নিজের হাতই আপনার সবচেয়ে বড় শত্রু
বাংলাদেশ আসলেই বিশ্বে অনন্য। বিশ্বের আরো অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও অঘোষিত লকডাউন চলছে। সরকার দুই দফায় টানা ১৭ দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে। এই ছুটি মানুষকে ঘরে রাখার জন্য। কিন্তু এরই মধ্যে কুষ্টিয়ায় ক্রিকেট খেলা নিয়ে সংঘর্ষে দুই জন মারা গেছেন। নারায়ণগঞ্জে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় এক ব্যবসায়ী মারা গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তুচ্ছ বিষয় নিয়ে পরপর দু্ইদিন দুইদল গ্রামবাসীর সংঘর্ষে অন্তত ৮০ জন আহত হয়েছে। এর আগে করোনাভাইরাস না আল্লাহর গজব এই বিতর্কে প্রাণ গেছে একজনের।
বিশ্বের লোকজন যদি এ সময়ে এই সংবাদ দেখে, আমাদের বীরের জাতির মর্যাদা দেবে। কিন্তু আসলে আমাদের লজ্জায় মুখ দেখানোর জো থাকবে না। সারাবিশ্বের মানুষ যখন করোনা আতঙ্কে কাবু, বিশ্ব যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটে ভুগছে, তখন বাংলাদেশে মারামারি করছে, খুনাখুনি করছে; এটা ভাবা যায়? আসলেই এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো কেউ।
বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলিম। এদের মধ্যে অল্পকিছু ধর্মান্ধ হলেও, অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ। তারা নিয়মিত ইসলামের বিধান মেনে চলেন। সম্ভব হলে মসজিদে গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করেন। মসজিদে নামাজের জামাত মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য বাড়ায়। মসজিদে সব মানুষ এক কাতারে মিলে যায়। কিন্তু কখনো কখনো তো পরিস্থিতির দাবি অন্যরকম থাকে। যেমন এখন মানবতার জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বিচ্ছিন্নতা। মানুষে মানুষে দুই মিটার অন্তত এক মিটার দূরত্ব এখন বাধ্যতামূলক। কিন্তু আমরা নিয়ম করে মসজিদে গিয়ে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করছি বরং করোনার ভয়ে কোথাও কোথাও মসজিদে ভিড় বেড়েছে। মসজিদে যে লোকসমাগম হচ্ছে তা এই মুহূর্তে বিপদজনক। সেজদা দেয়ার সময় ফ্লোর বা জায়নামাজ থেকে করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন আপনি। অবশ্য শুধু মসজিদ নয়, এই মুহূর্তে সব ধরনের লোক সমাগমই বিপজ্জনক।
অনেকে বলছেন, হায়াত মউত আল্লাহর হাতে, যতদিন বাঁচার, ততদিনই বাঁচবো। এটা ঠিক, কিন্তু তাই বলে তো আপনি চলন্ত ট্রেনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন না বা অসুস্থ হলে ঘরে বসে থাকবেন না। আল্লাহ বলেছেন, চেষ্টা করতে। সৌদি আরবে মসজিদ বন্ধ করা হয়েছে। হজ না হওয়ার মতো সিদ্ধান্তও বোধহয় নিতে যাচ্ছে সৌদি সরকার। অথচ বাংলাদেশের মসজিদে জামাত বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। থেমে নেই তাবলিগ জামাতের দাওয়াতি কার্যক্রমও। অনেকে বলছেন, আপনি না গেলে না যান, আমি যাবোই। বিপদটা যদি আপনার একার হতো, তাও আমি মৃদু হলেও আপত্তি করতাম। কিন্তু আপনার মসজিদে যাওয়াটা শুধু আপনাকে নয়, আমাদেরকেও বিপদে ফেলছে; আপনার কমিউনিটিকে ঝুঁকিতে ফেলছে। সরকার সরাসরি মসজিদে যাওয়ার কথা না করতে পারছে না। সকল আলেম-ওলামা, ইমামরা সাধারণ মানুষকে বিপদটা বোঝাতে পারেন। ঘরে থাকার উপকারিতাটা বলতে পারেন।
