বুলবুল ঝড়ের পর সুন্দরবন, ভাবিয়া করিও কাজ
ঝিমিয়ে পড়া ঝড় বুলবুলের সহনীয় দাপটে সম্পদ আর স্থাপনার উল্লেখযোগ্য ক্ষতি দৃশ্যমান না হলেও প্রাণহানি ঘটেছে, মরেছে মানুষ। ক্ষয়ক্ষতির পুরো চালচিত্র হয়তো কোনোদিনও ঠিকঠিক পাওয়া যাবে না। আমরা হারিয়ে যাবো অন্য কোনো হিসাবের খাতায়। ঝড়ের পরপর বনকর্তারা জানিয়ে দিয়েছিলেন, তারা বন বন্ধ করে দেবেন। প্রথম দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে। একদিন পর একটু সংশোধন করে বলেন, আপাতত বন্ধ। আরও পরে জানিয়ে দেন, সীমিত আকারে পর্যটকরা যেতে পারবেন।
নিন্দুকেরা বলছে, ট্যুর কোম্পানিগুলোর চাপে বনকর্তারা মত পালটিয়েছে। কিন্তু মাওয়ালি বাউয়ালিদের কী হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। সুন্দরবনে কার্ফু জারির একটা ইতিহাস আছে, সেটা কি ক্রমশ একটা চর্চায় পরিণত হচ্ছে? আমলাতন্ত্রের খাসলতটাই এমন। আগে কী হয়েছে, কেমন করে সামলেছে আগেরজন সেটাই অনুসরণ করেন পরেরজন।
সিডরের পর বাংলাদেশের কিছু পরিবেশ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়েছিলেন সুন্দরবনকে যেনো নিজের মতো থাকতে দেয়া হয়। তাদের বয়ান ছিল, বাইরের হস্তক্ষেপ বন্ধ রাখলে প্রাকৃতিকভাবেই পুনর্বাসিত হবে সুন্দরবন। তাই করা হয়েছিল। বন থেকে এক বছরের জন্য (মতান্তরে দুই বছর) সব ধরনের বনজ সম্পদ আহরণও নিষিদ্ধ ছিল। আগাপাশতলা না ভেবে শুধু ধারণার বশবর্তী হয়ে বিশেষজ্ঞদের দেয়া এই পরামর্শ আদতে সুন্দরবনের লাভের চাইতে ক্ষতিই করেছে বেশি।
মানুষ যেমন বেঁচে থাকার জন্য বনসম্পদের দিকে তাকিয়ে থাকে, তেমনি বনও তাকিয়ে থাকে মানুষের দিকে। মানুষের স্পর্শ সান্নিধ্য ছাড়া বনের অনেক গাছগাছালি, মধু, মাছি তাদের জীবনচক্র চালু রাখতে পারে না। যেমন গোলপাতার ঝাড়। নারিকেল গাছ যেমন প্রতিবছর ঝুড়তে বা পরিষ্কার করতে হয়, গোলপাতার গাছও তেমন পরিষ্কার করে দিতে হয়, পুরাতন ডাল কেটে নিতে হয়, নয়তো শুকিয়ে যায় গোলপাতার ঝাড়। পরিচর্যার অভাবে হারিয়ে যায় অনেক ঝাড়। মাউয়ালিরা মধু আহরণের সময় গাছ বেয়ে ওঠা লতা, গাছে গজানো পরজীবী লতা,পরডালা ভেঙ্গে দিয়ে গাছকে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে।
সিডরের পর বনজীবিদের বনে প্রবেশ নিষিদ্ধ হলে সুন্দরবনের গাছে গাছে জীবন বিনাশী লতার বৃদ্ধি আমরা লক্ষ্য করেছি। আবার অমাবস্যা পূর্ণিমার তিথি অনুসরণ করে মৌমাছির চাক ভেঙ্গে নতুন রাণী মৌমাছিদের নতুন চাক তৈরির সুযোগ করে দেন মাউয়ালিরাই। গোলপাতার গাছ পরিষ্কারের মওসুম শুরু হয়ে গেছে, মওসুম এসেছে গোলপাতার গুর তৈরির। গোলপাতার গুর পটুয়াখালী-বরগুনা অঞ্চলের স্থানীয় মিষ্টি চাহিদার ৩৫% পূরণ করে থাকে। সুন্দরবনে তালা লাগানোর আগে এই বিষয়গুলো আমাদের আমলে নিতে হবে।
সর্বশেষ ঘোষণায় পর্যটকদের ছাড়ের কথা বলা হলেও মাউয়ালি বাউয়ালিদের কথা পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি। চাদপাই আর সাতক্ষীরা রেঞ্জের বনজীবিদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে জানা গেছে তারা দ্বিধা দ্বন্দ্বে আছে। বনে ঢুকতে না দিলে তাদের পরবাসী হতে হবে কাজের সন্ধানে। সেটারও অনেক সামাজিক সমস্যা আছে।
এবার অবশ্য বন বন্ধ ঘোষণার সময় বলা হয়েছিলো ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য এই বিরতি প্রয়োজন। বন কর্মীরা একটু শান্তির সঙ্গে একমনে নির্ভুল একটা হিসাবের কাজ করতে চান। এটা যেমন তেমন জায়গা না। সুন্দরবন বলে কথা। সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পেতে সময় লাগবে। তাদের হিসাবের পদ্ধতিও আলাদা। আগে বনে কারফিউ দেবে তার পর গুনতে বসবে। মানুষ যেন না দেখে। মানুষ দেখলে জানলে ক্ষতি কি? জানা গেছে, বনকর্মীরা ৬৩টি দলে ভাগ হয়ে সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জ পাতিপাতি করে দেখবে কী কী হারাল সুন্দরবন। এদের সমন্বয় করবেন সুন্দরবন পূর্ব ও সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের কর্মকর্তারা। আমরা ফলাফলের অপেক্ষায় থাকলাম।
