বিতর্কের চেয়ে বিপদ বড়
করোনায় কজন মারা গেলো আর কজন উপসর্গ নিয়ে মরলো- সেই বিতর্কের চেয়ে বড় হচ্ছে এটা বোঝা যে আমরা ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যেই আছি। বিপদটা কেমন? সেটা ভারতের তাবলিগের হেড কোয়ার্টার নিজামুদ্দিনের মারকাজ মসজিদের হালের হালফিল দেখলেই টের পাওয়া যাবে। ভারতে এক ধরনের কঠোর লকডাউন করোনা পরিস্থিতিকে কিছুটা ঠেকাতে পারলেও তাবলিগের জমায়েত সেখানে এখন বড় আশঙ্কা তৈরি করেছে। কতজন এই রোগের জীবাণু নিয়ে ভারতের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ল সেটাই এখন ভারতের করোনা মোকাবিলার স্ট্রাটেজি যারা তৈরি করছেন তাদের ভাবাচ্ছে। সামান্য একটু অবহেলা বা ভুল কতটা বড় বিপদের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে এই ঘটনা তার প্রমাণ!
আর আমেরিকার কথা তো বলাই বাহুল্য। দুনিয়া কাঁপানো ট্রাম্প মহাশয়ের বাগাড়ম্বর এখন মৃত্যুকূপে পরিণত করেছে আমেরিকাকে। করোনাভাইরাস মোকাবিলার চেয়ে, করোনা ভাইরাস নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনকে রাজনৈতিকভাবে কুপোকাত করার কাজেই ব্যস্ত ছিলেন তিনি। এই ভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ বলেও পরিহাস করতে ছাড়েননি। তথ্য লুকিয়ে বা তথ্য নিয়ে বাগাড়ম্বর করা যুদ্ধ কাজে চলে, সেটার ফায়দাও মেলে, কিন্তু ভাইরাসযুদ্ধে সেটা হিতে বিপরীত হয়। এখন যেমন হচ্ছে।
খোদ আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিজেই এখন ভয়ের প্রধান মুখপাত্র। নিজের দেশের জনগণকে এখন বড় ভয়ের মধ্যে রেখেছেন তিনি। তিনি বলছেন, 'আগামী দু’সপ্তাহে খুবই কঠিন দিন আসছে। প্রত্যেক মার্কিন নাগরিক তৈরি থাকুন। দু’সপ্তাহ পরে বিশেষজ্ঞরা যেমন বলছেন, হয়তো সুড়ঙ্গের শেষের আলোটা আমরা দেখতে পাব। কিন্তু তার আগের সময়টা খুবই যন্ত্রণাদায়ক হতে চলেছে।' কী রকম যন্ত্রণাদায়ক? ট্রাম্পের ভবিষ্যতবাণী হচ্ছে, খোদ আমেরিকাকে দুই থেকে আড়াই লাখ লোকের লাশ বইতে হতে পারে! ওটাই নাকি সেখানকার রক্ষণশীল হিসাব!
মৃত্যুর হার যাই হোক না কেন, এটা এখন পরিষ্কার আমেরিকার চিকিৎসা পরিকাঠামো এই আক্রমণের মুখে প্রস্তুত ছিল না। ভয় শুধু ট্রাম্প পাননি, সেদেশের প্রধান ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ডা. ফাউচি, যিনি সে দেশে সবচেয়ে সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি বলে পরিচিত, জনগণের রোষানল থেকে সুরক্ষা দিতে তার জন্য বিশেষ সশস্ত্র নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করতে হয়েছে।
আমেরিকা তার যে নৌ-সমরাস্ত্রযান দিয়ে গোটা দুনিয়াকে ভীত করে রাখে, সেই পারমানবিক অস্ত্র বহনকারী মার্কিন নেভি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থিওডোর রুজভেল্ট-এর ৭০ জন নৌ সেনা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। নেভি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থিওডোর রুজভেল্টের কমান্ডার কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লিখে উষ্মা প্রকাশ করেছেন এই বলে যে, আমরা এখন যুদ্ধে নেই। আমাদের নৌ সেনাদের তাই মরার কোনো যুক্তি নেই। যদি আপনারা যথাযথ ব্যবস্থা না নেন, তবে সমুদ্রেই আমাদের সেনাদের মরতে হবে। কমান্ডারের ভাষায়, ‘ডিসাইসিভ অ্যাকশন ইজ রিকোয়ার্ড’।
সবচেয়ে বড় সাবধান বাণীটা উচ্চারণ করেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহা পরিচালক টেড্রোস আডহ্যানম গেব্রিয়েসাস। সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘কোভিড ১৯-কে মহামারি ঘোষণার পর চার মাস হয়ে গেল। বিশ্বব্যাপী এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আসার কোনও নাম নিচ্ছে না, উল্টো হুড়মুড়িয়ে বাড়ছে সংক্রমণের সংখ্যা, বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। গত এক সপ্তাহে মৃতের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই সংক্রমণের সংখ্যা, ১০ লাখ ছুঁয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। মৃতের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০ হাজার।’
