আবেগের মেঘে ঢেকে গেছে সত্যের সূর্য



প্রভাষ আমিন
সাকিব আল হাসান, ইনসেটে প্রভাষ আমিন, ছবি: সংগৃহীত

সাকিব আল হাসান, ইনসেটে প্রভাষ আমিন, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

ক্রিকেট আমাদের কাছে দারুণ এক আবেগের নাম। রাজনীতি, ধর্ম, বর্ণ, ধনী, গরিব নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে দেয় ক্রিকেট। আমরা ক্রিকেটে খাই, ক্রিকেট ঘুমাই; ক্রিকেট আমাদের আনন্দে ভাসায়, ক্রিকেটই চোখে জল আনে। ক্রিকেট এখন আমাদের দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদের দূরন্ত প্রকাশের মাধ্যম।

আমার বয়স ৫০ পেরিয়েছে। অন্য অনেক আবেগ সংবরণ করতে পারি। কিন্তু ক্রিকেট এলেই সব এলোমেলো হয়ে যায়, যুক্তিহীন আবেগে ভেসে যায়। আশরাফুলকাণ্ডের পর অভিমানে দুই বছর আমি সব ধরনের ক্রিকেট দেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম। ক্রিকেট দেখতে বসলেই নিজেকে প্রতারিত মনে হতো। মনে হতো, দুই বছর পর হয়তো জানব, এই ম্যাচটিও পাতানো ছিল। ব্যাকডেটে প্রতারিত হতে চাইনি বলেই খেলা দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

ক্রিকেট আমার কাছে নেশার মত ছিল। সেই নেশা ছাড়াতে অনেক কষ্ট হয়েছে। ক্রিকেট খেলা হলে হইচই শুনলে আমার গলা উসখুস করত, শরীরে এক ধরনের অস্বস্তির অনুভূতি হতো। সিগারেট যেমন মানুষ বারবার ছাড়ে আর ধরে, আমিও তেমন ক্রিকেট দেখা শুরুর একটা উসিলা খুঁজছিলাম।

২০১৫ সালের বিশ্বকাপে আমি মনে মনে একটা টার্গেট ঠিক করি, বাংলাদেশ যদি কোয়ার্টার ফাইনালে যেতে পারে, তাহলে আবার খেলা দেখা শুরু করব। আশরাফুল প্রতারণা করলেও বাংলাদেশ আমার মান রেখেছিল। সেই থেকে আবার ক্রিকেট নেশায় মজেছি। কিন্তু আবারও ধাক্কা খেলাম। আশরাফুলের নিষেধাজ্ঞার পর যেমন বেদনায় দুমড়ে মুচড়ে গেছি। সাকিবের নিষেধাজ্ঞার পরও একই অনুভূতি ফিরে এসেছে। প্রথমে শোনার পর আর সবার মত আমিও ভেবেছি, আশরাফুল তো ম্যাচ পাতানোতে জড়িত ছিলেন, সাকিব তো তা নন। তিনি জুয়াড়ির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার ভুল শুধু আইসিসিকে না জানানো। এটা অপরাধ নয়, ছেলেমানুষি ভুল বা । তাতেও বেদনা কমেনি। সাকিবের মত একজন বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের এক বছর না থাকা বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য অপুরনীয় ক্ষতি। কিন্তু আইসিসির রায়ের বিস্তারিত পড়ার পর আমার বেদনার সাথে যোগ হয়েছে ক্ষোভ। আশরাফুলের ঘটনার মত এবারও নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে। সাকিব আল হাসানও আমার ভালোবাসা নিয়ে প্রতারণা করেছেন।

গত কদিন ধরেই ফেসবুকে সাকিবকে নিয়ে রীতিমত ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকে অনেক প্রশ্ন- এই মূহুর্তে কেন? ভারত সফরের আগে কেন? দুই বছর আগের ঘটনায় এখন সাজা হচ্ছে কেন? নানামুখী ষড়যন্ত্র তত্ত্বে সয়লাব ফেসবুকের টাইম লাইন।

সবচেয়ে জনপ্রিয় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হলো, আইসিসির ওপর ভারতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তাই তারা ভয় পেয়ে বাংলাদেশের ভারত সফরের আগেই সাকিবকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আরেকটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হলো, যেহেতু সাকিব খেলোয়াড়দের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাই পাপন ষড়যন্ত্র করে পুরনো ঘটনা সামনে এনে আইসিসিকে দিয়ে সাকিবকে নিষিদ্ধ করিয়েছেন। অসম্ভব হলেও দ্বিতীয় তত্ত্বটিই এখন সবার মুখে মুখে। নাজমুল হাসান পাপন এখন গণশত্রু। আর অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি পাওয়া সাকিব আল হাসান এখন জাতীয় বীর!

এটা ঠিক, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানামুখী ষড়যন্ত্র হয়েছে। বারবার পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের শিকার হয়েছে নবীন বাংলাদেশ। যারা আমাদের সবচেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারত, সেই ভারতের বিরুদ্ধেই অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। আর আইসসির ওপর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যই সবচেয়ে বেশি। কারণ আইসিসির আয়ের প্রধান উৎস ভারত। এতসব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেট।

তবে সবকিছুতে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খোঁজা দুর্বলদের কাজ। সব ষড়যন্ত্র উড়িয়ে দেয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, ভালো খেলা এবং আরো ভালো খেলা; জবাবটা মাঠে দিতে পারলেই সবচেয়ে ভালো।

সাকিবের শাস্তি এতদিন পরে এই সময়ে কেন? এই প্রশ্নটি যারা করেন, কোনো পর্যায়ের বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কেই তাদের কোনো ধারণা আছে বলে মনে হয় না। তারা মনে হয়, ক্রসফায়ারের সমর্থক। যে কোনো বিচার প্রক্রিয়ার মূল অংশ তদন্ত। আর নির্দোষ কেউ যাতে সাজা না পান, তা নিাশ্চিত করতে সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্তটাই সবচেয়ে জরুরি। ঘটনা দুই বছর আগে হলেও এই সময়ে আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ইউনিট তদন্ত করেছে।

সাকিবের সাথে দুই দফায় কথা বলেছেন তারা। নিশ্চিত হয়েই তারা সাকিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হলেও বিচার প্রক্রিয়া কিন্তু শুরুই হয়নি। সাকিব তদন্ত প্রক্রিয়ায় আইসিসিকে সহায়তা করেছেন এবং বিচার শুরুর আগেই অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছেন। তাই তাকে তদন্ত শেষেই শাস্তি দেয়া হয়েছে, যেটা সাকিব মেনেও নিয়েছেন। যদি সাকিব আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী ট্রাইব্যুনালে আইনি লড়াইয়ে যেতেন, তাহলে হয়তো সে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পেতেন। তবে সে ক্ষেত্রে শাস্তি আরো বেশি হতে পারত।

সাকিব যেহেতু জানেন, তিনি অপরাধটা করেছেন, তাই ট্রাইব্যুনালে লড়ার ঝুঁকি তিনি নেননি। তার আগেই আপিল অযোগ্য এক বছরের সাজা মেনে নিয়েছেন। ট্রাইব্যুনালে গেলে চূড়ান্ত রায় আসতে আরো সময় লাগতে পারত। ভারত সফরের আগেই কেন শাস্তি? এই প্রশ্নের জবাবটাও সহজ। আইসিসির দুর্নীতি বিরোধী ইউনিট যখন নিশ্চিত হয়ে যাবে, একজন ক্রিকেটার অপরাধ করেছেন। তখন তো তাকে আর খেলতে দেবে না, সিরিজটা তার বা তার দেশের জন্য যত গুরুত্বপূর্ণই হোক। আমাদের কাছে ভারত সফরে সাকিবের উপস্থিতিটা জরুরি, কিন্তু আইসিসির চোখে তো তিনির একজন অপরাধীমাত্র।

আরও পড়ুন: সাকিবকে প্রস্তাব দেওয়া সেই ক্রিকেট জুয়াড়ি ভারতের দীপক আগারওয়াল!

