করোনা: নন ফার্মাসিউটিক্যাল কৌশলই একমাত্র অবলম্বন

  • প্রফেসর ড. মু. আলী আসগর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

অ্যাডভ্যান্সেস ইন ভাইরাস রিসার্চ জার্নালের গবেষণা অনুযায়ী করোনাভাইরাস হচ্ছে আবরণ বিশিষ্ট RNA ভাইরাস পরিবারভুক্ত যা মূলত মানুষের শ্বসনতন্ত্রে (ফুসফুস ইত্যাদি) সংক্রমণ করে। RNA অর্থ Ribonucleic acid। মানুষের রোগের জন্য দায়ী সাতটি করোনাভাইরাসের মধ্যে কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাস সার্স-কোভ-২ হচ্ছে সপ্তম প্রজাতি। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনের গবেষণা অনুযায়ী, চারটি করোনাভাইরাস- 229E, OC43, NL63, ও HKU1 মানুষের জন্য অল্প ক্ষতির কারণ হলেও, অন্য তিনটি করোনাভাইরাস -SARS-CoV (severe acute respiratory syndrome coronavirus), MERS-CoV (Middle East respiratory syndrome coronavirus) ও সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ বৈশ্বিক মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-COV-2 (severe acute respiratory syndrome coronavirus-2) মানুষের মারাত্মক অসুস্থতার কারণ হিসেবে বিবেচিত।

SARS-CoV ভাইরাস ২০০২-২০০৩ সালে চীনের গুয়াংডং প্রদেশে ও MERS-CoV ভাইরাস ২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্যে মহামারি সৃষ্টি করেছিল (সূত্র: ল্যানসেট জার্নাল এবং দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন)। চায়না সিডিসি (চাইনিজ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন) এর গবেষকদের গবেষণা অনুযায়ী নতুন সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি সুস্থ ব্যক্তির ফুসফুসের বাতাস নির্গমন পথ এবং মিউকাস পর্দায় গিয়ে এপিথেলিয়াল কোষকে তীব্রভাবে আক্রমণ করার কারণে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশাল সংখ্যক মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীনের যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, চীনের উহান শহরে আক্রান্তদের ১৩.৮% মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছিল এবং মারাত্মকভাবে আক্রান্তদের শ্বসনতন্ত্রের এপিথেলিয়াল কোষের রিসেপ্টরে ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ রোগের প্রধান সাধারণ উপসর্গগুলো হচ্ছে- জ্বর, ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট ও শুষ্ক কাশি।

ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV ও ২০১৯-২০২০ সালের মহামারি কোভিট-১৯ এর ভাইরাস SARS-COV-2 এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ জেনেটিক সম্পর্ক আছে। করোনাভাইরাসের বাইরের আবরণে স্পাইক প্রোটিনগুলো একত্রিত হয়ে মুকুটের মত ট্রাইমারস গঠন করে। তবে করোনাভাইরাস, SARS-CoV ও SARS-COV-2 এর বাইরের আবরণের ‘স্পাইক’ প্রোটিনের গঠনে পার্থক্য রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কোভিড-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাসের বাইরের আবরণের স্পাইক প্রোটিনগুলো ২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশি সন্নিবিষ্ট হওয়ায় সার্স-কোভ-২ ভাইরাস দ্বারা মানুষের দেহের কোষগুলো দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত হওয়ার ফলে কোভিড-১৯ রোগ আক্রমণ ও বিস্তারের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে (সূত্র: ন্যাচার জার্নাল)। অধিকন্তু, সংক্রমণের সময় সার্স-কোভ ও সার্স-কোভ-২ উভয় ভাইরাসই স্পাইক প্রোটিনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন (receptor-binding domain) এর মাধ্যমে মানুষের কোষের একই রিসেপ্টর ‘hACE 2/এইচএসিই ২’ (হিউম্যান এনজিওটেনসিন-কনভার্টিং এনজাইম ২) তে সংযুক্ত হলেও, এইচএসিই ২-তে সংযুক্ত হওয়ার জন্য উভয় ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের দুইটি hotspots (হটস্পটস), hotspot-31 (হটস্পট-৩১) ও hotspot-353 (হটস্পট-৩৫৩) এর গঠনে ভিন্নতা আছে। সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের দুইটি হটস্পটস, সার্স-কোভ এর দুইটি হটস্পটস এর তুলনায় মানুষের (হোস্ট) কোষের এইচএসিই ২ এর সঙ্গে বন্ধনে অধিকতর নিবিড় ও স্থিতিশীল। কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসের রিসেপটর-বাইন্ডিং ডোমেনের হটস্পটগুলোর ভিন্ন গঠনের কারণে হোস্ট কোষের এইচএসিই-২’কে তীব্রভাবে আকর্ষণের মাধ্যমে দ্রুত সংক্রমণ ও বিস্তারে প্রধান ভূমিকা রাখছে (সূত্র: ন্যাচার জার্নাল)।

