করোনা: গবেষণা-পরিসংখ্যানে ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা বিপজ্জনক!
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসকরোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে গবেষণার অন্ত নেই। অভাব নেই নানা রকমের তথ্য-পরিসংখ্যানের। কিন্তু সেগুলো কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য? সব গবেষণার বক্তব্য অন্ধভাবে অনুসরণ যোগ্য? সব পরিসংখ্যান নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়ার মতো? সবগুলোর উদ্দেশ্য মহৎ?
এসব প্রশ্ন উঠেছে খোদ গবেষকদের মধ্যেই। কারণ করোনা নিয়ে চলছে অনেক উদ্দেশ্যমূলক গবেষণা। আবার প্রকাশ পাচ্ছে এমন তথ্য-পরিসংখ্যান ও নির্দেশনা, যা এক দেশের জন্য সত্য ও পালনীয় হলেও অন্যসব দেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ নয়।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো কোনো গবেষক অভিযোগ করেছেন, অনেক গবেষণায় বহুজাতিক সংস্থার হস্তক্ষেপ এবং সেখানে পরিসংখ্যানের ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা চলছে। বেসরকারি পুঁজির অধিকারী কোম্পানিগুলো জনগণের স্বার্থে কোভিড-১৯-এর প্রতিষেধক নিয়ে রাত জেগে কাজ করছেন, নাকি তাদের বাণিজ্যিক স্বার্থে তৎপর হয়েছেন, এমন প্রশ্নও উত্থাপিত হয়েছে।
কারণ কোম্পানিগুলোর প্রধান ও প্রথম উদ্দেশ্য মুনাফা অর্জন। করোনাকালে বিভিন্ন তৎপরতা, বিশেষত গবেষণা ও তথ্য-পরিসংখ্যান উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক মতলব আঁচ করেছেন অনেকেই। ফলে অতি উন্নত ও অগ্রসর প্রথম বিশ্বের দেশগুলোতে এই নিয়ে প্রচুর দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক চলছে।
দেখা গেছে, বিভিন্ন ওষুধের নাম করে কখনও ইতিবাচক আবার কখনও নেতিবাচক পর্যবেক্ষণের ঘোষণা আসছে। প্রকৃতপক্ষে যা অর্জন হচ্ছে, তারচেয়ে বেশি হচ্ছে প্রচারণা-প্রোপাডান্ডা। করোনার বিরুদ্ধে চিকিৎসাশাস্ত্র ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান এখনো অসম্পূর্ণ, এই সত্যটুকু আড়াল করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এমন কিছু গবেষণা তথ্য-পরিসংখ্যান সামনে নিয়ে আসছে, যা আসলে অর্ধ-সত্য এবং তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন ও বাজার তৈরির কৌশল।
উন্নত বিশ্বের মতো অনুন্নত দেশেও চলেছে আরেক ধরনের উদ্দেশ্যমূলক গবেষণা, যাতে অবৈজ্ঞানিক ও অবিশ্বস্ততার প্রচার চালানো হচ্ছে ব্যবসায়িক লাভের ধান্ধায়। তন্ত্র, মন্ত্র, আয়ুর্বেদ, হোমিও, লোকচিকিৎসার নামে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষকে আশাবাদী ও প্রলুব্ধ করার মতো বহু তথ্য-পরিসংখ্যান। প্রচার করা হচ্ছে কোভিড মুক্তির মিথ্যা আশা এবং হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বিপুল অর্থ।
উভয় দিক থেকেই গবেষণাকে ভুল প্রয়োগ করার এবং তথ্য-পরিসংখ্যানকে স্বার্থগত কারণে অপব্যবহার করার অভিযোগ করেছেন বিশ্বের নামজাদা গবেষণা সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিতগণ। তারা মনে করেন, করোনার ঘোরতর বিপদের কালে ব্যবসা-বাণিজ্যের লক্ষ্যে কোনো গবেষণার তথ্য-উপাত্ত প্রচার করা অনৈতিক এবং প্রকৃত সত্যকে অর্ধ-সত্য দিয়ে আড়াল করার শামিল। এতে মানুষ মূল বাস্তবতার বদলে কাল্পনিক আশার জগতকে দেখতে পারেন এবং এতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কিছু লাভ হলেও মূল পরিস্থিতির আদৌ কোনো উন্নতি হবেনা।
গবেষকগণ মনে করেন, করোনা গবেষণার তথ্য, উপাত্ত, পরিসংখ্যানকে হাজার কিংবা লক্ষ কোটির ব্যবসায় অর্ধসত্য বিজ্ঞাপনের কাজে না লাগিয়ে পরিস্থিতির প্রকৃত মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণে মনোনিবেশ করতে হবে। এজন্য বিশ্বব্যাপী এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ব্যক্তিগত বা বাণিজ্যিক বিষয়গুলো সরিয়ে দিয়ে কোভিড আক্রান্তদের সম্পূর্ণ এবং স্বচ্ছ তথ্য সংগ্রহ করা। সে তথ্য গবেষণার কাজে ব্যবহার করতে হবে দক্ষ পরিসংখ্যানবিদদের মাধ্যমে। তারপর ঠিক কী কী বিষয় বিশ্লেষণে পাওয়া গেছে, তা তারা বলে দেবেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদের।
কারণ, মিছে অঙ্ক কষে আশা দেখিয়ে লাভ নেই, চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতাই সঙ্কটজনক কোভিড-আক্রান্তদের বাঁচার একমাত্র পথ। গবেষণার তথ্য-উপাত্তকে এ দিকেই ব্যবহার করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামান্য উপসর্গ নিয়ে অসুস্থরা এমনিতেই সুস্থ হচ্ছেন। কিন্তু উপসর্গবিহীনরা কিছু জানতেই পারছেন না। তারা নিজেরা আক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি অসুখটা ছড়াচ্ছেন। পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা বিপুল। গবেষকদের এদের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এক কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। আক্রান্ত হননি কিংবা আক্রান্তের বিপদে আছেন শত কোটি মানুষ। এদের বাঁচাতে গবেষণা জরুরি। জরুরি এদের সম্পর্কে তথ্য-পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে মুক্তির পথ দেখানো।কোভিড-১৯-এর সঙ্কটকালে সামগ্রিক পরিস্থিতির দিকে নজর না দিয়ে বাণিজ্যিক স্বার্থে গবেষণা-পরিসংখ্যানের মাধ্যমে ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা অনেক বেশি বিপজ্জনক।