অনেকে বলছেন, সাকিব বাংলাদেশের না হয়ে ভারত বা অস্ট্রেলিয়ার হলে তাকে সাজা পেতে হতো না। প্রবল আবেগের তোড়ে আমাদের যুক্তি ভেসে গেলেই কেবল এমনটা বলা সম্ভব। ম্যাচ পাতানোর দায়ে আজহারউদ্দিন, সেলিম মালিক, ক্রনিয়েদের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেছে। বল টেম্পারিংয়ের দায়ে তুখোড় ফর্মে থাকা দুই অস্ট্রেলিয়ান স্টিভ স্মিথ আর ডেভিড ওয়ার্নারকে আইসিসি দুই ম্যাচ নিষিদ্ধ করলেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া করেছিল এক বছর।

বল টেম্পারিং ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্য নয়, তারা করেছিলেন অস্ট্রেলিয়াকে জেতাতে। তারপরও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ান জনগণ তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি। দেশের জন্য করলেও তারা যা করেছিলেন তা ক্রিকেটের চেতনার পরিপন্থি। ক্রিকেট এবং অস্ট্রেলিয়ার মর্যাদাহানির অভিযোগ আনা হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে। দেশের মুথে চুনকালি মাখার দায়ে, এমনকি ফিরে আসার পরও তাদের ধুয়ে দিয়েছে। আর আমরা সবাই আবেগের জোয়ারে ভেসে একজন আত্মস্বীকৃত অপরাধীর জন্য চোখের জলে সাগর বানিয়ে ফেলছি।

এটা ঠিক, সাকিব ম্যাচ পাতানোর সাথে জড়িত নন। কিন্তু তথ্য গোপনের দায়েও সাকিবের আগে অনেকের সাজা হয়েছে, যাদের মধ্যে আছেন জয়সুরিয়ার মত বিশ্বকাপজয়ী তারকাও।

২১ অক্টোবর ক্রিকেটারদের আন্দোলন, বোর্ডের সাথে সমঝোতা, নিয়ম ভেঙ্গে গ্রামীণফোনের সঙ্গে সাকিবের চুক্তি এবং এর জন্য সাকিবকে বোর্ডের শোকজ, ২৯ অক্টোবর সাবিকের নিষেধাজ্ঞা- সব মিলিয়ে মাত্র নয় দিনে বাংলাদেশ ক্রিকেটে এমন তুলকালামকে কেউ কাককালীয়, আবার কেউ সাকিবের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র বলছেন। আমি কিন্তু ষড়যন্ত্র মনে করি না, কাকতালীয় তো নয়ই। পুরো বিষয়টিই আমার কাছে সুপরিকল্পিত কৌশল বলেই মনে হয়েছে। আর আমার মনে হয়, সে কৌশলটা এঁকেছেন সাকিব নিজেই। কারণ একমাত্র তিনিই তার সম্ভাব্য শাস্তির বিষয়টি জানতেন। যখন জেনে গেলেন বাঁচার আর কোনো উপায় নেই, তখনই তিনি ক্রিকেটারদের ১১ দফা নিয়ে মাঠে নামলেন। বাংলাদেশে ক্রিকেটারদের অবিসংবাদিত নেতা এবং এখন ওয়ানডে দলের অধিনায়ক মাশরাফিকে বাইরে রেখে সাকিব যখন এই আন্দোলন এবং তাৎক্ষণিকভাবে ধর্মঘটের ডাক দিলেন; তখন অনেকেই অবাক হয়েছেন। যেই সাকিব নেতৃত্ব এনজয় করেন না, সেই সাকিব হঠাৎ ক্রিকেটারদের মহানেতা বনে গেলেন। ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।

আরও পড়ুন: যে তিন অভিযোগে সাকিব নিষিদ্ধ

আবার ১১ দফা দাবিতে ধর্মঘটে যাওয়ার পরদিনই তড়িঘড়ি করে বিসিবিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গ্রামীণফোনের সঙ্গে তার চুক্তিও রহস্যজনক। আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় রেগে গিয়েই আসলে হেরে গেছেন বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপন। নিয়ম না মেনে গ্রামীণফোনের সাথে চুক্তি করলেন সাকিব, আর শোকজ করে ভিলেন হলেন পাপন। অথচ সাকিবের তিন কোটি টাকা চুক্তির কারণে বোর্ডের ১০০ কোটি টাকার সম্ভাব্য চুক্তি ঝুঁকির মুখে পড়েছে। ক্রিকেটারদের আন্দোলন এবং সাকিবকে শোকজের ঘটনায় পাপনের ক্রিকেটারবিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। এর পরপরই সাকিবের বিরুদ্ধে আইসিসির নিষেধাজ্ঞার জন্য গোটা জাতি ভিলেন বানিয়ে ফেলেছে পাপনকে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন ধারণা প্রায় প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, সাকিবকে শায়েস্তা করতে পুরনো ঘটনা টেনে এনে পাপন আইসিসিকে দিয়ে সাকিবকে নিষিদ্ধ করিয়েছেন। কেউ কেউ আরো এক দফা এগিয়ে বলছেন, আইসিসি নয়, আসলে পাপনই সাকিবকে নিষিদ্ধ করেছেন।

এমনিতে পাপনের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। বিশেষ করে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির সাথে জড়িত লোকমান হোসেন ভুইয়ার সাথে বন্ধুত্বের কারণে পাপন সমালোচিত হয়েছেন। এছাড়া আশরাফুল কেলেঙ্কারির সময় যার নাম এসেছিল, বরাবরই সেই খালেদ মাহমুদ সুজনের বোর্ডের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন আছে।

প্রশ্ন আছে পাপনের ঘনিষ্ঠদের বোর্ডে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠা নিয়েও। আছে নানান দুর্নীতির প্রশ্ন। তাছাড়া পাপনের অনেক দিনের রাজত্বে ক্রিকেটে এক ধরনের ক্লান্তি ও স্থবিরতা ভর করেছে। তাই পরিবর্তনের একটা আকাঙ্ক্ষা আছে অনেকের মধ্যেই।

