দিবসী আয়োজনের একক যখন নূর হোসেন

  • কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

স্বৈরাচারের কালে দুরন্ত যুবকের বুকে-পিঠে গোটা অক্ষরে লেখা ছিল—‘স্বৈরাচার নীপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। স্লোগান নয়, দাবি ছিল এটা; প্রাণপণ। সে দাবির শক্তিতে কেঁপে ওঠেছিল শাসকের মসনদ। ছুটে আসে গুলি। ঝাঁঝরা করে দেয় ছাব্বিশের যুবকের দেহ। লুটিয়ে পড়া দেহ নিথর হয়ে যায়। মুখ দিয়ে স্লোগানগুলো আর বেরোয় না ঠিক, তবে সে দাবি শাশ্বত হয়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়া শহিদ নূর হোসেন একজন থেকে অগণন হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র মুক্তির স্মারক হয়ে ওঠেন নূর হোসেন; একজন নূর হোসেন।

সময়টা তখন স্বৈরাচারের। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের। বৈরী সময় দেশের। গণতন্ত্র বন্দি ছিল সামরিক শাসনের ধারাবাহিক যাঁতাকলে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের লক্ষ্যে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণা করে। এর আগে ১৯৮২ সালে এক সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এরশাদ এবং ১৯৮৭ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেন। কিন্তু বিরোধী দলগুলো তার এই নির্বাচনকে জালিয়াতি বলে অভিযুক্ত করে। তাদের একমাত্র দাবি ছিল, নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অবরোধ কর্মসূচির অংশ হিসেবে ঢাকায় একটি মিছিলে নূর হোসেন অংশ নেন এবং প্রতিবাদ হিসেবে বুকে পিঠে সাদা রঙে লিখিয়ে নেন—‘স্বৈরাচার নীপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক।’ তার এই লেখাগুলো চোখে পড়ে সকলের। মিছিলটি ঢাকা জিপিওর সামনে জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি এলে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেনের মৃত্যু হয়। এই রক্তদানের মধ্য দিয়ে তৎকালীন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয় এবং অব্যাহত লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর স্বৈরশাসকের পতন ঘটে।

বিজ্ঞাপন

এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশ হাঁটা ধরে গণতন্ত্রের পথে, কাগজে-কলমে। প্রাতিষ্ঠানিক সেই স্বীকৃতির পর আমরা গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে পেরেছি কিনা এটা বিতর্কসাপেক্ষ; তবে সেই স্বীকৃতি আছে। এখন শাসকেরা আদ্যোপান্ত গণতান্ত্রিক না হলেও মুখে গণতন্ত্রের কথা বলতেই বাধ্য হয়। বিরোধীরা গণতন্ত্র নাই বললেও সেই গণতন্ত্রের পথ ধরেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়, জানাচ্ছে। গণতন্ত্র আছে এবং নাই এই দ্বিমুখী দাবির মাঝেও যে গণতন্ত্রের উপস্থিতি সেটা এই নূর হোসেনদের রক্ত থেকে উৎসারিত।

গণতন্ত্রের জন্যে নূর হোসেনের আত্মত্যাগের বয়স ছত্রিশ শেষে সাঁইত্রিশে। একাত্তরের জনযুদ্ধ যে স্বাধিকার আর স্বাধীনতার জন্যে ছিল তার অন্যতম অঙ্গীকারের সঙ্গে ছিল গণতন্ত্রও। নূর হোসেনের মৃত্যুর তিন বছর ছাব্বিশ দিনের মাথায় স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হয়েছিল। তার পতনে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের পথে ফিরেছে ঠিক, কিন্তু স্বৈরশাসক এবং স্বৈরাচারের প্রেতাত্মাদের স্থায়ী পতন হয়নি। কিছুদিন কারাগারে থাকার পর সেই এরশাদ ক্ষমতায় না গেলেও তিনি ও তার দল ফের ক্ষমতার কাছাকাছি গেছে। কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর একটা সময় এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। মুক্ত পৃথিবীতে মৃত্যু হয়েছে তার। ক্ষমতার রাজনীতিতে এরশাদকে নিয়ে টানাটানি দেখেছি আমরা। বিরল সম্মান পেয়েছেন তিনি আমৃত্যু। মৃত্যুতে মহান হয়ে ওঠা সেই স্বৈরাচার রাষ্ট্রপ্রধান-সরকারপ্রধানের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সম্মানও পেয়েছেন। জাতীয় সংসদেও শোকের বাণী রেকর্ড হয়েছে। স্বৈরশাসনের পতনের দাবিতে যারা রাস্তায় মার খেয়েছেন, গ্রেফতার-নির্যাতনের ভয়ে যাদের কেটেছে রাজনৈতিক জীবন তাদেরও শোকের বার্তা দেখেছে দেশ। মৃত্যুতে যেন সাফ হয়েছিল তার সমূহ অপরাধ।

বিজ্ঞাপন

রাজনীতিতে এরশাদ ও তার দলের এই গুরুত্ব নূর হোসেনের রক্তের প্রতি, নূর হোসেনের চেতনার প্রতি অমর্যাদা কিনা, প্রশ্ন থেকে যায়। গত দুইটা সংসদে এরশাদের দল বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল। তার দলের একাধিক নেতা এরই মধ্যে মন্ত্রিত্বও পেয়েছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটের অংশ হয়ে তারা ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। পরের দুই নির্বাচনেও পেয়েছে রাজনৈতিকসহ বিবিধ সুবিধা। এখন এই মহাজোট আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত না হলেও ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও দলটির নেতারা নির্বাচনী মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগিতা পাবেন।

গণতন্ত্রের মুক্তির জন্যে স্বৈরাচারের উদ্ধত স্টেনগানের সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণ হারানো অকুতোভয় নূর হোসেন এই তিন যুগে কেবল দিবসী আয়োজনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছেন। তার মৃত্যুদিন এলে আমরা স্মরণ করি তাকে। রাজনৈতিক দলগুলোও স্মরণ করে তাকে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকামী মানুষের আকাঙ্ক্ষার এক সাইনবোর্ড ছিলেন তিনি সে কথা বলে সকলেই। কিন্তু আচার-আচরণ-বিশ্বাসে সেটার প্রতিষ্ঠায় যায় না, ভুলে যায়; সচেতন কিংবা অবচেতনভাবে।

দিবসী আয়োজনের পুষ্পমাল্যে, আলোচনা সভা আর গদ্য-কবিতার স্মরণের বাইরে নূর হোসেন আজ কোথায়? রাজধানীর গুলিস্তানের নূর হোসেন স্কয়ারে! এর বাইরে আর কোথায় নূর হোসেন? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তার সেই দীপ্ত শপথ, স্লোগান, রক্ত, আত্মবলিদান—সব কি আজ যাদুঘরে পোশাকি মর্যাদায় আসীন?