সঙ্কুল বর্তমান, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, তবুও সূর্য ওঠে

  • ড. মাহফুজ পারভেজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সঙ্কুল বর্তমান, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, তবুও সূর্য ওঠে

সঙ্কুল বর্তমান, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, তবুও সূর্য ওঠে

১. হে অতীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুল পঠিত কবিতাটির রচনাস্থল বাংলাদেশের শিলাইদহে। তিনি বলেছেন, 'হে অতীত, তুমি ভুবনে ভুবনে/কাজ করে যাও গোপনে গোপনে/মুখর দিনের চপলতা-মাঝে/স্থির হয়ে তুমি রও/হে অতীত, তুমি গোপনে হৃদয়ে/কথা কও, কথা কও।

বিজ্ঞাপন

অতীতের দিকে তাকিয়ে দেখি, ১৯৩০ সালে নিউ ইয়র্কের ১০২তলা এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং অবিশ্বাস্য গতিতে মাত্র ১ বছর ৪৫ দিনে শেষ করার নেপথ্যে প্রধান কারণ ছিল, কোনও ভাবেই মহানগরের প্রধান রাজপথ বন্ধ করা যাবে না, এবং অফিস ও দোকানপাটের সামনে কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না।

৯৩ বছর পর আমরা কোথায় রয়েছি? আমাদের গন্তব্য কি মসৃণ? নাকি সঙ্কুল বর্তমানের গর্ভে নিষ্পেষিত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি?

বিজ্ঞাপন

২. অবরোধ ও ক্ষয়ক্ষতি

দেশব্যাপী চলছে বিএন‌পি জামায়া‌তসহ সমমনা দলের ডাকা তৃতীয় দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূ‌চি, আগামী সপ্তাহেও তা প্রলম্বিত হতে পারে। চলমান কর্মসূ‌চিকে ঘিরে যে ‌কোনো ধরনের অপ্রীতিকর প‌রি‌স্থি‌তি নিয়ন্ত্রণে ক‌ঠোর নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো রয়েছে পুরো দেশ। তারপরও দুই দিনের সর্বাত্মক অবরোধের ২৭ ঘণ্টায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৩টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বাস রয়েছে ৭টি। বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) সকালে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স।

অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, শুধুমাত্র ২৮ অক্টোবর থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সহযোগিদের ডাকা মোট ছয় দিনের অবরোধ ও হরতালে দেশের অর্থনীতির আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।

এরই মাঝে বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপক সংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেফতারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। নির্বাচন কমিশনের সংলাপে ৪ নভেম্বর প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশ নেয়নি। কিন্তু তারা সুষ্ঠু নির্বাচন দাবি করছে- একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে দেশে ব্যাপকহারে গ্রেফতারের বিষয়ে এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক। তিনি আগের মতোই আবারও বলেন, আপনাকে বলতে পারি বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু, সহিংসতামুক্ত নির্বাচন আমরা খুব বেশি প্রত্যাশা করি।

২. উত্তাল পোশাক শিল্প

নতুন মজুরি কাঠামো প্রত্যাখ্যান করে গাজীপুরে কোনাবাড়ীর নাওজোর এলাকায় বাইপাস সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করছেন পোশাকশ্রমিকরা। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে মিডিয়ার সরেজমিন বিবরণে দেখা গেছে, আশপাশের কারখানার বেশ কিছু শ্রমিক কাঠ ও টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করছেন। অর্ধশতাধিক কারখানা ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেসব কারখানার শ্রমিকদের অনেককে বাড়ি ফিরে যেতে দেখা গেছে। সতর্ক অবস্থানে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। মাঠে নেমেছে ৪৪ প্লাটুন বিজিবি।

অন্যদিকে, এককভাবে দেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানির পরিমাণ কমেই চলেছে। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি’২৩-সেপ্টেম্বর’২৩) দেশটির বাজারে পোশাক রফতানি কমেছে ২৩.৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই রফতানি কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ (৩৪.৭১%)। আরও অনেক পশ্চিমা দেশের ক্ষেত্রেও অনুরূপ নেতিবাচক খবর পাওয়া যাচ্ছে। দাবি অনুযায়ী ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি না করার প্রতিবাদে দেশে আন্দোলনরত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ওপর সহিংসতা এবং একই সঙ্গে বৈধ শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মকাণ্ডকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করছে যুক্তরাষ্ট্র। বুধবার (৮ নভেম্বর) এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার।