পাপনের বিরুদ্ধে হাজারটা অভিযোগ আনা যাবে। কিন্তু সাকিবের বিরুদ্ধে আইসিসির নিষেধাজ্ঞায় তার হাত আছে, এমন ভাবনা হাস্যকর। আসলে এটা অসম্ভব। পাপন চাইলেও আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটকে প্রভাবিত করে কাউকে সাজা দেওয়াতে পারবেন না। পাপনের এত ক্ষমতা থাকলে, বাংলাদেশ ক্রিকেট অনেক এগিয়ে যেত। ক্রিকেটে মাঠে খেলার চেয়ে টেবিলে খেলা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাবের হোসেন চৌধুরীরা ক্রিকেট ডিপ্লোম্যাসি লড়ে টেস্ট স্ট্যাটাস আদায় করে এনেছিলেনন। বাংলাদেশ এখন মাঠের পারফরম্যান্সেও ভালো না, টেবিলের পারফরম্যান্স তো নয়ই।

খেলোয়াড়দের সাথে সমঝোতার পরদিনই পাপনের অফিসে গিয়ে সাকিব তাকে সম্ভাব্য শাস্তির কথা জানিয়েছেন এবং তার সহায়তা চেয়েছিলেন। পাপনও সব তিক্ততা ভুলে সাকিবের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীও যেমন বলেছেন, সাকিবের শাস্তির ব্যাপারে বোর্ডের করার কিছু নেই। কারণ সাকিব আগেই অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি মেনে নিয়েছেন। তারপরও সবার অভিযোগের তীর পাপনের দিকেই। আন্দোলন থেকে শুরু করে গ্রামীণফোণের সাথে চুক্তি- সব মিলিয়ে সাকিব কৌশলে পাপনকেই ক্রিকেটের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। আস্তে করে বলটা চলে গেছে পাপনের কোর্টে। জনআবেগটা এখন এমন- সাকিব যেহেতু প্রতিভাবান তাই বোর্ডের নিয়ম না মেনে চুক্তি করলেও তাকে কিছু বলা যাবে না। নিয়ম না মেনে জুয়াড়ির সাথে যোগাযোগ করলেও তাকে কোনো শাস্তি দেয়া যাবে না।

তবে একটা কথা ঠিক, সাকিব বলার আগে পাপন কিছুই জানতেন না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ ক্রিকেটারদের আন্দোলনের পরদিন তিনি জবাব দিতে গিয়ে ফিক্সিংয়ের সন্দেহের কথা বলেছিলেন। আসলে মধ্য অক্টোবরে আইসিসির বৈঠক থেকেই পাপন বিষয়টা সম্পর্কে আঁচ পেয়েছিলেন। হতে পারে, বিস্তারিত জেনেছেন সাকিবের কাছ থেকে।

অনেকেই বলছেন, সাকিবকে লঘুপাপে গুরুদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনি তো জুয়াড়ির প্রস্তাব মানেননি, প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই তার নিন্দা না করে বরং প্রশংসা করা উচিত। একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমারও একজন বাংলাদেশি ক্রিকেটারের পক্ষেই থাকা উচিত। কিন্তু একজন ক্রিকেটারের পক্ষে থাকা আর একজন অপরাধীকে সমর্থন দেয়া এক কথা নয়। রায়ের বিস্তারিত পড়ার পর আমার মনে হয়েছে, সাকিবের অপরাধ মোটেই লঘু নয়, আর এটি নিছক ভুল নয়, সুনির্দিষ্ট অপরাধ।

আরো অনেকের মত সাকিবের অপরাধকে লঘু, খামখেয়ালি, নিছক ভুল, অবহেলা হিসেবে বিবেচনা করতে পারলে আমারও ভালো লাগতো, স্বস্তি পেতাম। কিন্তু রায় পড়লে আপনিও বুঝবেন, বিষয়টা অত সহজ নয়।

আরও পড়ুন: শাস্তি শোনার পর ‘বিধ্বস্ত’ সাকিব বিসিবিতে

ভারতীয় জুয়াড়ি দিলীপ আগরওয়ালের সাথে সাকিবের যোগাযোগের শুরুটা ২০১৭ সালের নভেম্বরে, আর সাকিবের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী তা চলেছে ২৬ এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত। যদি একটা-দুইটা বিচ্ছিন্ন ফোন কল বা বার্তা বিনিময় হতো, তাহলে তাকে বেনিফিট অব ডাউট দেয়া যেত। কিন্তু সেই সুযোগই রাখেননি সাকিব। জুয়াড়ি দিলীপ আগরওয়াল সাকিবের নাম্বারটি পেয়েছিলেন সাকিবেরই পরিচিত একজনের মাধ্যমে এবং সাকিব সেটা জানতেনও।

২০১৭ সালের ৪ নভেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ খেলা হয়েছে। তখন থেকেই আগরওয়ালের সাথে সাকিবের যোগাযোগ। সাকিব তার সাথে বিভিন্ন সময়ে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা আদানপ্রদান করেছেন। আগরওয়াল তখন সাকিবের সাথে দেখাও করতে চেয়েছিলেন।

২০১৮ সালের ৯ ও ১০ জানুয়ারি মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) বৈঠকে জুয়াড়িদের নাম-ধাম, ছবি দেখিয়ে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছিল। সাকিব নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং জুয়াড়িদের তালিকায় আগরওয়ালের নামও ছিল। তারপরও সাকিব সতর্ক হননি। বরং তার পরপরই বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং জিম্বাবুয়ের মধ্যকার ত্রিদেশীয় সিরিজের সময় আবার আগরওয়ালের সাথে সাকিবের যোগাযোগ হয়।

২০১৮ সালের ১৯ জানুয়ারি আগরওয়াল বার্তা পাঠান, ‘আমরা কি এখনই কাজ করব, নাকি আইপিএল পর্যন্ত অপেক্ষা করব?’। সাকিব নিজেই স্বীকার করেছেন, এই বার্তায় ‘কাজ’ বলতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ভেতরের তথ্যের কথা বলা হয়েছে। সে বছরই ২৩ জানুয়ারি আগরওয়াল আবার বার্তা পাঠান, ‘ব্রো, এই সিরিজে কিছু আছে?’ সাকিব নিশ্চিত করেছেন, এই বার্তার মাধ্যমেও সিরিজের ভেতরের খবর জানতে চাওয়া হয়েছিল।

২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল আইপিএলে কিংস ইলাভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে সাকিবের সানরাইজ হায়দ্রাবাদের ম্যাচের আগে আগরওয়াল একজন নির্দিষ্ট ক্রিকেটার এই ম্যাচে খেলবেন কিনা জানতে চেয়েছিলেন। এরপরও আগরওয়ালের সাথে সাকিবের বার্তা বিনিময় চলতে খাকে। আগরওয়াল কথা বলেন বিটকয়েন, ডলার একাউন্ট নিয়ে।

তিনি সাকিবের কাছে তার ডলার একাউন্টের বিস্তারিত জানতে চাইলে সাকিব আগে দেখা করার কথা বলেন।

সাকিব স্বীকার করেছেন, তিনি ২৬ এপ্রিলের অনেকগুলো বার্তা মুছে দিয়েছেন। ৯ ও ১০ জানুয়ারি এমসিসির বৈঠকে এই আগরওয়ালের ব্যাপারে সতর্ক করা হলেও সাকিবেকর দাবি, তিনি এপ্রিলে এসে বুঝতে পেরেছেন আসলে আগরওয়াল জুয়াড়ি। বোঝার পরে তিনি দেখা করতে চেয়েছিলেন। আগরওয়ালের সাথে পুরো আলাপচারিতায় সাকিবের দিক থেকে কোনো প্রত্যাখ্যান ছিল না।

