৪৬ বছরে রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আনল বিএনপি?



শরিফুল হাসান সুমন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। তিন দফা বাংলাদেশের সরকার গঠনে ভূমিকা রেখেছে দলটি। রাজনীতির চড়াই উৎরাইয়ে মধ্যবয়েসি এই রাজনৈতিক দলটির ভূমিকা নিতান্তই কম নয়। এবং একইসাথে এই দলটির ভোটার সংখ্যা রাজনীতিতে সবসময়েই একটা বড় পার্থক্য গড়ে দিতে সক্ষম। সৃষ্টির ৪৬ বছর পরে এসে নেতৃত্ব আর অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে দলটি, দলীয় নেত্রীর অসুস্থতাজনিত কারণে এবং ভিডিও ও মাইক সর্বস্ব নেতৃত্বের কারণে।

১৯৭৫ উত্তর বাংলাদেশে প্রধান সামরিক কর্মকর্তা আর প্রশাসক জিয়াউর রহমানের সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের প্রচেষ্টায় ১৯ দফা অর্থনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে জাগদল নামে রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করেন। সেই প্রক্রিয়ায় শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপির জন্ম হয় ১৯৭৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর। গঠনের এই ৪৬ বছরে বাংলাদেশকে কী দিয়েছে বিএনপি?

রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ছাত্রনেতারা। তাদের সকলের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধুর পরিবারের হত্যাকাণ্ড পরিকল্পনায় জিয়াউর রহমানের নীরব সম্মতি প্রদান, এবং সমস্ত কিছু জেনেও কোন বাধা বা কাউকে অবহিত না করার কারণেই ১৫ আগস্টের বাংলাদেশে সবচেয়ে জঘন্যতম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এবং এই ঘটনার সবচেয় বড় সুবিধাভোগী হন তৎকালীন উপসেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। পরবর্তী সময়ে সর্বময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা জিয়াউর রহমানের প্রচ্ছন্ন নির্দেশেই ৩ নভেম্বর জেল হত্যা ঘটে, ৭ নভেম্বর পরবর্তী ধরপাকড় আর গ্রেফতার হত্যার মাধ্যমে রাজনীতি থেকে শুরু করে সেনাবাহিনীর ফ্রন্টলাইনে যারা ছিলেন তাদের সবাইকে সরানো হয়। ১৯৬০ থেকে শুরু করে ১৯৭৫ পর্যন্ত আন্দোলন সংগ্রামে বাংলাদেশের রাজনীতির পুরোধা যারা ছিলেন তারা সবাই ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭, এই দু বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যান, যার রূপকার ছিলেন জিয়াউর রহমান। এই যে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর মেধার শূন্যতা, এর ফল ভোগ করতে হয় পরবর্তী দুই দশক বাংলাদেশে।

রাজনৈতিক মতাদর্শহীনতা

অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী একবার বলছিলেন, ‘নানান স্রোত থেকে লোক এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করল। ফলে এটা কোন মতাদর্শগতভাবে গড়ে উঠেছে, তা আমরা বলতে পারব না। গড়ে ওঠার পরে তারা একটা রাজনৈতিক আদর্শের কথা বলছে, যেটা তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলছে। এটা কিন্তু আগে নির্ধারিত কিছু ছিল না। এটা প্রয়োজনের জন্য তারা তৈরি করেছে। যেমন, আওয়ামী লীগ এক ধরনের রাজনীতি করছে, তার সাথে ভারতের একটা সম্পর্ক ছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। কাজেই অন্য যারা রাজনীতিতে আসবে, তাদের পার্থক্য দেখানোর জন্য ভারত বিরোধিতার অবস্থানে যাওয়া দরকার ছিল। এবং আমার মনে হয় না, সেটা পরিষ্কার কোন চিন্তা থেকে করা হয়েছিল।’

জিয়াউর রহমান ভাবতেন, তিনি বাংলাদেশভিত্তিক একধরনের রাজনীতি করবেন। যাতে বামপন্থী থেকে শুরু করে ইসলামপন্থীরা একত্রিত হবে। এবং এর ফলে যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করে তাদের সাথে একটা দূরত্ব রেখে এগোনো যাবে। এমন ধারণা নিয়ে জিয়াউর রহমান এগোচ্ছিলেন। কিন্তু যারা অনুসারী ছিলেন অথবা স্বাধীনতা বিরোধী যারা ছিলেন, তারা সুযোগ পেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে বিভাজনকে তীব্র করলেন। আদতে যেই মতাদর্শ থেকে বিএনপি নামক দলটির রাজনৈতিক ভিত্তি সৃষ্টি হচ্ছিল সেটা ছিল, এন্টি আওয়ামী লীগ ঘরানা। আওয়ামী আর বঙ্গবন্ধু বিরোধিতা থেকেই প্রো-পাকিস্তানি, এন্টি মুক্তিযুদ্ধ, প্রো-ইসলামি, এন্টি লীগ ধ্যান ধারনার বিভিন্ন মানুষের রাজনৈতিক সংমিশ্রণ ছিল বিএনপি। এছাড়া আর কোন আদর্শ দল গঠনের ৪৫ বছরেও দলটি সৃষ্টি করতে পারেনি।

মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে বিভক্তি ও ইতিহাস বিকৃতি

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তিনি নিজে বিষয়টিকে বড় ইস্যু হিসেবে তুলে ধরেননি। তবে তার মৃত্যুর পর তাকে অতিরিক্ত মূল্যায়নের চেষ্টার কারণে বিতর্ক দেখা দেয় বলে বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলছিলেন, বিএনপি প্রতিষ্ঠার পরই মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ইতিহাসকেই ভিন্নভাবে উপস্থাপনের কারণে বিভাজন সৃষ্টি হয়। শুধুমাত্র জিয়াকে ইতিহাসের নায়ক, মুক্তিযুদ্ধের বিশাল যোদ্ধা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরির লক্ষ্যে বিএনপি নামক দলটির তরফ থেকে মিথ্যা ইতিহাস সৃষ্টি ও সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, যার কারণে দেশে লম্বা সময়ের ইতিহাসবিমুখতা ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের সত্যকারের ইতিহাস না জেনেই শুধুমাত্র কিছু বীরশ্রেষ্ঠ আর ওয়ান ম্যান আর্মি জিয়াউর রহমানের বীরত্ব আর অসীম সাহসিকতার গল্প পড়ে বড় হয়েছে ৮০’র দশকের প্রজন্ম। সেই ইতিহাসে ছিলেন না বঙ্গবন্ধু, ছিলেন না জাতীয় চার নেতা, ছিল না ক্র্যাক প্লাটুন, ছিলেন না খালেদ মোশাররফ, ছিলেন না মেজর হায়দার, ছিলেন না জগতজ্যোতি দাসরা।

গণতন্ত্রের উল্টোরথ যাত্রা

সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম আরও বলছিলেন, ‘খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি অনেক বেশি গণতান্ত্রিক। যদিও বলা যায় না যে, গণতন্ত্রের সব শর্তই দলটি পূরণ করছে। কারণ দলটির ভিতরেই গণতান্ত্রিক চর্চা হয় না। কিন্তু খালেদা জিয়া অন্তত বহুদলীয় গণতন্ত্রের একটা সচল রূপ গ্রহণ করেছেন। আর জিয়াউর রহমানের সময় ছিল তার এক ধরনের কর্তৃত্ববাদ। এধরনের শাসন ব্যবস্থায় যে লাভ হয়, অর্থাৎ অর্থনীতি সচল থাকে, জনজীবনে শান্তি শৃঙ্খলা থাকে, যেটা তার অনুকূলে গিয়েছিল।’

বহু আদর্শিক এই জোটের কারণে বিএনপিকে নিজেদের রাস্তা পরিষ্কার করতে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করতে দেখা গেছে অনেকবারই। সেটা বিএনপির কেন্দ্র থেকে নির্দেশিত চেষ্টা হোক বা সহযোগীদের চেষ্টা, বিএনপির কমান্ড সেই চেষ্টায় বাধা দেয় নাই। ঠিক যেন পূর্বজের মতোই সামরিক ধারায় ফিরিয়ে এনেছিল বিএনপি গণতন্ত্রের মোড়কে।

ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রচলন

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম মনে করেন, বিএনপি’র এই জোট ধর্মভিত্তিক বা চরম ডানপন্থী দলগুলোকে জায়গা করে নেওয়ার শক্তি যোগাচ্ছে। এর থেকে বিএনপি বেরিয়ে আসতে পারবে কি না, সে ব্যাপারে তার সন্দেহ রয়েছে।

বিএনপি নেতাদের অনেকেই বলেছেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রাখাসহ কিছু বিষয়ে জোটের শরিকদের সাথে বিএনপির মিল থাকায় এটাকে তারা আদর্শিক জোট হিসেবে দেখছেন। কিন্তু দলটি নিজের আদর্শ বা স্বকীয়তা বজায় রাখবে এবং চরম ডানপন্থার দিকে এগুবে না বলেই তাদের দাবি।

মুক্তিযুদ্ধ বা এর পরবর্তী সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র আর গণতান্ত্রিক ধারায় এগুতে থাকা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির শুরুটা হয় সামরিক শাসক জিয়ার হাত ধরে। যুদ্ধাপরাধী ও রাজাকারদের মুক্তি দিয়ে, বঙ্গবন্ধু ও জেল হত্যায় জড়িতদের ইনডেমনিটি দিয়ে এদের সবাইকে রাজনীতিতে যুক্ত করেন তিনি। গোলাম আযমকে বাংলাদেশ ফিরিয়ে আনেন ১৯৭৮ সালে, তার হাত ধরে যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে গঠন হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর। ইনডেমনিটি প্রাপ্তদের নিয়ে ১৯৮০ সালে গঠিত হয় ফ্রিডম পার্টি। কারণ জিয়া নিশ্চিত ছিলেন বিপ্লব ও প্রতিবিপ্লব আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ ছিনিয়ে আনা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে উনার কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন ধর্মীয় অনুভূতি এবং সহযোগী দল হিসাবেও বিছে নিয়েছিলেন ধর্মীয় অনুভূতিসম্পন্ন দল। তার এই ধারা বিএনপি পরবর্তী সময়েও বলবৎ রেখেছে।

মুক্তিযুদ্ধপন্থী অফিসারদের নিধন

জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে ছোট-বড় ২১টি অভ্যুত্থান ঘটেছে বলে গবেষক ও বিশ্লেষকদের লেখায় তথ্য পাওয়া যায়। কেউ কেউ বলেন সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছিল ২৬টি। এসব অভ্যুত্থানের পর নামমাত্র বিচারে কতজনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, তার তালিকা করা দুঃসাধ্য। শুধু ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিমানবাহিনীর সদস্যদের ব্যর্থ অভ্যুত্থানেই ফাঁসি ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় ১৩০০ জনের বেশি সেনাকে। এর মাধ্যমে সামরিক বাহিনীতে পাকিস্তানপন্থী অফিসার এবং জিয়াউর রহমানের প্রতি বিশ্বস্ত অফিসারদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য নিশ্চিত করা হয়। জিয়ার সেই ক্যাঙ্গারু কোর্টের নথিপত্রের প্রমাণ সব পরবর্তীতে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়। শুধুমাত্র বিমানবাহিনীতেই ৪৬০ জনের বিচার করা হয়। যার মধ্যে কোন শুনানি বাদে সরাসরি ফাঁসির আদেশ দিয়ে সেই রাতেই ফাঁসি নিশ্চিত করা হয় ৩৭ জনের, ২০ জন যাবজ্জীবন সাজা পান, ৬৩ জন খালাস পান। বাকি ৩৪০ জনের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা কেউই আজ পর্যন্ত জানতে পারেনি; তাদের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

যুদ্ধাপরাধী আর রাজাকারদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন

১৯৭২ সালে প্রণীত দালাল আইনে ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২৮৮৪টি মামলা রুজু করা হয়। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপকর্ম আর দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রের জন্য আটক করা হয়েছিল ৩৭ হাজারেরও বেশি রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী ও পাকিস্তানের দোসরদের। পরবর্তীতে ৪টি অপরাধ বাদে ছোটখাটো অপরাধের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে পরিচালিত মামলায় সারাদেশে ৭৩টি যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বাকি ২ হাজার ৮৪৮ জনের বিচার হয়। যার মধ্যে ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদের সাজা দেওয়া হয়।

১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেন এবং বড় বড় অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত ৭৫২ জনসহ বিচারাধীন ১১ হাজার অপরাধীকে মুক্ত করে দেন। এবং এদের মধ্যে নেতৃত্ব স্থানীয়দের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেন ধর্মভিত্তিক ইসলামী দল হিসাবে, যাদের উত্তরসূরিরা আজও বাংলাদেশকে নিজেদের দেশ হিসাবে স্বীকার করে নিতে পারেনি। প্রতিষ্ঠাতার সেই ধারা বজায় রেখে দেশ বিরোধী সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীরা আজও বিএনপির সবচেয়ে বড়ো সহযোগী শক্তি, সে হোক ক্ষমতার বা আন্দোলন সংগ্রামের।

পাকিস্তান তথা আইএসআই-এর প্রভাব বৃদ্ধি

বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, মওদুদীপন্থী জামায়াত শিবির এবং আরাকানে ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মাধ্যমে ভারতে সেভেন সিস্টারে অস্থিরতা সৃষ্টি, বাংলাদেশে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস, এগুলো সবই ছিল আইএসআই-এর প্রধান লক্ষ্য। এই সব কয়টি লক্ষ্য পূরণেই আইএসআইকে সহায়তা করেছে বিএনপি, এবং বাংলাদেশে তাদের অপারেশনকে শক্তিশালী করেছে।

মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশ নিয়ে আইএসআই এর সমস্ত ভাবনা বদলে যায়। তাদের অপারেশনগুলো দেখলে এবং সেই অপারেশন কার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়েছিল সেটা স্টাডি করলেই বোঝা যায়। এক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা লক্ষণীয়:

১. ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা
২. ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেল হত্যা
৩. হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে পালাতে সাহায্য করা এবং পুনর্বাসন করা
৪. পঁচাত্তর পরবর্তী সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র” ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া
৫. সশস্ত্র বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা
৬. ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করে জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী দলগুলোর রাজনৈতিক বৈধতা দেয়া
৭. গোলাম আযমকে পাকিস্তানি পাস[পোর্ট দিয়ে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা
৮. পার্বত্য চট্টগ্রামে সেটেলার স্থাপন করে রাজনৈতিক ও জাতিগত বিভেদ তৈরির মাধ্যমে আইএসআই-এর হাব নিশ্চিত রাখা। পরবর্তীতে সেখানে সেনা মোতায়েনের মাধ্যমে জায়গাটিকে অবরুদ্ধ করে রাখা।

এছাড়াও আইএসআই তথ্য সংগ্রহের জন্য মেজর নুরুল ইসলাম মিশুকে নিয়োগ দেওয়া হয়। যিনি প্রধান সামরিক শাসক প্রশাসক জিয়াউর রহমানের প্রধান সহকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বন ও কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শেষে তিনি খালেদা জিয়ার সময়ে বিএনপির মহাসচিব হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রদল গঠনে মেজর নুরুল ইসলাম মিশুই মূল উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। আইএসআই-এর সাবেক চিফ-এর স্বীকারোক্তিতে ১৯৯১ সালের নির্বাচন করতে দুই দফায় বিএনপিকে ১৪০ মিলিয়ন ও ৫০ মিলিয়ন রুপি প্রদানের বিষয়টি ওঠে এসেছে। আইএসআই যে দুইটি উইংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের অপারেশন জারি রেখেছে তার মধ্যে একটি দল হচ্ছে বিএনপি এবং অন্যটি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ।

