'করুণা ধারায় এসো'
‘এসো হে বৈশাখ’চৈত্রের দাবদাহ পেরিয়ে বৈশাখে, নববর্ষের আবাহনে, শোনা যায় চির নূতনের ডাক এবং আশার প্রাণোচ্ছল ধ্বনি: "জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো/সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো।" আর এভাবেই ধর্ম, বর্ণ, অঞ্চলে বিন্যস্ত বাঙালি যুক্তসাধনার মুক্ত প্রতীতিতে পুনরুজ্জীবন লাভ করে বাঙলা নববর্ষের মাহেন্দ্রক্ষণে।
বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক উৎসব। বাংলা নববর্ষ বাঙালি সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। ইংরেজি নতুন বছরের দিন শুরু হয় মধ্যরাতে। আর বাংলা সাল শুরু হয় ভোরে, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে।
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে হয়েছিল বাংলা সনের প্রবর্তন। মোগল সম্রাট আকবরের আদেশে তাঁর রাজস্ব কর্মকর্তা ফতেহ উল্লাহ সিরাজি ‘সৌর সন’ এবং আরবি ‘হিজরি’ সালের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সন তৈরি করেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা থেকে মদিনা যাত্রা বা 'হিজরত'- এর সময়টিকে (৬২২ খ্রিস্টাব্দে) সূচনা বিন্দু ধরে অব্দের গণনা শুরু হয়। প্রথমে এই সালের নাম ছিল ‘ফসলি সন,’ পরে তা ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা নববর্ষ’ নামে পরিচিত হয়। অনেকে মনে করেন, বঙ্গাব্দের গণনায় আকবরের রাজ্যাভিষেককেই সূচনা বলে ধরে নেওয়া হয়।
সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের সঙ্গে শুরু হয় ‘হালখাতার প্রথা’। হালনাগাদের খাতাটি হল বিগত বছরের যাবতীয় হিসাব বিবরণীর নথি। আজও ব্যবসায়ীরা লাল রঙের শালু কাপড়ের মলাটে মোড়ানো খাতাটি ব্যবহার করেন। নববর্ষের প্রথম দিন ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের হিসাবের হালখাতা অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ করেন। থাকে মিষ্টিমুখের আয়োজন।
পহেলা বৈশাখ শুধু একটি তারিখমাত্র নয়, বাঙালির উৎসবের দিন। আহারে-বিহারে সাজগোজে নিজস্বতার ছোঁয়া থাকে এই দিনটিতে। বাঙালির অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে হলে নিজস্ব সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। চর্চা করতে হবে। মনে-প্রাণে তাকে লালন করতে হবে। এটাই জীবন্ত সংস্কৃতির জাগ্রত মানুষের জীবনাবেগ। কারণ, যে জাতি যত সংস্কৃতিমান, সেই জাতি তত উন্নত এবং সমৃদ্ধ।
নববর্ষ মানে বিগত বছরের সমস্ত জীর্ণতা ও মলিনতাকে মুছে দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোরও দিন। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, আমাদের ইতিহাসবোধ, সমকালবোধও, আজ আন্তর্জাতিক খ্রিস্টীয় কালপঞ্জির দ্বারা এতটাই নিয়ন্ত্রিত যে, বাংলা সন-তারিখ দেখলে একটু বিহ্বল বোধ করেন অনেকেই। কোথাও তারিখ হিসাবে বাংলা সন উল্লিখিত হলে সমস্যায় পড়তে 'শিক্ষিত' মানুষদেরও।
