করোনা প্রতিরোধের হাতিয়ার ঘুম

  করোনা ভাইরাস
  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

করোনা প্রতিরোধে ঘুমানো খুব জরুরি, মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ঘুম সহায়তা করে। তাই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘুম গুরুত্বপূর্ণ একটি হাতিয়ার হতে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

গবেষণায় দেখা যায়, ঘুমের ব্যাঘাত আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহায়তায় আয়োজিত এক সেমিনারে গবেষকরা দেখিয়েছেন— ঘুম কীভাবে কোডিভ-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তিকে সহায়তা করতে পারে।

বিজ্ঞাপন

করোনাভাইরাসের এই সময়ে অধিকাংশ মানুষ যে তীব্র চাপের মুখোমুখি হয়েছেন, তাতে বেশিরভাগের ঘুমের রুটিন দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছে। অনেকেই নিয়মমাফিক ঘুমাতে পারছেন না। অথচ এই সময়ে সুস্থ থাকতে গভীর ঘুম জরুরি।

নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, সংক্রমিত ব্যক্তির শরীর প্রতিদিন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায়, আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঘুমের ব্যত্যয় ঘটলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভেঙে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

গত জানুয়ারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহায়তায় একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্টিত হয়। সেই সেমিনারে করোনা প্রতিরোধে ঘুম কীভাবে সহায়ক হতে পারে তা তুলে ধরেন গবেষকরা।

গবেষকরা বলেন, শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা হলো সংক্রমণের বিরুদ্ধে শরীরের নিজের প্রতিরক্ষা। আমাদের দেহের একাধিক স্তর আমাদের শরীরকে সুরক্ষা দেয়। সংক্রমণের প্রথম বাধা হলো— ত্বক, যা দৃঢ়ভাবে কোষ দ্বারা গঠিত, এটা সাধারণত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াকে দেহে প্রবেশ করতে বাধা দেয়।

ত্বকের শীর্ষতম স্তরটিতে মৃত কোষগুলি থাকে, যা কোন আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে ঘন শারীরিক বাধা তৈরি করে। ত্বকের তলদেশের অ্যান্টিমাইক্রোবাইয়াল পেপটাইড যা সংক্রমণের বিকাশকে বাধা দিতে পারে বা তাকে হত্যা করতে পারে।

তবে ব্যাকটিরিয়া ও ভাইরাসগুলি ত্বকে জীবিত থাকতে পারে এবং কম সুরক্ষিত অঞ্চলে স্থানান্তরিত হতে পারে - যেমন চোখ, নাক এবং ফুসফুস, যেখানে তারা প্রবেশ করতে পারে।

যদি রোগজীবাণু শরীরে প্রবেশ করতে সফল হয়, তবে রক্ত প্রবাহে প্রতিরক্ষার দ্বিতীয় স্তর আক্রমণকারী ভাইরাস/ব্যাকটেরিয়াকে শনাক্ত করতে ও প্রতিরোধ করতে কাজ করে।

ঘুম ত্বকের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
মানব দেহের প্রতিটি টিস্যু এবং অঙ্গ জৈবিক ছন্দ অনুযায়ী পরিচালিত হয়। মানবঘড়ি বা বা ‘সার্কেডিয়ান রিদম’ আমাদের শরীরকে জানান দেয় কখন ঘুম, খাওয়া, চিন্তাভাবনা ও অত্যাবশ্যক জৈবিক কার্য সম্পাদন করতে হবে। সার্কেডিয়ান রিদমের এই নিয়ন্ত্রণ ছাড়া আমরা বিরাট গোলমালে পড়ে যেতাম।

আমরা জানি মানব ঘড়ি বা সার্কেডিয়ান রিদম আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। সন্ধ্যায় ত্বক দুর্বল হয়ে ওঠে, এর অর্থ তখন অনেক বেশি পানিস্বল্পতা তৈরি হয়েছে। রাতের বেলায় ত্বকে চুলকানি বেড়ে যাওয়ার এটিও অন্যতম কারণ। ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক রাতের তুলনায় দিনের বেলাতে দ্বিগুণের চেয়ে দ্রুত নিরাময় হয়।

ফুসফুস রাতে বেশি ঝুঁকিতে থাকে
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৬ সালে হার্পিস ভাইরাসে আক্রান্ত ইঁদুরের ওপর একটি গবেষণা প্রকাশ করেছিল। ওই গবেষণায় দেখা যায় - যদি ঘুমের শুরুতে ইঁদুরের শরীরে ভাইরাসটি দেয়া হয় তা ইঁদুরটির জেগে থাকা সময়ের চেয়ে দশ গুণ বেশি গতিবেগে আক্রমণ করে।

বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় বলা হয়, প্রবীণ ব্যক্তিরা সকালে (৯-১১টা) অথবা বিকেলে (৩-৪ টা) একটি ফ্লু ভাইরাসের টিকা দেওয়া হয়েছিল। সকালে ভ্যাকসিন দেওয়া ব্যক্তিরা বিকেলে ভ্যাকসিন দেওয়া ব্যক্তিদের তুলনায় তিনগুণ বেশি কার্যকরী হয়েছিল।

এই গবেষণার অভিজ্ঞতা তৈরি হতে যাওয়া কোভিড-১৯ এর জন্য ভ্যাকসিন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কাজে দিতে পারে।

যাই হোক গবেষণাগুলি বারবার দেখিয়েছে যে, আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা দিনের বেলায় বেশি সক্রিয় থাকে, যখন আমরা সক্রিয় থাকি। রাতের বেলায় আমাদের সংক্রমণ প্রতিরোধের ব্যবস্থা ততটা ভালো নয়। এ কারণে স্বাস্থকর্মীদের রাতের বেলায় সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহার করা আরও বেশি জরুরি।