৩. 'রেড জোন' ও অধিকার

রাজনৈতিক ও নাগরিক স্বাধীনতা, দুর্নীতি, আইনের শাসন, সরকারের কার্যকারিতা, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারসহ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানের ২০ সূচকের মধ্যে ১৭টিতেই ‘রেড জোনে’ অবস্থান করছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে বড় অবনতি হয়েছে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকারে। এর পরই আছে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ। দারিদ্র্য বিমোচনে বিপুল অর্থ সহায়তা দেওয়ার জন্য এ সূচক তৈরি করে থাকে দেশটির সরকারি সংস্থা মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি)। সূচকের এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ তাদের অর্থ সহায়তা পাচ্ছে না।

এদিকে, জেনেভায় অনুষ্ঠেয় বৈঠকে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট রেকর্ডগুলো যাচাই করা হবে বলে জানা গেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) ওয়ার্কিং গ্রুপ এই যাচাই কাজটি করবে।

৪. বিপর্যস্ত শিক্ষা

সারাদেশে চলছে অবরোধ। সপ্তাহের পাঁচ দিন স্কুল খোলা থাকে, এর মধ্যে চার দিনই চলছে অবরোধ। গত সপ্তাহের চিত্রও একই। এছাড়া আগামী সপ্তাহ থেকে টানা অবরোধ আসতে পারে—এমন ধারণা করা হচ্ছে। অবরোধ চলাকালীন গণপরিবহনের সংখ্যা অনেক কম। অনেকে ভয়ে ব্যক্তিগত গাড়িও বের করেন না। প্রতিদিনই আগুনে পুড়ছে গাড়ি। জনগণের মধ্যে রয়েছে এক ধরনের আতঙ্ক। দূরপাল্লার সব গাড়িও থাকছে বন্ধ। অবরোধ চলছে, চলছে স্কুলও। তবে উপস্থিতি কম। যাদের বাড়ি স্কুলের সন্নিকটে, তারা স্কুলে আসছে। যাদের গণপরিবহনে যেতে হয়, তারা স্কুলে আসতে পারছে না। ঝুঁকি ও নানা অজানা শঙ্কা নিয়েই অনেকে স্কুলে উপস্থিত হচ্ছে। আগামী সপ্তাহ থেকে স্কুলগুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণাও রয়েছে। ইতিমধ্যে পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণাও করেছে প্রায় সব স্কুল-কলেজ। আর এতেই শঙ্কা বেড়ে গেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।

শিক্ষা বিভাগ বলছে, আগের নির্দেশনার আলোকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখতে হবে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে চলতি শিক্ষাবর্ষের সব কার্যক্রম শেষ করতে হবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ১৫-৩০ নভেম্বরের মধ্যে শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের। এ সময়ে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রথম শ্রেণিতে বার্ষিক মূল্যায়ন কার্যক্রম চলবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় প্রান্তিকের (বার্ষিক) মূল্যায়ন পরীক্ষা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে শেষ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বিভিন্ন স্কুল ও অভিভাবকরা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নাজেহাল। বিপর্যস্ত শিক্ষা পরিস্থিতি বিপন্ন করেছে কয়েক লাখ শিক্ষার্থীকে।