ইসলামিক জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের আমদানি

আইএসআই সংশ্লিষ্টতার কারণে তালেবানি ও পাকিস্তানি জঙ্গি সংস্কৃতি বাংলাদেশে সহজেই ঢুকেছে বিএনপির হাত ধরেই। আইএসআই এই একই ফর্মুলায় আফগানিস্তান, কাশ্মির, ভারতসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মৌলবাদের যোগান দিয়েছে। বাংলাদেশে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ওপর বোমা হামলা, রমনা বটমূলে বোমা হামলা, গোপালগঞ্জে বোমা পূতে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা, শাহ এমএস কিবরিয়া হত্যা, আহসানুল্লাহ মাস্টার হত্যা, জাগ্রত মুসলিম জনতার বাংলা ভাইয়ের উত্থান, হরকাতুল জেহাদ নেতা মুফতি হান্নান, জিন্দাল, পরবর্তী সময়ে মেজর জিয়া এই সকল ভাবধারাই বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে আইএসআই-এর হাত ধরে। আর ১০ ট্রাক অস্ত্রের মতো এই আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে দীর্ঘদিনের সঙ্গী বিএনপি-জামায়াত। জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গেটওয়ে হয়েছে বাংলাদেশ, দেশ ও দশের কথা চিন্তা না করা বিএনপির কারণে।

উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধিতে কতোটা অবদান রেখেছে বিএনপি সেটা আলোচনার দাবি রাখে। কিন্তু একটি দেশ, যেই দেশের শতভাগ মানুষ রাজনীতি সচেতন, এবং কোন কোন দল গোষ্ঠীকে সমর্থন করে, সেই দেশের রাজনীতিতে বিএনপি নামক দলটির অবদান একটা স্পষ্ট মেরুকরণের সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। রাজনীতির এই ধারায় দেশের মানুষের কথা, দেশের ভাগ্যন্নোয়নের কথা কেউ ভাবে না, লক্ষ্য একটাই ক্ষমতায় যাওয়া। সফলতার সাথে সরকার পরিচালনার কথা কেউ ভাবে না, ভাবে সরকার গঠনে জিততেই হবে। একমাত্র ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া কোন ভিশন নাই, কোন টার্গেট নাই, দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কোন রূপরেখা নাই।

ক্ষমতার, জয়ের এই রাজনীতির অবসান হোক, রাজনীতিটা আবার জনমানুষের জন্য হোক। দলীয় কর্মীরা না, একজন দিনমজুর, একজন পরিবহন শ্রমিক, একজন খেটে খাওয়া জেলে, কৃষক আপন হয়ে উঠুক রাজনৈতিক দলগুলোর। জনমানুষের রাজনীতি ফিরুক বাংলাদেশে।

শরিফুল হাসান সুমন: রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট।

সংঘাত এক অসমাপিকা ক্রিয়া



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

এতো মৃত্যু, এতো রক্ত, এতো ধ্বংস, এতো তাণ্ডবের সম্মিলিত চেহারাটা বড় বীভৎস এবং করুণ। মধ্য জুলাই ২০২৪ সালের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাপ্রবাহের জেরে দগ্ধ ও রক্তাক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। দেশবাসীর তাজা স্মৃতি ছুঁয়ে রয়েছে আতঙ্ক, ভীতি ও উদ্বেগ, যা ক্রমশ স্বস্তির দেখা পেলেও একটি প্রশ্ন সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, এই সংঘাতময় নজিরবিহীন নৈরাজ্যে কার জয় হলো? কার হলো পরাজয়?

সহজে বা এককথায় উত্তর পাওয়া যাবে না। কারণ, নৈরাজ্য এক বিকারগ্রস্ত পরিস্থিতির নাম। যুক্তি ও বুদ্ধি কাজ করে না নৈরাজ্যবাদী সংঘাতে। আর সংঘাত এক অসমাপিকা ক্রিয়া। দুষ্টচক্রের মতো বাড়তে থাকে। এক সংঘাত আরেক সংঘাতকে ডেকে আনে। সংঘাতে আচ্ছন্ন করে ফেলে সবকিছু।

সংঘাত ও নৈরাজ্যের কারণে কোনও কাজ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন আর স্বরূপে স্থির থাকতে পারে না। পরিণত হয় ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবে। পক্ষ-বিপক্ষের প্রতিটি ধারাও নিয়মের সীমারেখার ভেতর থাকতে পারে না। চলে যায় নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ফলাফল সর্বাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ, অগণিত মৃত্যু, সীমাহীন রক্তপাত। পক্ষ-বিপক্ষ উভয়েই অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখীন। ক্ষতির মাত্রা কল্পনার চেয়েও অধিক।

সংঘাত ও নৈরাজ্যের পরিস্থিতিতে একটা লাগামছাড়া আক্রোশ সওয়ার হয়। ক্ষোভ ও হিংসা দখল করে পুরো পরিস্থিতি। উন্মত্ততা তেড়ে আসে বন্য পশুর মতো। গণউন্মত্ততার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় ধ্বংসযজ্ঞে। কেন এমন হয়েছিল কেউ ঠিক ঠিক বলতে পারবে? হয়তো কখনও জানা যাবে সমাজতাত্ত্বিক-মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা করা হলে। হয়তো এর রাজনৈতিক কার্যকারণও জানা যাবে। কিন্তু মানবিক ও বস্তুগত ক্ষতির পূরণ সম্ভব হবে না কোনোও দিনও। হয়তো ধ্বংসের পর নির্মাণ হবে। মৃত্যুর পর নবজন্ম হবে। তথাপি সহজে মুছবে না দগদগে ক্ষতির চিহ্ন ও রেশ।

সংঘাত ও নৈরাজ্যের সংগঠিত রূপ হলো গণউন্মত্ততা। প্রায়ই যে ছেলেধরা বা কথিত চোর সন্দেহে অবলীলাক্রমে জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে মারা হয়, তা আসলে এক ধরনের গণউন্মত্ততা, যা সংঘাতময় মনোবৃত্তি ও নৈরাজ্যজনক মানসিকতার ভিন্নধর্মী বহিঃপ্রকাশ। সমাজ ও মানুষ অস্থিরতার কবলে নিপতিত হলে বিস্ফোরণ ঘটে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার।

সেজন্যই সমাজে শান্তি, ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা জরুরি। আর শান্তিপূর্ণ, স্বাভাবিক সমাজের স্বার্থে ও মানুষের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গণউন্মত্ততা বড়ই বিপদজনক। এর প্রকৃত কার্যকারণ অবশ্যই খুঁজে বের করা দরকার। নচেৎ বিষফোঁড়া হয়ে তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে ফেটে বের হবে এবং সংঘাত ও নৈরাজ্যের ধারাকে পুষ্ট করতে থাকবে অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো, যার শুরু থাকলেও শেষ থাকবে না। বরং এর থেকে জন্ম নেবে আরও সংঘাত। আরও নৈরাজ্য। আরও তাণ্ডব ও উন্মত্ততা।

মধ্য জুলাই ২০২৪ সালের ধ্বংস-চিহ্নিত ও রক্ত-মথিত ঘটনাপ্রবাহে সংঘাত ছিল। নৈরাজ্য ছিল। তাণ্ডব ছিল। গণউন্মত্ততা ছিল। সবই ছিল। শুধু অনুপস্থিত ছিল বিবেক, যুক্তি, মানবিকতা, সহনশীলতা। যার পরিণতি ভোগ করতে হলো পুরো দেশ ও জাতিকে। প্রচুর মূল্য দিয়ে এবং শঙ্কার কৃষ্ণপ্রহর পেরিয়ে মানুষকে ফিরতে হয়েছে স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে।

বিশ্বের দেশে দেশে সংঘাত এক ভয়ঙ্কর বিপদের নাম। রাজনৈতিক কারণে, সামাজিক বিভেদে, অর্থনৈতিক বৈষম্যে, জাতিগত দ্বন্দ্বে, মতাদর্শিক মতপার্থক্যে বহু দেশ সংঘাতে নিমজ্জিত হয়ে পৌঁছে গেছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। সংঘাত-কবলিত সমাজ হচ্ছে রক্তাক্ত, মানুষ হচ্ছে বিপন্ন।

