ঘরের শান্তি, বাইরের ভাইরাস
কী দিন কী রাত, ২৪ ঘণ্টাই খবর। ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট বা সম্প্রচার সাংবাদিকদের ছোটাছুটি। দেশে সংবাদ ভিত্তিক টেলিভিশনগুলো এখন শীর্ষে। নিউজরুম ও মাঠ সচল ঝুঁকির পরও। ঘরে বসে গেলো এক মাসে অধিকাংশ মানুষ টেলিভিশন দেখছেন, মেটাচ্ছেন তথ্যের ক্ষুধা। দেখছেন অনলাইন পোর্টালগুলোও। বরাবরের মতো অনলাইন মাধ্যমগুলো দুরন্ত গতিতে আপডেট দিচ্ছে। অধিকাংশ খবর পরিবেশিত হচ্ছে মাল্টিমিডিয়া ধাঁচে। কিন্তু টেলিভিশন থেকে তাদের পার্থক্য হলো, সংকট সময়ে কাজের পদ্ধতিতে। ঘরে বসেই অনলাইনের জন্য কাজ করা যাচ্ছে, অফিসে বহু মানুষের সমাগম হচ্ছে না একসঙ্গে। এটা তাদের কিছুটা হলেও চাপ মুক্ত করেছে। কয়েকটি বাদে অধিকাংশ পত্রিকা বন্ধ। তারাও অনলাইন নির্ভর। চলছে বাসা থেকেই নিউজ আপলোড, প্রতিবেদন তৈরি।
সম্প্রচার সাংবাদিকদের ঝুঁকি এ সময়টায় সবচেয়ে বেশি। এ অবস্থায় সাংবাদিকতার ধরন-ধারণাও বদলেছে। সেফটি ফর জার্নালিজমের সময় এখন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানে সাংবাদিক হানা মেস এ নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। কীভাবে সাংবাদিকরা কোভিড-১৯-এর সময়টায় কাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছেন, তাই তুলে ধরেছেন তিনি।
দেশে দেশে যখন করোনায় মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন, তথ্য গোপনের পাঁয়তারা চলছে রোজ, তখনই প্রতিবারের মতো বুক চিতিয়ে লড়ছেন সাংবাদিকরা। আমাদের দেশে তো করোনার ত্রাণের চাল-তেল-নানা পণ্য চুরি নিয়েও সংবাদ করতে হচ্ছে। যদিও সেই সংবাদের ভিত্তিতে কতটুকু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন।
সাংবাদিকতা না থাকলে করোনায় মৃত্যু আরও বেশি হতো, যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম মিরর ইউকে’তে কলামে এ কথা বলা হয়। সাংবাদিকতা ছাড়া গুজব লাগামহীন হয়ে পড়তে পারে- তাও বলা হয়। দেশের গুজবের পরিস্থিতিও আমরা জানি। পুলিশ হয়ত তার ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করতে পারে। মানুষ হয়ত মনের আনন্দে সৈকতে ছুটে যাবে, এতে ঘটবে আরও সংক্রমণ, আরও মৃত্যু- এসব বিষয়ও উঠে এসেছে প্রবন্ধটিতে।
করোনার মৃত্যু কি সাংবাদিকদের ছাড় দেবে? একজন সংবাদকর্মী হিসেবে তাই আমারও প্রাণের মায়া আছে। অথবা ধরলাম নেই। কিন্তু বাসায় বাবা-মা-ভাই-বোন আছেন। তারা যদি আমার জন্য, আমার পেশার জন্য আক্রান্ত হন, এই পাপ মোচন কীভাবে করবো জীবনে! পরিবার-পরিজনের মৃত্যুর দায় সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। কেউ অভিযোগ না দিলেও মনের মধ্যে থেকেই যাবে বিষয়টি। তাই আমার জন্য বিষয়টি ঘরের শান্তি, কাজের ভাইরাসের মতো।
