পাপকে ঘৃণা কর, পাপিয়াকে নয়?
আমাদের দেশে অতি দ্রুত টাকা কামাই করার একটা সহজ উপায় হচ্ছে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা। রাজনীতি করলে স্থানীয় উন্নয়ন কাজেও শরিক হওয়া যায় আর নিজেরও কিছু কামাই-রোজগার হয়। এ কাজ করতে গিয়ে কেউ কেউ আরও একধাপ এগিয়ে যায়। তারা হয় গডফাদার, গডমাদার।
গডফাদার শব্দটি আমাদের কাছে নতুন নয়। গডফাদার ও গডমাদার নামে হলিউড-বলিউডে সিনেমাও হয়েছে। আমাদের দেশে অনেকেই গডফাদার হয়েছেন। কেউ হয়েছেন সন্ত্রাসের গডফাদার, কেউ মাদকের-ইয়াবার, কেউ চোরাচালানের। এসব করে টাকা-পয়সার মালিক হয়েছে অনেকেই, কিন্তু সে অর্থে ক্লাসিক্যাল বা অভিজাত গডফাদার বলতে যা বোঝায় তা আমাদের দেশে নেই।
আমাদের দেশের গডফাদাররা সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট একটি ব্যবসা নিয়ে গডফাদারগিরি করেন। মাদকের গডফাদার মাদকের পাইকারি কারবারই করেন। খুচরা কারবারের ধার ধারেন না। তিনি অন্য কোনো ব্যবসা যেমন চিটাগুড়, রাস্তার চাঁদাবাজি বা অন্য কোনো ধান্ধাও করেন না। যে যার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন ও নিজ নিজে সাম্রাজ্যের আধিপত্য করেন।
কিন্তু হালে আমরা একজন নবাগতা গডমাদার পেয়েছি যিনি ঢালিউড, টালিউড, বলিউড ও হলিউডকেও হার মানিয়েছেন। বয়স অনুযায়ী গডসিস্টারের বয়সও হয়নি, কিন্তু অনেক গডমাদারকেও টপকে গেছেন। তিনি অনেক কিছুরই ব্যবসা করেন। তার প্রোফাইল অনেক প্রতিষ্ঠিত গডফাদারের চেয়েও বেশি।
অন্য আর দশজন গডফাদারের মতো গডমাদার শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউও রাজনীতি করেন। তিনি যুব মহিলা লীগের নরসিংদী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদিকা। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গেই যুবলীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সম্প্রতি কেউ ধরা খেতে দেরি, কিন্তু সংগঠন থেকে বহিষ্কার হতে দেরি নেই। কিন্তু এতে সংগঠন কি আসলেই দায়মুক্ত হয়ে যায়? সংগঠনের অন্য নেতা-নেত্রীরা কি কখনো ওই নেতা বা নেত্রীর অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন? তারা কি ওই নেতা-নেত্রীর কাছে থেকে কোনো সুবিধা ভোগ করেননি? ব্যক্তিগত না হোক, সাংগঠনিক বা রাজনৈতিক সুবিধা কি তারা ভোগ করেননি? সুবিধা ভোগ করার সময় ষোলো আনা, আর ধরা খেলে তওবা করে দায়মুক্তি। এতে কি সত্যি সংগঠন দায়মুক্ত হতে পারে? ব্যক্তি হয়তো দায়মুক্ত হয়ে যায়, কিন্তু সংগঠনকে কাফফারা দিতে হয় বহুদিন ধরে। এভাবে কাফফারা দিতে দিতে সংগঠন দেউলিয়াও হয়ে যায়। আমাদের দেশের বাম সংগঠনগুলো নেতাদের লোভ-লালসা ও আদর্শহীনতার কাফফারা দিতে দিতে আজ দেউলিয়া। শেখ মনির যুবলীগ আজ তারই সুযোগ্য উত্তরসূরির হাতে। তারই পরশে যুবলীগে প্রাণ সঞ্চার হোক এটাই কাম্য। সময় থাকতেই একাজে হাত দিতে হবে। না হলে এ বোঝা দিনে দিনে আরও ভারী হবে।
এদেশে রাজা-বাদশাহি গত হয়েছে বহু বছর। কিন্তু হেরেমখানা, জলসাঘর, বাইজীঘর, রংমহল এখনও রয়ে গেছে। অতীতের ইতিহাস স্মরণ করে এসব ঘরে মাতম চলে না। বরং এখনও বেশুমার ফুর্তি চলে। ফুর্তির রসদ সরবরাহ করে অনেকে জীবিকাও নির্বাহ করে।