করোনার বিস্তার ঘটে একটা চেইনের মাধ্যমে। আপনি যত বাইরে যাবেন, লোক সমাগমে যাবেন; সেই চেইনটা শক্তিশালী হবে। যত বিচ্ছিন্ন থাকবেন, তত চেইনটা দুর্বল হবে। বেঁচে থাকলে সবাইকে নিয়ে আল্লাহকে ডাকার অনেক সুযোগ পাবেন। আপাতত ঘরে বসে একাই ডাকুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনার প্রার্থনা শুনবেন। ঘরে বসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ুন, তাহাজ্জুদ পড়ুন। আর মসজিদে যেতে হলে একেবারে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইন মানে এতেকাফে বসে যান। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। আর এই সময়ে ঘরে থাকাই হলো সবচেয়ে বড় দেশপ্রেম। দেশপ্রেমিক হোন, ঈমানদার হোন, ঘরে থাকুন।
অনেকেই ঘরে থাকাকে শাস্তি হিসেবে বিবেচনা করছেন। সারাদেশ অবরুদ্ধ হওয়ার আগের গল্প। আমার স্ত্রী মুক্তিকে তার সহকারী বলছিল, আফা, আমগো এলাকার এক লোগ বিদেশ থেইকা আইছে। পুলিশ হ্যারে ১৪ দিনের জেল দিছে। অথচ ঘরে থাকা বা কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন কোনোটাই কিন্তু শাস্তি নয়। ঘরে বন্ধ থাকতে আপনার ভালো লাগবে না নিশ্চিত। কিন্তু ভালো না লাগলেও বাসায়ই থাকতে হবে। এই ভালো থাকাটা আপনার জন্য, আপনার পরিবারের জন্য, আপনার স্বজনদের জন্য। সরকারের সাধারণ ছুটিকে যারা ক্রিকেট খেলা বা মারামারি করার উপলক্ষ্য বানিয়েছে, তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।
প্রথম কথা হলো, করোনায় বিচ্ছিন্ন থাকা এবং সতর্ক থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। কোনোভাবেই আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। বেসিক নিয়মগুলো মেনে চললে আপনার সংক্রমণের আশঙ্কা নেই বললেই চলে।
আপনার সবচেয়ে বড় শত্রু কিন্তু আপনি নিজেই। আমরা কথায় কথায় বলি অমুক তমুকের ডান হাত বা বিশ্বস্ত হাত। মানে হলো, হাতই আমাদের সবচেয়ে বড় অবলম্বন। কিন্তু এখন নিজের হাতই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। আসুন দেখে নিই কীভাবে। করোনা ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারে না। তাই আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্তত দুই মিটার দূরত্বে থাকলে আপনি ঝুঁকিমুক্ত। যেহেতু আমরা জানি না, কে সংক্রমিত, কে নয়; তাই আমাদের সবারই উচিত সবার কাছ থেকে অন্তত দুই মিটার দূরত্ব বজায় রাখা। এটাকে বলা হচ্ছে, সামাজিক দূরত্ব। মানে দূরে থাকলেও আমরা কিন্তু অসামাজিক হবো না। আমাদের শরীরে করোনাভাইরাস প্রবেশের রাস্তা মোট ছয়টি— মুখ, নাক, চোখ, কান এবং প্রস্রাব ও পায়খানার রাস্তা। শেষ দুটি স্থান আমরা সবসময় ঢেকে রাখি। তাই শরীরের বাকি চারটি অঙ্গের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যেহেতেু করোনা বাতাসে ভেসে থাকে না, তাই উড়ে এসে আপনার নাক-মুখ-চোখ-কান দিয়ে ঢুকে পড়ার কোনো সুযোগই নেই। তবে সাবধান থাকতে হবে। আপনি সারাদিন নানা জায়গায় হাত দেন- গাড়ির দরজা, বাসের হাতল, লিফটের বাটন, খাবার টেবিল, কম্পিউটারের কি-বোর্ড, বাসার দরজা। কোথাও থেকে করোনাভাইরাস যদি আপনার হাতের সংস্পর্শে আসে, আর আপনি যদি সেই হাত মুখে দেন, যদি কান চুলকান, নাক খোঁচান, চোখে হাত দেন; তাহলে ভাইরাসটি আরামসে আপনার শরীরে ঢুকে যেতে পারে। এজন্য আপনার সবচেয়ে বড় শত্রু হলো— আপনারই হাত।
এখন পর্যন্ত যেটুকু বুঝেছি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারলে ও নিজের হাত সামলে রাখতে পারলে করোনার ঝুঁকি একেবারেই কমিয়ে আনা সম্ভব। কোনোভাবেই নোংরা হাত মুখের কাছে আনা যাবে না। মুখে হাত দিতে হলে আগে হাত ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। হাতের যা বিপদজনক ভঙ্গির কথা বললাম, তার সবগুলো আমার ছিল। করোনা আসার পর অনেক কষ্টে হাত সামলে রেখেছি।
আমাদের এখন দুইটা দায়িত্ব- বাসায় থাকা ও হাত সামলে রাখা। বাধ্য হয়ে বাসার বাইরে যেতে হলেও মুখে একটা ভালো মাস্ক ব্যবহার করবেন এবং অবশ্যই হাত সামলে রাখবেন।
প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