দুর্নীতি বিরোধী ইউনিটে তদন্ত এখানেই শেষ। এরপর সব ধোঁয়াশা। সাকিবের সাথে কি আগরওয়ালের দেখা হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর নেই। কারণ তদন্ত আর এগুনোর মত প্রমাণ ছিল না তাদের। তবে আলাপের ধারাবাহিকতায় দেখা হওয়াটাকেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। আগের বছর নভেম্বরে আগরওয়াল দেখা করতে চেয়েছিলেন সাকিবের সাথে। আর ছয় মাস পর সাকিব দেখা করতে চাইছেন আগরওয়ালের সাথে। আগরওয়াল নিশ্চয়ই সাকিবের দেখা করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেননি। তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়া আরো এগুলে আরো কেলেঙ্কারি বেরিয়ে আসতে পারে, এমন শঙ্কাতেই কি সাকিব আগেভাগে অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছিলেন?

অপরাধের মাত্রাটা সাকিব জানতেন না, এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। একজন সিনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে সাকিব আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী অনেক সেশনে অংশ নিয়েছেন। তিনি জানেন, তথ্য গোপন করাটা গুরুতর অপরাধ। আর জানেন বলেই এসএমসএস মুছেও দিয়েছেন। আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অবশ্য তিনি অপরাধ স্বীকার করেননি। পরে যখন এসএমএস'র স্ক্রিনশট দেখানো হয়, তখন তিনি বাধ্য হয়ে মুখ খোলেন।

২০০৮ সালে সাকিব যখন সত্যিই ইনোসেন্ট ছিলেন, তখন তিনি ঠিকই সন্দেহজনক যোগাযোগের কথা সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছিলেন। এবারও আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিট মুশফিকের ফোন পরীক্ষা করেছে, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু পায়নি।

এছাড়া বিভিন্ন সময়ে মাশরাফি, তামিম; এমনকি জাতীয় দলের সুযোগ পাওয়ার আগে আফিফও সন্দেহজনক যোগাযোগের কথা সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছিলেন। যেটা সাকিব করেননি। সাকিবের পারফরাম্যান্স যেমন সবারই নজর টানে, জানে, তার লোভের কথাও কারো অজানা নয়।

সর্বগ্রাসী লোভের ফাঁদেই কি তবে আটকে গেল এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ার? নিষেধাজ্ঞা শেষে আশরাফুল আবার জাতীয় দলে ফিরতে চেয়েছিলেন, পারফরম্যান্সও খারাপ ছিল না। কিন্তু সাকিবের প্রবল আপত্তির কারণে আশরাফুলকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। সাকিব নাকি ম্যাচ পাতানোর দায় আছে এমন কারো সঙ্গে ড্রেসিং রুম শেয়ার করতে রাজি নন। নিয়তির নির্মম পরিহাস, সেই সাকিব আজ নিষিদ্ধ, আর সেদিনই জাতীয় লীগে ঠিক ১৫০ রান করেছেন আশরাফুল। এক বছর পর সাকিব ফিরে এলে তখন যদি কেউ তার সঙ্গে ড্রেসিং রুম শেয়ার করতে না চান, তখন কেমন লাগবে তার?

পারফরমার সাকিব আল হাসান অবশ্যই বাংলাদেশের জান। কিন্তু একজন চিহ্নিত জুয়াড়ির সাথে টানা ছয় মাস আলোচনা চালিয়ে যাওয়া, ডলার একাউন্ট চাওয়ার বিপরীতে জুয়াড়ির সাথে দেখা করতে চাওয়া লোভী সাকিব আল হাসান অবশ্যই আমাদের জান নয়। আমি অবশ্যই সাকিবের পাশে আছি। আমার সন্তান অপরাধ করলেও আমি তার পাশেই থাকব, তাকে শুধরানোর চেষ্টা করব; কিন্তু তার অপরাধকে জায়েজ করার চেষ্টা করব না। তাকে মাথায় তুলে নাচব না।

সাকিবও আমাদের সন্তানের মত। তার অপরাধের জন্য যতটুকু শাস্তি তার পাওনা, তা তাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। আর আমাদের ভালোবাসার সাথে প্রতারণা করার জন্য, দেশের মুখে চুনকালি মাখার জন্য ঘৃণাটুকুও তারই পাওনা, জয়ধ্বনি নয়।

সবার মতো সাকিবের জন্য আমারও মন কাঁদে। কিন্তু সাকিব অপরাধী এটা জেনেই আমি মন খারাপ করব। ভালোবাসা যেন আমাদের অন্ধ করে না দেয়, আবেগের মেঘ যেন ঢেকে না দেয় সত্যের সূর্য।

স্মিথ আর ওয়ার্নার এক বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষে দুর্দান্তভাবে অস্ট্রেলিয়া দলে ফিরে এসেছেন। আমরা চাই সাকিবও শুদ্ধ ও আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসুক। আর সে ক্ষমতা সাকিবের আছে। তবে ক্রিকেট মানে শুধু মাঠের ভালো পারফরম্যান্স নয়। ক্রিকেট হলো ভদ্রলোকের খেলা। ক্রিকেট মানে শুদ্ধতা, শুভ্রতা। নীতি-নৈতিকতা ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই তো আমাদের সাধারণ মানুষের তথ্য গোপন আর সাকিবের তথ্য গোপনে আকাশ পাতাল ফারাক থাকে। তাই ফিরে আসার পরও সাকিব দলকে নেতৃত্ব দেয়ার নৈতিক অধিকার, তরুণদের আইডল হওয়ার সুযোগ হারিয়েছেন চিরতরে।

আমি জানি, সাকিব এখন প্রবল জনআবেগের নাম। এই লেখার জন্য আমাকে প্রচুর গালিও খেতে হবে। তাই লেখাটা শেষ করার আগে ভেবেছি অনেক। কিন্তু আবেগের মেঘে সত্যের সূর্যটা ঢেকে যাওয়া কখনোই কাম্য নয়। আমরা যারা এখনও প্রবল আবেগে যুক্তি হারিয়ে ফেলেছি, তাদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা সত্যটা জানার চেষ্টা করুন।

আইসিসির ওয়েবসাইটে গেলেই রায়ের বিস্তারিত পাবেন। খালি সাকিবের স্বীকারোক্তির অংশটুকু পড়লেই আপনার বিভ্রান্তি অনেকটা কেটে যাবে, আবেগের আবেশটুকু ফিকে হয়ে যাবে। সাকিব নিজে যেখানে অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি মাথা পেতে নিয়েছেন, সেখানে আপনি চাইলেও তাকে হিরো বানাতে পারবেন না।

আর অপরাধ স্বীকার করলেই অপরাধ মাফ হয়ে যায় না। আমি জানি ভুল মানুষকে ভালোবাসার কষ্ট অনেক। বাংলাদেশের প্রথম সুপারস্টার আশরাফুলকে ভালোবেসে গোটা জাতি সে কষ্ট পেয়েছে। আবার পেলে আরেক মেগাস্টার সাকিবকে ভালোবেসে। আসলেই তীব্র ভালোবাসার পাশেই শুয়ে থাকে তীব্রতম বিষাদ।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

   

বর্জনে অসারের তর্জন গর্জন সার



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের একটা প্রচারণা শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন এটা ছিল কেবল সামাজিক মাধ্যমে। এখন এটা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আগে যদিও ছিল, তবে সেটার প্রভাব এতখানি বিস্তৃত ছিল না।

রুহুল কবির রিজভীর পরনের চাদর ছুড়ে ফেলা এবং এরপর পুড়ানোর ঘটনার পর এখন এটা নিয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও কথা বলেছেন। ঘটনা যখন এত দূর গড়িয়েছে, তখন ধারণা করা যায়, খুব সহসা এটা থামছে না। যদিও শেষ পর্যন্ত এটা চূড়ান্ত বর্জন পর্যন্ত না পৌঁছে বাগযুদ্ধ পর্যন্তই সীমিত থাকবে।

বিএনপি মুখে ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে তাদের এই ভারত-বিরোধিতা চালিয়ে যেতে হয়েছে। দলটির ধারণা এবং প্রচারণা বলছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেছে ভারত বা ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থনে আওয়ামী লীগ 'যেনতেন উপায়ে' নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে আছে। তাদের ধারণা, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ টিকে আছে মূলত ভারতের সমর্থন ও সহায়তার কারণে। সবশেষ নির্বাচনে পশ্চিমা দেশগুলোর তৎপরতাকে যেভাবে উড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ তাতে বিএনপির এই ধারণা আরও শক্ত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েও আমেরিকা ও ইইউভুক্ত দেশগুলো যে শেষ পর্যন্ত কঠোর হয়নি, এখানেও রয়েছে ভারতের প্রভাব। বিএনপির এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্য, যেখানে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'গত নির্বাচনে ভারত বাংলাদেশের পাশে ছিল বলে বড় বড় দেশগুলো অশুভ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।’ হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'নির্বাচন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ওই সময় ভারত আমাদের পাশে ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনে ভারত আমাদের সঙ্গে ছিল। এবারও ভারত আমাদের পাশে ছিল ও আছে।’

বিএনপির বিশ্বাস আর মন্ত্রীদের বক্তব্য যখন কাছাকাছি, তখন দলটি এবার কামান দাগাচ্ছে ভারতের দিকেই। নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে এখন সামনে এনেছে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা। প্রচারণায় সর্বশক্তি দেওয়ার এ প্রবণতায় মাঝে মাঝে ভ্রম হয়—ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বুঝি বাংলাদেশের ওপরই নির্ভরশীল! অথচ বাস্তবতা ঠিক উল্টো। ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়ে।

বাজার ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিজের পরনের ভারতীয় পণ্য (চাদর) ছুড়ে ফেলে দিয়ে এরপর নেতাকর্মীদের মাধ্যমে আগুনে পুড়ানোর দুইদিন পর ২২ মার্চ ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'ভারতীয় পণ্য বয়কটের নামে বিএনপি বাজার ব্যবস্থা অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্র করছে।' তিনি বলেন, 'বিএনপি নেতার (রিজভী) শাল ফেলে দিয়ে ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রদর্শন করা পাগলামি। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটি বড় অংশ আসে ভারত থেকে। বিএনপির এক নেতা (আব্দুল মঈন খান) গণতন্ত্র উদ্ধারে ভারতের সহযোগিতা চায়, আবার আরেক নেতা ভারতের পণ্য বয়কটের ডাক দেয়। আসলে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেরা দিশেহারা হয়ে গেছে।'

ভারত বর্জনের প্রচারণায় যখন সংহতি জানালেন রুহুল কবির রিজভী, এর দিন তিনেক পর কিন্তু বিএনপির ইফতার মাহফিলে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের কূটনীতিকরা। গত ২৪ মার্চ রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে কূটনীতিকদের সম্মানে বিএনপি যে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে তাতে অংশ নেন ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার ড. বিনয় জর্জসহ দেশটির দূতাবাসের আরও কয়েকজন। ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রিজভী ইফতার মাহফিলে না থাকলেও দল কিন্তু এখানে ভারতকে বর্জন করতে পারেনি।

দলের নীতিনির্ধারণীতে রুহুল কবির রিজভী যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, তিনি দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব; এবং নিত্যকার সংবাদ সম্মেলনের বেশিরভাগ তিনিই করে থাকেন। তার হঠাৎ ভারত-বিদ্বেষ প্রকাশ্য হলেও এটা নিয়ে দলের মধ্যে যে আলোচনা হয়নি তা এর মধ্যেই প্রকাশিত। যদিও বিএনপির যাবতীয় সিদ্ধান্ত দেশে হয় না, লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশনা আসে, এবং সে অনুযায়ী সেটা প্রকাশিত হয়। রিজভীর এই ভারতীয় পণ্য বর্জনে সংহতি প্রকাশ লন্ডন থেকে আসা সিদ্ধান্ত, নাকি রিজভীর একার তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তার চাদর-নাটক যে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে দেশের রাজনীতিতে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভারত-বিরোধিতা এবং ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিষয়টি কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ১১ মার্চ বিষয়টি তুলেছেন মুশফিকুল ফজল আনসারী। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্বে থাকা মুশফিকুল ফজল আনসারী মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কাছে জানতে চান, ''মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, এই অঞ্চলে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ছে। একতরফা নির্বাচনের পর প্রতিবেশী ভারতে তৈরি পণ্য বর্জনকে উৎসাহিত করছে জনগণ। তাদের সন্দেহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এই পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?" জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, 'এই প্রচারণা সম্পর্কেও আমরা অবহিত। আমি অবশ্যই ভোক্তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না—সেটা বাংলাদেশ হোক বা বিশ্বের অন্য কোথাও। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করি। অবাধ, মুক্ত, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিত করাসহ অভিন্ন স্বার্থে দুই দেশের সরকারের সঙ্গেই আমরা অব্যাহতভাবে কাজ করব।' এরপরই রুহুল কবির রিজভীর এই চাদর ছুড়ে ফেলা আর আগুন দেওয়ার ঘটনা। অর্থাৎ নির্বাচনকেন্দ্রিক এই ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচার-প্রচারণা, যেখানে আমাদের অতিপরিচিত 'দেশি পণ্য, কিনে হও ধন্য' স্লোগানের কোনো সম্পর্ক নেই; সব সম্পর্ক, সব বিরোধিতা মূলত রাজনৈতিক। রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়ালের চেষ্টা।