২০০২-২০০৩ সালের মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাস SARS-CoV মূলত শ্বসনতন্ত্রের নিম্নাংশে অর্থাৎ ফুসফুসে আক্রান্ত করলেও, কোভিট-১৯ রোগের জন্য দায়ী ভাইরাস শ্বসনতন্ত্রের উভয় অংশে, উচ্চাংশে অর্থাৎ গলায় এবং নিম্নাংশে অর্থাৎ ফুসফুসে সংক্রমণ ও বংশবিস্তার ঘটায় (সূত্র: ন্যাচার জার্নাল এবং নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন)।

কোভিড-১৯ রোগ সংক্রান্ত চীনের শীর্ষ গবেষক গাও এর মতে সামাজিক শিষ্টাচার/শারীরিক দূরত্ব (social distancing) যে কোনো সংক্রমণ বিশেষভাবে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অত্যাবশ্যকীয় কৌশল (সূত্র: ২৭ মার্চ ২০২০ তারিখের যুক্তরাষ্ট্রের সায়েন্স নিউজ পেপার)। কোভিড-১৯ রোগের কোনো মেডিসিন ও ভ্যাকসিন না থাকায় বর্তমানে বিশ্বের সকল আক্রান্ত দেশই নিম্নলিখিত ননফার্মাসিউটিক্যাল কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে এই রোগকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে।

১। সাবান/হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে ঘন ঘন হাত পরিষ্কার
২। মুখে ও নাকে মাস্ক ব্যবহার
৩। মানুষদের নিরাপদে সামাজিক শিষ্টাচার/ শারীরিক দূরত্ব বা কোয়ারেন্টাইনে রাখা
৪। গণ জমায়েত পরিহার

কোভিড-১৯ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করায় সম্প্রতি বেশ কিছু দেশ লকডাউনের মত ননফার্মাসিউটিক্যাল কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে কোভিড-১৯ রোগটি আবির্ভূত হলে দেশগুলোর জনগণ মাস্ক না ব্যবহার করায় রোগটি বৈশ্বিক মহামারিতে পরিণত হয়। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের "বড় ভুল" ছিল বলে মনে করেন চীনের শীর্ষ গবেষক গাও। ইউ এস সার্জন জেনারেল (যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ডাক্তার) জেরম এডামস যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণকে মাস্ক "অপ্রয়োজনীয়" বলে না পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন (সূত্র: সিএনবিসি)। ইউএস সার্জন জেনারেল শুধুমাত্র স্বাস্থ্যকর্মীদের মাস্ক পড়ার পক্ষে ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেলে ইউএস সার্জন জেনারেল এডামস ২ এপ্রিল ২০২০ তারিখে সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন) এর কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন পূর্বের সুপারিশ প্রত্যাহার করে সকল জনগণকে বাইরে মাস্ক ব্যবহারের সুপারিশ করতে। কারণ এই ভাইরাস মূলত দুইভাবে- থুতু/হাঁচি/কাশির তরল ড্রপলেট এবং সংস্পর্শের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়।

প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসটি উচ্চ তাপমাত্রায় ও বাতাসের জলীয় বাষ্পে দুর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয় দেশের গবেষণায় দেখা গেছে ভাইরাসটি বিভিন্ন পৃষ্ঠের ওপর ধ্বংস রোধক।

ডায়াগনস্টিক টেস্টের মাধ্যমে কোভিড-১৯ রোগের ভাইরাসের পরীক্ষা করে আক্রান্ত মানুষকে বিচ্ছিন্ন রাখাটা এই মহামারি প্রতিরোধের চাবিকাঠি। কোভিড-১৯ কে শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যদি সংক্রমণের উৎস দূরীভূত করা যায়।

প্রফেসর ড. মু. আলী আসগর: অধ্যাপক, ক্রপ সায়েন্স ও টেকনোলজি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়