দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। তিন দফা বাংলাদেশের সরকার গঠনে ভূমিকা রেখেছে দলটি। রাজনীতির চড়াই উৎরাইয়ে মধ্যবয়েসি এই রাজনৈতিক দলটির ভূমিকা নিতান্তই কম নয়। এবং একইসাথে এই দলটির ভোটার সংখ্যা রাজনীতিতে সবসময়েই একটা বড় পার্থক্য গড়ে দিতে সক্ষম। সৃষ্টির ৪৬ বছর পরে এসে নেতৃত্ব আর অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে দলটি, দলীয় নেত্রীর অসুস্থতাজনিত কারণে এবং ভিডিও ও মাইক সর্বস্ব নেতৃত্বের কারণে।
১৯৭৫ উত্তর বাংলাদেশে প্রধান সামরিক কর্মকর্তা আর প্রশাসক জিয়াউর রহমানের সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের প্রচেষ্টায় ১৯ দফা অর্থনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে জাগদল নামে রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করেন। সেই প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির জন্ম হয় ১৯৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর। গঠনের এই ৪৬ বছরে বাংলাদেশকে কী দিয়েছে বিএনপি?
রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ছাত্রনেতারা। তাদের সকলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর পরিবারের হত্যাকাণ্ড পরিকল্পনায় জিয়াউর রহমানের নীরব সম্মতি প্রদান, এবং সমস্ত কিছু জেনেও কোন বাধা বা কাউকে অবহিত না করার কারণেই ১৫ আগস্টের বাংলাদেশে সবচেয়ে জঘন্যতম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এবং এই ঘটনার সবচেয় বড় সুবিধাভোগী হন তৎকালীন উপসেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। পরবর্তী সময়ে সর্বময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা জিয়াউর রহমানের প্রচ্ছন্ন নির্দেশেই ৩ নভেম্বর জেল হত্যা ঘটে, ৭ নভেম্বর পরবর্তী ধরপাকড় আর গ্রেফতার হত্যার মাধ্যমে রাজনীতি থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর ফ্রন্টলাইনে যারা ছিলেন তাদের সবাইকে সরানো হয়। ১৯৬০ থেকে শুরু করে ১৯৭৫ পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রামে বাংলাদেশের রাজনীতির পুরোধা যারা ছিলেন তারা সবাই ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭, এই দু বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যান, যার রূপকার ছিলেন জিয়াউর রহমান। এই যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর মেধার শূন্যতা, এর ফল ভোগ করতে হয় পরবর্তী দুই দশক বাংলাদেশে।
রাজনৈতিক মতাদর্শহীনতা
অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী একবার বলছিলেন, ‘নানান স্রোত থেকে লোক এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করল। ফলে এটা কোন মতাদর্শগতভাবে গড়ে উঠেছে, তা আমরা বলতে পারব না। গড়ে ওঠার পরে তারা একটা রাজনৈতিক আদর্শের কথা বলছে, যেটা তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলছে। এটা কিন্তু আগে নির্ধারিত কিছু ছিল না। এটা প্রয়োজনের জন্য তারা তৈরি করেছে। যেমন, আওয়ামী লীগ এক ধরনের রাজনীতি করছে, তার সাথে ভারতের একটা সম্পর্ক ছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। কাজেই অন্য যারা রাজনীতিতে আসবে, তাদের পার্থক্য দেখানোর জন্য ভারত বিরোধিতার অবস্থানে যাওয়া দরকার ছিল। এবং আমার মনে হয় না, সেটা পরিষ্কার কোন চিন্তা থেকে করা হয়েছিল।’
জিয়াউর রহমান ভাবতেন, তিনি বাংলাদেশভিত্তিক একধরনের রাজনীতি করবেন। যাতে বামপন্থী থেকে শুরু করে ইসলামপন্থীরা একত্রিত হবে। এবং এর ফলে যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে তাদের সাথে একটা দূরত্ব রেখে এগোনো যাবে। এমন ধারণা নিয়ে জিয়াউর রহমান এগোচ্ছিলেন। কিন্তু যারা অনুসারী ছিলেন অথবা স্বাধীনতা বিরোধী যারা ছিলেন, তারা সুযোগ পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে বিভাজনকে তীব্র করলেন। আদতে যেই মতাদর্শ থেকে বিএনপি নামক দলটির রাজনৈতিক ভিত্তি সৃষ্টি হচ্ছিল সেটা ছিল, এন্টি আওয়ামী লীগ ঘরানা। আওয়ামী আর বঙ্গবন্ধু বিরোধিতা থেকেই প্রো-পাকিস্তানি, এন্টি মুক্তিযুদ্ধ, প্রো-ইসলামি, এন্টি লীগ ধ্যান ধারনার বিভিন্ন মানুষের রাজনৈতিক সংমিশ্রণ ছিল বিএনপি। এছাড়া আর কোন আদর্শ দল গঠনের ৪৫ বছরেও দলটি সৃষ্টি করতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বিভক্তি ও ইতিহাস বিকৃতি