ক্ষুদ্র আয়তনে বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সংঘাত কতো মারাত্মক হতে পারে তার প্রমাণ মধ্য জুলাইয়ের নজিরবিহীন ঘটনাপ্রবাহ। এই দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সংঘাত-মুক্তির পথ খুঁজে বের করা আবশ্যক। বিভেদ ও বিতর্কের গতিপথ আর যেন দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দিকে চলে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। সংঘাতকে সংঘাত দিয়ে নয়, সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধানে উত্তীর্ণ করার কৌশল অবলম্বন করাই সুবিবেচনার কাজ। প্রতিপক্ষের ক্যাম্পে ঠেলে দিয়ে নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাবে কাছে টেনেই বরং সঙ্কট সমাধান ও সঙ্কট প্রশমন করা লাভজনক, শান্তিপূর্ণ ও বিচক্ষণ পদ্ধতি।

উদীয়মান অর্থনীতির বাংলাদেশকে সামনে এগুতে হচ্ছে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে। লড়তে হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, চাকরি প্রাপ্তির অনিয়ম ও নানা রকমের অব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এই যাত্রাপথ মসৃণ নয়। এতে যদি সংঘাতের দৈত্য এসে হানা দেয় তাহলে কষ্টার্জিত সকল অর্জনই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। অগ্রগামী বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়তে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভোগও বাড়তে থাকবে।

এমন সঙ্কুল পরিস্থিতিতে কার লাভ হবে? কে জিতবে? কে হারবে? এসব প্রশ্নের উত্তর না দিয়েও নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের আপামর মানুষের ক্ষতি ছাড়া কোনও লাভ হবে না। আসলে সংঘাত, নৈরাজ্য, উন্মত্ততা পরিশেষে কাউকেই লাভবান করতে পারে না। এক অসমাপিকা ক্রিয়ার মতো সবাইকে এক সমাপ্তিহীন ধ্বংসের গহ্বরে ফেলে দিতে পারে শুধু

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

উদারবাদিতার সীমা



সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবার আগে পৃথিবীব্যাপী মানুষের মনুষ্যত্বের দুর্দশা দেখে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রশ্ন’ নামের কবিতাটিতে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো/ তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছো ভালো?” তাঁর চোখ সেদিন অশ্রুসিক্ত ছিল, জানিয়েছেন তিনি। সেটা ১৯৩১-এর ঘটনা। তার পরে প্রায় এক শ’ বছর কেটে গেছে কিন্তু মনুষ্যত্বের দুর্গতি মোটেই কমেনি। ১৯৩৯ আবার একটি বিশ্বযুদ্ধ বেধেছে, পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদীরাই ঘটিয়েছে দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতায় নেমে; তারপরে তৃতীয় একটা বিশ্বযুদ্ধ ঘটেনি ঠিকই, কিন্তু পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের শোষণ পীড়ন লুণ্ঠন অসংখ্য স্থানীয় ও আঞ্চলিক যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। তারা আজ কেবল যে বায়ু ও আলোকে বিপন্ন করছে তা-ই নয়, পানিও দিয়েছে নষ্ট করে, ধরিত্রীকে তপ্ত করেছে দুঃসহ রূপে। খবর বলছে ২০২৩ সালে গ্রীষ্ম ছিল গত দুই হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ; এবং শঙ্কা নাকি এই রকমের যে চলতি বছরের উষ্ণতা ওই রেকর্ডও ভেঙে ফেলবে।

রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নটা ছিল ভগবানের কাছে। এযুগে ইহজাগতিকরণ বৃদ্ধি পেয়েছে, প্রশ্ন নিয়ে মানুষ এখন আর ভগবানের দ্বারস্থ হয় না, জিজ্ঞাসা করে মানুষকেই। এ ক্ষেত্রে মানুষই এখন ভগবানের জায়গা নিয়ে নিয়েছে। মানুষের নাকি অনেক ক্ষমতা; বিশেষ করে এই জন্য যে তারা ভোট দিতে পারে, ভোট দিয়ে পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারে। কিন্তু পছন্দ করবার মতো সক্ষমতা মানুষের আছে কী? গণতন্ত্রের জন্য ‘আদর্শ’ ভূমি আমেরিকা; সেখানে একটি নির্বাচন এগিয়ে আসছে; জনগণ পুনরায় ক্ষমতা পাবে পছন্দের মানুষটিকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসাবার। কিন্তু তারা কাকে বসাবে? হয় বাইডেনকে নয়তো ট্রাম্পকে। দু’জনের মধ্যে পার্থক্য কতটা? সে তো উনিশ বিশের।

ফিলিস্তিনি প্রশ্নে তাদের অবস্থান দেখলে তো বোঝা যায় যে উনিশ বিশের নয়, সাড়ে উনিশ ও বিশের বটে। ট্রাম্প বলেছেন তিনি নির্বাচিত না হলে আমেরিকাই থাকবে না; অর্থাৎ যে বর্ণবাদী আমেরিকা একদা কলম্বাসের ইউরোপীয় সহযোগীরা তাদের জবরদখল-করা ভূমিতে কায়েম করেছিল সেটা থাকবে না। ট্রাম্পের আওয়াজটা হচ্ছে, শ্বেতাঙ্গদের শাসন যদি টিকিয়ে রাখতে চাও তাহলে আমাকে ভোট দাও। কথাটা বাইডেন ঠিক ওই ভাবে বলেন না, কিন্তু তিনিও যে শ্বেতাঙ্গ-শাসনই অক্ষুন্ন রাখতে চান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে কথিত যে ভারত, সেখানেও তো বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন, দুটি ভিন্ন দলের কাঁধে ভর দিয়ে, তবে উন্নয়নের ডঙ্কা বাজিয়ে নয়, যেটা আগেরবার বাজিয়ে ছিলেন; এবার সেটা করেননি কারণ উন্নয়ন তেমন ঘটাতে পারেননি, তার চেয়ে সহজ এবং তাঁর ধারণা অধিক কার্যকর পথ হচ্ছে তিনি না এলে মুসলমানরা ক্ষমতাবান হয়ে উঠবে, দেশের ধনসম্পত্তি সব দখল করে নেবে ভৌতিক এই ভয়টাকে প্রচার করে।

বুর্জোয়া নির্বাচন ব্যবস্থা মোটামুটি পৃথিবী জুড়েই অকেজো হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে যে জাতীয় নির্বাচন হয়ে গেল সেখানে তো দেখলাম ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলো নিজের দলের লোকদের বিরুদ্ধেই। স্থানীয় নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলেছে দলের লোকদের মধ্যেই। নির্বাচনে বিজয়ীরা যা খরচ করেন তার বহুগুণ তাঁরা যে তুলে নেবেন সেটা তাঁরা জানেন আমরাও জানি; স্থানীয় নির্বাচনে অনেক ক্ষেত্রেই কী ঘটেছে সে সম্পর্কে ঠাকুরগাঁওয়ের এক আওয়ামী লীগ নেতা ঠিকই জানিয়েছেন : “ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা নেই, বিশ্বাস উঠে গেছে। সারাদিন দুই-তিনটা ভোট পড়েছে, বিকেলে তা বানানো হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩০০০ হাজার” [আজকের পত্রিকা, ১৭ মে]। ৩০০ থেকে ৩০০০ হাজারের ভেতর একটি মাত্র শূন্যের ব্যবধান বৈকি; ব্যাপারটাও দাঁড়াচ্ছে শূন্য কুম্ভের মতোই। শূন্য কুম্ভের আওয়াজ বেশি, কারণ ভেতরের জিনিস কম।

মোক্ষম সত্যটা অবশ্য প্রকাশ পেয়েছে একটি দৈনিকের শিরোনামে : “যেখানে এক আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি”। সংবাদে-উল্লেখিত মিলের জায়গাগুলো হলো উপজেলা নির্বাচনে (ক) দলীয় সিদ্ধান্ত মানছে না দুই দলের মাঠ পর্যায়ের নেতারা, (খ) নির্দেশনা অমান্য করার শাস্তি হয়নি সরকারি দলের কারও; এবং (গ) বিএনপি বহিষ্কারের পথে হাঁটলেও পাল্টা দায় দিচ্ছেন বহিষ্কৃত নেতারা”। মূল ঐক্যটা যেখানে তার কথা অবশ্য এই সংবাদ-তথ্যে নেই; সেটা হলো পুঁজিবাদী উন্নয়নে দীক্ষা। এক্ষেত্রে উভয় দলই সহযাত্রী, তাঁরা সেই উন্নয়নই সমর্থন করে থাকে যে-উন্নয়ন বৈষম্য বৃদ্ধি করে, বিচ্ছিন্নতা বাড়ায়, নিচের দিকে ঠেলে দেয় দেশপ্রেমকে। উন্নয়নের ওই নীতিতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি’তে কোনো ফারাক নেই, যেমনটা ঘটেছে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর এলাকায়, যেখানে দুইদলের নেতারা পাবলিকের জমি দখল করে একত্রযোগে একটি দোকান গড়েছেন।

উদারনীতিকেরা সংস্কারের কথা বলেন, কিন্তু সংস্কারে যে কুলাবে না তা অত্যন্ত স্পষ্ট। নাট্যকার হেনরিক ইবসেন বুনো হাঁস নামে একটি নাটক লিখেছিলেন সেই ১৮৮৪ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ১৪০ বছর আগে। নাটকটিতে ওই সময়েই পুঁজিবাদ কী ভাবে কাজ করে সেটা তিনি দেখিয়েছেন। নাটকে দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী প্রতারণা ব্যবস্থার শিকার হচ্ছে একডাল পরিবার। বৃদ্ধ একডাল ব্যবসা করতেন তাঁর বন্ধু ওয়ারলের সঙ্গে। ওয়ারল খাঁটি পুঁজিবাদী। সে নেমেছিল কাঠকাটার অবৈধ ব্যবসাতে; কাজটা ধরা পড়ে যায়। মামলা হয়। ওয়ারলের ছিল প্রচুর টাকা; টাকার জোরে সে খালাস পেয়ে যায়, কিন্তু দশ বছরের জেল হয় একডালের। একডালরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, টাকাওয়ালা ওয়ারল লোকটা ছিল ভীষণ ভোগবাদী; সে তার গৃহ পরিচারিকা জীনার ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। জীনা সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়লে তড়িঘড়ি তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় একডালেরই পুত্র হেলমারের সঙ্গে। জীনা একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। জীনার স্বামী হেলমার একডাল যে কন্যাটির জৈব-পিতা নয়, এটা সে খোঁজ নিলেই জানতে পারতো। কিন্তু খোঁজ হেলমার নেয়নি। তার বসবাস ছিল স্বপ্নের জগতে।

জীনা এবং কন্যাটিকে নিয়ে তার দিন কেটে যাচ্ছিল। পেশা ছিল ফটোগ্রাফারের। স্বপ্ন ছিল একটি ফটোগ্রাফির যন্ত্র উদ্ভাবনের, যাতে তাদের সংসারে প্রচুর টাকা আসবে, পরিবারের জন্য আসবে সম্মান ও সুখ। কিন্তু হেলমারের বাল্যবন্ধু ওয়ারলের একমাত্র সন্তান গ্রেগারস বাবার কীর্তিগুলো ধরে ফেলেছিল। এই পুত্র বাবাকে ভীষণ ঘৃণা করে, বন্ধু হেলমারকে সে গভীর ভাবে ভালোবাসে। সে আদর্শবাদী এবং সংস্কারপন্থি। সে চাইলো অন্তরের বন্ধু হেলমারকে মিথ্যার জাল থেকে উদ্ধার করবে, সত্য ধরিয়ে দিয়ে পরিপূর্ণ বোঝাবুঝির ওপর বন্ধুর দাম্পত্যজীবনের প্রতিষ্ঠা ঘটাবে। তাই একদিন সে তার বন্ধু হেলমারকে ডেকে নিয়ে জীনার সন্তান সম্পর্কে ‘সত্য’টা জানিয়ে দিল। ফল দাঁড়ালো এই যে, হেলমারের কষ্ট-করে-সাজানো সংসারটা গেল ভেঙে, হেলমারের অবস্থাটা দাঁড়াল অর্ধউন্মাদের; সে তার অত্যন্ত আদরের কন্যাটিকে ঘৃণা ভরে দূরে সরিয়ে দিল।, স্ত্রীকে অসৎ বলে ঘোষণা দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে ঠিক করলো।

১৪ বছর বয়সের কন্যাটি বুঝতে পারলো না কী ঘটেছে, কেন ঘটছে, কিন্তু টের পেল যে তার বাবা তাকে আর ভালোবাসেন না, সহ্যই করতে পারেন না। মেয়েটির সন্দেহ হলো হয়তো সে তার বাবা-মা’র সন্তান নয়, মা তাকে কুড়িয়ে পেয়েছেন। হঠাৎ-জাগা উপলব্ধিতে অসহায় মেয়েটি আত্মহত্যা করে বসলো। বাবার অকৃত্রিম বন্ধুর সংস্কার-চেষ্টার সমস্তটা ভার গিয়ে পড়েছিল নিরূপায় কন্যাটির ওপর, যেটা বহন করার ক্ষমতা তার ছিল না। নষ্ট পিতা ওয়ারল টাকার জোরে যে-পরিবারটিকে পথে বসিয়ে দিয়েছে, উপকার করতে গিয়ে আদর্শবাদী পুত্র তাদেরকেই দিল ছিন্নভিন্ন করে।

বিখ্যাত এই নাটকটির নানা রকমের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে; কিন্তু এর এই বক্তব্যটা খুবই সুস্পষ্ট যে, নষ্ট পিতার আদর্শবাদী পুত্র গ্রেগারস বন্ধুর পরিবারে সংস্কার ঘটাতে গিয়ে যা ডেকে আনলো তা ভয়াবহ বিপর্যয় ভিন্ন অন্যকিছু নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে গেলে পরিণতিটা এর চেয়ে ভালো হবার নয়। গ্রেগারস তার বন্ধু হেলমারের উপকার করতে পারতো সংস্কারের পথে না গিয়ে, আর্থিক ভাবে সাহায্য করতে সে সামর্থ্য তার ছিল। বিজ্ঞানী ডারউইন প্রাকৃতিক জগৎকে পরিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক সত্য আবিষ্কার করার পরে মানবজাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন প্রকৃতিকে নিজের মতো থাকতে দিতে, হস্তক্ষেপ না ঘটাতে; পুঁজিবাদীরা সে-পরামর্শকে গুরুত্ব দেয়নি, তারা প্রকৃতিকে নানা ভাবে উত্ত্যক্ত করেছে, যার পরিণতি হচ্ছে বর্তমান দুরবস্থা।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

;

ছাত্র-শক্তিকে অগ্রাহ্যে হলো যে ক্ষতি



কবির য়াহমদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

কোটা বিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের শুরুর দিকে এটাকে পাত্তা দেয়নি সরকার। দাবিদাওয়া কিংবা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো আন্দোলনকে শুরুর দিকে সচরাচর পাত্তা দেয় না আওয়ামী লীগ সরকার। টানা চার মেয়াদে ক্ষমতাসীন থাকার নানা সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনের মুখে পড়েছে তারা, কিন্তু কোনো আন্দোলনকেই শুরুর দিকে পাত্তা দেয়নি তারা। বিভিন্ন ভাবে আন্দোলন বানচালের চেষ্টা চালিয়ে এরপর শক্তি প্রয়োগে সে সব আন্দোলনকে স্তব্ধ কর দিয়ে এসেছে। কোটা নিয়ে শিক্ষার্থী আন্দোলনও এক পর্যায়ে এই ধারাবাহিকতার মধ্যে পড়েছিল।