ঘুমের ব্যাঘাত ভ্যাকসিনের কার্যকরিতা কমায়
একটি নিয়মিত ঘুম আমাদের শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়তা করতে পারে। ঘুম ইমিউন সিস্টেমের অতিরিক্ত ক্রিয়াকলাপ এবং আমাদের নিজের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস করতে সহায়তা করে।

এটা সত্য যে, শিফট কর্মীদের ঘুম ও সার্কেডিয়ান রিদম ব্যাহত হয়। যারা অল্প ঘুমায় তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য দুর্বল হয়ে পড়ে, যাতে রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা কমতে থাকে।

২০০২ সালে শিকাগো ইউনিভার্সিটির এক সমীক্ষায় দুটি ভিন্ন ঘুমের সময়সূচি পালনকারী ব্যক্তিদের ফ্লু ভাইরাসের টিকা দিয়ে অধ্যয়ন করা হয়েছিল।

যে ব্যক্তিরা প্রতি রাতে মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমাতো তাদের মধ্যে ফ্লু ভাইরাসের প্রতিরক্ষামূলক অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছিল অর্ধেকেরও কম। অন্যদিকে যারা প্রতি রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমিয়েছিল তাদের শরীরে দ্বিগুণ অ্যান্টিবডি তৈরি হয়।

২০১২ সালে পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা হেপাটাইটিস ‘এ’ টিকার জন্য অ্যান্টিবডি প্রতিক্রিয়া অধ্যয়ন করে একই রকম তথ্য পেয়েছেন।

গভীর ঘুমের উপায় কী
গভীর ঘুমের কোন বিকল্প নাই, ব্যাঘাতপূর্ণ ঘুমও আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থার কার্যকারিতা হ্রাস করে।

সুসংবাদ হলো ৬২ শতাংশ মানুষ লকডাউন শুরুর আগে যতটা ঘুমাত এখনও ততটাই ঘুমাচ্ছেন। লন্ডনের কিং কলেজ সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে। কিন্তু করোনাকালে ৩৮ শতাংশ লোক বিরক্তিকর ঘুমের মধ্যে পড়েছেন।

লকডাউনের সময়ে গভীর ঘুমের কয়েকটি উপায় নিচে উল্লেখ করা হলো—

জানালার পাশে বিছানা; প্রাকৃতিক আলো / অন্ধকার চক্রের সঙ্গে আমাদের দেহকে সুসংহত করতে খুব জরুরি। এতে ভালোমানের ঘুমের সঙ্গে প্রতিরোধ ক্ষমতা দৃঢ় হবে।

যদি চার দেয়ালের বাইরে সময় কাটানো সম্ভব না তবে যতটা সম্ভব জানালার পাশে থাকুন, বিশেষত খুব সকালে কমপক্ষে ৩০ মিনিটের জন্য।

ভিটামিন ডি গ্রহণ করুন, যদি আপনি খুব বেশি প্রাকৃতিক আলো না পান তবে আপনার শরীরও প্রাকৃতিক আলোর প্রতিক্রিয়া হিসাবে ত্বক দ্বারা তৈরি ভিটামিন ডি সংশ্লেষ করতে সক্ষম হবে না।

হাড়, দাঁত এবং পেশী সুস্থ রাখার জন্য ভিটামিন ডি প্রয়োজন, এবং এমন একটি প্রমাণও পাওয়া যায় যে ঘুমের ব্যাধিগুলির উচ্চ ঝুঁকির সাথে এটার ঘাটতি জড়িত।

সূর্যের আলো থেকে আল্ট্রাভায়োলেট (ইউভি) আলো (বিশেষত ইউভি-বি) আমাদের ত্বকে ভিটামিন ডি তৈরি করতে সহায়তা করে। তবে জানালার গ্লাস বেশিরভাগ ইউভি-বি আলোকে আটকে দেয়। তাই জানালার গ্লাস দিয়ে আসা আলো ভিটামিন ডি উৎপাদনে সহায়তা করবে না। আপনি যদি বাইরে না যেতে পারেন তবে ভিটামিন ডি’র পরিপূরক গ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন।

প্রতিদিন বাইরে ব্যায়াম করুন। অনুশীলন নিজেই এবং উজ্জ্বল আলোর সংস্পর্শ উভয়ই শরীরের ঘড়িকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।

সারা রাত টিভি, মোবাইল বা ইলেক্ট্রনিক্স গ্যাজেট নিয়ে বসে থাকবেন না। প্রতিদিনের স্বাভাবিক রুটিন বজায় রাখুন, একই সাথে যথাযথ সময়ে ঘুম থেকে ওঠুন।

অ্যালকোহল গ্রহণে বিরত থাকুন। অত্যধিক অ্যালকোহল ঘুমকে ব্যাহত করতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। এটি ফুসফুসের প্রতিরোধক কোষগুলির ক্রিয়াকলাপের সাথে যুক্ত।

বিছানায় শুয়ে খবর দেখা বা পড়া বন্ধ করুন। এমনকি সাধারণ সময়ে বিছানায় স্মার্টফোন নিয়ে যাওয়া ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। আপনার মোবাইলটি অন্য ঘরে ফেলে আসুন।

কাজ ও বিশ্রামের সময়কে আলাদা করুন। অনেক বাড়িতে কাজ করছেন, কাজের সময় ও বিশ্রামের সময় আলাদা করা ভালো ঘুমের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

বই পড়া, গান শোনা এবং পছন্দের কাজ ভালো ঘুমের সহায়ক। তাই এগুরো বেশি করে করুন।