প্রেম, দ্রোহ আর স্মরণ

  • কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

১৪ ফেব্রুয়ারি বছর ঘুরে দিনটা ফিরে এলেই নানা কথা শুরু হয়। নানান যুক্তি ভাসে বাতাসে-অনলাইনে। এই দিনের একটা পরিচিতি ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ বা ‘ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে। আরেক পরিচিতি আছে, ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে। প্রথম পরিচিতি ডালপালা যতখানি মেলেছে, দ্বিতীয় পরিচিতি ততটা নয়। তবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা আছে। এই আলোচনা কিছু ক্ষেত্রে আবার মুখোমুখি দাঁড় করে দেওয়ার মতোও!

ভ্যালেন্টাইন'স ডে’র আলোচনা আবার দুই শ্রেণির মানুষের মতবিরুদ্ধ। প্রগতিশীলদের একটা অংশ, যারা ১৪ ফেব্রুয়ারিকে স্রেফ স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালনের পক্ষপাতী। তাদের কাছে এই দিনটি স্রেফ ১৯৮৩ সালের শিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাসকে স্মরণের দিন। এই দিন উদযাপনের নয়—এমনই মত তাদের। ভ্যালেন্টাইন’স ডে’কে তারা সেই বেদনাবিধুর দিনের স্মৃতি ‘ভুলিয়ে দেওয়ার’ একটা উপলক্ষ হিসেবেই দেখেন। তারা নিশ্চিতভাবেই দেশের প্রগতিশীল অংশের প্রতিনিধিত্বকারী বা প্রগতিশীলতাকে ধারণ করেন।

বিজ্ঞাপন

এর বাইরে এই ভালোবাসা দিবসের বিরোধিতাকারীদের বড় অংশ যেকোনো উৎসব কিংবা আনন্দবিরোধী অংশ; মোটা দাগে তারা প্রতিক্রিয়াশীল। তারা এই দিনকে তাদের ভাষায় ‘বেলেল্লাপনার’ অংশ হিসেবেই দেখেন। কেবল এই ভাবনার মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ নন। এটা নিয়ে তারা ধর্মের নাম নিয়ে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টিরও পাঁয়তারা করেন। এই প্রবণতা মারাত্মক! এর প্রভাব যে সমাজে পড়ছে না, তা নয়। হয়তে এখনই এ প্রভাব প্রকাশ্য নয়, কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে এর জের ধরে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ঘটে গেলে এর দায় চুকাতে হতে পারে এই সমাজকেই।

২.
১৪ ফেব্রুয়ারি 'স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস' হিসেবে পালনের যে আওয়াজ উঠেছে, তাকে গুরুত্বহীন ভাবার কোনো কারণ নেই। আমাদের আজন্ম সাধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধিকারের মূলে কুঠারাঘাত করে যে গোষ্ঠী, তাদের ধিক্কার জানানো আমাদের কর্তব্যের পর্যায়ে পড়ে। এই ধিক্কার এবং ওই তারিখের নৃশংস ঘটনাকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। স্মরণের আবরণে সেই ঘটনার স্মৃতি রোমন্থনের পাশাপাশি আমাদের উচিত এ থেকে শিক্ষা নেওয়া। একইসঙ্গে এই ইতিহাসকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার পথ রচনা করা।

বিজ্ঞাপন

ইতিহাস স্মরণ ইতিহাসের দায়। এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১৯৮২ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর সামরিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব ও রেজাল্ট খারাপ হলেও যারা ৫০% শিক্ষার ব্যয়ভার দিতে সমর্থ, তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয় এতে। মজিদ খানের ওই শিক্ষানীতিতে দরিদ্ররা উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে পারে—এই শঙ্কায় ছাত্ররা এর বিরোধিতা করেন। ১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে এই শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্র সংগঠনগুলো ঐকমত্যে পৌঁছায়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ শিক্ষানীতি বাতিল, বন্দিমুক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি ও গণমুখী, বৈজ্ঞানিক ও অসাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির দাবিতে ছাত্র জমায়েত ডাকে।

হাজার-হাজার শিক্ষার্থীর শান্তিপূর্ণ মিছিল হাইকোর্টের গেটের সামনে ব্যারিকেডের সামনে পড়লে ছাত্রনেতারা সেখানে সমাবেশ শুরু করেন। ওই সময় পুলিশ বিনা উসকানিতে ছাত্রজমায়েতে রায়টকার ঢুকিয়ে দিয়ে রঙিন গরম পানি, বেধড়ক লাঠিচার্জ, ইট-পাটকেল ও বেপরোয়া গুলি ছুঁড়তে থাকে। এসময় গুলিবিদ্ধ হন কয়েকজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিহত ও আহতদের অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে নিতে চাইলে ঘটনাস্থলে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ।

ছাত্ররা পুলিশ সদস্যদের হত্যা করেছে, এমন অপপ্রচার চালিয়ে সামরিক সরকার পুলিশকে উসকে দেয়। ওই দিন নিহত হয়েছিলেন জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালীসহ কয়েকজন। সরকারি হিসেবেই আটক করা হয় ১ হাজার ৩৩১ জন। বাস্তবে এই সংখ্যা ছিল আরো বেশি। সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি হয়ে ওঠে মুক্তিকামী মানুষের প্রতিরোধ চেতনার দিন। সেসময়কার রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীরা দিনটি পালন করছে ‘স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে।

৩.
জাতীয় অথচ অনালোচিত এই স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের বাইরে ১৪ ফেব্রুয়ারির বৈশ্বিক পরিচিতি আছে ভ্যালেন্টাইন'স ডে বা ভালোবাসা দিবস হিসেবে। প্রতিবছর এই দিনটি ফিরে আসার পর দিনকে ঘিরে কিছু মিথ আলোচিত হয়। অন্য কিছু মিথের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত, প্রাচীন কিংবা প্রতিষ্ঠিত মিথ সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন নামের রোমান একজন ক্রিশ্চিয়ান পাদ্রিকে ঘিরে। পেশায় ওই চিকিৎসককে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অভিযোগে ২৭০ খ্রিষ্টাব্দে রোমের দ্বিতীয় ক্লডিয়াস মৃত্যুদণ্ড দেন। বন্দি ভ্যালেন্টাইনকে ছোট ছেলেমেয়েরা জানালা দিয়ে চিঠি ছুঁড়ে দিতো। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন কারাগারে বন্দি অবস্থায় চিকিৎসা করে জেলারের মেয়ের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। একটা সময়ে জেলারের মেয়ের সঙ্গে গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে ভ্যালেন্টাইনের। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে মেয়েটিকে তিনি যে চিঠি লেখেন, তার নিচে লেখা ছিল, ‘ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। অনেকের ধারণা, সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারেই প্রথম জুলিয়াস ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেন।

বাংলাদেশে গত শতকের নব্বই দশকের ভ্যালেন্টাইন’স ডে উদযাপন শুরু হয়। যায়যায়দিন সাপ্তাহিকের শফিক রেহমান এই দিবসটি প্রথমে মিডিয়ায় বহুল প্রচার করেন বলে অনেকের প্রচার। এটা একটা ম্যাগাজিনের সম্পাদকের ব্যবসায়িক কৌশল কিংবা ভালোবাসা দিবসকে সবার সামনে উপস্থাপনা—যাই হোক না কেন, অনেকের ধারণা তিরাশির জয়নাল, জাফর, কাঞ্চন, দীপালীদের শোক আর স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের দ্রোহ ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। তবে শেষোক্ত যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে, সেটা সত্য কি না—এ নিয়ে আমার মতো অনেকেই সন্দিহান।

৪.
১৪ ফেব্রুয়ারির তারিখকে ঘিরে এই সময়ে আরো এক শোকের ঘটনা আছে। বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা ও তারুণ্যকে পাল্টে দেওয়া গণআন্দোলন গণজাগরণের সময়ে শাহবাগ আন্দোলনের প্রথম শহিদ জাফর মুন্সীর মৃত্যুর তারিখও এই দিন। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা তারুণ্যের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ গণজাগরণে একাত্ম হয়, দেশের সব শ্রেণিপেশার মানুষ। ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মতিঝিলে জাফর মুন্সীর অফিসের ফটকে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে সাঁটানো ব্যানার এবং পোস্টার ছিঁড়তে আসা জামায়াত-শিবির কর্মীদের বাধা দিতে গেলে সংগঠনটির কর্মীদের হামলার শিকার হন জাফর মুন্সী। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তির পরের দিন ১৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান তিনি।

শাহবাগ আন্দোলনে জড়িতদের অনেকেই জামায়াত-শিবির ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর হামলার শিকার হয়েছেন। বেশ কয়েকজন মারাও গেছেন বিভিন্ন সময়ে। সেই মৃত্যুর মিছিলের প্রথম নাম ছিল জাফর মুন্সীর। গণজাগরণ আন্দোলন সারাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আলোড়ন তুলেছিল, আন্দোলনের এক যুগের কাছাকাছি সময়ে এসে বলা যায়, সেই আন্দোলনের সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশ। এই সময়ে দেশের মানুষের অধিকাংশই মানবতাবিরোধী অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি চায়, যুদ্ধাপরাধী ও সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ চায় এবং এই সংগঠন আর তাদের রাজনৈতিক দোসরদের বর্জনও করেছে মানুষ। এছাড়া গণজাগরণের পথ ধরে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে সাংগঠনিকভাবে জড়িত দল জামায়াত-শিবির রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ধাক্কা খেয়েছিল, তা সামলে ওঠতে পারেনি এখনো।

জাফর মুন্সীর এই সময়ে আলোচনার বাইরে কিংবা তার স্মরণে কোথাও কোনো কর্মসূচি না থাকলেও গণজাগরণ আন্দোলনের ইতিহাসের একটা ক্ষেত্রে তার নাম লেখা হয়ে গেছে। গণজাগরণের শহিদদের নাম যখনই কেউ উল্লেখের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে, তখন জাফর মুন্সীকে অস্বীকার করা যাবে না।

৫.
বছরের ৩৬৫ দিনই ঘটনাবহুল হয়ে থাকে। কালের পরিক্রমায় এক ইতিহাসের সঙ্গে আরো অনেক ইতিহাস যুক্ত হয়; এ স্বাভাবিক ধর্ম প্রকৃতির। এখানে কারো হাত নেই। অতীতকে অস্বীকার করার উপায় নেই যেমন আমাদের, ঠিক তেমনি একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটা ধরারও উপায় নেই।

১৪ ফেব্রুয়ারি 'ভ্যালেন্টাইন'স ডে', 'স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস', গণজাগরণের 'প্রথম শহিদের মৃত্যুতারিখ'—এই সব বিষয়সহ জানা-আপাত অজানা—যা কিছুই সামনে আসবে, সেগুলোকে আমাদের গ্রহণ করা ছাড়া উপায় কই! এই দিন সুখ বা শোকের যাই হোক না কেন, এখানে সুখের জন্য শোক বাদ বা শোকের জন্য সুখ বাদ—এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াটা উচিত হবে বলে মনে হয় না।

এই সময়ে একটা পক্ষ 'স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস' পালন করতে গিয়ে 'ভ্যালেন্টাইন’স ডে' পালনকারীদের কঠোর সমালোচনা করছেন। 'ভ্যালেন্টাইন'স ডে' উদযাপনের সমালোচনা করছে প্রতিক্রিয়াশীল একটা চক্রও। আবার 'ভ্যালেন্টাইন'স ডে' উদযাপনকারীরা 'স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস' পালনের আহ্বানকারীদের সমালোচনা করছে। মুখোমুখি অবস্থা প্রায়। অথচ চাইলেই এনিয়ে ইতিবাচক হওয়া সম্ভব।

স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান থাকতে হবে। একইসঙ্গে ভালোবাসাবাসিতে উন্মুখ জনভাবনাকেও মূল্য দিতে হবে। এগুলোর সবটাই আমাদের জন্য দরকারি। একটাকে বাদ দিয়ে আরেকটা ধরা এখানে যেমন সঙ্গত নয়, তেমনি নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠায় অন্যের অবস্থানের বিরোধিতাও অনুচিত।

ভ্যালেন্টাইন’স ডে’কে ঘিরে নারী-পুরুষের সম্পর্কে একটা শ্রেণির আপত্তি খুব! নারীকে অন্তঃপুরবাসিনী হিসেবে দেখতে তারা উদগ্রীব। এই শ্রেণির মানুষদের আস্কারা দেওয়া হবে, যদি আমরা সত্যি সত্যি ভ্যালেন্টাইন'স ডে’কে ঘিরে দেশের মধ্যকার তারুণ্যের এই উৎসবে বাঁধ সাধি।

এই সময়ে গোঁড়ামি আর বেঁধে রাখার প্রবণতা যখন আশকারা পাচ্ছে, তখন সব মহল থেকে ভালোবাসা দিবস ও স্বৈরাচারবিরোধী প্রতিবাদ-স্মরণ—উভয়ই চলুক। যারা প্রতিবাদী, তারা প্রতিবাদ করুক, যারা ভালোবাসায় তারা ভালোবাসতেই থাকুক। যারা যে উদ্দেশ্যে আসছে, তারা সেভাবেই আসুক; প্রেম-দ্রোহ আর স্মরণের সম্মিলনে!