এই যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা, এটা যদি দেশি পণ্যের প্রসারের উদ্দেশ্যে হতো, তাহলে সমস্যা ছিল না। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আওয়াজ তোলা হয়েছে, এবং সে অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণা চলছে। এই প্রচার-প্রচারণা আবার লুফে নিয়েছে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কথা বলছেন, কথা বলছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, কথা বলছেন অন্য মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও। গতকাল বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'বিএনপির এক নেতা (রুহুল কবির রিজভী) চাদর খুলে বলে দিয়েছেন, ভারতের পণ্য ব্যবহার করবেন না। যে নেতারা বলছেন ভারতীয় পণ্য বর্জন করেন, তাদের বউদের কয়খানা ভারতীয় শাড়ি আছে? তারা বউদের কাছ থেকে শাড়িগুলো এনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন? আমি বিএনপি নেতাদের বলব, তাদের বউরা যেন ভারতীয় শাড়ি না পরেন। যেদিন ওগুলো এনে অফিসের সামনে পোড়াবেন, সেদিন বিশ্বাস করব, আপনারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করলেন।' আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আরেক বক্তব্যে বলেছেন, 'চিরাচরিত পাকিস্তানি কায়দায় ভারতের বিরোধিতা শুরু করেছে বিএনপি। তারা যখন কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না পায়, তখনই এই একটা ইস্যু সামনে নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর আমলেও করেছে, এখন শেখ হাসিনার আমলেও তাই করছে।' বলা যায়, রুহুল কবির রিজভীর একটা চাদর কেবল চাদরই থাকল না, এটা রাজনৈতিক অঙ্গনে বাগযুদ্ধের এক প্রপঞ্চ হয়ে গেছে।

মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এভাবে কোনো দেশের পণ্য কি বর্জন করা সম্ভব? আমাদের দেশে কি সম্ভব ভারতের সব পণ্য বর্জনের? যে বিএনপি নেতারা বর্জনের পক্ষে তর্জন গর্জন করছেন তারা কি বাস্তবতা টের পান না? গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর যেদিন খুলেছেন সেদিনই কি প্রমাণ হয়নি রুহুল কবির রিজভী ভারতের পণ্যের অন্যতম ভোক্তা? অন্য অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, সামান্য এক উদাহরণ দিলেও বলা যায়—যে সিএনজিচালিত অটোরিকশার দখলে রাজধানীসহ সারাদেশ, সে অটোরিকশাগুলোও আসে ভারত থেকে। ২০০২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে এই সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়, এবং এর শুরুটা করে বিএনপি সরকারই। মোটরসাইকেলসহ অন্য অনেক যানবাহন, নিত্য ভোগ্যপণ্য, ব্যবহার্য পণ্যের অনেক কিছুতেই আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাকে অস্বীকার করার উপায় নাই।

আমরা জানি, বিএনপিও জানে এসব; কিন্তু স্বীকার করছে না। নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ভারত-বিরোধী প্রচারণাকে। এটাকে কি বলা যায় 'অসারের তর্জন গর্জন সার'? কারণ রাজপথ আর রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতাহীনের গর্জনই বেশি শোনা যায়। বিএনপি এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ হয়ে আছে এই ভারতের পণ্য বর্জনের প্রচার-প্রচারণা বা তর্জন গর্জন দিয়ে।

তবু বলি, এই বাকযুদ্ধে সরকার ও সরকার দল আওয়ামী লীগের বিপুল অংশগ্রহণ জরুরি নয়। জরুরি নয় মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক বাক্য খরচের। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত অন্তঃসারশূন্য যে প্রচার-প্রচারণা, সেখানে অংশ না নেওয়াটাই হতে পারে যথার্থ সিদ্ধান্ত।

;

সফুরের পুড়ে অঙ্গার হওয়া ও রাষ্ট্রের গভীর ‘ঘুম’



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে অপঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে, তাতে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি’ চাওয়া প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক নির্মল সেনের সেই আকাঙ্ক্ষা আজ যেন বিদ্রুপ করছে! আমরা কে যে কখন অপঘাতের এই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চলেছি তা বলা কঠিন!

রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের দীর্ঘ ঔদাসীন্যে যখনই একেকটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ছুটতে শুরু করে, তখনই তাদের কিঞ্চিৎ নিদ্রাভঙ্গ ঘটে। মিডিয়ার তৎপরতায় তাদের দৌঁড়ঝাঁপ কিছু সময় সমান্তরালে চলতে থাকে। ফের গভীর ঘুমে চলে যান তারা!

হতাশাজনক এই অবস্থায় উপনীত হয়ে প্রতিদিনই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়, কোথায় কী ঘটতে চলেছে! সংবাদপত্রের অফিসগুলোতে অপঘাতের মৃত্যুর এই হরহামেশা ব্যাপারটি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কেবল সংখ্যা দিয়ে বিচার করা হয় ঘটনার ভয়াবহতা।

শুনতে খারাপ লাগলেও মানুষের প্রাণের মূল্য আজ এমনি মূল্যহীন হয়ে পড়েছে যে, নিত্যনতুন ঘটনার ডামাডোলে, আজকের ‘ক্রন্দনরোল’ দু’দিন বাদে কোথায় যে অপসৃত হয়ে যাচ্ছে, আমরা কেউ তার খোঁজ রাখি না। বাস্তবতা আমাদের এমন জায়গায় উপনীত করেছে যে, বর্তমানের এই সমাজকে ‘প্রাণহীন’, ‘মূল্যবোধহীন’ বললেও বোধহয় কম বলা হবে।

গেল সোমবার (২৫ মার্চ, ২০২৪) বিকেলে চট্টগ্রামের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কালঘর এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগুনে পুড়ে ছফুর নামের সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকের মৃত্যু পাষাণ হৃদয়কেও টলিয়ে দিয়েছে! এ দু’দিন ফেসবুকের পাতায় সফুরের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ছবিটি ঘুরে ফিরে আমাদের দংশন করেছে।

ফায়ার সার্ভিসের বরাতে ঘটনার বিবরণে যা জানা যাচ্ছে, হাইওয়ের গাছবাড়িয়া এলাকায় পুলিশ বালুবাহী একটি ডাম্প ট্রাককে থামার নির্দেশ দিলেও চালক নির্দেশ অমান্য করে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে থাকেন। বেপরোয়া গতির ট্রাকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে ধাক্কা দিলে অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতভাগ্য চালক নিজের সিটে বসেই নির্মম মৃত্যুকে বরণ করেন।

সফুরের মৃত্যুর শোক কেটে উঠতে না উঠতেই গতকাল (২৬ মার্চ, ২০২৪) একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যুর খবর পেলাম আমরা। খবরে প্রকাশ, মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় মঙ্গলবার ভোরে জুড়ীর পূর্ব গোয়ালবাড়ি গ্রামের মখলিছ মিয়ার বাড়িতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ওই পরিবারের ৫ জনের অপমৃত্যু ঘটে।

দুর্ঘটনা ঘটবে, এতে হতাহতও হবেন কেউ না কেউ; কিন্তু চারপাশে অপঘাতে এমন মৃত্যুর মিছিল যে রাষ্ট্রের বিভাগগুলোর ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনার কারণেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যদি পথ দুর্ঘটনার কথাই বলি, তবে বলতে হবে দেশের সড়কগুলো যেন মৃত্যুর ফাঁদ রচনা করে বসে আছে।