প্রথমে ছাত্রলীগকে দিয়ে আন্দোলন দমাতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়েছে। ছাত্রলীগই মার খেয়েছে, ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। পুলিশ দিয়ে আন্দোলন দমাতে গিয়ে এটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়েছে। পুলিশের লাঠি-বন্দুকে ভয় না পেয়ে বরং দুর্দমনীয় সাহসে পেতে দিয়েছে বুক। পুলিশ গুলি করেছে, তবু সরেনি পুনর্বার গুলির শঙ্কা থাকলেও। ফের গুলি করেছে পুলিশ। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ এভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে। তার প্রাণ বলিদান আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে দেয়নি। উপরন্তু এক মৃত্যুতে মরণের সমূহ ভয় কেটে গেছে অন্য সবার। বন্দুক-লাঠি-বেয়নেট-টিয়ার গ্যাস তখন হয়ে গেছে মামুলি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আরও শক্তি প্রয়োগের দিকে গেছে সরকার। বিজিবি নামিয়েছে। পরে সেনাবাহিনী।

দাপ্তরিক আদেশে বন্ধ করেছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ক্যাম্পাস থেকে কৌশলে এবং জোর করে বের করে দিয়েছে শিক্ষার্থীদের। কিন্তু তবু আন্দোলন থামেনি। বরং ক্যাম্পাসের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারাদেশে। শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়েছে সাধারণ মানুষও। অনেকেই রাস্তায় নেমেছে। ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে পড়েছে পুলিশ-র‍্যাব-বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনী।

ছাত্র-শক্তির এই তুমুল রূপের সামনে আওয়ামী লীগ এবারই প্রথম পড়েনি। ২০১৮ সালের পর পর দুইটা আন্দোলনের মুখে পড়ে তখনো পিছু হটেছিল। কোটা বিরোধী আন্দোলনে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে একই বছরের অপর এক আন্দোলনেও বিজয়ী হয়েছিল শিক্ষার্থীরা। লক্ষণীয় যে, এবারের কোটা আন্দোলন শুরু করেছিল যারা তাদের হাত ধরেই গড়ে ওঠেছিল সড়ক নিরাপত্তার আন্দোলন। তখন তারা ছিল মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। এবার তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

কোটা বাতিলের এবারের যে আন্দোলন এবং যে দাবি তাতে সরকারের দ্বিমত ছিল না। বরং সরকারের জারি করা ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করেছিল হাইকোর্ট, এবং পরিপত্র বাতিলের কারণে ফিরে এসেছিল কোটা ব্যবস্থা। যদিও সরকার ছয় বছর আগে আন্দোলনের মুখে বাতিল করেছিল কোটা, তবে হাইকোর্টের ভিন্ন রায় এবং অব্যবহিত পরও সরকার ছিল কোটা বাতিলের পক্ষেই। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল তার প্রমাণ। এরপর শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে প্রথম দিকে পাত্তা দেয়নি। ফলে আপিল পর্যন্ত থেমে থেকেছিল বিষয়টি। শুনানি এগিয়ে আনতে রাষ্ট্রপক্ষের বিশেষ কোন উদ্যোগের দেখা মেলেনি। তবে যখনই আন্দোলন ক্রমে বড় হতে থাকল, তখন হাইকোর্টের রায়ে স্থগিতাদেশ দিলেন আপিল বিভাগ, এবং পূর্ণাঙ্গ শুনানির জন্যে এক মাসের অপেক্ষার জন্যে রেখে দেওয়া হলো। এরপর পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেল, তখন আপিল এগিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়, এবং সর্বশেষ ফুল কোর্ট শুনানিতে আসল চূড়ান্ত রায়। আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায়ে ৭ শতাংশ কোটা রেখে রায় দেন আদালত।

চূড়ান্ত রায়ের আগে সরকারের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিদের অগ্রাধিকারের প্রসঙ্গ আসায়, আন্দোলনকারীরা ভাবল, এই বুঝি কোটা ফিরে এলো। যেখানে দেশে রাজাকারের কোন তালিকাই নাই সেখানে রাজাকারের নাতিপুতির প্রসঙ্গ এনে যে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, তাদের উদ্দেশ্য নিয়েই সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছিল তা হচ্ছে ৩০ শতাংশের মুক্তিযোদ্ধা কোটা। এই সুযোগে অনেকেই একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপমানের সুযোগ ছাড়ল না। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণের উদ্দেশ্য নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলল। মুক্তিযোদ্ধারা রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকেন, চাকরি ক্ষেত্রে তাদের সন্তান ও নাতিপুতিরা কেন বিশেষ সুবিধা পাবে, এই প্রশ্ন তুলল।

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও সরকার বিষয়টিকে ইগোর লড়াই হিসেবে দেখল বলেই কিনা ক্ষীণ স্বরে হলে কোটা ফিরিয়ে আনার একটা আওয়াজ ওঠল। বিষয়টি যদিও আনুষ্ঠানিক ছিল না, তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্যে সন্দেহ দানা বাঁধল। ফলে কোটা ফিরে আসার যে ইঙ্গিত, তাতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠল শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে আওয়ামী লীগ সরকার হালকাভাবে দেখল, এবং ভাবল ছাত্রলীগ আর পুলিশকে দিয়ে নস্যাৎ করে দেওয়া যাবে এটা। তাদের এই অভিসন্ধি ফুটে ওঠল ওবায়দুল কাদেরের নানা বক্তৃতায়। তিনি আন্দোলনকারীদের বিষয়টি ছাত্রলীগ দেখবে বলে যে কথা উচ্চারণ করেছেন, সেটা ক্ষোভের সঞ্চার করেছে আন্দোলনকারীদের মাঝে। এরপর তিনি বিষয়টি রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলার কথা জানিয়ে ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে প্রতিরোধ গড়ার নির্দেশ দেন দলীয় নেতাদের। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত ঢুকে গেছে এমন মন্তব্য করেন তিনি। ছাত্র-শক্তিকে অগ্রাহ্য করে তার বক্তব্য ও নির্দেশনা আগুনে ঘি ঢেলে দেয়।

ছাত্র-শক্তিকে অগ্রাহ্য করার বিষয়টি এসেছে মূলত সরকারবিরোধী আন্দোলনকে মোকাবেলা করার সাম্প্রতিক ইতিহাস। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার বিএনপি-জামায়াতসহ সকল সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে অগ্রাহ্য করে, তাদের বর্জন সত্ত্বেও নির্বাচন করেছিল। ওই নির্বাচনের আগে আমেরিকা-ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিদেশি অনেক শক্তি সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও শেষ পর্যন্ত সরকার নির্বাচন করে এবং ফের সরকার গঠন করে। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবেলা করে সরকারের এই পথ চলায় তাদের মধ্যে অহংবোধ জেগে ওঠায়, কোন শক্তিকেই পাত্তা না দেওয়ার একটা মানসিকতা গড়ে ওঠেছে। এই মানসিকতা কাল হয়েছে শিক্ষার্থী আন্দোলনকেও একইভাবে দেখার মধ্য দিয়ে।

সরকার ভেবেছিল নির্বাহী আদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও ক্যাম্পাস খালি করে দিয়ে পুলিশি ভয় দেখিয়ে শিক্ষার্থীদেরও দমিয়ে রাখা যাবে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করার কারণে আন্দোলন ক্যাম্পাস থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। রাস্তায় নেমে আসে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও। ছাত্র আন্দোলন রূপ নেয় ছাত্র অভ্যুত্থানে।

যদিও আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের হাতে থাকেনি, তবে যথাসময়ে এর সমাধান করলে বিপুল প্রাণের অপচয় আর সরকারি-বেসরকারি সম্পদহানির ঘটনা ঘটত না, দেশ অর্থনৈতিকসহ নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। যে অনিয়ন্ত্রিত, অস্থির এবং অস্বাভাবিক অবস্থা চলছে দেশে, সেটা এমন নাও হতে পারত সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে।

টানা ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ কাউকেই পাত্তা দেয় না বলে যে অভিযোগ, এবারের শিক্ষার্থী আন্দোলনের সময়ে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছ থেকে যে সঠিক নির্দেশনার দরকার ছিল সে নির্দেশনা দিতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। যার খেসারত দিতে হলো দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে এবং রাষ্ট্রকে। সাধারণ এক শিক্ষার্থীকে আন্দোলনের এমন ভয়াল রূপে এখন আঙুল তোলা হচ্ছে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তির দিকে। নাশকতায় তারা জড়িত থাকতে পারে, কিন্তু এই আন্দোলনকে সেই পর্যায়ে নিয়ে আসার পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের দায়কে কি অস্বীকার করা যাবে? আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এখন দায়-চাপানোর রাজনীতিতে মনোযোগী হওয়ায় একদিকে যেমন সাংগঠনিক দুরবস্থাকে আড়াল করা হচ্ছে, অন্যদিকে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টিও।