যদিও এ পেশা থেমে থাকার নয়। টেলিভিশনে কাজের সুবাদে অফিস যেতে হয়। রাত্রিকালীন কাজও থেমে নেই। করোনাভাইরাসের কারণে কাজের চাপ আরও বেড়েছে। অনেকে ছুটিতে। কারণ তাদের আশপাশে ধরা পড়েছে প্রাণঘাতী রোগ। লোকজন কম সেজন্যে। আর অফিসও চায় বেশি লোক এক শিফটে না থাকুক, তিন ফুট দূরত্ব যেন নিশ্চিত হয়। অফিস থেকে বাসায় ফিরে জুতো খুলে রাখি সিঁড়িতেই। সিঁড়িতে থাকা তাকে জুতো রেখে, মোজা পরা পায়ে হেঁটে যাই উপরে। দ্বিতীয় তলার বাসার দুটি দরজা। প্রথম দরজা খুললে ড্রয়িংরুম অন্যটি খুললে আমার ঘর হওয়ায় ঢুকে পড়ে দ্বিতীয়টি দিয়ে। কোথাও হাত না লাগিয়ে সোজা বাথরুমে চলে যাওয়া। এরপর ব্যাগে জামা খুলে রাখি বা বালতিতে জমানো ডিটারজেন্ট পানিতে শরীরের প্রতিটি জামা খুলে ডুবিয়ে রাখা হয় (একদিন পর তা ধোয়া হয়)। তাৎক্ষণিক গোসলও সেরে নিতে হয়। গোসলের সময়ই স্যানিটাইজার দিয়ে মোবাইল, পেন ড্রাইভ, ওয়ালেট, আইডি কার্ড, চশমা, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও কাগজপত্রের ছোট ব্যাগও মুছে ফেলতে ভুলে গেলে চলে না। তারপর সেগুলো বুক সেলফের এক পাশে রাখি। শেষ হয় নিজেকে পরিষ্কার করার কার্যক্রম। কিন্তু তাতে কি! নিজ ঘরেই থাকছি। বের হচ্ছি না ড্রইং-কাম-ডাইনিংয়ে। অন্য ঘরগুলোতে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। বিশেষ করে বাবা-মায়ের ঘরে তো নয়-ই। খাওয়া-দাওয়া ঘরে বসেই, নচেৎ ঘরের সামনে চেয়ারে হাতে প্লেট ধরে খাদ্য গ্রহণ। বাবা-মা, দুজনেরই বয়স হয়েছে। দুজনেই নানা অসুখে আক্রান্ত। এই বয়সে কোনো কারণে তারা আক্রান্ত হলে কী পরিস্থিতি হবে তা আমি বুঝি।
এমন বহু সংবাদকর্মী আছেন যারা এভাবেই রয়েছেন কাজে। নিজেরাই নিজেকে কোয়ারেন্টিনে নিয়েছেন, অফিস করেন, অফিস শেষে বাসায় কোয়ারেন্টিন বা সঙ্গরোধ জীবন। অনেকের বাসায় আছে ছোট্ট বাচ্চা। তারা শিশুকে ফেলে কাজ করছেন বাইরে, বাসায় এসে ঠিক মতো কোলেও নিতে পারছেন না! অবুঝ শিশু তা হয়ত বোঝে না। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে কর্মরত পরিচিতজন আক্ষেপের সঙ্গে জানান, বাসায় শিশুকন্যা ও বয়স্ক বাবা-মা দুজনেই আছেন, তাদের নিয়েই যত ভয় তার।
বলছি না সব ঝুঁকি কেবল সাংবাদিকদের। প্রথম শ্রেণীর ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা চিকিৎসকরা, সেবিকা ও হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। এমনকি ওষুধের বিক্রেতাও। তারাই প্রকৃত নায়ক। এরপরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তৃতীয় ধাপে সংবাদকর্মীরা। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে দেশে অনেক সাংবাদিক কোভিড-১৯-এ আক্রান্তও হয়েছেন ইতোমধ্যে যাদের বেশিরভাগই টেলিভিশন চ্যানেলের। রাষ্ট্র যদি চিকিৎসকদের মতো সংবাদকর্মীদের জন্য এগিয়ে আসতো তাহলে ভবিষ্যৎ নিয়ে জটিলতা বা ভাবনা থাকতো না আর।
একদিকে করোনার মৃত্যু ভয়, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ ভয়ও কাজ করছে। দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনের বাজারে তা প্রভাব ফেলছে এটাই স্বাভাবিক। ইতোমধ্যে মার্কিন প্রশাসনের কাছে দেশটির গণমাধ্যমগুলো প্রণোদনা চেয়েছে, ছোট অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো ততটা ধনী নয়। তাদের কথাও দরকার আছে ভাবার। এই অনুরোধ রাখবো।
আরেকটা অনুরোধ, যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছি- তারা একান্তই পেশাগত কাজে। কেউ নিজে শখ করে নামেননি। আমাদেরও ইচ্ছে করে পুরোপুরি ঘরে থাকতে। ঘরে থাকলে বাইরে থেকে ভাইরাস বহন করে আনতে হবে না। নিরাপদ রাখতে পারবো পরিবারকে, চারপাশকে। তখন শুধু ভাবনা থাকবে- বাজার করা ও আগামীর অর্থ সংকুলানের। কিন্তু জীবন নিয়ে নয়। তাই ঘরের শান্তিটা যারা ঘরে আছেন বজায় রাখুন অনুগ্রহ করে, এটাই প্রত্যাশা। ছুটি বা লকডাউন ভেঙে বাড়ির বাইরে গিয়ে নিজেকে বিপদে ফেলবেন না। আপনি যত নিয়ম মানবেন না, তত ক্ষতি। তত আক্রান্ত হবেন, লকডাউন আরও হবে দীর্ঘ।
আমাদের প্রশাসন কঠোর হচ্ছে কম, তাই বলে আপনারাও সুযোগ নেবেন? অকারণে কেন ঘর থেকে বের হয়ে নিজে ও অন্যকে সংক্রমিত করবেন। তাহলে কি লাঠিপেটা করাটাই ঠিক?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব বা আবেগ দিয়ে কোনো সুষ্ঠু কাজকে বিপদে ফেলবেন না। অনেকের হয়ত বাসায় থাকতে থাকতে ধরে গেছে বিরক্তি। কিন্তু মনে রাখবেন, এই বিরক্তি শুধু আপনার একার নয়। সারা বিশ্বেই মানুষ থাকছে ঘরবন্দি হয়ে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ছুটি বাড়াতে হবে আমাদেরও। কর্তৃপক্ষ এদিকে নজর দেবে আশা করি। আগেভাগে সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এছাড়া গরিব মানুষদের ত্রাণ চুরি বন্ধ করা জরুরি।
বাসায় যারা আছেন তারা চিকিৎসকদের উৎসাহ দিন। অনুপ্রেরণা জোগান। ভুলে যাবেন না, যুদ্ধের অংশ আপনিও। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর ভালো কাজের প্রশংসা করুন। দেশগঠন ও দেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে চাঙা করতে কী করা যায় আগামীতে তার পথ বের করুন। পরিবারকে কোয়ালিটি টাইম বলতে যা বোঝায় তাই দিন। আর ইচ্ছে থাকলে আসতে পারেন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজেও। সামর্থ্য মতো গরিব, অসহায় মানুষকেও সাহায্য করা উচিত। করোনা আমাদের সাময়িক সামাজিক দূরত্ব শেখালো বটে তবে আমরা এর থেকে স্থায়ী মানবিক বন্ধন গড়ে তোলার শিক্ষা নিতে পারি।
সৈয়দ ইফতেখার: লেখক, সাংবাদিক