পশ্চিমারা আদৌ কাউকে ক্ষমতায় বসাতে পারে?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে ক্ষমতার রাজনীতিতে বিদেশিদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে। বিদেশিরাও উৎসুক খুব। একদল চায় রাজনীতিতে-নির্বাচনে বিদেশিরা হস্তক্ষেপ করুক, আরেক দল হস্তক্ষেপ চায় না। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো চায় বিদেশিরা ক্ষমতার পটপরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা পালন করুক। যেকোনো মূল্যে আওয়ামী লীগের পতন চায় দলগুলো, এজন্যে তাদের এই চাওয়া। অপরদিকে, আওয়ামী লীগসহ সমমনা দলগুলোর চাওয়া বিদেশিদের হস্তক্ষেপমুক্ত নির্বাচন। দ্বিধাবিভক্ত নাগরিক সমাজ। বেশিরভাগই মুখে বলতে পারছে না হস্তক্ষেপ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সেটাকে অনেকেই ভাবছে ‘মন্দের ভালো’!
নাগরিক সমাজের সমাজভাবনার যে গতিরেখা সেখানে ক্ষমতাসীনের বিরোধিতাটাই যেন মুখ্য। সরকারের সমালোচনা মানে নিরপেক্ষ থাকা, এই ধারণায় বদ্ধমূল অনেকেই। সরকারবিরোধী মতামতগুলো প্রাথমিকভাবে জনপ্রিয় ধারণার। জনপ্রিয় এই ধারণাকে আঁকড়ে ধরে আছে অনেকেই। ফলে প্রতি সরকারের আমলেই নাগরিক সমাজ কিংবা ‘বিশিষ্ট ব্যক্তি’ নামের যে বায়বীয় গোষ্ঠী তারা সরকারের প্রতি রুষ্ট থাকেন, সরকারও তাদের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করে থাকে। তাদের বেশিরভাগই সরকারের প্রিয়পাত্র নন। এর মাঝে আবার আছে উপহাস। কিছু উপহাসও জুটে সুশীল কিংবা নাগরিক সমাজের। তবু একটা শ্রেণি নিজেদের দল নিরপেক্ষ প্রমাণে নিজেদের উপস্থাপন করে চলেছেন, যদিও সংখ্যায় বেশিরভাগই অদ্য যতটা না নিরপেক্ষ, তারচেয়ে বেশি নিরপেক্ষতার ভূমিকায় সরকারের বিরুদ্ধ-পক্ষ।
নাগরিক সমাজের বর্তমান ভূমিকা অনেকটাই বিদেশি হস্তক্ষেপের প্রচ্ছন্ন সমর্থক। স্রেফ লোকলজ্জায় হস্তক্ষেপ শব্দের উচ্চারণ হচ্ছে না ঠিক, তবে এর অপেক্ষায় রয়েছে তারাও। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিদেশিদের প্রভাবকে তাদের বেশিরভাগই নেতিবাচক রূপে দেখছে না। আত্মমর্যাদা বোধের অনুপস্থিতি এখানে! বিষয়টি দুঃখজনক যদিও, তবে এখানে সরকারবিরোধিতা মুখ্য অনুষঙ্গ বলে তাদের অনেকেই নীতি নৈতিকতা জলাঞ্জলি দেওয়ার পথে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের যে ভূমিকা, স্যাংশন দেওয়ার যে প্রচারণা তার পালে হাওয়া দিচ্ছেন অনেকেই। যেকোনো মূল্যে সরকারকে বিতাড়িত করে সেখানে তৃতীয় শক্তিকে দেখতে চাইছেন অনেকেই। এখানে দেশের সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের মুখে এবং অথবা হালকা করে দেখা হচ্ছে কিনা এটা ভাবছে না অনেকেই। যেকোনো মূল্যে সরকারকে ফেলে দেওয়ার যে মানসিকতা সেখানে অগ্রাহ্য করা হচ্ছে দেশের সম্মান। এখানে নিজেদেরকে যতখানি অবমূল্যায়ন হচ্ছে, ততখানি অবমূল্যায়িত হওয়ার মতো দেশ নিশ্চয়ই আমরা নই।
এটা ঠিক কেবল এবারই প্রথম নয়, প্রতিবারই নির্বাচনের আগে দেশের রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ চায় অনেকেই। আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় আছে বলে তারা এবার শক্ত বিরোধিতা করছে, কিন্তু যখন তারা বিরোধী দলে ছিল তখন তারাও বিদেশিদের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করত। এখন যারা বিরোধী দলের অবস্থানে সেই বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে একইভাবে বিরোধিতা করেছে। এখন পিটার হাসরা বিএনপির কাছে ‘অবতার’ কিন্তু আগে তারা অবতার না হয়ে ‘অসুর’ রূপে মূল্যায়িত হতেন। স্থান-কাল ভেদে এই পরস্পরবিরোধী ভাবনার মূলে আদতে ক্ষমতার রাজনীতি। আর এই এই ধারার রাজনীতিতে দেশের সম্মান, দেশের স্বার্থ কম মূল্য পেয়ে এসেছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার টানা তিন মেয়াদ শেষের পথে। আগামী জানুয়ারিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নভেম্বরের চলমান অর্ধেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ লক্ষ্যে তারা কাজ গুছিয়ে এনেছে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সার্বিক পরিস্থিতি ও নির্বাচনের প্রস্তুতির অগ্রগতি বিষয়ে অবহিত করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজি হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও নির্বাচন তাদের নির্বাচন করতেই হবে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা এখানে তাদের, এটা জোর দিয়ে বলেছেন তিনি।