৫. বাজার, অগ্নিমূল্য, সিন্ডিকেট

বাজারে আগুন জ্বলছে। দ্রব্যমূল্য লাগামহীন। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য চরমে। আলু, পেঁয়াজ মূল্য বৃদ্ধির মূল হোতা সিন্ডিকেট। সর্বক্ষেত্রে এক শ্রেণির সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে জনজীবন অতিষ্ঠ। এইসব পণ্যের মূল্য স্বাভাবিক পর্যায়ে আনতে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা ও নীরবতা সত্যিই বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক। লাফিয়ে লাফিয়ে পণ্যের দাম বাড়ছে। এইসব পণ্যের পাগলা ঘোড়াকে থামানো যাচ্ছে না। নিম্নবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষ পড়েছেন সীমাহীন দুর্ভোগে। বাজারে কেজিপ্রতি আলু ৬০/৬৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। পেঁয়াজ ১০০ টাকা। চালের পরই খাদ্যপণ্য হিসেবে আলুর ব্যবহার। চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বেশি করে আলু খাওয়ার পরামর্শ দেন। সেই আলু এখন চালের সমান দামি। অথচ দেশে চাহিদার তুলনায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টন বেশি আলু উৎপাদিত হয়েছে। দেড়মাস আগে সরকার আলুর দাম ৩৫ টাকায় নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু সেই দামে কেউ আলু কিনতে পারেনি। বরং অল্প সময়ের মধ্যে সেটি দ্বিগুণ বাড়ল। পেঁয়াজ রান্নার একটি অত্যাবশ্যক অনুষঙ্গ। মসলা হিসেবে ব্যবহার হলেও এর চাহিদা বিপুল। পেঁয়াজ নিয়ে কারসাজি চলছে কয়েক বছর ধরে। সরকার পেঁয়াজের দাম ৬৫ টাকা নির্ধারণ করলেও বাজারে এর কোন প্রভাব পড়েনি। দেশে বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে আছে। এখন বাজারে আলু পেঁয়াজের দাম লাফ দিয়ে বাড়লেও তাদের দেখা মিলছে না। সিন্ডিকেটের বিষয়টি একেবারে ওপেন সিক্রেট, যার প্রভাব পড়ছে অন্যান্য নিত্যপণ্য ও খাদ্য সামগ্রীর ক্ষেত্রেও।

৬. লাগামহীন বিপদ জীবনের পদে পদে

অবরোধের মধ্যেও লাগামহীন বিপদ জীবনের পদে পদে হামলা করছে। প্রতিদিন সড়কে অকাতরে দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে মানুষ। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হচ্ছে বহুজন। হরহামেশা ঘটছে অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা। হতাশা গ্রাস করেছে অনেককেই। জীবনবিমুখ হয়ে পড়ছে প্রজন্মে সবচেয়ে সবুজ ও প্রাণবন্ত অংশটি। পরিসংখ্যান সামনে আনা হলে দেখা যাবে, মহামারির প্রতিদিনের গড় মৃত্যুর চেয়ে দুর্ঘটনাবশত এবং অস্বাভাবিক কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। জীবনযাপনের স্বাভাবিক নিরাপত্তার বেষ্টনী ক্রমেই আলগা হয়ে পড়ছে যেন।

৭. ডেঙ্গু- করোনাভাইরাসের ঘূর্ণাবর্ত

করোনা থমকে গেলেও ডেঙ্গুর আঘাত চলছেই। এরই মাঝে ফিরে আসছে ২০১৯/২০/২১ সালের দুঃস্বপ্নের সেই ভয়াল স্মৃতি। বিশ্বের খুব কম মানুষই ছিল যাদের পরিবারের একজন না একজন করোনায় আক্রান্ত হননি। গোটা বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের সংখ্যা অসংখ্য, মৃতের সংখ্যা কোটির ঘর ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সতর্কবার্তা, করোনা আবার ফিরে আসছে। এবারে ভ্যারিয়েন্ট বদলে করোনা আরও মারাত্মক, আরও সংক্রামক বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে।

করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের নামকরণ করা হয়েছে জেএন.ওয়ান। ইতিমধ্যেই লুক্সেমবার্গ, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও ফ্রান্স এই করোনার শিকার হতে আরম্ভ করেছে বলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে। জেএন.ওয়ান-এ ভ্যাকসিন কার্যকর নয় বলে জানিয়েছে হু। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বিগত বছরগুলোতে গোটা বিশ্বে সাতাত্তর কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছিল। মোট মৃতের সংখ্যা ঊনসত্তর লক্ষ। এর মধ্যে আমেরিকায় দশ কোটি লোক আক্রান্ত হয়, মৃত্যু হয় এগারো লক্ষের। চীনে নয় কোটি লোক আক্রান্ত হয়, মৃত্যু হয় এক কোটি পঁচিশ লক্ষ লোকের। ফ্রান্সে তিন কোটি আশি লক্ষ আক্রান্তের মধ্যে মারা যায় দেড় লক্ষ মানুষ, জার্মানিতে সাড়ে তিন কোটি আক্রান্ত, মৃত দেড় লক্ষ।