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তিনি নিজে বিষয়টিকে বড় ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেননি। তবে তার মৃত্যুর পর তাকে অতিরিক্ত মূল্যায়নের চেষ্টার কারণে বিতর্ক দেখা দেয় বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলছিলেন, বিএনপি প্রতিষ্ঠার পরই মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাসকেই ভিন্নভাবে উপস্থাপনের কারণে বিভাজন সৃষ্টি হয়। শুধুমাত্র জিয়াকে ইতিহাসের নায়ক, মুক্তিযুদ্ধের বিশাল যোদ্ধা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরির লক্ষ্যে বিএনপি নামক দলটির তরফ থেকে মিথ্যা ইতিহাস সৃষ্টি ও সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যার কারণে দেশে লম্বা সময়ের ইতিহাসবিমুখতা ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সত্যকারের ইতিহাস না জেনেই শুধুমাত্র কিছু বীরশ্রেষ্ঠ আর ওয়ান ম্যান আর্মি জিয়াউর রহমানের বীরত্ব আর অসীম সাহসিকতার গল্প পড়ে বড় হয়েছে ৮০’র দশকের প্রজন্ম। সেই ইতিহাসে ছিলেন না বঙ্গবন্ধু, ছিলেন না জাতীয় চার নেতা, ছিল না ক্র্যাক প্লাটুন, ছিলেন না খালেদ মোশাররফ, ছিলেন না মেজর হায়দার, ছিলেন না জগতজ্যোতি দাসরা।
গণতন্ত্রের উল্টোরথ যাত্রা
সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম আরও বলছিলেন, ‘খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। যদিও বলা যায় না যে, গণতন্ত্রের সব শর্তই দলটি পূরণ করছে। কারণ দলটির ভিতরেই গণতান্ত্রিক চর্চা হয় না। কিন্তু খালেদা জিয়া অন্তত বহুদলীয় গণতন্ত্রের একটা সচল রূপ গ্রহণ করেছেন। আর জিয়াউর রহমানের সময় ছিল তার এক ধরনের কর্তৃত্ববাদ। এধরনের শাসন ব্যবস্থায় যে লাভ হয়, অর্থাৎ অর্থনীতি সচল থাকে, জনজীবনে শান্তি শৃঙ্খলা থাকে, যেটা তার অনুকূলে গিয়েছিল।’
বহু আদর্শিক এই জোটের কারণে বিএনপিকে নিজেদের রাস্তা পরিষ্কার করতে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করতে দেখা গেছে অনেকবারই। সেটা বিএনপির কেন্দ্র থেকে নির্দেশিত চেষ্টা হোক বা সহযোগীদের চেষ্টা, বিএনপির কমান্ড সেই চেষ্টায় বাধা দেয় নাই। ঠিক যেন পূর্বজের মতোই সামরিক ধারায় ফিরিয়ে এনেছিল বিএনপি গণতন্ত্রের মোড়কে।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রচলন
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম মনে করেন, বিএনপি’র এই জোট ধর্মভিত্তিক বা চরম ডানপন্থী দলগুলোকে জায়গা করে নেওয়ার শক্তি যোগাচ্ছে। এর থেকে বিএনপি বেরিয়ে আসতে পারবে কি না, সে ব্যাপারে তার সন্দেহ রয়েছে।
বিএনপি নেতাদের অনেকেই বলেছেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রাখাসহ কিছু বিষয়ে জোটের শরিকদের সাথে বিএনপির মিল থাকায় এটাকে তারা আদর্শিক জোট হিসেবে দেখছেন। কিন্তু দলটি নিজের আদর্শ বা স্বকীয়তা বজায় রাখবে এবং চরম ডানপন্থার দিকে এগুবে না বলেই তাদের দাবি।
মুক্তিযুদ্ধ বা এর পরবর্তী সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র আর গণতান্ত্রিক ধারায় এগুতে থাকা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির শুরুটা হয় সামরিক শাসক জিয়ার হাত ধরে। যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের মুক্তি দিয়ে, বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যায় জড়িতদের ইনডেমনিটি দিয়ে এদের সবাইকে রাজনীতিতে যুক্ত করেন তিনি। গোলাম আযমকে বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনেন ১৯৭৮ সালে, তার হাত ধরে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে গঠন হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর। ইনডেমনিটি প্রাপ্তদের নিয়ে ১৯৮০ সালে গঠিত হয় ফ্রিডম পার্টি। কারণ জিয়া নিশ্চিত ছিলেন বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে উনার কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন ধর্মীয় অনুভূতি এবং সহযোগী দল হিসাবেও বিছে নিয়েছিলেন ধর্মীয় অনুভূতিসম্পন্ন দল। তার এই ধারা বিএনপি পরবর্তী সময়েও বলবৎ রেখেছে।