সড়কে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে কিন্তু তারও একটা মাত্রা আছে। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, সংশ্লিষ্ট সবার আইন মানার প্রবণতা আর কর্তৃপক্ষের কঠোর তদারকির মাধ্যমে এই মাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। আমাদের সরকারের বিপুলসংখ্যক কর্মচারী জনগণের করের অর্থে নানা ‘প্রকল্প’ সংক্রান্তে (অভিজ্ঞতা লাভ, কেনাকাটা ইত্যাদি) বিদেশ ভ্রমণ করেন।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করে বিশ্বে যেসব দেশ রোলমডেল হয়েছে, সেসব দেশের অভিজ্ঞতা লাভে আমাদের ‘রাজ কর্মচারীরা’ বিদেশ সফর করেছেন কি না আমাদের জানা নেই, তবে নিশ্চয়ই করবার কথা। যদি এ ধরনের সফরে গিয়েই থাকেন তবে লব্ধ অভিজ্ঞতার কী কাজে লাগানো হয়েছে, তা আমরা জানতে চাই! সড়কে মৃত্যুর এই মিছিল বন্ধে আইনের প্রয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মনোবৃত্তির যে বিরাট পরিবর্তন করা জরুরি আর বাংলাদেশের যে বাস্তবতা তাতে সম্পূর্ণরূপে খোলনলচে বদলে ফেলার বিকল্প কী হতে পারে, তা আমাদের জানা নেই।

তবে যুৎসই একটি শব্দ প্রয়োগ করা যেতেই পারে। তা হচ্ছে, ‘আমূল পরিবর্তন’। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট নেতারা কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ‘রাজ কর্মচারীরা’ এই রকম পরিবর্তনের প্রয়াস আদৌ কি হতে দেবেন বা ইতোপূর্বে দিয়েছেন! এর সোজাসাপটা উত্তর- ‘না’।

সোশ্যাল মিডিয়ায় গেল দু’দিনের বিস্তর মুক্ত আলোচনায় কেবলমাত্র পরিবহন ও যোগাযোগ খাত নিয়ে নাগরিকেরা যত অভিমত তুলে ধরেছেন, তা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। তবে যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার ও বর্তমান বাস্তবতা আমাদের কী পরিমাণ ঝুঁকিতে রাখে, তা নিয়ে কিছু মন্তব্য নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। অনেকের অভিমত, গাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাসভর্তি সিলিন্ডারগুলো একেকটি চলন্ত বোমা।

দেশের এই চলন্ত বোমা (মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা ব্যবহার অনুপযোগী) নিয়ে কতসংখ্যক যানবাহন নিত্যদিন চলছে তার হিসাব আমাদের জানা নেই। সড়কে গাড়ির কাগজপত্রের বৈধতা দেখতে যেভাবে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়, ঠিক তেমনি করে সিলিন্ডারের উপযোগিতা দেখার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষের এমন তদারকি চোখে পড়ে না।

কিন্তু বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলবেন। তবে আমরা স্বল্পজ্ঞানে এইটুকু বুঝতে পারি, এই জায়গাটিতে যথেষ্ট উদাসীনতা বিরাজমান এবং আমরা এও শুনি, তদারকি কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে ছাড়পত্র নিতে অসুবিধা হয় না। তার মানে সুশাসনের অভাব দুর্ঘটনা রোধের প্রতিটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিরুদ্ধেই করা যাবে।

আমরা জানি না, সড়কে নাগরিকদের মৃত্যুর এই মিছিল থামাতে রাষ্ট্র আদৌ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না কিংবা ‘কঠোরতর’ পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত কার্যকারিতার মুখ দেখবে কি না! তবে আপাতদৃষ্টিতে তার কোনো সুলক্ষণ চোখে পড়ছে না বিধায় আমাদের দীর্ঘশ্বাস হয়ত আরও দীর্ঘায়িতই হবে।

একইভাবে বলা যায়, অগ্নি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান গেল এক দশকেই আমরা জানতে পারছি, তাতে শিউরে না ওঠার কোনো উপায় নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের তোড়জোড়ে অগণন মানুষের প্রাণহানি ইতিহাসে লেখা হবে না।

সংশ্লিষ্টদের হেলায় বহু প্রাণ ঝরে যাওয়ায় দায়ীদের দায়মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্র হয়ত ক্ষমতাবানদেরই পাশে থাকবে। আর ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ টাইপের কিছু বচন আওড়ে রাজনীতির সরেস মানুষেরা ক্ষমতার মসনদে পালাবদল করবেন!

;

‘মুক্তিযুদ্ধ’র সমাপ্তি টানতে যে কাজ আজও বাকী



অঞ্জনা দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

এই বছরের মার্চের ২৫ তারিখে কাকতালীয় ভাবে মিলে গেল দোল পূর্ণিমা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সাধারণত দোলের দিনে রঙের খেলায় মেতে উঠেন । বোলপুরের শান্তিনিকেতন এই দিনে রঙে রঙে রঙিন হয়ে উঠে। তবে এখন দোল পূর্ণিমার কথা হবে না। শুধু মনে করিয়ে দিতে এসেছি ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাত দশটা থেকে ঢাকার রাস্তায় ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নেমেছিল বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে৷ সেই রাতে বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছিল বাংলাদেশের যেসব বড়ো বড়ো শহরে ক্যান্টনমেন্ট ছিল, সেইসব শহরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি রক্তপিপাসু সৈন্যরা। সেই বড়ো দুঃখের দিনের কিছু কথা বলতে এসেছি।

যতদিন বাঙালি জাতি স্মৃতিশক্তি হারাবে না, বিশেষ করে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, যেসব পরিবার স্বজন হারিয়েছেন, যেসব পরিবার থেকে তাঁদের মা-বোনদের এই হায়েনারা ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক নির্যাতন করেছিল... হত্যা করেছিল সেইসব পরিবার কোনোদিন ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত একটা দিনকেও ভুলতে পারবেন না। এইসব পরিবারের সদস্যরা ধুঁকে ধুঁকে বেঁচেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। এঁদের সাথে যুক্ত করুন এক কোটি শরণার্থীদের যাঁরা বাধ্য হয়েছিল দেশ ত্যাগ করতে এবং দেশের ভিতরেও কোটি কোটি মানুষ নিজ বাড়িতে থাকতে না পেরে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে বের হতে পারবেন।

পাকিস্তানিরা এই দেশের মুসলমানদের সাচ্চা মুসলমান ভাবত না। তারা এঁদের ভারতের দালাল ভাবত। ওরা আমাদের দেশের মুসলমানদের নিকৃষ্ট ভাবত, আরও একটি কারণে যে তাদের দৃষ্টিতে বাঙালি মুসলিমরা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছে। তাই তাদের এতটুকু কষ্ট হয়নি, খারাপ লাগেনি, পরকালের ভয় হয়নি পাখির মতো গুলি করে মারতে আমাদের ভাইদের, বাবাদের, আমাদের সন্তানদের। এক চুকনগরে কয়েকঘন্টায় দশ সহস্রাধিক বাঙালিকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছে এই জালিমরা।