শিক্ষার্থীরা যতই বিক্ষুব্ধ হোক, তারা অন্তত নাশকতায় জড়াবে না। কেপিআই ভুক্ত এলাকায় আগুন দেবে না, মেট্রোরেলের ক্ষতি করতে যাবে না, টেলিভিশন ভবনে হামলা করবে না, রাতভর সংঘর্ষে জড়াবে না, কারাগারে হামলা করে অস্ত্রাগার লুট করে বন্দি ছিনতাই করবে না; এসবে অন্য কেউ থাকবেই। এদেরকে প্রতিরোধ করতে পারেনি সরকার; না রাজনৈতিক ভাবে, না প্রশাসনিক ভাবে। এই ব্যর্থতার দায় তারা অস্বীকার করলেও এটা অস্বীকারের বিষয় নয়। এখন রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সামনে আসছে, সরকারই এখানে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণ দেখানো হচ্ছে। এতে কি আড়ালে পড়ে যাচ্ছে না বিপুল প্রাণের অপচয়? অথচ রাষ্ট্রীয় সম্পদের হেফাজতের দায়িত্ব যেমন সরকারের, তেমনি দায়িত্বও তাদের নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এই আন্দোলন এবং আন্দোলনের একটা পর্যায়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ হারানো প্রমাণ করে ছাত্র-শক্তিকে অগ্রাহ্য করা উচিত হয়নি। তবে আশঙ্কা হচ্ছে, সরকার না আবার এটাকে এই ভাবতে বসে—শেষ পর্যন্ত আমরা হারিনি! আওয়াজ ওঠতে শুরু করেছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা জোর দিয়ে বলেছেন কথাটা। এবার অন্যরা বলতে শুরু করলে শক্তির খেলায় হার-জিতের প্রসঙ্গ নির্ণয় ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে!

;

তকমা, ক্ষোভ অভিমান ও নিষ্ঠুরতার হোলি



-প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
তকমা, ক্ষোবাভিমান ও নিষ্ঠুরতার হোলি

তকমা, ক্ষোবাভিমান ও নিষ্ঠুরতার হোলি

  • Font increase
  • Font Decrease

কোটা সংস্কার নিয়ে ১ জুলাই ২০২৪ ঢাকাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসমাবেশ ও বিক্ষোভ কর্মসূচি দিয়ে প্রথম শুরু হয় প্রতিবাদ। এটা কোন দলীয় বা রাজনৈতিক কর্মসুচি ছিল না, এখনও নয়। দলমত নির্বিশেষে এটা সকল শিক্ষার্থীর আন্দোলন। তাই এ সপ্তাহ না পেরুতেই এর সমর্থন ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে গেছে। কিন্তু একে বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক তকমা দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ তকমা এসেছে উচ্চ পর্যায় থেকে রাজাকারের ‘নাতিপুতি’ নামক শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে। এটাকে কোমলমাতি শিক্ষার্থীরা মেনে নিতে পারেনি। তারা অনেকেই মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা নাতিপুতি অথবা মুত্তিযোদ্ধা পরিবারের হওয়ায় তাদের অন্তরকে ক্ষোভের আগুনে উদ্দীপ্ত করে তুলেছে। তারা এই তকমাকে মিথ্যা অপবাদ ও চরম অপমানজনক হিসেবে ধরে নেয়ায় এটা তাদের আন্দেলনে ভস্মে ঘি ঢেলে দেয়ার মতো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে চারদিকে।

এটাকে মনের অভিমানে তারা নিজেদেরেকে রাজাকার বলে যখন ব্যঙ্গ করে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ মুরু করেছে তখনও তাদের অভিমানকে কেউ পাত্তা দেয়নি। বরং উল্টো তাদেরকে আরো বেশী করে রাজাকারের ‘নাতিপুতি’ অপবাদ দিয়ে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার চেষ্টায় মেতে উঠে এক শ্রেণির সুবিদাবাদী নেতা। কারো যৌক্তিক প্রশ্ন বা কোনকিছুর উপর সঠিক যুক্তি দিতে অপারগ হলে বিভিন্ন অপবাদ দেয় অথবা কথার ফাঁকে রাজাকার হিসেবে গালি দিয়ে দেয়। অনেকে কথায় কথায় একজন শিশু-কিশোরকেও এমন টিজ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে হিন্দু ছাত্রকেও স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার, শিবির হিসেবে ট্যাগ দিয়ে চাঁদা আদায় করতে দেখা গেছে। এমন ঘটনা বেশ কবছর ধরে পত্রিকায় লক্ষ্যণীয় হচ্ছিল।

এসব ভুঁইফোড় নেতাদের দম্ভ, উন্নসিকতা, হম্বিতম্বি তখন দেখার মতো ছিল। তাদের কথাগুলো সাড়ম্বরে প্রচারিত হয়ে আন্দোলনকারীদের অন্তরকে আরো বেশী বিষিয়ে তোলে। ফলে এসব মিথ্যা অপবাদ সহ্য করতে না পেরে তারা সরকারী ছাত্ররাজনীতি থেকে পদত্যাগ করে ফেসবুকে স্টাটাস দিয়ে দলে দলে আরো বেশী কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে উঠে।

তাদের এই দু:খ, কষ্ট, অভিমানকে সরকারী মহলের কেউই পাত্তা দেননি। বরং বিভিন্ন উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়ে তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে সরকারী ছাত্রসংগঠন থেকে আরো দূরে ঠেলে দিয়েছেন। এ থেকে ঘটনা ভিন্ন দিকে মোড় নিতে শুরু করে। তাদেরকে লুফে নিয়ে এটাকে বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের ব্যানারে ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে, সারা পৃথিবীতে। তাদের সমর্থক বেড়ে লক্ষ কোটি জনতায় পরিণত হয়ে পড়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী এসকল নিরীহ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় সাফল্য হলো- খুব দ্রুতগতিতে জনপ্রিয়তা অর্জন লাভ করা। তারা দেশের অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থন লাভ করতে থাকে এবং এর সাথে অভিভাবক, সাধারণ মানুষ তাদের জন্য দরদী হয়ে উঠে। ফলে তারা অসীম সাহসী ও জেদী হয়ে উঠে এবং তাদের দাবী আদায়ে অনড় থাকে।

দেশের কর্ণধারগণ তাদেরকে অনেকটা দূরে ঠেলে দেয়ায় তারা মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট স্মারকলিপি দিয়ে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা শুরু করে। সেখানে কিছুটা আশ্বাস পেলেও তা তৎক্ষণিকভাবে কোন সুফল বয়ে আনেনি। ফলে আন্দোলন আরো গতিপ্রাপ্ত হয়ে নতুন দিকে মোড় নিতে শুরু করে।

অপরদিকে কোটা আন্দোলনকারীদেরকে দমন করার জন্য ‘শুধু ছাত্রলীগ’বা একটি ছাত্রসংগঠনই যথেষ্ট এমন মন্তব্য আরো বেশী উস্কে দিয়েছে তাদের এই অভিমানকে। কর্তৃপক্ষকে উন্নাসিকতার সুরে বলতে শোনা গেছে- ‘আন্দোলন করে করে ওরা ক্লান্ত হোক তখন দেখা যাবে।’এভাবে সরকারের তরফ থেকে দীর্ঘদিন এই আন্দোলনকে গুরুত্ব না দেয়ায় যে বিভ্রান্তি ও ভুল বুঝাবুঝি পারস্পরিক আলাপ আলোচনায় না গিয়ে শুধু হম্বিতম্বি ও দৈহিক শক্তি প্রদর্শণ করাটা সবার জন্যই চরম ক্ষতিকর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। চারদিকে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যেতে থাকে।