মুক্তিযুদ্ধপন্থী অফিসারদের নিধন
জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে ছোট-বড় ২১টি অভ্যুত্থান ঘটেছে বলে গবেষক ও বিশ্লেষকদের লেখায় তথ্য পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল ২৬টি। এসব অভ্যুত্থানের পর নামমাত্র বিচারে কতজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, তার তালিকা করা দুঃসাধ্য। শুধু ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীর সদস্যদের ব্যর্থ অভ্যুত্থানেই ফাঁসি ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ১৩০০ জনের বেশি সেনাকে। এর মাধ্যমে সামরিক বাহিনীতে পাকিস্তানপন্থী অফিসার এবং জিয়াউর রহমানের প্রতি বিশ্বস্ত অফিসারদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য নিশ্চিত করা হয়। জিয়ার সেই ক্যাঙ্গারু কোর্টের নথিপত্রের প্রমাণ সব পরবর্তীতে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। শুধুমাত্র বিমানবাহিনীতেই ৪৬০ জনের বিচার করা হয়। যার মধ্যে কোন শুনানি বাদে সরাসরি ফাঁসির আদেশ দিয়ে সেই রাতেই ফাঁসি নিশ্চিত করা হয় ৩৭ জনের, ২০ জন যাবজ্জীবন সাজা পান, ৬৩ জন খালাস পান। বাকি ৩৪০ জনের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা কেউই আজ পর্যন্ত জানতে পারেনি; তাদের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
যুদ্ধাপরাধী আর রাজাকারদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন
১৯৭২ সালে প্রণীত দালাল আইনে ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২৮৮৪টি মামলা রুজু করা হয়। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপকর্ম আর দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের জন্য আটক করা হয়েছিল ৩৭ হাজারেরও বেশি রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানের দোসরদের। পরবর্তীতে ৪টি অপরাধ বাদে ছোটখাটো অপরাধের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে পরিচালিত মামলায় সারাদেশে ৭৩টি যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বাকি ২ হাজার ৮৪৮ জনের বিচার হয়। যার মধ্যে ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেওয়া হয়।
১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেন এবং বড় বড় অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ জনসহ বিচারাধীন ১১ হাজার অপরাধীকে মুক্ত করে দেন। এবং এদের মধ্যে নেতৃত্ব স্থানীয়দের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেন ধর্মভিত্তিক ইসলামী দল হিসাবে, যাদের উত্তরসূরিরা আজও বাংলাদেশকে নিজেদের দেশ হিসাবে স্বীকার করে নিতে পারেনি। প্রতিষ্ঠাতার সেই ধারা বজায় রেখে দেশ বিরোধী সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীরা আজও বিএনপির সবচেয়ে বড়ো সহযোগী শক্তি, সে হোক ক্ষমতার বা আন্দোলন সংগ্রামের।
পাকিস্তান তথা আইএসআই-এর প্রভাব বৃদ্ধি
বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, মওদুদীপন্থী জামায়াত শিবির এবং আরাকানে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মাধ্যমে ভারতে সেভেন সিস্টারে অস্থিরতা সৃষ্টি, বাংলাদেশে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস, এগুলো সবই ছিল আইএসআই-এর প্রধান লক্ষ্য। এই সব কয়টি লক্ষ্য পূরণেই আইএসআইকে সহায়তা করেছে বিএনপি, এবং বাংলাদেশে তাদের অপারেশনকে শক্তিশালী করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ নিয়ে আইএসআই এর সমস্ত ভাবনা বদলে যায়। তাদের অপারেশনগুলো দেখলে এবং সেই অপারেশন কার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়েছিল সেটা স্টাডি করলেই বোঝা যায়। এক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা লক্ষণীয়:
১. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা
২. ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেল হত্যা
