বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের পরম্পরা

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম 
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

মৃত্যুর শোকাবহ আবহ ঘিরে রেখেছে সদ্যপ্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমকে। নেতা, কর্মী, স্বজনের শতসহস্র স্মৃতির প্রদীপ আলো ছড়াচ্ছে তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও উল্লেখযোগ্য কর্মের চারদিকে। ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিলে জন্ম নিয়ে ২০২০ সালের ১৩ জুন চিরবিদায় নেওয়া এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ৭২ বছরের সুদীর্ঘ জীবনের খণ্ড, বিখণ্ড বহু ঘটনা সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে।

যদিও শোকসন্তপ্ত পরিস্থিতি নৈর্ব্যক্তিক, বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের উপযুক্ত পরিবেশের নিশ্চয়তা দেয়না। সুদীর্ঘ জীবনকালের অনুপুঙ্খ পর্যালোচনাও শোক আর আবেগের তীব্রতার মধ্যে সম্পন্ন করা যায়না। ঘটনাবহুল জীবনের ভালো ও মন্দের মাঝ দিয়ে সঠিক মূল্যায়ন সময়সাপেক্ষ বিষয়। তথাপি বাংলাদেশের রাজনীতির নানা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্বাক্ষী ও অংশগ্রহণকারী নেতা মোহাম্মদ নাসিমের পরিপূর্ণ মূল্যায়ন তার দল ও সংশ্লিষ্টরা যথাসময়ে নিশ্চয় করবেন।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের উত্থানপতনের সত্যনিষ্ঠ পাঠ গ্রহণের প্রয়োজনেই মোহাম্মদ নাসিম ও তার মতো জাতীয় স্তরে তৎপর নেতাদের জীবন, কর্ম ও রাজনীতির নানাদিক লিপিবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান স্রোতধারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আন্দোলন, সংগ্রাম ও অর্জন সম্পর্কে জানতে হলে মোহাম্মদ নাসিমের মতো দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের সম্পর্কেও জানতে হবে। কারণ, তার পুরো জীবন ও কর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগ আজকে একটি সুদৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে দীর্ঘ লড়াই ও সংগ্রামের ভেতর দিয়ে। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে পাকিস্তানের শোষণ, নিপীড়ন, পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা লাভ ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গতিশীল পথযাত্রায় বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের পরম্পরা, যেখানে শর্তহীনভাবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, কামরুজ্জামান ও মনসুর আলী।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের অব্যাহত সাফল্যের পেছনে অনেক কিছুর মতো সৌভাগ্যবশত কাজ করেছিল জাতীয় চার নেতার রক্ত ও ঐতিহ্য থেকে উৎসারিত বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যের পরম্পরা, মোহাম্মদ নাসিম ছিলেন যার অন্যতম ধারক ও বাহক। একইভাবে আরো ছিলেন সৈয়দ আশরাফ এবং আছেন আরো অনেকেই।

পিতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মনসুর আলী, যিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তার ভাবাদর্শের রাজনীতিই গ্রহণ করেন তিনি। আর তা ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বস্ততায় আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য । বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যে আনুগত্য নিঃশর্তে জ্ঞাপন করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি।    

মুক্তিযুদ্ধের পর মোহাম্মদ নাসিম ঢাকার জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নেন।গত শতকের ষাটের দশকে ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী নাসিম স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কারাগারে মনসুর আলীকেও হত্যা করা হলে আওয়ামী লীগে সক্রিয় হন নাসিম। তখন কারাগারেও যেতে হয়েছিল তাকে। বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও রাজনীতির উত্তরাধিকার শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণকালে যারা পাশে ছিলেন, মোহাম্মদ নাসিম তাদেরও অন্যতম।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বৈরাচার এরশাদ ও বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় ছিলেন তিনি। ঢাকার রাজপথে রক্তাক্ত হয়েছেন তবু সরে যাননি। এক নির্ভীক, লড়াকু যোদ্ধার মতো বিশ্বস্ততায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি অনুগত থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়েছেন তিনি।        

১৯৮৬ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নাসিম। তখন সংসদে বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপের দায়িত্বও পান তিনি। তখন তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক। পরে দলের সাংগঠিক সম্পাদক হন। আওয়ামী লীগের সাংগঠিক ভিত্তি বাড়ানোর কাজে  তিনি ছিলেন সদাতৎপর।

সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে মোহাম্মদ নাসিম দলীয় অনেক দায়িত্বশীল পদের পাশাপাশি সামলেছেন সরকারের বিভিন্ন পদ ও পদবী। স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়েও কাজ করেছেন তিনি।

শেষ দিকে সরকার ও দলের গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে সরে গেলেও তিনি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিকাশের কাজ করে গেছেন। তিনি ছিলেন আওয়ামী রাজনীতির পরীক্ষিত সহযোগী ১৪ দলের সমন্বয়ক। নিজের দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে বন্ধু সংগঠনগুলোর সেতুবন্ধন রচনা করেছিলেন তিনি। 

রাজনীতিতে তিনি যেমন অনেক কিছু পেয়েছেন, তেমনি হারিয়েছেনও অনেক কিছু। হারিয়েছেন পিতাকেও। কিন্তু পিতার দেখানো পথ, রাজনৈতিক বিশ্বাস, মতাদর্শিক ঠিকানা হারাননি কখনোই। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে লালন করেছেন সব সময়। আওয়ামী লীগকে ধারণ করেছেন জীবনভর। অবিচল ছিলেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি।

শাঠ্য ও ষড়যন্ত্রে পঙ্কিল তৃতীয় বিশ্বের ডিগবাজির স্বার্থান্ধ রাজনীতির অন্ধকারে মোহাম্মদ নাসিম নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যিনি পিতার রাজনৈতিক আত্মত্যাগের পথকে নিজের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা, বিশ্বস্ততা ও আনুগত্যে আঁকড়ে ধরেছেন সর্বক্ষণ। দল, নেতৃত্ব ও আদর্শের প্রশ্নে থেকেছেন অটল। তার মৃত্যু অবশ্যই আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য এক বিরাট ক্ষতি। বাংলাদেশের রাজনীতির জন্যেও তার বিদায় বেদনাবহ। তবে মৃত্যুতেই তার অবদানের পরিসমাপ্তি ঘটবেনা। কারণ, আদর্শের প্রতি বিশ্বাস ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের যে পরম্পরা তিনি স্থাপন করেছেন, আওয়ামী রাজনীতির নেতা-কর্মীরা তা থেকে অনিঃশেষ অনুপ্রেরণা লাভ করবেন।

আরও পড়ুন: সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম আর নেই

 সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম করোনায় আক্রান্ত

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অবস্থা সংকটজনক