করোনায় বিশ্বব্যাপী কমেছে দূষণ
করোনা মহামারি হিসেবে আবির্ভূত হলেও ভূপ্রকৃতি ফিরে পাচ্ছে তার স্বাভাবিক প্রাণ। বিশ্বব্যাপী কমেছে মানব সৃষ্ট দূষণ। হ্রাস পেয়েছে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা।
করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বময় স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। দেশে দেশে করা হয়েছে লকডাউন। ফলে বন্ধ রয়েছে কলকারখানা, স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত। বাতিল হয়েছে লাখ লাখ ফ্লাইট। কমেছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। কার্বন নির্গমন কমার মাত্রা দশকের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা করছে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত হাজার টেবিলটক, সেমিনার, কনফারেন্স যা করতে পারেনি, ছোট্ট একটি ভাইরাস তা করে দিচ্ছে।
পরিবেশকর্মীদের মতে, প্রকৃতির সঙ্গে যখন বেশি অনাচার হয়, প্রকৃতিই তখন আপন গতিতে কোনো একটি বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে তার গতি প্রকৃতি ঠিক করে নেয়।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্যা গার্ডিয়ান জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ব নেতাদের গাফিলতিই বিশ্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন রুখতেও বিশ্বজুড়ে এমন কঠোর ও জরুরি পদক্ষেপ চান পরিবেশকর্মীরা।
বিশ্বের শীর্ষ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ চীনে গত দুই মাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ২৫ শতাংশ কমে গেছে বলে এক গবেষণায় জানিয়েছে ব্রিটিশভিত্তিক থিংকট্যাংক কার্বন ব্রিফ। সম্প্রতি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে চীনের বায়ুদূষণ কমে গেছে। বিশ্বব্যাপী ভূ-প্রকৃতি ফিরে পেতে শুরু করেছে আপন প্রাণ।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০০৮-০৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর প্রথমবারের মতো কার্বন নির্গমন হ্রাসের মাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। ফলে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়েও সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কার্যকর পদক্ষেপগুলোই পরিবেশের জন্য এ উপহার বয়ে নিয়ে আসছে। চিকিৎসকদের নির্দেশ মেনে দেশে দেশে প্রায় ৩০ কোটি শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজে যাচ্ছে না। দোকানপাট, অফিস-আদালত বন্ধ রাখা হয়েছে। লাখ লাখ ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। চীনের অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ। করোনার প্রভাবে জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পূর্বঘোষিত বহু অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে জেনেভার মোটর শো এবং হিউস্টনে বার্ষিক তেল ও গ্যাস নির্বাহীদের কেরাউইক সম্মেলন। বন্ধ করা হয়েছে শাংহাইয়ের ফর্মুলা ওয়ান কার রেসিং।
এদিকে, বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে দেশগুলো লকডাউন থাকায় পুরো ইউরোপের বাতাসে দূষণের মাত্রা অনেক কমে গেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড (NO2) তার গতিপথ পরিবর্তন করেছে। এ কারণে বাতাসে দূষণের মাত্রা কমতে শুরু করেছে। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে মূলত বাতাস এত দূষিত হয়ে পড়ে।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এ ভাইরাস ঠেকাতে বিশ্বের নানা দেশ লকডাউনের ব্যবস্থা নিয়েছে। এ কারণে এসব দেশে যান চলাচল ও কলকারখানা প্রায় বন্ধ। গৃহবন্দী বহু মানুষ। বাইরে মানুষের চলাফেরাসহ অন্যান্য তৎপরতা এক রকম বন্ধ হওয়ায় বাতাসে দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, করোনাভাইরাস ঠেকাতে নানা দেশে লকডাউন জারি করা হয়েছে। এ কারণে যানবাহন চলাচল ও নানা ধরনের কলকারখানা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বাতাসে দূষণের মাত্রা কমে যাচ্ছে। প্রতিদিন বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইডের পরিবর্তন ঘটছে। পুরো আবহাওয়ার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে। বাতাস তার দিক ও গতি পরিবর্তন করছে।
এদিকে সারা বিশ্বের পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ রোধে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ছুটি থাকায় কার্যত অচল সারা দেশ। যানবাহন চলছে না। কলকারখানাও বন্ধ। নিজ ঘরে সময় কাটাচ্ছে মানুষ। চারদিকে নেই ধুলাবালু কিংবা ধোঁয়ার রাজত্ব। এ সুযোগে নিজের রূপের জানান দিচ্ছে প্রাণ ও প্রকৃতি। পাখির কিচির মিচিরে মুখরিত থাকছে দিনের বেশিরভাগ সময়। গাছে গাছে ফুটেছে রকমারি ফুল। বাতাসে ভাসছে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। সাগরে ফিরেছে শুশুক। ২৯ মার্চ রোববার দুপুরে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর বায়ুমান সূচক (একিউআই) ইনডেক্সে সূচকের মান ছিল ৮০। যদিও পরিবেশ অধিদফতরের মানমাত্রায় ৫০ একিউআইকে স্বাভাবিক বায়ু বলা হয়। রাজধানীসহ সারদেশে যা কল্পনা করাও দায় ছিল।
জলবায়ু পরিবর্তন জনিত বিপর্যয় মোকাবিলায় এ শিক্ষাকে কাজে লাগানোর জন্য করোনা দুর্যোগ মানব জাতিকে একটা সুযোগ করে দিয়েছে। কক্সবাজারে পর্যটকদের ভিড়, ট্রলার, স্টিমারের চলাচলে শুশুক সাগর তীরে আসত না। এখন সাগর শান্ত। সমুদ্র পাড়ের পরিবেশ কোলাহল মুক্ত। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যেমন মেট্রোরেল কিংবা কাটা খোড়া সড়ক প্রকল্পগুলো এখনো চলমান কিংবা স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। এসব জায়গা থেকে ধুলা উড়ে বাতাসে মেশায় এখনো সন্তোষজনক অবস্থায় আসছে না বায়ুর মান। লকডাউন বাদে অন্য সময়েও সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে বায়ুর মান ভালো রাখা যায়। সেক্ষেত্রে পরিকল্পনা মাফিক আমাদের কাজ করতে হবে। পরিবেশের সুরক্ষা হয় এমনভাবে উন্নয়ন কাজগুলো করতে হবে। ঢাকার চারপাশের ব্রিক ফিল্ডগুলো সরাতে হবে। ব্যক্তিগত যানবাহন কমিয়ে গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
এদিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গত এক দশকে বিশ্বের নানা প্রান্তে দুই কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জানিয়েছে দারিদ্র্য বিরোধী দাতব্য সংস্থা অক্সফাম। সংস্থাটির সর্বশেষ গবেষণায় এ পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। গবেষকরা বলছেন, বেশিরভাগ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও দাবানলের কারণে। গত মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ফনির কারণে বাংলাদেশ ও ভারতে ৩৫ লাখ মানুষ ঘর-বাড়ি হারিয়েছে।
জাতিসংঘের উদ্যোগে স্পেনের মাদ্রিদে কপ-২৫ লিডার্স সামিট শুরুর আগে অক্সফাম তাদের গবেষণা প্রতিবেদন হাজির করেছে। এতে ২০০৮ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির শিকার হওয়া মানুষের কথা উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যুদ্ধে যত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, তার তিন গুণেরও বেশি মানুষ ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে বন্যা ও দাবানলে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ সারা পৃথিবী জুড়ে বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে ইতিবাচক বা মন ভালো করার মতো খবর পাওয়া কঠিন। কিন্তু ভালো খবর যে একেবারেই নেই তা নয়। করোনা সংকটের ইতিবাচক দিক হচ্ছে লকডাউন শহরগুলোতে দূষিত বাতাস এখন আবার নিরাপদ, বহমান নদীর জল তার গুণগত মান ফিরে পাচ্ছে, ইতালির উপকূলে আবার ডলফিন খেলা করছে, শহরের শব্দ দানব এখন বন্দী, পাখিরা ফিরে আসছে। এক কথায়, আমরা প্রকৃতির কাছ থেকে যা কেড়ে নিয়েছি, এবার যেন তা ফেরত দেওয়ার সময় এসেছে। ‘সংযত হও, অন্য প্রজাতিদের তাদের বাস্তুতন্ত্র ফিরিয়ে দাও’— এটাই করোনা সংকটের শিক্ষা।
বিল্লাল বিন কাশেম: কবি, লেখক ও গল্পকার