দিনমজুরদের কথা ভাবতে হবে

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

সঙ্গরোধের প্রায় কুড়ি দিন হতে চলল। আর ক'দিন এভাবে যাবে, তা আমাদের জানা নেই। শুধু আমরা কেন, পুরো পৃথিবীর মানুষই আজ ঘরবন্দী। খবরে দেখলাম, চীনের মানুষ একটু একটু করে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। তারা আমাদের অন্তত দুই মাস আগে থেকেই ঘরবন্দী।

কবে আমরা স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ফিরতে পারব, সেটাই প্রশ্ন। বাঁচতে হলে আজ না হয় কাল ঘর থেকে বের হতেই হবে। আশা করি, তার আগেই করোনার এই কালো মেঘ কেটে যাবে।

বিজ্ঞাপন

কাজই জীবন। কার্যত লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই দিনমজুর, নিম্ন আয়ের মানুষ, পোশাক শ্রমিকরা ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি গিয়েছে। একটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে তারা আবার ঢাকার পথে আসতে শুরু করেছিল। এসেও পড়েছিল অনেকে। মাঝপথে আবার তাদের বাড়ি ফিরে যেতে বলা হয়েছে। আসলে এই যে তাদের আসা-যাওয়া সবই রুটি-রুজির গরজে, পেটের দায়ে। পেটের দায় সবারই আছে। মালিকেরও আছে, শ্রমিকেরও আছে। দীর্ঘ মেয়াদে সবাইকেই ভুগতে হয়।

দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ায় মানুষের মনে একটা অজানা ভয় ও আতঙ্ক নেমে এসেছে। প্রথমে স্কুল-কলেজ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হলো। এদিকে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ল বাজারে। ঈদেও এতো কেনা কাটা হয় না। যারা সপ্তাহের বাজার করে, তারা মাসের বাজার করল, যারা মাসের বাজার করে, তারা তিন মাস, ছয় মাসের বাজার করে রাখল। এর ভালো মন্দ নিয়ে কথা না হয় নাই বললাম। কিন্তু এভাবে কি এই মহাসংকট মোকাবিলা করা যায়? বসে বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়। রাজ্যও হয় দেউলিয়া।

বিজ্ঞাপন

ধনী রাষ্ট্র আমেরিকাও তাই আজ বিভিন্ন প্রণোদনা দিচ্ছে, আমাদের মতো গরিব দেশও প্রণোদনা দিচ্ছে। যদিও আমরা নিজেদের গরিব বলে স্বীকার করি না। আমরা উন্নয়নশীল দেশ। এমনকি অনেক উন্নত দেশকেও আমরা ছাড়িয়ে গেছি। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যে এই প্রণোদনা যাদের হক, তারাই পায় না। তারা রয়ে যায় এসব প্রণোদনার বাইরে। এই সব প্রণোদনা পায় বিভিন্ন সেক্টরের মালিক পক্ষ। প্রান্তিকরা প্রান্তিকই রয়ে যায়।

আমাদের সার্বিক জীবন যাত্রায় করোনার প্রভাব আজ দৃশ্যমান। উৎপাদন ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থাও অস্থির, অস্বাভাবিক। এভাবে চললে অর্থনীতির চাকাও ধীরগতির হয়ে যাবে। ভোগ বিলাস তো অনেক পরের কথা, আলু খেয়েও দিন কাটানো কঠিন হয়ে যাবে।

বন্যা, খরা, মহামারি এসব বালা-মুসিবত সচরাচর একটি–দু’টি দেশে বা অঞ্চলে হানা দেয়। এবার হানা দিয়েছে বিশ্বব্যাপী। করোনা এখন বৈশ্বিক মহামারি। এ মহামারিতে গোটা দুনিয়া তিন মাস ধরে নাস্তানাবুদ। এখন প্রায় সব দেশেই চলছে লকডাউন। কলকারখানা বন্ধ। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। এ অবস্থা বেশি দিন চললে অর্থনীতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে বলেই মত অর্থনীতিবিদদের।

আমাদের দেশটা ছোট, অর্থনীতিও ছোট। কিন্তু মানুষের ভারে ন্যুব্জ। এর ওপর অনেক মানুষ বেকার। যারা চাকরি করেন, তারা কোনো রকম বেঁচে বর্তে আছেন। কেউ দিন আনে দিন খায়, কেউ মাস আনে মাস খায়। অনেকেই মাসকাবারি চাকরি করতে পারেন না। তারা দিনমজুর। প্রতিদিন রিজিকের সন্ধানে বের হয়ে সন্ধ্যায় ফেরেন।

পোশাক শ্রমিকরা কারখানায় কাজ করেন আর প্রবাসীরা দেশে রেমিটেন্স পাঠান। মোটামুটি ওদের ওপরই দেশের অর্থনীতি পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। দেশের অর্থনীতির চাকা তারাই সচল রেখেছেন। খবরে দেখলাম, কয়েকটি দেশ তাদের দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ফেরত নিতে চাপ দিচ্ছে সরকারকে। যদি শেষেমেষ তাদের ফিরিয়ে আনতেই হয়, তবে তা আমাদের বেকার সমস্যার ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করবে। বোঝার ওপর শাকের আঁটিটাও ভারী। যদি রেমিটেন্স আসা বন্ধ হয়ে যায় বা হ্রাস পায়, তবে তা অর্থনীতির ওপরও আঘাত। সব মিলিয়ে আগামী দিনে সামাজিক শৃঙ্খলার ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

যারা কাজ করেন বা চাকরি করেন, তাদের বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে কাজ করেন। তাদের অংশ শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি। এরা কেউ চাষাবাদ করেন, কেউ পশুপালন করেন। বাকিরা রিকশাচালক, পরিবহন শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, রেস্তোরাঁ শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহকর্মী, দারোয়ান-ড্রাইভার, হকার, চায়ের দোকানদার ইত্যাদি। এরা রাষ্ট্রের প্রণোদনার হিসেবের বাইরে। সমাজে এরা দৃশ্যমান, কিন্তু রাষ্ট্রের কাছে অদৃশ্য। বলা যায়, তারা অনিবন্ধিত বা ভ্রাম্যমাণ শ্রমিক। তাদের চাকরির ও কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাদের নেই তেমন কোনো সঞ্চয়ও। সুরক্ষিত জীবন তাদের কপালে নেই। অর্থনৈতিক দূরবস্থার প্রথম ঝাঁকিটি আসবে তাদের ওপরই। কিন্তু এ রাষ্ট্র জানবে না তারা কারা। কাজেই তাদের কথা আমাদের ভাবতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী দিনমজুর ও মধ্যবিত্তদের তালিকা করতে বলেছেন। এটি শুভ উদ্যোগ। তিনি যারা যারা হাত পাততে পারবেন না, সাহায্য চাইতে আসবেন না, মুখ বুজে কষ্ট সহ্য করবেন, তাদের কথাও ভেবেছেন। তিনি সবার তালিকা করার নির্দেশ দিয়েছেন। ১০ টাকা কেজির চাল বিতরণ ও বিনামূল্যে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার কথা তিনি বলেছেন। এছাড়া বিদ্যমান বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিও বহাল রাখার কথা বলেছেন। এসবই সময়োপযোগী উদ্যোগ। এর সঠিক
ব্যবহার করতে হবে। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা এই দায়িত্ব ইমানের সঙ্গে পালন করলে মানুষ উপকৃত হবে। কিন্তু এর রাজনৈতিক ও স্বজনপ্রীতিমূলক ব্যবহার কোনো কাজে আসবে না। এ বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। এসব তালিকায় যেন এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বর, মেয়রদের ভায়রা ভাই, শালীর ননদ জামাইরা না ঢুকে পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আবার তারা দুস্থ ও দিনমজুর হলে, তাদের হক যেন নষ্ট না হয়, সেটাও দেখতে হবে।

লকডাউনে অনেকে ঘরে বসে কাজ করছেন। কিন্তু সব কাজ ঘরে বসে করা যায় না। নেট দুনিয়ায় সব কিছুই অনলাইনে সম্ভব না। রিকশা চালাতে হলে রাস্তায় নামতে হয়। পান-বিড়ির দোকানদারকে ফুটপাতেই বসতে হয়। কিন্তু তাদের কাজের ওপরই নির্ভর করে আমাদের দেশের কোটি কোটি লোকের জীবন ও জীবিকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতেই প্রায় আড়াই কোটি লোক মজুরি বা বেতনের ভিত্তিতে কাজ করেন। তাদের মধ্যে দিন মজুর আছেন প্রায় এক কোটিরও বেশি। এছাড়া পোশাক শিল্পে নিয়োজিত আছেন ৪০ লাখের মতো শ্রমিক। এর বাইরে আছেন আরও ৫০ লাখ শিল্প শ্রমিক। এর বাইরে স্বনিয়োজিত কাজ করছেন অসংখ্য মানুষ। তারা সবাই আজ বেকার। তাদের রুজি নেই তো রুটিও নেই। প্রথমে তাই তাদের পাতেই খাবার তুলে দিতে হবে। এর বাইরে একটি শ্রেণির মানুষ আছেন, যারা খাবার চাইতে পারেন না, তাদের কথাও ভাবতে হবে। সরকার ও বেসরকারি সাহায্যের হাত সবার জন্যই বাড়িয়ে দিতে হবে।

দীর্ঘ মেয়াদী লকডাউন গুরুতর খাদ্য সংকটের কারণ হিসেবে দেখা দেবে। অর্থনীতির ওপর চাপতো পড়বেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ নিয়ে সরকারকে আগে থেকেই ভাবতে হবে। সর্বত্র সমন্বয়হীনতা আজ প্রকট। অতিদ্রুত এসব দূর করতে হবে। মনে রাখতে হবে জাতি আজ এক মহাসংকটকাল অতিক্রম করছে। সবাইকে নিয়েই এর মোকাবিলা করতে হবে। সবাইকেই সবার কথা ভাবতে হবে।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কলামিস্ট