এক সময়ে ভারতবর্ষের সেরা রাজ-নর্তকী ছিল হীরা বাই। কথিত আছে, হীরা বাইয়ের উচ্চতা ছিল ৬ ফুট ২ ইঞ্চি আর ওজন ছিল মাত্র ৪২ কেজি। আর বাংলায় তখন গডফাদার শিরোমণি ছিল জগৎশেঠ। শোনা যায়, দিল্লীর রাজদরবারও নাকি জগৎশেঠের কাছে থেকে টাকা ধার করতো। এই জগৎশেঠ তার মনোরঞ্জনের জন্য দিল্লীর সেরা রাজ-নর্তকী হিরা বাইকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসেন। জগৎশেঠের জলসাঘরে ঠাই হয় হীরা বাইর। হিরা বাইয়ের একটি পেইন্টিং আজও জগৎশেঠের প্রাসাদে শোভা পায়। শুধু জগৎশেঠ নয়, বুড়ো নবাব মীর জাফর আলী খার জলসাঘরে ফুর্তির জোগান দিত আরেক রাজ নর্তকী-মুন্নী বাই। মুন্নী বাই'র রূপে মীরজাফর এতোই বেসামাল হয়ে গিয়েছিলেন যে তাকে শেষমেশ অন্য বিবিদের সঙ্গে হেরেমেও ঠাই দিতে হয়েছে। মীরজাফরের তৃতীয় বিবি হন এই মুন্নী বাই। জীবনে তো নয়ই, মরণেও মুন্নী বাই মীর জাফরের পিছু ছাড়েননি। মুর্শিদাবাদের জাফরাগঞ্জে মীরজাফরের কবরের পাশে অন্যান্য বিবিদের পাশেই শায়িত রয়েছে মুন্নী বাই। কাজেই রাজ নর্তকীরা ও বাইজীরা সর্বজনীন। জলসাঘর ও ফুর্তি যতদিন বহাল থাকবে ততদিন লাঠি হাতে শাসন করে যাবেন বাইজীরা। রাজা নেই, রাজার হাতের তরবারিও নেই। কিন্তু বাইজীরা এখনও লাঠি হাতে বাবুদের শাসন করে যাচ্ছেন।
আমাদের গডমাদারের বয়স বেশি নয় আগেই বলেছি। কিন্তু কম বয়সেই অনেক দায়িত্ব নিয়েছেন। ঘরের দুষ্টু ছেলে ছোকড়াদের ঘরমুখো করতে পেরেছেন। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে লাস-ভেগাস-ব্যাংকক যাওয়া বন্ধ করে ঘরের টাকা ঘরেই রেখেছেন, ঘরের ছেলে ঘরেই রেখেছেন। হাসন রাজার নাচ-গানের প্রতি ছিল খুব ঝোঁক। এদিকে হাসনকে জমিদারিও রক্ষা করতে হবে। বাইজীর নাচ দেখে হাসনের রাজকাজে মন নেই। দুশ্চিন্তায় মা। শেষমেশ মা ছেলেকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিজেই একদিন মুখে কাপড় ঢেকে বাইজী সেজে জলসাঘরে নাচতে শুরু করলো। ছেলে হাসন তো নাচ দেখে মহা খুশি। নিজের গলার হিরে জহরত বাইজীর দিকে ছুড়ে মারতেই মা মুখের পর্দা ওঠালো। হাসন দেখলো এতো তার মা। ছেলেকে শিক্ষা দিতেই মায়ের এই কাজ। সেই থেকে হাসন আর বাইজী নাচ দেখে না। আমরা পেলাম হাসন রাজা।
আমাদের গডমাদার ছেলেদের ফুর্তির জোগান দিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু ছেলেদের যে আর ফুর্তি মেটে না। শেষমেশ গডমাদারকে বাইজী সরবরাহ কাজে লেগে যেতে হলো। ঢাকার অদূরে নরসিংদী ও অন্যান্য এলাকা থেকে বাইজী এনে বাবুদের খুশি করতে হতো।
আমরা এখন সভ্য হয়েছি। ইয়ার্কি-ফাজলামি যা করার পাড়ার বাইরে গিয়ে করি। নিজের এলাকায় আমরা সবাই গোবেচারা। আমাদের নাগরিক জীবনে সব ফুর্তির ব্যবস্থাই আছে। পাঁচ তারকা হোটেলের প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুটই আজকের জলসাঘর। মাসের পর মাস বুক করে আনন্দ আয়োজন চলে এসব ঘরে। এক কোটি ৩০ লাখ টাকা বিল কোনো বিষয়ই না। সুরার খরচ প্রতিদিন আড়াই লাখ টাকা-সেটাও ব্যাপার না। বাবুদের খুশি করতে হলে অনেক পয়সা খরচ করতে হয়। আর খুশি হলে পয়সাও উসুল হয়। কাজেই পয়সা এখানে কোনো সমস্যা না।
আগের দিনে রাজা বাদশারা বাইজীদের নাচন কুর্দনে খুশি হলে বড়জোর হেরেমে জায়দা দিতেন। কিন্তু এখন বাবুরা বড়জোর ফুর্তি করে টাকা দেয়। সে টাকায় গডমাদারের আচল ভরে না। তাই বাবুদের বিশেষ মুহূর্তের ছবি তুলে রাখে গডমাদাররা। ডিজিটাল যুগের গডমাদাররা সেই ছবি দিয়ে বাবুদের কাত করে আরও পয়সা উসুল করে। সভ্য সমাজের বাবু বলে কথা। সব ফাঁস করে দিলে বাবুদের যে আর মুখ রক্ষা হয় না। মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কী উপায়? জাত রক্ষা করে মদ খাওয়া আর ফুর্তি করে সমাজ রক্ষা করা দুটোই কঠিন।