এখন পর্যন্ত সহনীয় মাত্রার বুলবুলিয় ঝড়ে স্বাভাবিকভাবে কোনো বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তবে হিসাবের আগেই খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক আওয়াজ দিয়ে রেখেছেন, ঝড়ে বন বিভাগের কিছু ক্যাম্প, কাঠের পন্টুন, জেটি, ওয়াকওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক গাছপালার ডাল ভেঙেছে। যে গতির ঝড় হয়েছে কার্ত্তিক মাসে তাকে কার্তিকের কাইত্যান বলে। গ্রাম দেশে ধান শোয়ানো এই বড় বাতাস ঋতু পরিবর্তনের স্বাভাবিক অনুসর্গ। ধান শোয়ানো বাতাসে পন্টুন, জেটি, ওয়াকওয়ে ভেঙ্গে পরার কথা নয়। তাহলে কি এগুলি সময়মতো মেরামত করা হয়নি? রক্ষণাবেক্ষণের বরাদ্দ কি অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে খরচ হয়ে গিয়েছিলো? সেই খরচের হিসাব মিলানোর জন্যই কি সুন্দরবনে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ করে কার্ফু দিয়ে ক্ষতি গণনার কারসাজি? এসব হয়তো দুষ্টলোকের নিতান্তই ত্যাড়া কথা।
তারপরেও একথা মানতে হবে আঁচ অনুমান আর দেশি হিসাবের সাথে মেট্রিক হিসাব গুলিয়ে ফেলা মার্কা ক্ষয়ক্ষতি আর চাহিদা নিরূপণের বাইরে বিজ্ঞান ভিত্তিক পদ্ধতি প্রক্রিয়া অনুসরণের চর্চা এখনো গড়ে ওঠেনি। সিডরের ক্ষতি মাপার প্রথম বিজ্ঞান ভিত্তিক উদ্যোগ এসেছিলো বিদেশি সাহায্য সংস্থার তরফ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা ইউএসএআইডি এবং জন ডি রকফেলার ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় একটা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো ঝড়ের সাত বছর পরে।
উইনরক ইন্টারন্যাশনালের তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউট ‘সুন্দরবনের পর্যটন, ঘূর্ণিঝড় থেকে বসতবাড়ি সুরক্ষা এবং আহরিত সম্পদের আর্থিক মূল্যায়ন’ নামের এই গবেষণা পরিচালনা করে। নভেম্বর ২০১৪ সালের শুরু হওয়া এই গবেষণা তিন বছর পর ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শেষ হয়। ক্ষতি নিরূপণ এই বিজ্ঞান ভিত্তিক তথ্য তালাশের উদ্যোগ আর টাকা বিদেশ থেকে আসলেও কাজটি করেছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আর ব্যক্তিরা। এরা সবাই দেশেই আছেন। বুলবুলের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে এদের এলেমের সাহায্য নেয়া যেতো, এখনো নেয়া যায় ।
উইনরক ইন্টারন্যাশনাল আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের নেতৃতে করা সিডরের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ প্রতিবেদন একটি নতুন তথ্য সবাইকে চমকে দিয়েছিল। প্রতিবেদন তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করেছিলো সিডর ঝড়ে সুন্দরবন থেকে দূরের জনবসতির ক্ষতি হয়েছিল বেশি। এবারো আমরা তাই দেখলাম। ঝড় আছড়ে পরে সুন্দরবনে কিন্তু গাছ উপড়ে মানুষ মরে দূরের জনপদে। স্থানীয়জাতের গাছ না লাগিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ে এমনসব বিদেশি গাছ লাগানোর জন্যই এমনটি ঘটে। সিডরের পর সবাই তওবা করেছিলো আর চম্বল আর বিদেশি কড়ই লাগাবে না। বন্ধ হয়নি মরনঘাতি গাছের চর্চা। এবারো বেশির ভাগ মানুষই মরেছে নিজের অথবা প্রতিবেশী কিংবা সরকারের লাগানো ভুল গাছের মর্মান্তিক চাপায়।
সিডরের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণকারী দল ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় এলাকার জনপদ রক্ষায় সুন্দরবনের ভূমিকা আরও বৃদ্ধি করার জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করেছিলেন ।
দুর্যোগ থেকে রক্ষায় দেশের বিভিন্ন উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বৃক্ষ বনায়ন করারও পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা। কৃষি, নগর উন্নয়ন কিংবা অন্য কোনো কাজের জন্য ম্যানগ্রোভ ও উপকূলীয় প্যারাবন কোনোভাবেই নষ্ট ও ধ্বংস না করার কথা বলেছিলেন গবেষকরা। সুন্দরবন-সংলগ্ন যেসব এলাকায় চিংড়ি চাষ হচ্ছে তা সরিয়ে নেওয়া ও সুন্দরবনের সীমানা থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে যেকোনো ধরনের অবকাঠামোগত স্থাপনা, চিংড়িঘের প্রকল্প অনুমোদন না দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল এই গবেষণায়। বলাবাহুল্য এর একটিও কেউ আমলে নেয়নি, বাস্তবায়ন অনেক দুরের কথা।
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক