করোনাকালে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কীভাবে টিকে থাকবে?
ধারণা করা হচ্ছে কোভিড-১৯ পৃথিবীজুড়ে অনেকগুলো ছোট ব্যবসাকে লাইফ সাপোর্টে নিয়ে যাবে। জীবন যেখানে মৃত্যুর মুখোমুখি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সেখানে অস্তিত্ব সংকটে ভুগবে এটাই সাধারণ সমীকরণ। কিন্তু প্রত্যেক সংকটের একটা মাত্রা থাকে, উত্তরণের পথ থাকে। জেনেশুনে সেই পথে হাঁটাটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।
“Fintech, Small Business and American Dream” বইয়ের লেখক ক্যারেন জি মিলস সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসীয় এবং ব্যবসায়ী নেতাদের সম্ভাব্য সহায়তা পদ্ধতির বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। নীতি নির্ধারকদের সহায়তার বিকল্প ব্যবস্থা বিষয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছা মালিকদের বেশ কিছু দিক নির্দেশনা দেন।
মিলস ২০০৯ সালের শুরুর দিকে ওবামা প্রশাসন এবং তার জাতীয় অর্থনৈতিক সংস্থার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন এবং ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালের মন্দার প্রেক্ষিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পুনরুদ্ধারে কাজ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি মনে করেন “ক্ষুদ্র-ব্যবসায়ীরা করোনাভাইরাস সহ্য করার চেষ্টা করছে যার মাধ্যমে তারা এমন আর্থিক আঘাতের মুখোমুখি হবে যা তারা এক দশকেরও বেশি সময় আগে ঘটে যাওয়া মহা মন্দার সময় যে অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তার চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে” । মিলস আরও মনে করেন, “এই বিশেষ সংকট চলাকালীন আমাদের অর্থনীতিকে এগিয়ে রাখতে এক নম্বর কাজ হবে ক্ষুদ্র ব্যবসায় সহায়তা করা, পাশাপাশি তাদের কর্মচারী এবং তাদের পরিবারকে সহায়তা করা।’এজন্য গত কয়েক সপ্তাহে তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের ৩০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র ব্যবসাকে উপকৃত করার উপায়গুলো অনুসন্ধান করতে পরামর্শ দিচ্ছেন।
মার্চের শুরুর দিকে, কংগ্রেস এবং ট্রাম্প প্রশাসন কোভিড-১৯ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ছোট ব্যবসায়ের জন্য দুর্যোগ ঋণ হিসেবে ৭ বিলিয়ন ডলার অনুমোদন করে। এই কর্মসূচীটি রাজ্যগুলোতে ব্যবসায়ের সহায়তা করে যা জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ঘোষণা করে যে, ২ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত যার যত প্রয়োজন ধার নিতে এবং তা ৩০ বছরের মধ্যে ৪ শতাংশেরও কম সুদের হারে পরিশোধ করতে। এছাড়া,কংগ্রেসের উভয় কক্ষই অতিরিক্ত ত্রাণ নিয়ে ভাবছে। ৩০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক ঋণ প্যাকেজ তাদের বিবেচনায় রয়েছে। এর ফলে দেশটির ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আশংকা কমিয়ে আশার সঞ্চার করবে বলে নীতি নির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস।
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পর ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকদের ওপর একটি জরিপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেখা যাচ্ছে, ৭৭ শতাংশ করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে খুব চিন্তিত। ৫৪ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করছেন যে আগামী ১২ মাসের মধ্যে মার্কিন অর্থনীতি মন্দার মধ্যে পড়বে। আর ৪৯ শতাংশ স্বীকার করছেন যে গ্রাহকের চাহিদা কমছে। কারণ সংক্রামক ভাইরাস কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা পেতে গ্রাহকরা ঘরে অবস্থান করায় ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো আনুপাতিকহারে কমে যাচ্ছে এবং সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