তখন বিশ্বজুড়ে চলছিল সমাজতান্ত্রিক এবং ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই। তাই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পাশে দাঁড়ালো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন না থাকলে ভারত এতবড়ো ঝুঁকি নিত কি না সন্দেহ আছে। কেননা ঠিক ঐ সময়ে আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক পাতানোর কাজে দূতিয়ালি করছিল পাকিস্তান। চীন ছিল পাকিস্তানের মিত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কও ভালো ছিল। যদিও সাধারণ মার্কিন জনগণ এই জেনোসাইডের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। তাঁদের ছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধের নির্মম অভিজ্ঞতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ভিয়েতনাম থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজছিল। মার্কিন প্রশাসনের কাজ ছিল তখন কোনো দেশের জনগণ শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাঁদের টুঁটি চেপে ধরত। না জানি এখানে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে যায়! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও মার্কিন সরকারের এই ভয় ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই বাঙালি মুসলমানদের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে শুরু করেছিল। ১৯৪৭ সালের অল্প কিছু সময়ের পর থেকেই বাঙালিরা নানারকম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিল। তার প্রথম রক্তঝরা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়ে। '৫২ এর হাত ধরেই আসে একাত্তর।

গভীর শ্রদ্ধা জানাই ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে যেসব নীরিহ বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন। সংসদ নির্বাচনে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও পাকিস্তানি জেনারেলরা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তার বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমরা জাতিসংঘ থেকে জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি। আরও ৫৩ বৎসর অপেক্ষা করতে হবে? অনেকেই আর্মেনিয়ার উদাহরণ দেখায় ওদের ওপর করা অটোমান সাম্রাজ্যের জেনোসাইডের স্বীকৃতি পেতে, তাও আংশিক, ১০০ বছর লেগেছিল। তাহলে কি আমাদের সেদিকে ঠেলে দিচ্ছে?

আপনারা সোচ্চার হন জাতিসংঘ কর্তৃক আমাদের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে। আমাদের মা-বোনদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, আমাদের ত্রিশ লক্ষ শহিদের হত্যা করেছিল, তাঁদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। ওঁরা আমাদের একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। আর আমাদের কর্তব্য হলো যারা একাজ করেছিল তাদের বিচার করা। আর সেটি সম্ভব হবে যখন আমরা জেনোসাইডের স্বীকৃতি পাবো। তাই আসুন আজ থেকে গণহত্যা না বলে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে যা কিছু সংঘটিত করেছে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী, একে আমরা বলব জেনোসাইড। আর একটি কথা আপনাদের সন্তানদের, আপনাদের বংশধরদের বলে যান-কী ঘটেছিল ১৯৭১ সালে এই দেশে। কেননা জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের যুদ্ধে ওদের অংশগ্রহণের প্রয়োজন হবে। সেদিন হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

;

স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের এক অম্লান মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত। এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারী শাসনের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কয়েক দশকের নিপীড়ন, প্রান্তিকতা এবং শোষণের চূড়ান্ত পরিণতি।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে বুঝতে হলে প্রথমেই এর জটিল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বোঝা আবশ্যক। প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একমাত্র ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আর কোনো বিষয়ে মিল ছিলনা। যাই হোক, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি এর দুই অংশের মধ্যে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে বাঙালি জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ জন্ম নেয় ও অসন্তোষ দেখা দেয়।

শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দেয় ও শোষণ ব্যবস্থা কায়েম করে। তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে আচরণ করে এবং তাদের সম্পদ ও প্রতিনিধিত্বের ন্যায্য অংশ অস্বীকার করে। একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুকে আরোপ করা বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে আরও বিচ্ছিন্ন করে এবং ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক অধিকারের দাবিতে ক্ষোভ ও বিক্ষোভের জন্ম দেয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও মোহভঙ্গের মধ্যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা ও কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হন। গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ভাষাগত অধিকারের নীতির প্রতি তার অটল অঙ্গীকার বাঙালি জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাথে গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাঁকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধিতে ভূষিত করেছিল।

১৯৬০ এর দশক জুড়ে, বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার ও মর্যাদার জন্য নিরলস সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, একটি ফেডারেল ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন এবং প্রতিনিধিত্বের পক্ষে ছিলেন। যাই হোক, সামরিক ও স্বার্থান্বেষী পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারগুলো বাঙালি জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি উপেক্ষা দেখায় যা তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও ক্ষোভের অনুভূতি তীব্রতর করে।

পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা ও সংলাপে জড়িত থাকার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বাঙালি জনগণের দাবি মেনে নিতে অনড় এবং অনিচ্ছুক ছিলেন। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি, সম্পদের বৈষম্যমূলক বণ্টন এবং সামরিক শক্তির মাধ্যমে ভিন্নমতকে দমন করা বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে এবং অন্যায়ের বোধকে গভীরতর করে।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে টার্নিং পয়েন্ট আসে যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আওয়ামী লীগকে যে অপ্রতিরোধ্য ম্যান্ডেট দিয়েছিল তা ছিল স্বায়ত্তশাসন ও স্বশাসনের জন্য একটি সুস্পষ্ট ম্যান্ডেট, যেখানে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী, বাঙালি নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নারাজ ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার জন্য বিলম্বিত কৌশল ও অপকৌশল অবলম্বন করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা দেয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন ও সহিংসতার মুখে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বাঙালি জনগণের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য সিদ্ধান্তমূলক অবস্থান নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে জনগণকে ঐক্য, প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার সংগ্রামের আহ্বান জানান।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে এবং ভিন্নমতের যে কোনো চিহ্নকে চূর্ণ করার জন্য অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি নৃশংস গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ এবং নৃশংসতা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ ও আতঙ্কের পথ রেখে যায়, যা বঙ্গবন্ধুকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা, প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং মুক্তির শিখা জ্বালিয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত একটি নতুন জাতির জন্মের দিকে পরিচালিত করে।

বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিছক প্রতীকী বিষয় ছিল না। এটি ছিল অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। এটি নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করেছিল, যে সময়ে বাংলাদেশের জনগণ, মুক্তিবাহিনীর (মুক্তিযোদ্ধা) নেতৃত্বে, ভারতীয় যৌথ বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম পরিচালনা করে বিজয় ছিনিয়ে আনে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার এবং তার স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং জাতীয় ঐক্যের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশীদের ধারাবাহিকভাবে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে যেমনটা ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোতে ছিল।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অমর ঘটনা। এই ঘোষণা ছিল বাঙালিদের অধিকার, মর্যাদা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার এক সাহসী প্রকাশ। এই ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মই দেননি, বরং একটি নতুন জাতির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

এই ঘোষণা বাঙালিদেরকে একত্রিত করেছিল এবং তাদেরকে তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই ঘোষণা ছিল একটি নতুন সূচনার প্রতীক, একটি নতুন যুগের সূচনা, যেখানে বাঙালিরা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারবে।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে, আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা কী অর্জন করেছি এবং আমাদের কী অর্জন করতে হবে। এই ঘোষণা আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার এবং আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা সকলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানায়।

২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। এটি একটি স্মরণীয় দিন যা আমরা চিরকাল গর্বের সাথে উদযাপন করব। কয়েক দশকের নিপীড়ন ও শোষণের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার অটল সংকল্প, নিরলস নেতৃত্ব, অসীম ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রাম মুক্তির সূচনা করে জন্ম দিয়েছিল এক নতুন জাতির।

ন্যায়বিচার, সাম্য ও গণতন্ত্রের মূলনীতিতে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার আদর্শের আলোয় আজও বাংলাদেশ তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

;