এর পরবর্তী ঘটনাগুলোর সময় দেশে ইন্টারনেট সচল থাকায় হয়তো সবাই মোটামুটিভাবে অবগত হয়েছেন। কিন্তু ১৮ জুলাই থেকে হঠাৎ করে দেশের ইন্টারনেট সেবা ও মোবাইল ফোর জি সেবা বন্ধ করে দেয়ায় এই আন্দোলনের সঠিক তথ্য সঠিক সময়ে জনগণের নিকট পৌঁছাতে পারেনি। দেশের মানুষ যা ভাবেনি বা জানে না কিন্তু এসময় কোন কোন নেতা আগ বাড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছেন- ‘শেখ হাসিনা মারা গেলেও দেশ ছেড়ে পালাবে না’। এসব হঠকারী বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা সন্দেহ দানা বাঁধতে দেখা গেছে। কিন্তু দেশে ইন্টারনেট না থাকলেও বিদেশী গণমাধ্যমের মাধ্যমে কোন না কোনভাবে সেগুলো মানুষের নিকট পৌঁছাতে থাকে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গুলিতে প্রাণ হারায় শিক্ষার্থীরা। কিন্তু দেশের গণমাধ্যমগুলো সে রাত ১০টা পর্যন্ত মাত্র ১১ জন নিহত হবার কথা প্রকাশ করেছে।

এতে সাধারণ জনগণ আরো বেশী কৌতুহলী ও হতাশ হয়ে উঠে।  জায়গায় তারা রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। সারা দেশে আন্দোলনের গতি ছড়িয়ে পড়লে ঢাকার সাথে দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং পুলিশের সাথে র‌্যাব, বিজিবি-কে মাঠে নামানো হয়। গত ১৮ জুলাই এসকল বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় অজানা সংখ্যক মানুষ।

কেন এমন হলো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের হলগুলো ভ্যাকেট করে দেয়ায় তারা বাধ্য হয়ে অন্যত্র চলে যায়। তারা নিকটস্থ বেসরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হল বা মেসে অবস্থান নেয়। সেখানে তাদের বন্ধু, আত্মীয় বা পরিচিতজনদের আশ্রয়ে থেকে আন্দোলনকে আরো বেশী শাণিত করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো হঠাৎ ভ্যাকেট  ‘শাঁখের করাত’হিসেবে মনে করা হচ্ছে। রাজধানীর উত্তরা, শনির আখড়া, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, সাভার ইত্যাদিতে তারা ছড়িয়ে থেকে ১৮ জুলাই আরো সক্রিয় হয়ে উঠে। পুলিশও সেখানে মারমুখি হয়ে উঠে গুলি, গ্যাস ছোঁড়ায় যুদ্ধ বেঁধে যায়। পুলিশের সাঁজোয়া যান ছাত্রদের মিছিলে উঠে যায়। সেদিন রয়টার, সিএনএন, এনএইচকে, এপি, সিনহুয়া, নিউইয়র্ক টাইমস্ ইত্যাদি থেকে প্রচারিত সংবাদে ৮৩ জনের মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হলেও দেশের গণমাধ্যমগুলো কারো ভয়ে মাত্র কয়েকজনের মৃত্যুর কথা বলেছে! হাসপাতাল সূত্রে মৃত্যুসংখ্যা শত শত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে তেমন কোন সংখ্যা প্রচার করেনি। এটাই কি তাদের বৃহত্তর গণতন্ত্রের নমুনা?

কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে সাঁজোয়া যান দিয়ে আঘাত করার এই নিষ্ঠুর কান্ড ঘটানো দেখে পুরো পৃথিবী নির্বাক, স্তম্ভিত হয়ে পড়েছে। তার পরেও দেশের কর্ণধাররা এতদিন নির্বিকার হয়ে আরো বেশী হার্ডলাইনে যাবার ঘোষণা দিয়ে জাতিকে মর্মাহত করেছে।

সাধারণত: সামরিক সরকারকে জনগণের পালস্ বুঝতে দয়ে না তার আশেপাশের চাটুকাররা। কিন্তু এমন বিষাদময় পরিস্থিতিতেও একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দাবীদারকে সেই পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কেন? যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করে সুবিধা নিয়ে আসছেন এক্ষেত্রে তাদের চাটুকারিতা ও দাপট বেশী। তারা প্রধানমন্ত্রীকে বাইরের আন্দোলনের আবহাওয়া বুঝতে না দিয়ে ঘেরাটোপের মধ্যে রেখে দেন। এভাবে একটি জনগণের পালস্ বুঝেও সেটা বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করা বা শক্তি দেখানো বিপজ্জনক-সেটা সম্প্রতি অতি নেতিবাচকভাবে দৃশ্যমান হয়েছে।

অন্যদিকে এই আধুনিক যুগে আন্দোলন দমনের নামে সারাদেশে ইন্টারনেট ও ফোরজি মোবাইল সেবা বন্ধ করে দিয়ে আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ফুডের ই-সেবা সবকিছু স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। এটা ডিজিটাল স্বৈারচারের নতুন দিক। এ দিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক মানুষের কর্মগতি রুদ্ধ করা যায় না। যারা শুধু শুধু মানুষের হতাশা বাড়ানোর জন্য এসব কুবুদ্ধি দেন তারা প্রাচীন যুগের মনমানসিকতা নিয়ে আধুনিকতার বড়াই করেন মাত্র।

কর্তৃপক্ষ বলছেন, আন্দোলনকারীরা নেটওয়ার্ক অফিসে আগুন দিয়েছে বলে নেটসেবা নেই। কিন্তু মাত্র একটি অফিসে আগুন লাগলে যদি কয়েকদিন ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায় ও তড়িৎ কোন বিকল্প ব্যবস্থায় নেট চালু করা সম্ভব না হয় তাহলে এই সেক্টর নিরাপত্তাহীনতার চাদর গায়ে এতদিন কি ঘুমিয়ে ছিল? যে কোন দুর্ঘটনায় উন্নত বিশ্বের মানুষ বিকল্প উপায়ে এসব সেবা দ্রুত পেয়ে যান।

ইন্টারনেট আজকাল একটি জরুরী সেবা, এদিয়ে মানুষ খাদ্য-পথ্য কেনে, ওষুধ কেনে, এ্যম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে যায়।। এটাকে বন্ধ করে দিয়ে মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করা হয়। এই জরুরী সেবা বন্ধ রেখে মানুষকে কষ্ট-হতাশায় ফেলে যারা বাহাদুরী করেছেন তাদের মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশ মানায় না। যদি আন্দোলনকারীরা অথবা কোন শত্রুতাবশত কেউ ইন্টারনেট নষ্ট করে দিয়ে থাকে তাহলে বিকল্প বা প্যারালাল চ্যানেলে দ্রুত রিকভার করার ব্যবস্থা না থাকাটা বোকামি। যে কোন কারনেই হোক দীর্ঘদিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় দেশের সবার জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে।

অন্যায়ভাবে কোন ভাল ইনোসেন্ট মানুষকে গালি দেয়া, খারাপ কিছুর তকমা দেয়া একধরণের বুলিং, ইভটিজিং। এগুলোও বিভিন্ন দেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। আমাদের সমাজে খোটা দেয়া, গাজ্বলা তকমা ছুঁড়ে দিয়ে মানুষের মনে কষ্ট, ক্ষোভ, অভিমান, পারস্পরিক বৈরীতা সৃষ্টি করা একটি অন্যায় কালচার ও সামাজিক অপরাধ। এর জন্য সৃষ্ট ক্ষোভ ও অভিমান সংগে সংগে নিরসনের জন্য ব্যবস্থা নিতে বড্ড দেরী করায় বাংলাদেশে ‘কারফিউ’জারি রাখতে হচ্ছে। তবে এখনও যে ক্ষতির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে তার দায় কেউ নিতে এলেও সেই ক্ষত দ্রুত সেরে উঠবে কি? সেই ক্ষতি কি খুব সহজে পোষানো সম্ভব হবে ?

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

;