তাদের দ্বিধার কারণ হলো, কোন মাস ঠিকঠাক কী ভাবে বুঝব? কেননা, ইংরেজি বছরে ঢুকে থাকে দুইটি বাংলা সাল। ও দিকে ঐতিহাসিক পারম্পর্যের কাহিনিবিন্যাসটি খ্রিস্টাব্দের পরিপ্রেক্ষিতেই সাধারণ মানুষের মনোলোকে সাজানো আছে। আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত কালপঞ্জির প্রতি এত আগ্রহ কখনও আত্মপরিচিতির অজ্ঞতার কারণ হলে বিপদ। এই বিপদকে সঙ্গে করেই চলছে একবিংশ শতকের উত্তরাধুনিক বাঙালি জনগোষ্ঠী। পরিস্থিতি এমনই শোচনীয় হয়েছে যে, পহেলা বৈশাখ শেষ হলেই বাংলা মাসের নাম ও বাঙালিয়ানা গানে ও কবিতায় আশ্রয় নেয় আত্মরক্ষার্থে।
টি এস এলিয়ট লিখেছিলেন, ‘এপ্রিল ইজ় দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ'/‘এপ্রিল নিষ্ঠুর মাস। বিপরীতে ইংরেজি সাহিত্যের ডাকসাইটে ছাত্র সমর সেন লিখেছিলেন: ‘উজ্জ্বল, ক্ষুধিত জাগুয়ার যেন,/ এপ্রিলের বসন্ত আজ’। দৃষ্টান্তস্বরূপ, ‘চৈত্রে রচিত কবিতা’, ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান’, ‘শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু’, ‘কার্তিকের মাঠে’, শিরোনামগুলোয় গভীর হয়ে আছে নিজস্ব চিহ্ন। এমন পঙ্ক্তিতেও আছে শিহরণ: ‘আগত শরৎ অগোচর প্রতিবেশে;/ হানে মৃদঙ্গ বাতাসে প্রতিধ্বনি,/ মূক প্রতীক্ষা সমাপ্ত অবশেষে/ মাঠে, ঘাটে, বাটে আরব্ধ আগমনী।’ কিংবা ‘স্বপ্ন, একুশে ভাদ্র’ অথবা ‘আমাকে আমি ভুলেছি এই একুশে আশ্বিনে’। তাৎপর্য খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, দু’টিই যথাক্রমে কবিদ্বয়ের জন্মতারিখ। হায়! আমরা কয়জন জন্মদিনের, জন্ম তারিখের, বাংলা ভার্সান মনে রেখেছি?
মনে রাখে নি অধিকাংশই। বরং ‘পহেলা বৈশাখ’ এলেই হঠাৎ চারিদিকে উন্মত্ততা চাপিয়েছে। একদিনের বাঙালিয়ানার মচ্ছব চলছে। বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার নামে হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। সুপ্ত অপসংস্কৃতির তাণ্ডব কখনও দৃশ্যমান হচ্ছে। কেউ একজন একবার বলেছিলেন, "আমরা আসলে বেশি উদ্যাপন করেছি ক্ষণোন্মাদনার তীব্রতা, ধারণ করেছি কম। উদ্যাপন বাহ্যিক, ধারণ অভ্যন্তরীণ। প্রমিত তথা ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজ়ড’ আন্তর্জাতিক হওয়ার অতি-আগ্রহে ভুলতে চেয়েছি আত্মপরিচয়ের প্রাতিস্বিক চিহ্ন।'
এসবই ‘সাংস্কৃতিক আগ্রাসন’। ‘হেজিমনি'। ‘গোলকায়নের ভবিতব্য'। সর্ববাঙালির সামনে আরেক বিপদ 'ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কর্ণবিদারী ঢক্কানিনাদ'। যদিও বাঙালির সংস্কৃতি এবং আত্মপরিচয় নির্মাণ সীমান্তহীন, ধর্মনির্দিষ্টতাহীন, বহুস্বরিক, তার বহু শরিকও, তথাপি, আগ্রাসন একটা আছে। খুব বলশালী, ধূর্ত আর কৌশলী সেই আগ্রাসন।
আগ্রাসীরা বাঙালিকে একমাত্রিক একঢালা বানাতে চায়। বাঙালির বহুস্তরিক বর্ণালি ভাঙতে চায়। বহুস্বরিক কলকণ্ঠ স্তব্ধ করতে চায়। গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের আবহ মুছে দিতে চায়। ‘সংখ্যাগুরু’ ও ‘সংখ্যালঘু’ এবং ‘প্রতাপান্বিত’ ও ‘দুর্বল’-এর সম্মানজনক ভারসাম্যের বুনিয়াদ উপড়ে ফেলতে চায়।
নববর্ষে একদিনের বাঙালিয়ানায় এইসব আগ্রাসন রোধ করা অসম্ভব। চিরায়ত বাংলা ও সর্বজনীন বাঙালিত্বে শাশ্বত করুণা ধারায় হটানো সম্ভব ইত্যাকার যাবতীয় আগ্রাসন, আবিলতা, ক্লেদ, ক্লেশ, গ্লানি, হীনমন্যতা ও অবদমন।