কাজেই এটা এখন পরিষ্কার, গোটা পৃথিবী এখন করোনার ভয়ালতম থাবার মুখে। বাংলাদেশেও আমরা তার ব্যতিক্রম নই। বলা হচ্ছে, ঘরবন্দী থাকাই এখন সবচাইতে বড় সুরক্ষা। অথচ মানুষ ঘরে থাকতে চাইছে না। এটা ঠিক, ঘরে থাকার অনেক সংকট আছে। সবার পক্ষে ঘরে আটকে থাকলে, ঘরের খাবার জুটবে না। কিন্তু এটাও ঠিক, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যে বিপদের সম্ভাবনা আমরা তৈরি করছি, তাতে পরিবারের, সমাজের, রাষ্ট্রের সবার জন্য বিপদের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ব্যাপকভাবে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বাড়লে আমাদের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তা বহন করতে সক্ষম নয়-এটা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
খোদ আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে করোনা যেভাবে নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে তাতে আমরা কোন ছার! আর দু সপ্তাহ ঘরে থাকলেই আমাদের বিপদ অনেকটা কমতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এবং আপাতত সেটাই সুরক্ষার একমাত্র পথ বলে ভাবা হচ্ছে।
কিন্তু বাঙালির পক্ষে ঘরে থাকা তো কঠিন! কেননা, নিয়ম মেনে ঘরে থাকা একটা কর্মসূচী। কর্মসূচী পালনের ক্ষমতা বাঙালির নেই। সে বরং উৎসবে মাততে উৎসাহী। বলা ভালো করোনা এমনিতেই আমাদের জীবনাচারের বিরোধী একটা অসুখ। আমরা বলেছি আমরা বিশ্বায়নে, গোলকায়নে বাস করতে চাই। সেটাই ছিল উন্নতি ও আধুনিকতার লক্ষণ। করোনা বলছে তার থাবা থেকে বাঁচতে হলে, দূরে থাকতে হবে। সামাজিক ও শারীরিক ডিসটেন্সিংই হচ্ছে এই রোগ থেকে বাঁচার উপায়। আইসোলেশনে যেতে হবে আমাদের। সঙ্গসান্নিধ্য নয়, সঙ্গ নিরোধ হচ্ছে করোনা থেকে বাঁচার উপায়।
দুই
বাংলাদেশে করোনায় সংক্রমণের সংখ্যা এখনও কম। এর একটা বড় কারণ হয়তো আমরা করোনা সন্দেহে পরীক্ষা করতে পেরেছি কম মানুষকে। অনেক বেশি মানুষকে পরীক্ষা করা সম্ভব হলে হয়ত সংক্রমণের সংখ্যা বাড়লেও বাড়তে পারে। বলা ভালো, বাংলাদেশের যে স্বাস্থ্যব্যবস্থা তৈরি হয়েছে তাতে সংক্রামিত ব্যাধি চিকিৎসার ব্যবস্থা সবচাইতে দুর্বল। করোনা আক্রমণের আগে যাদের মহাখালীতে অবস্থিত সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে যাবার সুযোগ পেয়েছেন তারা জানেন যে হাসপাতালটি অত্যন্ত অবহেলিত।
অন্যদিকে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার একটা বড় অংশীজন হচ্ছে বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত। মুনাফা ও বাণিজ্যনির্ভর বেসরকারি খাতে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসারও কোনো বিশেষ ব্যবস্থা নেই। ফলে করোনা আক্রমণের কারণে আমরা সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে যত হইচই করছি এর আগে সে বিষয়ে আমাদের কোনো পক্ষেরই কোনো আওয়াজ ছিল না। এখন করোনা বিষয়ে পরীক্ষা আর নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ের কারণে দেশব্যাপী আইইডিসিআর নামের প্রতিষ্ঠানটি পরিচয় পেয়েছে। এর আগে খুব কম সংখ্যক মানুষই এই প্রতিষ্ঠানের নাম শুনেছে। আমার বলার কথা হচ্ছে এই, সংক্রামক ব্যাধি মোকাবিলার সচেতনতা ও ব্যবস্থাদি কিংবা মনোযোগ কোনোকালেই আমাদের ছিল না। হয়তো আমরা প্রয়োজনও অনুভব করিনি। আজ করোনা আমাদের সেই দুর্বলতাকে সামনে এনেছে কেবল।
ফলে, করোনা ভাইরাস ব্যাপকভাবে সংক্রমিত হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা এই পরিকাঠামোর পক্ষে সত্যিই দুরূহ। তাই আমরা করোনাজনিত সংক্রমণের সংখ্যা বা তথ্য নিয়ে যত উদ্বিগ্নই হই না কেন, তার চেয়ে এখন বড় প্রয়োজন যার যার জায়গা থেকে নিজেদের ঘরে আটকে রাখা। আইসোলশনে থাকা। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা ধার করে বলি, ‘সব নির্দেশ মেনে চলুন, এখন জীবন-মরণের প্রশ্ন।’
পুনশ্চ: এই বিপদ কাটলে আমাদের সত্যি সত্যিই বিতর্ক করতে হবে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়ে। আমাদের বিতর্ক করতে হবে গবেষণা খাতে বিনিয়োগ ও বরাদ্দ নিয়ে। বিতর্ক করতে হবে উন্নয়নের মৌল প্রসঙ্গ নিয়ে।
শুভ কিবরিয়া: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক