করোনা অর্থনীতিতে সরকারের ঋণ নির্ভর প্রণোদনা
বিশ্ব আরেকটি মহামন্দার দিকে এগিয়ে চলছে বলেই মনে হয়। বৈশ্বিক মহামারির এ সময়ে বিশ্বের শক্ত অর্থনীতিগুলো কেমন কম্পন অনুভব করছে তা সহজেই অনুমেয়। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছে। কোনো কোনো জরিপ বলছে যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্ব হার ৩০% এ গিয়ে ঠেকতে পারে যা কিনা ১৯৩০ এর মহামন্দার চেয়েও বেশি।
চীনে প্রায় ৫ লাখ প্রতিষ্ঠান স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। নির্বিঘ্নে এগিয়ে চলা চীনের অর্থনীতি ১৯৭৬ সালের পর প্রথমবারের মত সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। বিশ্ববাজারের সার্বিক আয়তন সংকুচিত হয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। বিশ্বের ৩৩০ কোটি কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি কোনো না কোনোভাবে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত। আইএলও’র তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) আরব বিশ্বে ৫০ লাখ, ইউরোপে ১ কোটি ২০ লাখ, এবং এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ১২৫ কোটি পূর্ণকালীন শ্রমিকের কাজের সমান কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে। এমন মহাপ্লাবন আরেকটি মহামন্দার ইঙ্গিত দিচ্ছে কোনো সন্দেহ নেই।
অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশকেও এ ধকল সামাল দিতে হবে। বাংলাদেশের জিডিপি সংকুচিত হতে পারে এমনই আভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য প্রায় ৫% হ্রাস পেয়েছে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনসহ বেশ কটি মেগাপ্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ। রেমিটেন্স প্রবাহে ব্যাপক ধ্বস। ইতোমধ্যে দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতের প্রায় ১.৫ কোটি শ্রমিক কর্ম হারিয়ে অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।
সদাব্যস্ত সড়ক মহাসড়ক বর্তমানে জনমানবশূন্য। অর্থনীতি স্থবির। জীবন রক্ষাই যেন এখন মুখ্য। চারদিক যখন সুনসান পরিস্থিতি, যখন ঘরে বসে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার প্রহর গুনছে ঠিক এমন সময় সরকারপ্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করলেন যা অভ্যন্তরীণ দেশজ উৎপাদনের ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। উক্ত প্রণোদনার মূল উদ্দেশ্য সরকারি ব্যয়, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং অর্থের জোগান বৃদ্ধি করা। যে উদ্দেশে উক্ত কর্মসূচী তা বাস্তবায়ন সফল হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আসন্ন মন্দা কিংবা মহামন্দার যাঁতায় একেবারে পিষে যাবে না।
প্রণোদনাকে সফল করতে বেশ সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এ প্রণোদনার সুফল অর্জনের জন্য সরকারকে চালকের আসনে থাকতে হবে। দল অথবা গোষ্ঠী পক্ষপাত বর্জন করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবসা উন্মুক্ত করা যাবে না। চলতি পাঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দ্বিবার্ষিক করোনা পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে।
সর্বমহলে একটি শঙ্কা রয়েছে প্রণোদনার অর্থ যদি এলিট শ্রেণির হাতে চলে যায় তবে প্রকল্পটি ভেস্তে যাবে। একইসাথে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান আরও বৃদ্ধি পাবে। সাধারণত ক্ষুদ্রায়তন শিল্পকারখানা ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বন্ধক সমস্যায় পতিত হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে সন্তোষজনক নগদ প্রবাহের ওপর ভিত্তি করে তাদের ঋণ ও আর্থিক প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যেসব প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার মত নয় তাদেরকে ঋণ দেয়া যাবে না। যেসব প্রতিষ্ঠান করপোরেট সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ, যাদের ভালো করপ্রদান ইতিহাস রয়েছে তাদেরকে ঋণ প্রদান করা যেতে পারে। সরকারের আপদকালীন গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজস্ব ও আর্থিক কর্তৃপক্ষের নিবিড় সমন্বয় থাকা চাই।
উল্লেখ্য, ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার পুরো ভার সরকারের ওপর বর্তাবে না। ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ব্যবস্থা হতে ঋণ আকারে অর্থনীতিতে প্রবেশ করবে। তন্মধ্যে বড় মাপের শিল্পকারখানা কেবলমাত্র ৪.৫% সুদহারে ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ পাবে। উক্ত ঋণের জন্য সরকার সমহারে সুদ প্রদান করবে যার মোট পরিমাণ প্রথম বর্ষে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। কৃষি, দুগ্ধখামার, পোল্ট্রিসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ব্যাংক হতে ৪% সুদে ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণ সংগ্রহ করতে পারবে যেখানে সরকার ৫% হারে সর্বমোট ১ হাজার কোটি টাকা সুদভর্তুকি প্রদান করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে।
তাছাড়া রপ্তানি খাত উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে স্বল্পসুদে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ঋণ প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিমের অধীনে ৭% সুদে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ জোগান দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। করোনা ক্ষতিগ্রস্ত তৈরি পোশাক শ্রমিকদের বেতন ভাতা পরিশোধের জন্য ইতিপূর্বের ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনাসহ পুরো প্রকল্পটি অনেকটা ঋণ নির্ভর। হিসেব কষে দেখা যায় যদি সব ঋণ অর্থনীতিতে প্রবাহিত হয় তবে সরকার প্রথম বছর ঋণের সুদ বাবদ পরিশোধ করবে ৩ হাজার কোটি টাকার মত। প্রকৃত বিবেচনায় এটাই প্রণোদনার পরিমাণ।
প্রশ্ন হলো, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলো যেখানে তারল্য সংকটে ভুগছে সেখানে বিশাল অংকের ঋণ সরবরাহ কতটা সহজ হবে? এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কম সুদে বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে ঋণ প্রদান করতে পারে। ইতোমধ্যে সরকার সি আর আর, এস এল আর, ব্যাংক সুদের হার কমিয়েছে। পরিমাণগত সহজিকরণের আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিকট থেকে ট্রেজারি বিল, বন্ড ক্রয়ের মাধ্যমেও অর্থের যোগান বৃদ্ধি করতে পারে। সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট থেকে ঋণ নিতে পারে। যেভাবেই হোক বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন কারা ঋণ নিচ্ছে সেদিকটাতে। চিরাচরিত ঋণখেলাফিরা যদি এ টাকাতে ভাগ বসায় তবে পুরো প্রণোদনা ব্যর্থ হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী ঋণের সুবিধা না পেয়ে বরং এলিট শ্রেণির পোয়াবারো হবে। এতে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়ে সংকট তীব্র হবে।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত বিশাল জনগোষ্ঠীর দুর্দশা মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ নেই। ভিক্ষুক, কাজের বুয়া, টোকাই, ফেরিওয়ালা, দিনমজুর, ঠেলাচালক, রিকশাচালক, মোটরগাড়িচালক, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, দোকানকর্মী যারা দিনে এনে দিনে খায় এমনসব প্রান্তিক মানুষগুলো বর্তমানে আয়শূন্য। এসব নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ১০ টাকা কেজিতে চাল সরবরাহের আওতা বৃদ্ধি আবশ্যক। পাশাপাশি চাল চুরির হিড়িক কঠোর হস্তে দমন জরুরি। প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের কোনো সুযোগ যাদের নেই তাদের জন্য হেলিকপ্টার মানি স্কিম প্রবর্তন করা যেতে পারে। এলাকাভিত্তিক স্বনামধন্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি, বেসরকারি সংস্থা এবং যুবসমাজকে কাজে লাগিয়ে প্রান্তিক মানুষের তালিকা তৈরি করে তাদের হাতে নগদ অর্থ পৌঁছাতে পারলে অর্থনীতিতে চাহিদা ঘাটতি হবে না। পাশাপাশি কৃষি ও শিল্প জোগান সুসংহত থাকলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থেকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ন্যূনতম থাকবে আশা করা যায়।
ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়