রাজা যায়, রাজা আসে। কিন্তু বাবুদের আমোদ ফুর্তি আর শেষ হয় না। সে কারণেই হীরা বাই, মুন্নী বাই, আনারকলি বাই, পাপিয়ারা যুগে যুগে আসে। এ কাহিনীর শেষ নেই। তবে আমাদের গডমাদার নজিরবিহীন। তার তুলনা তিনি নিজেই। লাঠি হাতে শাসন করেছেন বাবুদের। ম্যারিও পুজোর গডফাদার, শাবানা আজমীর গডমাদারকেও হার মানিয়েছেন এতো অল্প বয়সে। ম্যারিও পুজো বুড়ো বয়সে একটু-আধটু আরাম আয়েশের মুখ দেখেছেন। তিনি সংগ্রামই করেছেন এক জীবন। বাকি দুই পুরুষ সেই সম্পদ খেয়েছে। গানে আছে, এক পুরুষ গড়ে ধন, আরেক পুরুষ খায়, আরেক পুরুষ এসে দেখে খাওয়ার কিছু নাই। আমাদের গডমাদার যে ধন গড়েছেন তা তিন পুরুষ খেলেও শেষ হবে না। কিন্তু বাধ সেধেছেন নগরের কোতোয়াল। পুলিশ গ্রেফতার করেই তার জীবনটা শেষ করে দিল!
আমাদের গডমাদার হার মানিয়েছেন ‘লা মাদরিনা’কেও। কোকেনের গডমাদার ছিল এই লা মাদরিনা। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় তিনি ইউরোপের কয়েকটি দেশের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন। গত শতকের সত্তর-আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক বাণিজ্যে বিপ্লব ঘটান মাদরিনা। সে জন্য অনেক সংগ্রামও করতে হয়েছে তাকে। এই কোকেন সম্রাজ্ঞী অল্প বয়সেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন। এক পর্যায়ে লা মাদরিনা নিজের তিন স্বামীকেও খুন করেছেন। বলা হয়, তিনি অন্তত ২০০ জনকে হত্যার ইন্ধনদাতা। তার সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ২০০ কোটি ডলার। আমাদের গডমাদারকে জীবনে কোনো সংগ্রাম করতে হয়নি। যুবলীগের নেত্রী থেকেই গডমাদার। রাস্তা খুব সহজ। অল্প বয়সেই কোটি কোটি টাকার মালিক। টাকার পরিমাণ নিয়ে তদন্ত চলমান।
পাপকে ঘৃণা কর, পাপিকে নয়-কথাটি নাকি বিখ্যাত মার্কিন কবি হুইটম্যানের। আমরা প্রতিনিয়তই পাপে জর্জরিত। কেউ কম, কেউ বেশি। কিন্তু দেশে এখন পাপীদের বাড় বাড়ন্ত। আগে পাপ করলে চুপিসারে আড়ালে আবডালে কোনো রকমে মুখ লুকিয়ে থাকতে হতো। এখন আর চোখের লজ্জা বলতে কিছু নেই। পয়সা ও ক্ষমতাই বড় কথা। পাপ-পুণ্য, লোকলজ্জা এসব উঠে গেছে। কথায় বলে, বড় হতে হলে রাগ, লজ্জা, ভয়-এই তিন থাকতে নয়। আমরা এখন এসব থেকে মুক্ত। তাই যে যতো দ্রুত সম্ভব টাকা-পয়সা কামাই করার ধান্ধায় রত। এই ধান্ধায় কেউ হয় সম্রাট, কেউ পাপিয়া। আমরা হয়তো এক পাপিয়া বা সম্রাটের কথাই জানি, কিন্তু আরও অনেক পাপিয়া ও সম্রাট কি আমাদের সমাজে নেই?
আমরা পাপিয়া ও সম্রাটের কথা জানি তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই এরকম পাপিয়া-সম্রাটও সমাজে কম নয়। ভাগ্যের ফেরে কেউ ধরা খায়, কেউ খায় না।
আমাদের এই গডমাদার অনেক কাজের কাজী। তদ্বির, অস্ত্র-মাদক ব্যবসা, টাকার বিনিময়ে চাকরি দেয়া, জমির দালালি, কাজ ও লাইসেন্স পাইয়ে দেয়া সবই করেন। গডমাদারের গুনের কোনো শেষ নেই। যুবলীগ থেকে পাপিয়া পিউকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু আমরা কি আমাদের রাজনীতি, জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে পাপিয়া-আদর্শকে বহিষ্কার করতে পারবো? নাকি আমাদের মননে পিউ পিউ বোলে পাপিয়ারাই বিরাজ করে? ঘৃণা করতে হবে পাপকে যেমন, পাপিয়াদেরও তেমন।
এরশাদুল আলম প্রিন্স: কলামিস্ট