মৃত্যুর মিছিল চলেছিল তখন গোটা বিশ্ব জুড়ে। এই উপমহাদেশের ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ বহুদেশের অবস্থা সঙ্গিন হয় এই রোগে। মানুষের রুজি-রোজগার সব বিপন্ন হয়। জেএন.ওয়ান এর উপসর্গ একদম করোনার মতো। জ্বর, ঠান্ডা লাগা, গায়ে ব্যথা, সর্দি কাশি, বমি, ডায়রিয়া, শ্বাস এর সমস্যা ইত্যাদি। অর্থাৎ করোনার যমজ ভাই এই জেএন.ওয়ান। হু এবং ভারতীয় বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন গোটা বিশ্বকে। এখন থেকে সাবধান হলে হয়তো দুহাজার কুড়ি-একুশের সর্বনাশ রোখা সম্ভব হবে।

৮. দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড়

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি ও সার্বিক বিষয় অবহিত করতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বঙ্গভবনে গিয়েছেব প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন তারা। ইসি সূত্রে জানা যায়, বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে আগামী সপ্তাহের মধ্যেই ঘোষণা করা হতে পারে সংসদ নির্বাচনের তফসিল।

ইসি জানিয়েছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অত্যাসন্ন। সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। রেওয়াজ অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার আগে কমিশন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন প্রস্তুতি সংক্রান্ত সব ধরনের অগ্রগতি বিষয়ে অবহিত করেন। প্রস্তুতি নিয়ে রাষ্ট্রপতি পরামর্শ ও নির্দেশনা থাকলে তা কমিশন শুনবেন। তফসিল ঘোষণার এখতিয়ার সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের। এ সংক্রান্ত কমিশন সভা এখনও অনুষ্ঠিত হয়নি।

এইদিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়েছে ১ নভেম্বর থেকে। এক্ষেত্রে ২০২৪ সালের ২৯ জানুয়ারির মধ্যে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। চলতি বছরের নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তফসিল ঘোষণার লক্ষ্য নিয়ে সকল কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনাদের বক্তব্য অনুযায়ী নভেম্বরের প্রথমআর্ধে তফসিল ঘোষণা করার কথা ছিলো। সে অনুযায়ী নভেম্বরের ১৫ তারিখের মধ্য তফসিল ঘোষণা করার কথা। এতে ভোটগ্রহণ জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে হওয়ার কথা রয়েছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করে ইসি। সেখানে দেখা যায়, দেশে বর্তমান মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। ইসির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মোট ভোটারের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন এবং নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। আর হিজড়া ভোটার ৮৫২। আসন্ন দ্বাদশ নির্বাচন আয়োজনে প্রায় ১০ লাখ ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে।

৯. দোলাচল ও পরাশক্তি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল দ্রুতই ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেলেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে দোলাচল কাটেনি। বিএনপি ভোটের মাঠে আসার বিষয়ে এখনও অনীহা নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আরেকটি একপক্ষীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ? এ পরিস্থিতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র কি মনে করছে? এমন প্রশ্নের জবাবে দেশটির মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বলেন, আমরা কোনো প্রার্থী বা কোনো দলকে সমর্থন করি না। আমরা চাই অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবাই একসঙ্গে কাজ করবে। এ জন্য বাংলাদেশের সব মহলের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ করছে যুক্তরাষ্ট্র। একজন সাংবাদিক জানতে চান- বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এ বিষয়ে আপনি কিভাবে আস্থাশীল? এ প্রশ্নের জবাবে বেদান্ত প্যাটেল বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বাংলাদেশের জনগণ। আমরাও সেটা চাই। এ জন্য আমরা যোগাযোগ রাখছি সরকার, বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ ও অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে। বাংলাদেশি জনগণের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করতে তা করা হচ্ছে।

জাতীয় বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করল চীনও। বাংলাদেশে উন্নত ও স্থিতিশীল পরিবেশ দেখতে চায় চীন বলে মন্তব্য করে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, সংবিধান ও আইন অনুযায়ীই বাংলাদেশে নির্বাচন চায় চীন। বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন চীনের রাষ্ট্রদূত। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, সংবিধান ও আইন অনুযায়ীই বাংলাদেশে নির্বাচন চায় চীন। আর ওই নির্বাচন নিয়ে বাইরের কারো হস্তক্ষেপ চায় না দেশটি। চীন নিজেও অন্যদেশে হস্তক্ষেপ করে না বলে জানান তিনি। রাষ্ট্রদূত বলেন, নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে বাংলাদেশিরাই সিদ্ধান্ত নেবে। চীনের প্রত্যাশা, সব অংশীদার মিলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের বিষয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত বলেন, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বলতে পারবে। চীন বাংলাদেশের সমাজে স্থিতিশীলতা চায়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভৌগোলিক অবস্থানগত ‘সুবিধার’ কারণে পরাশক্তি দেশগুলোর শক্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় ‘মূল ময়দান’ হয়ে উঠবে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, ভারতের উত্থান এবং দক্ষিণ চীন সাগরে চীন-মার্কিন উত্তেজনার প্রেক্ষিতে এমনটি হবে বলে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। গত সোমবার প্রকাশিত নতুন এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ‘দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড রিবুট’ শীর্ষক এই সমীক্ষা পরিচালনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পাবলিক ইউনিভার্সিটি উইলিয়াম অ্যান্ড মেরির গবেষণা ল্যাব ‘এইড-ডেটা’। এই গবেষণায় কেস স্টাডি হিসেবে বাংলাদেশ, জাম্বিয়া এবং আর্জেন্টিনাকে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি চীনের গ্লোবাল ফ্ল্যাগশিপ প্রোগ্রাম বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) মূল্যায়ন করেছে।

সমীক্ষা অনুসারে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের আরও সুযোগ আসবে ঢাকার দুয়ারে। এতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী উদার গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে ‘স্বৈরাচারের পথে’ বাংলাদেশকে আরও নিচে ঠেলে দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ডের নিন্দা করতে বাধ্য হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে বাস্তবতা হচ্ছে, চীনের প্রভাব দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রসারিত হচ্ছে।

১০. তবুও সূর্য উঠে

বাংলাদেশ বড় বিপদে আছে, বড় সংকটে আছে। এই সংকট সহসা তৈরি হয় নি। সমস্যাটা রাজনৈতিক। এটাই ছিল ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের অনিবার্য পরিণতি। দেশে কর্তৃত্ববাদের রাজনীতি, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম (স্বজনতোষী পুঁজিবাদ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ থেকে বের হওয়ার জন্য কোনো যাদুকরী সমাধান নেই। উপায় একটাই- সকলকে নিয়ে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করা, সকলকে নিজ নিজ ভোট দিতে দেওয়া। কেননা একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনই পারবে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি এবং অংশগ্রহণমূলক অর্থনীতি নিশ্চিত করতে। বৃহস্পতিবার (০৯ নভেম্বর) সকালে অনুষ্ঠিত "দমন, আন্দোলন ও অর্থনীতি: বাংলাদেশের পথরেখা" শীর্ষক ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ এর বিশেষ ওয়েবিনারের বক্তারা এসব মন্তব্য করেন।

নির্বাচনের মতো রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নাগরিক সুবিধা ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও নানামুখী সমস্যা দৃশ্যমান। আমাদের গন্তব্য কোন পথে, কেউ স্পষ্টভাবে জানে না। সত্য কবুল করলে বলতে হয়, ২০২৩ সালের শেষপাদে আমরা রয়েছি এক সঙ্কুল বর্তমানের জঠরে আর আমাদের সামনের দিনগুলো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গহ্বরে।

তারপরও মানুষ আশাবাদী। শঙ্কা ও সঙ্কুলতায় সাহসী মানুষ আলো ও উজ্জ্বতার প্রত্যাশী। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে-এর একটি উপন্যাস আছে 'দ্য সান অলসো রাইজেস' নামে। আবুল ফজল বাংলায় এর অনুবাদ করেছেন 'তবুও সূর্য ওঠে' শিরোনামে। বাংলাদেশের মানুষও এখন শত বিরূপতার অন্ধ-অন্ধকার ছিন্ন করে আলোকময় সূর্যের আশাবাদী উদয়ের অপেক্ষায়।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।