ইসি একদিকে প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন আয়োজনের, সরকার দল আওয়ামী লীগ ও তাদের সমমনা দলগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছে চলমান সাংবিধানিক ব্যবস্থার দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের; অন্যদিকে ঠিক বিপরীত অবস্থান বিএনপিসহ এর সমমনা দল ও জোটের। বিএনপির দাবি এক দফা, অর্থাৎ সরকারের পদত্যাগ। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর দাবি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের। আন্দোলনের অন্য দলগুলো বিএনপির সঙ্গে একই ধরনের কর্মসূচি দিচ্ছে ঠিক, কিন্তু তাদের সকলের দাবি এক নয়।
গত ২৮ অক্টোবরের ঢাকা-মহাসমাবেশ ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আন্দোলনে রয়েছে। একদিনের হরতাল আর ছয়দিনের অবরোধ শেষে চতুর্থ দফায় দুইদিনের অবরোধ শুরু হয়েছে আজ থেকে। অবরোধের এই পর্যায়ে এসে বিএনপি অনেকেই মাঠ-ছাড়া। আন্দোলন হয়ে পড়েছে তাদের প্রেস রিলিজ সর্বস্ব, আর ঝটিকা মিছিল ও আগুন-নির্ভর। এর বাইরে আদতে জনজীবন স্বাভাবিক। স্বাভাবিক জনজীবনের বাইরে চোরাগোপ্তা হামলার যে ভয় সেটা কেবল আতঙ্কে রাখছে নাগরিকদের।
আন্দোলনের এই পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে এবারও মাঠে বিএনপি ও এর সমমনা দল ও জোটগুলোর ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তারা নিজেরাও অনুধাবন করতে পারছে। তবে মাঠ-পরিস্থিতির বাইরে বিএনপির জন্যে ক্ষীণ আশার আলো হয়ে আছেন ঢাকায় নিযুক্ত পশ্চিমা-বিশ্বের কূটনীতিকরা, বিশেষত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমেরিকার অতি-উৎসাহ, ভিসানীতি, পিটার হাসের প্রকাশ্য ও গোপন বৈঠকগুলো বিএনপিকে আশাবাদী করছে। এর ফল যদিও অনিশ্চিত, তবু বিএনপির সবচেয়ে বড় ভরসা এখনো পিটার হাস।
ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করছেন কিনা, এ প্রশ্ন ক্ষীণ স্বরে হলেও ওঠতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন নীতি যদি শেষ পর্যন্ত না বদলায় তবে পিটার হাসের দৌড়ঝাঁপ ও তৎপরতা আরও বাড়বে। এক্ষেত্রে সরকারের প্রতিক্রিয়া কী হয়, সেটাও দেখার বিষয়।
পশ্চিমারা কি নির্ধারণ করবে কে ক্ষমতায় যাবে আর কে যাবে না? মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির কাকে সমর্থন করছে তারা—এমন এক অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়। তবে প্রতিবারই মার্কিনীরা বলছে, তারা বাংলাদেশের কোন নির্দিষ্ট দলকে সমর্থন করে না। তবে নির্বাচন সম্পর্কে তাদের যে ভাষ্য তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেশে আওয়ামী লীগ সরকারই বিব্রত হয়, যদিও সরকার বলছে মার্কিনীদের মতো তাদেরও লক্ষ্য সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন। তারা সংলাপের কথা বলছে, কিন্তু সরকার সংলাপকে গ্রহণ করছে না। বিএনপি ও এর সমমনা দল-জোটগুলো দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছে, কিন্তু মার্কিনীরা চলমান ব্যবস্থার বাইরে কোন মন্তব্য করছে না। এমন যখন অবস্থা, তখনো পশ্চিম পানে চাতক-চোখ বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দল ও জোটগুলোর।
‘অবতার’ হয়ে আসা পিটার হাসে ‘সাহস’ পাচ্ছে বিএনপি, তবে ‘ভরসা’ করতে হবে তাদের জনগণকে; কিন্তু আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি আর আগুন তাদের জনগণ থেকে দূরে ঠেলছে কিনা সেটা ভাবতে হবে আগে।