল আমলে এসে ব্রিটিস সাম্রাজ্য এই অঞ্চল শাসন করেছে। ব্রিটিশরা এই অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার পর সারা বিশ্বের ইহুদিরা এই ফিলিস্তিন এলাকার একটি বড় অংশ দখল করে তাদের নিজেদের জাতির জন্য “ইসরায়েল রাষ্ট্র” স্থাপন করে এবং মূল বাসিন্দাদের প্রতিনিয়ত আঘাত করছে। বর্তমানে ফিলিস্তনের বুকে মধ্যে িইসরায়েল প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আর ফিলিস্তিনিরা হয়ে পড়েছে উদ্বাস্তু।
ইসরায়েলের ইহুদিরা মনে করে যে, প্যালেস্টাইনের বাসিন্দারা এই অঞ্চলে নতুন এসে বসতি গড়েছে, আর ইহুদিরা নিজেরা হলো এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ও প্রাচীন লিপির সাহায্যে গবেষকগণ দেখিয়েছেন যে, প্যালেস্টাইন ধারনাটাই আসলে বাইবেলের প্যালেস্টাইনের চেয়ে অনেক পুরনো। অর্থাৎ ইহুদিরা ওল্ড টেস্টামেনের রেফারেন্স দিয়ে যে ইতিহাস বলে, আসলে এই অঞ্চলের ইতিহাস আরও বেশি পুরনো। তার মানে ওল্ড টেস্টামেনে উল্লিখিত সময়ে আদি ইহুদি গোষ্ঠী যখন এই অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে, তার আগের থেকেই এই অঞ্চলে প্যালেস্টাইনের জনগণ বসবাস করত। অতএব ইসরায়েল শুধু ইহুদিদের একক দেশ. এই তথ্য সত্য নয়। ফিলিস্তিনিরা সেখানকার প্রাচীন বাসিন্দা।
ইসরায়েল যদি ফিলিস্তান দখল করে একটি অংশ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতো, তাহলে হয়ত সমস্যা এতো প্রকট হতো না। কিন্তু ইসরায়েল প্রতিদিন ভূমি দখল করছে এবং ইসরায়েলের মানচিত্রকে প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে আর ফিলিস্তিনিদের দেশচ্যুৎ ও বিতাড়িত করছে। ১৯৪৮ সালে দখলদারিত্ব কায়েমের পর থেকে ইসরয়েলিরা ফিলিস্তিনিদের শান্তি বসবাস করতে দেয় নি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ফিলিস্তিনিরা বসবাস করছে বন্দিত্ব নিয়ে কিংবা আশ্রয় শিবিরে। অসহ্য ও বাধ্য হয়ে সেই ফিলিস্তিনিরা মাঝেমধ্যেই রুখে দাঁড়ায় আর ইসরায়েল তখন চরম হামলা ও গণহত্যা চালিয়ে ফিলিস্তিনের আরও ভূমি দখল করে। মূলত ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়াতেই সেখা চলছে হামলা ও পাল্টা-হামলা।
এমতাবস্থায় পশ্চিমা বিশ্বের একতরফা ইসায়েল তোষণ সমস্যাকে আরও কঠিন করে তুলবে। মানবতা ও শান্তির বিরুদ্ধে যে বিশ্ববিবেক তা-ও ক্ষীণ হবে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো ইসরায়েল প্রীতির বিপরীতে চীন, রাশিয়া, ইরান, তুরস্ক প্রভৃতি দেশও সরব হবে এবং বিশ্বশক্তিসমূহ ইসরায়েল-ফিলিস্তিন প্রশ্নে মেরুকরণের মাধ্যমে বিভাজিত হয়ে পড়বে। এতে যুদ্ধ ও সংঘাত স্তিমিত হওয়ার বদলে আরও ব্যাপক ও প্রলম্বিত হতে পারে, যার ফলে বিশ্বশান্তির জন্য মারাত্মক বিপদ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।