জেপি মরগান চেজ ইনস্টিটিউট ধারণা করে যে গড়ে ছোট ছোট ব্যবসায়ের কাছের ২৭ দিনের নগদ রিজার্ভ থাকে, তবে মেইন স্ট্রীট ব্যবসাগুলোতে প্রায়শই ২০ দিনেরও কম সমমূল্য থাকে।পূর্বাভাসে ভিন্নতা থাকলেও অনেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা প্রত্যাশা করতে পারছেন না যে সামাজিক দূরত্ব এবং অন্যান্য প্রশমন প্রচেষ্টার প্রসারণকে কমিয়ে দেওয়ার কথা বিবেচনা করে করোনাভাইরাস কমপক্ষে আট সপ্তাহের জন্য হ্রাস পাবে।
এই সময়সীমা নিয়ে মিলস মনে করেন, অনেকগুলো ক্ষুদ্র ব্যবসা একমাসের বেশি টিকতে পারবে না। এটি আর্থিক সংকটের চেয়েও আরও অধিকতর মন্দা অবস্থা হতে যাচ্ছে এবং দোকানগুলো শীঘ্রই তাদের কর্মীদের ছাঁটাই করতে হবে অথবা ভালোর জন্যে বন্ধ করতে হবে। স্কুল বন্ধ এবং শহরজুড়ে তালাবদ্ধের অপেক্ষমাণ সময়ে তাদের কর্মচারীদের বেতন দিতে এবং স্টোরফ্রন্টগুলো রাখার জন্য তাদের সুদমুক্ত ঋণ এবং অন্যান্য নগদ প্রবাহের প্রয়োজন হবে। এরপরে গ্রাহকরা তাদের ব্যয়ের কিছু অভ্যাস পুনরায় শুরু করতে পারে।
করোনাকালের এই সংকট কাটিয়ে পুনরায় ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলোকে চাঙ্গা করতে বেশ কিছু পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা উঠে এসেছে মিলস এর বক্তব্যে যা বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে এই সংকটকালে টিকিয়ে রাখতে সেগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।
প্রথমত, ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নগদ অর্থ প্রবাহ বাড়িয়ে দিতে সহায়তা করা। কারণ নগদ প্রবাহ হলে তাতে জীবন প্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে। বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বছরে প্রায় ২ মিলিয়ন নেট নতুন কাজ সরবরাহ করে এবং ৪৭ শতাংশ কর্মী নিয়োগ করে। ছোট ব্যবসাগুলো মোট দেশজ উৎপাদনের ৪৪ শতাংশ অবদান রাখে। বাংলাদেশে ৭৮ লাখ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তরা নিজেদের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি উৎপাদন ও রপ্তানিতে কাজ করছে।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের মত নির্দিষ্ট ‘ঋণ প্যাকেজ’ থাকতে পারে। যেখান থেকে একটি নির্ধারিত পরিমাণ পর্যন্ত স্বল্প সুদে উদ্যোক্তারা ধার নিতে পারবেন। যদিও গার্মেন্টস শিল্পের সহায়তার জন্য ৫ হাজার কোটি তহবিল ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এর সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ থাকলে সহায়ক হতে পারে।
একই সাথে, বকেয়া বা ঋণের বিষয়গুলো পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে আরও সহনীয় ও সহজ করা যায়। যেমন মালিকদের উচিত বাড়িওয়ালাদের কাছে ভাড়া পরিশোধের সময় বৃদ্ধির জন্য অনুরোধ করা। এনজওি বা ব্যাংকগুলোকে তাদের বকেয়া ঋণের বিপরীতে সুদের অর্থ প্রদান সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার নির্দেশনা প্রভৃতি। তাছাড়া, সংশ্লিষ্ট গ্রাহকরা তাদের স্থানীয় ব্যবসায়ের কাছ থেকে উপহার কার্ড কিনে সহায়তা করতে পারেন, যা মেইনস্ট্রিটের দোকানগুলোকে চালিয়ে রাখতে সহায়তা করবে।
মিলস মনে করেন, ছোট ব্যবসা দেশের সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব ভালো আর্থিক ভিত্তি তৈরি করে, যদি আমরা এই ছোট ব্যবসাগুলো হারাই তবে তা ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লাগবে। তাই এই কঠিন সময়ের দিনগুলোকে মোকাবেলা করতে পারলেই টিকে যেতে পারে ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যার ওপর দাঁড়িয়ে আছে দেশের বৃহৎ স্বার্থ, সমষ্টিক অর্থনীতি।
নাজমুল হুদা: উন্নয়ন গবেষক, প্রাবন্ধিক ও উপপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক