‘গ্র্যান্ড মুফতির পদ সৃষ্টি সময়ের দাবি’

  • ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশে গ্র্যান্ড মুফতি প্রসঙ্গে আলেমদের অভিমত, ছবি: বার্তা২৪.কম

বাংলাদেশে গ্র্যান্ড মুফতি প্রসঙ্গে আলেমদের অভিমত, ছবি: বার্তা২৪.কম

‘বাংলাদেশে গ্র্যান্ড মুফতি নিয়োগের দাবি’র প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রাজ্ঞ আলেম, শিক্ষাবিদ, গবেষক ও ইসলামবিষয়ক জনপ্রিয় কয়েকজন লেখকের মতামত।

ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ওমর গণি এম ই এস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম
বৈশ্বিক সঙ্কট ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সরকার ও জনগণকে ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে মতামত ও পরামর্শ প্রদানের জন্য ‘গ্র্যান্ড মুফতি’র (Islamic Jurisconsult of a State) পদ সৃষ্টি করা সময়ের দাবি। মুফতি সাহেবদের পক্ষ থেকে ভিন্ন ভিন্ন ফতোয়া আসলে ভুল বুঝাবুঝি বা বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। গ্র্যান্ড মুফতির অধীনে আঞ্চলিক মুফতিগণ থাকবেন। তারা ইজতিহাদি বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতগুলোকে সমন্বয় করে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত দেবেন। গ্র্যান্ড মুফতির পদ হবে হাইকোর্টের বিচারপতির অনুরূপ সাংবিধানিক। ভয়ভীতি ও চাপের উর্ধ্বে উঠে মতামত প্রদানে তারা স্বাধীন থাকবেন।

বিজ্ঞাপন

ষোড়শ শতাব্দীতে তুরস্কের উসমানীয় খেলাফতে সর্বপ্রথম গ্র্যান্ড মুফতির পদ সৃষ্টি করা হয়। পৃথিবীর বহু মুসলিম ও অমুসলিম দেশে গ্র্যান্ড মুফতি আছেন। মিসর, রাশিয়া, সিরিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোবিনা, ওমান, মালয়েশিয়া, দাগিস্তান, ব্রুনেই, আলবেনিয়া, ঘানা ও জর্দান অন্যতম।

মাওলানা মো. শহীদুল ইসলাম
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ইসলামিক ল’ রিসার্চ এন্ড লিগ্যাল এইড সেন্টার
করোনাকালে মসজিদে জামাতে নামাজ এবং জুমার নামাজে মুসল্লিদের উপস্থিতি নিয়ে আলেমদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় একজন গ্র্যান্ড মুফতির প্রয়োজনীয়তা বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। গ্র্যান্ড মুফতি এটর্নি জেনারেল, মহা হিসাবরক্ষক কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের মতো সাংবিধানিক পদধারী হবেন। তিনি জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ শরিয়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন। তার নেতৃত্বাধীন একটি সুপ্রিম কাউন্সিল থাকবে। যাদের সিদ্ধান্ত প্রতিপালন বাধ্যতামূলক হবে। এছাড়া প্রতিটি জেলা ও বিভাগ থেকে একজন করে প্রতিনিধি, ধর্ম ও আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কাউন্সিল থাকবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ধর্মীয় কোনো বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের জন্য এ পদ খুব জরুরি।

বিজ্ঞাপন

মুফতি সাঈদ আহমদ
মুদাররিস, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, মোহাম্মদপুর, ঢাকা
সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত না থাকলেও এদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। ইসলাম বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার সমাধানকে কেন্দ্র করে এদেশে বিতর্কের শেষ নেই। আলেম সমাজ বিভক্ত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সিদ্ধান্ত ও শীর্ষ আলেমদের সিদ্ধান্ত হিসেবে নানা বিষয় মিডিয়া প্রকাশ পায়, তাতে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়।

আমি মনে করি, এদেশে মুসলমানদের সমস্যার সমাধানে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে একটি মুফতি বোর্ড প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন একজন গ্র্যান্ড মুফতি। যার সিদ্ধান্ত ধর্মীয় বিষয়ে চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।

মুফতি মুহিউদ্দীন কাসেমী
শিক্ষাবিদ ও লেখক
পৃথিবী যত আগে বাড়বে নিত্যনতুন সমস্যা ও জিজ্ঞাসা সৃষ্টি হবে, এটাই স্বাভাবিক। নতুন সমস্যার শরয়ি সমাধানে প্রথমে গবেষকদের মতানৈক্য হবে, ধীরে ধীরে মতৈক্যে। যেমন, যখন লাউড স্পিকারে নামাজ শুরু হয় তখন উলামায়ে কেরামের মাঝে মতানৈক্য হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মুফতি শফী (রহ.) জায়েজের ফতোয়া দেন। এখন বিষয়টিতে আর কারও মতানৈক্য নেই।

নতুন সমস্যা ছাড়াও পুরাতন কোনো বিষয়ে সুষ্ঠু এবং মতৈক্যপূর্ণ সমাধানে উপনীত হওয়ার জন্য একজন গ্র্যান্ড মুফতির প্রয়োজন। যিনি বড় বড় গবেষক ও মুফতিদের মতামত শুনে একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত দেবেন। যেন ওই অঞ্চল বা দেশের সাধারণ জনগণ বিভ্রান্ত না হোন। বর্তমান করোনার কারণে মসজিদে ওয়াক্তিয়া, জুমা ও তারাবির নামাজে মুসল্লিদের উপস্থিতি ব্যাপক রাখা হবে, নাকি সীমিত করা হবে? একজন গ্র্যান্ড মুফতি থাকলে তার ফতোয়া অনুযায়ী সবাই চলতে পারতেন, তখন সমস্যা হতো না। অনাকাঙ্খিত বিতর্ক হতো না।

মাওলানা এহতেশামুল হক ক্বাসিমী
শায়খুল হাদিস, জামিয়া দারুল কুরআন সিলেট
সাধারণ মানুষ উলামায়ে কেরামের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমাদের দেশের সরকার প্রধানও ধর্মীয় বিষয়ে আলেম-উলামাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। সুতরাং ধর্মীয় বিষয়ে বা নিত্যনতুন বৈশ্বিক বিষয়ের সমাধানে উলামায়ে কেরামের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিতান্ত দরকার। নতুবা সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। যা আমাদের সামনে দৃশ্যমান। সরকার বরেণ্য ও বর্ষীয়ান আলেমদের একাংশকে নিয়ে মহামারি করোনার সঙ্কট রোধে শরিয়তের আলোকে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে উলামায়ে কেরামের আরেকাংশ তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর ফলে সাধারণ জনগণ বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। তার কোন দিকে যাবে, সরকারই বা কোন সিদ্ধান্ত দেবে। জনগণ কার কথা শুনবে? এর সমাধান রয়েছে একজন গণতান্ত্রিক পদ্ধতির গ্র্যান্ড মুফতির। এর প্রক্রিয়া অবশ্য ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কিন্তু আমাদের তো গ্র্যান্ড মুফতিই নাই।

মাওলানা সাদ আবদুল্লাহ মামুন
মুদাররিস, মুসলিম বাজার মাদরাসা, মিরপুর, ঢাকা
কোরআন মাজিদে আল্লাহতায়ালা মুমিন বান্দাদের সম্বোধন করে আদেশ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করো এবং দ্বীনি ও দুনিয়াবি বিষয়ে দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করো। এরপর কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে (যদি) বিবাদ-বিসংবাদ তৈরি হলে তা আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে পেশ করো। এটি কল্যাণকর এবং পরিণামের দিক থেকে উত্তম।’ -সূরা নিসা: ৫৯

আল্লাহতায়ালা মানব জীবনের প্রয়োজনীয় সব কথা ও কাজের মূলনীতি জানিয়ে দিয়েছেন। মুমিন তার জীবনের সব কাজ আল্লাহর হুকুম ও রাসূলের আনুগত্যের মধ্য দিয়ে করবে এবং দ্বীনি ক্ষেত্রে ও দুনিয়াবি বিষয়ে আল্লাহতায়ালা যাদের দায়িত্বশীল বানিয়েছেন তাদের আনুগত্য করবে। এরপর কোনো বিষয়ে তাদের মাঝে বিবাদ তৈরি হলে তা আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে পেশ করবে। ওখান থেকে যে ফয়সালা আসে তা সর্বান্তকরণে মেনে নেবে। মুসলিম জীবনের এই আনুগত্য সর্বাবস্থার। এই আনুগত্য ও অনুসরণ শান্তিময় ও বিবাদময় সব অবস্থার জন্য নির্ধারিত। আল্লাহতায়ালার এই হুকুমের সামনে মুমিনের পুরো জীবন নিবেদিত ও সমর্পিত। আল্লাহতায়ালার নির্দেশ, মুমিনের জীবন হবে আল্লাহ ও তার রাসূলের হুকুমের অধীন এবং দ্বীনি ও দুনিয়াবি বিষয়ের দায়িত্বশীলদের অনুসরণের মাঝে সমর্পিত। তা হলে তাদের দুনিয়াবি জীবন সুন্দর হবে, শৃঙ্খলাপূর্ণ হবে। আখেরাতের জীবন শান্তিময় হবে। তেমনিভাবে দায়িত্বশীলদের আনুগত্যহীন জীবন দুনিয়া ও আখেরাতে তার বিপরীত হবে, এটাই স্বাভাবিক।

দায়িত্বশীল ব্যক্তির আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা নিজেই। সেই সঙ্গে এর দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকর দিকগুলোও বলে দিয়েছেন বোধগম্যময় স্পষ্ট শব্দে। কোরআনি নির্দেশ তাফাক্কু ফিদ্দীন- দ্বীনের গভীর ইলম অর্জনকে উপেক্ষা করা আজকের এই ভাসা ভাসা পণ্ডিতি ফলানো বিশৃঙ্খলাকালে দায়িত্বশীল ফকিহ তথা প্রাজ্ঞ মুফতির কথা মান্যের কোনো বিকল্প আছে বলে জানা নেই। তার ওপর যেখানে রয়েছে আল্লাহতায়ালার সুস্পষ্ট নির্দেশ- দ্বীন ও দুনিয়ার বিষয়ে দায়িত্বশীলের আনুগত্য করো।

নোমান বিন আরমান
লেখক ও সাংবাদিক
জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় বিষয়ে ফিকহি নির্দেশনা প্রদানের জন্য একটি সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ থাকা জরুরি। করোনাকালে মসজিদে জামাত আদায় ও লোকসংখ্যা নিয়ে আলেমদের মতবিরোধের পর এই প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে। একক কর্তৃপক্ষ বা গ্র্যান্ড মুফতি ছাড়া যে একটি অঞ্চলে প্রায়োগিক ফিকহি সৌন্দর্য ও একতা প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব- এই মতবিরোধ তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। ফলে লোকজন এখন বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন। সমাজ ও রাষ্ট্রে অন্তত জরুরি মুহূর্তে শৃঙ্খলা বজায়ের স্বার্থে জাতীয় ফিকহি বোর্ড বা গ্র্যান্ড মুফতির কোনো বিকল্প নেই।

এহসান সিরাজ
সিএসআর এক্সিকিউটিভ, অন্যরকম গ্রুপ
বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশে একজন গ্র্যান্ড মুফতি আছেন। তিনি রাষ্ট্রের ধর্মীয় বিষয়ে সর্বশেষ শরয়ি দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। খেলাফতের সময়ও এমনটা ছিলো। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এমন একজন গ্র্যান্ড মুফতি প্রয়োজন। যিনি সরকার ও দেশবাসীকে সম-সাময়িক বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেবেন।

মুফতি রেজাউল করিম আবরার
ফিকহ বিভাগীয় প্রধান, মাদরাসা আবুবকর সিদ্দিক রা. যাত্রাবাড়ি, ঢাকা
আমার ক্ষুদ্রমতে দেশে একজন গ্র্যান্ড মুফতির প্রয়োজন আছে৷ তবে কোনো বিষয়ে ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে দেশের শীর্ষস্থানীয় মুফতিদের সমন্বয়ে একটি বোর্ড থাকবে৷ বোর্ডে পর্যালোচনার পর গ্র্যান্ড মুফতির নামে ফতোয়া প্রকাশিত হবে৷ তাহলে জনসাধারণের জন্য সেটা বুঝতে সহজ হবে৷

মুফতি সাঈদ কাদির
খতিব, মসজিদুল আকসা, ১০ নং ওয়ার্ড, গাজীপুর মহানগর
ইসলাম সর্বকালীন ধর্ম। কালের পরিক্রমায় মানুষের সামনে আসে নতুন নতুন সমস্যা। ইসলাম কোরআন-হাদিসের মূলনীতির আলোকে সব যুগের সব সমস্যার সমাধান দেয়। কিন্তু নতুন সমস্যা বা সমকালের উদ্ভুত পরিস্থিতির ইসলামি সমাধান দেওয়ার জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রে একজন ‘আল মুফতি আল আম’ বা গ্র্যান্ড মুফতি থাকা দরকার। যাতে করে তিনি উদ্ভুত সব জিজ্ঞাসা ও সমস্যার ইসলামি সমাধান দিতে পারেন। যেহেতু গ্র্যান্ড মুফতি হবেন সব মত ও চিন্তাধারার লোকের পছন্দের ব্যক্তি, সেহেতু মতপার্থক্য ও মতবিরোধের বিষয়গুলোর সমাধান তার পক্ষ থেকে আসলে তা হবে সর্বজন গৃহীত।

রাষ্ট্রের নাগরিকদের ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। সুতরাং রাষ্ট্রপ্রধান নিরপেক্ষ, যোগ্য ও জ্যেষ্ঠ একজন মুফতিকে ‘গ্র্যান্ড মুফতি’ হিসেবে নিয়োগ দেবেন। আধুনিক মাসয়ালা, বিভিন্ন পরিস্থিতে ধর্মীয় ব্যাখা ও ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে একমাত্র কার্যকরী হবে- গ্র্যান্ড মুফতির সিদ্ধান্ত।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে গ্র্যান্ড মুফতি নিয়োগের দাবি জোরালো হচ্ছে