৩. হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে পালাতে সাহায্য করা এবং পুনর্বাসন করা
৪. পঁচাত্তর পরবর্তী সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র” ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া
৫. সশস্ত্র বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা
৬. ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলোর রাজনৈতিক বৈধতা দেয়া
৭. গোলাম আযমকে পাকিস্তানি পাস[পোর্ট দিয়ে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা
৮. পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার স্থাপন করে রাজনৈতিক ও জাতিগত বিভেদ তৈরির মাধ্যমে আইএসআই-এর হাব নিশ্চিত রাখা। পরবর্তীতে সেখানে সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে জায়গাটিকে অবরুদ্ধ করে রাখা।
এছাড়াও আইএসআই তথ্য সংগ্রহের জন্য মেজর নুরুল ইসলাম মিশুকে নিয়োগ দেওয়া হয়। যিনি প্রধান সামরিক শাসক প্রশাসক জিয়াউর রহমানের প্রধান সহকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বন ও কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শেষে তিনি খালেদা জিয়ার সময়ে বিএনপির মহাসচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রদল গঠনে মেজর নুরুল ইসলাম মিশুই মূল উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। আইএসআই-এর সাবেক চিফ-এর স্বীকারোক্তিতে ১৯৯১ সালের নির্বাচন করতে দুই দফায় বিএনপিকে ১৪০ মিলিয়ন ও ৫০ মিলিয়ন রুপি প্রদানের বিষয়টি ওঠে এসেছে। আইএসআই যে দুইটি উইংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের অপারেশন জারি রেখেছে তার মধ্যে একটি দল হচ্ছে বিএনপি এবং অন্যটি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ।
ইসলামিক জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের আমদানি
আইএসআই সংশ্লিষ্টতার কারণে তালেবানি ও পাকিস্তানি জঙ্গি সংস্কৃতি বাংলাদেশে সহজেই ঢুকেছে বিএনপির হাত ধরেই। আইএসআই এই একই ফর্মুলায় আফগানিস্তান, কাশ্মির, ভারতসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মৌলবাদের যোগান দিয়েছে। বাংলাদেশে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ওপর বোমা হামলা, রমনা বটমূলে বোমা হামলা, গোপালগঞ্জে বোমা পূতে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা, শাহ এমএস কিবরিয়া হত্যা, আহসানুল্লাহ মাস্টার হত্যা, জাগ্রত মুসলিম জনতার বাংলা ভাইয়ের উত্থান, হরকাতুল জেহাদ নেতা মুফতি হান্নান, জিন্দাল, পরবর্তী সময়ে মেজর জিয়া এই সকল ভাবধারাই বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে আইএসআই-এর হাত ধরে। আর ১০ ট্রাক অস্ত্রের মতো এই আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে দীর্ঘদিনের সঙ্গী বিএনপি-জামায়াত। জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গেটওয়ে হয়েছে বাংলাদেশ, দেশ ও দশের কথা চিন্তা না করা বিএনপির কারণে।
উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধিতে কতোটা অবদান রেখেছে বিএনপি সেটা আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু একটি দেশ, যেই দেশের শতভাগ মানুষ রাজনীতি সচেতন, এবং কোন কোন দল গোষ্ঠীকে সমর্থন করে, সেই দেশের রাজনীতিতে বিএনপি নামক দলটির অবদান একটা স্পষ্ট মেরুকরণের সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। রাজনীতির এই ধারায় দেশের মানুষের কথা, দেশের ভাগ্যন্নোয়নের কথা কেউ ভাবে না, লক্ষ্য একটাই ক্ষমতায় যাওয়া। সফলতার সাথে সরকার পরিচালনার কথা কেউ ভাবে না, ভাবে সরকার গঠনে জিততেই হবে। একমাত্র ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া কোন ভিশন নাই, কোন টার্গেট নাই, দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কোন রূপরেখা নাই।
ক্ষমতার, জয়ের এই রাজনীতির অবসান হোক, রাজনীতিটা আবার জনমানুষের জন্য হোক। দলীয় কর্মীরা না, একজন দিনমজুর, একজন পরিবহন শ্রমিক, একজন খেটে খাওয়া জেলে, কৃষক আপন হয়ে উঠুক রাজনৈতিক দলগুলোর। জনমানুষের রাজনীতি ফিরুক বাংলাদেশে।
শরিফুল হাসান সুমন: রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট।