বৈশ্বিক মহামারির কালে মিয়ানমারে শৃঙ্খলা
করোনা ভাইরাস“দেশের সার্বভৌমত্ব শুধু সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই সুরক্ষিত হয় না। বিশ্বব্যাপী মহামারির সময় এটা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
মহামারির এই কালে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও সংবাদকর্মীরা মানুষের জীবন রক্ষায় প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করে চলেছেন।”
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর আচরণ বিশ্লেষণ করতে থাইল্যান্ডের চিয়াং মাইয়ের পায়াপ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিস বিল্ডিং প্রোগ্রামে এসব কথা বলেছেন পিএইচডি গবেষক মান মান মায়াট।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত তার প্রবন্ধে মায়াট বলেন, মিয়ানমারের সংবিধান দেশটির সেনাবাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। সম্প্রতি সাংবিধানিক সংস্কার সম্পর্কিত সংসদীয় বিতর্ক চলাকালে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা হ্রাস করার বিষয়ে সংসদে প্রস্তাব ওঠে।
২৫ শতাংশ নির্দিষ্ট আসনের দখলদার সেনাবাহিনীর সদস্যরা তখনই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, সেনাবাহিনীর শক্তি দুর্বল করা হলে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি হবে। এ ধরনের হুমকি দেশটির ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক উত্তরণকে প্রভাবিত করছে।
মায়াট বলেন, বিশ্বব্যাপী মহামারি চলাকালে মিয়ানমারের সংসদে সংশোধনী প্রস্তাবটির বিরোধিতা করার কারণে জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবারের কথা মনে পড়ে যায়। যিনি সামরিক শৃঙ্খলার প্রকৃতি বর্ণনা করে বলেন, “তারা নির্দেশ পেলে গুলি চালানো বন্ধ করার প্রশিক্ষণ পেয়েছে। শৃঙ্খলাবদ্ধ শক্তিতে ব্যক্তিগত চিন্তা বা মনন কখনওই গ্রাহ্য হয় না।” তবে সেনাবাহিনী নাগরিকদের জীবন রক্ষার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কিনা ওয়েবার তার লেখায় তা বলেননি।
মিয়ানমারের সংসদে সামরিক আইন প্রণেতারা তাদের উচ্চ পর্যায়ের কামান্ডের আদেশে সংবিধান রক্ষা করার জন্য প্রশিক্ষিত। তাদের ভোটগুলো একটি সিস্টেমের অধীনে সম্মিলিত প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কমান্ডে স্বতন্ত্র চিন্তাকে গ্রাহ্য করা হয় না। সামরিক সংস্কৃতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য, ‘শৃঙ্খলা’— এমনকি মিয়ানমারের সনদের একটি মূল নীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, শৃঙ্খলা নামে প্রাচীন মিশরের শাসকরা যেমনটি করেছেন। ফেরাউনরা বিশাল পিরামিড তৈরি করার সময় হাজার হাজার দাসকে পরিচালনা করার জন্য শৃঙ্খলা ব্যবহার করেছিল। মধ্য যুগের খনি মালিকরা শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে খনি শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করতো। ওয়েবারের মতে আমেরিকার ঔপনিবেশিক আমলে আখের আবাদে দাসত্ব করা আফ্রিকানদের মধ্যে শৃঙ্খলা প্রয়োগ করা হয়েছিল।
মিয়ানমারে ২০০৮ সালের সংবিধানে সেনাকে কর্তৃত্ব দিতে দুটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্ত নিজের ক্ষমতায় রাখা এবং সংবিধান সংশোধনকে বাধাগ্রস্ত করার ক্ষমতা দিতে ২৫ শতাংশ সেনা আসন সংরক্ষিত করা। এটি ছিল প্রাক্তন সিনিয়র জেনারেল থান শোয়ের মস্তিষ্ক প্রসূত।
মিয়ানমারের সংবিধানের ৪৩৬ (ক) অনুচ্ছেদে একটি বাক্যের দ্বারা সনদটি তালাবদ্ধ রয়েছে, “সকল প্রতিনিধিদের পঁচাত্তর শতাংশেরও বেশি সদস্যের দ্বারা পূর্বের অনুমোদন সংশোধন করা হবে।” এর সহজ অর্থ হলো কমপক্ষে একজন সামরিক আইন প্রণেতার সম্মতি ছাড়া সনদটি সংশোধন করা যায় না।
জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পর্যবেক্ষণ করেছে: মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও আইনি ব্যবস্থায় দায়মুক্তি গভীরভাবে জড়িত যা কার্যকরভাবে সেনাবাহিনীকে আইনের ঊর্ধ্বে রেখেছে। সংবিধান এবং অন্যান্য আইনগুলো সেনাবাহিনীকে স্বেচ্ছাচারী করে তোলে যা তাদের বেসামরিক তদারকির বাইরে রাখে।
আধুনিক কালের সংকট এবং বিপর্যয় অবশ্য নাগরিক এবং সৈনিকের ভুমিকা অস্পষ্ট করে তোলে, বিশেষত আজকে করোনাভাইরাস মহামারির সময়ে। গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ : পরিকল্পিত কল্পনাতীত সামরিক শৃঙ্খলা কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা।
বিশ্বব্যাপী মহামারির সময়, এটি আরও স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য সেনাবাহিনীই একমাত্র শৃঙ্খলাবদ্ধ শক্তি নয়, কারণ চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও সংবাদকর্মীরা মানুষের জীবন রক্ষায় প্রথম সারিতে ভূমিকা পালন করছে।
অত্যাচারীর সমাধিতে সুশৃঙ্খল সৈন্যের ‘অন্ধ আনুগত্য’ বেশি দিন স্থায়ী হবে না, কারণ সমাধির কোনও জীবন নেই। যদিও জোর করে মিয়ানমারের সংবিধানে তা স্থাপন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী মহামারি বন্ধ করতে প্রতিটি ব্যক্তির শক্তি আজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে - কারণ কেউই এই পৃথিবীর শেষ মানুষ হতে চায় না।