নদী ধ্বংস করে কোনো প্রতিষ্ঠান নয়: নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এমপি বলেছেন, নদীর পাড়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান হবে, বড় বড় স্থাপত্য হবে কিন্তু নদীকে রক্ষা করে সেসব প্রতিষ্ঠান করতে হবে, নদীকে ধ্বংস করে নয়।
তিনি বলেন, সরকার নদী রক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদের মন্ত্রণালয়ে যেসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, সেটা অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ করেই করা হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে সার্ভে ঠিকমতো না করেই প্রকল্প নেওয়ার নজিরও আছে। তবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অংশীজনদের মতামত ও সার্ভে সম্পন্ন করে যাতে প্রকল্পগুলো নেওয়া হয়, সেটি আমি কেবিনেটে তুলবো।
রোববার (২৬ মে) দুইদিনব্যাপী রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ মিলনায়তনে ‘জাতীয় নদী সম্মেলন’-এর শেষদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এ সব কথা বলেন।
অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (এএলআরডি), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), পানি অধিকার ফোরাম, রিভারাইন পিপল ও বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দলের যৌথ উদ্যোগে নদী রক্ষায় এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
বালুমহাল নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সম্পর্কে প্রতিমন্ত্রী বলেন, হাইড্রোগ্রাফিক সমীক্ষা ছাড়া কোথাও কোনো বালুমহাল করতে দেওয়া যাবে না এবং নদীতে কোনো স্লুইসগেট থাকবে না, এটিও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আছে।
এই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। কোনো ব্যত্যয় দেখলে আপনারা পরিচয় গোপন করে আমাদের জানাবেন। আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
খালিদ মাহমুদ আরো বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী সরকার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ৪০ শতাংশ ড্রেজিং করবে। বাকি ৬০ শতাংশ নিয়মানুযায়ী টেন্ডারের মাধ্যমে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার অধীনে দেওয়া হয়। বর্তমানে ১শ ৫০টি ড্রেজার মেশিন সরকারের কাছে আছে। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে কাজ সম্পূর্ণ হচ্ছে না।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান সারোয়ার মাহমুদ বলেন, নদী কমিশনের দায়িত্ব মূলত সুপারিশ করা। আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতা তাদের দেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, নদীর নাব্যতা, নদীদূষণ, নদীদখল, দখল বা অপদখল এই তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে কৌশলগত পরিকল্পনা মাফিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করলে আমাদের লক্ষ্য পূরণ হবে। এজন্য স্থানীয় মানুষদের অভিজ্ঞতার আলোকে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, সিএস রেকর্ডে নদীর উল্লেখ থাকলেও পরবর্তীতে দেখা যায়, সেটা স্বার্থান্বেষী মহলের প্রভাবে ব্যক্তি মালিকানার নামে রেকর্ড হয়ে আইনি জটিলতা তৈরি। আইনের অপপ্রয়োগের এই বিষয়গুলো সম্পর্কে জনগণকে আরো সচেতন করতে হবে। অবৈধ দখলকৃত জায়গা শুধু উদ্ধার করলেই হবে না, সরকারের পক্ষ থেকে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় দেখা যায়, এক পক্ষকে উচ্ছেদ করলে আরেক পক্ষ এসে সেটি দখল করে বসবে কিংবা সেই পক্ষেই ফের দখলে চলে আসে।
বাংলাদেশের নদীর জীবন ও অধিকারবিষয়ক প্রবন্ধ উপস্থাপনায় গবেষক ও নদী আন্দোলনকর্মী শেখ রোকন নদী রক্ষায় চারটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রস্তাবনা দেন।
নদীকে মুক্তভাবে চলতে দেওয়া, নদীনির্ভর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে নদীর অর্থনৈতিক যোগাযোগ স্থাপন করা, নদীর প্রতিবেশগত ঝুঁকি হ্রাস করা এবং নদীর পুনরুজ্জীবনের জন্য আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা; এছাড়াও আমাদের নদীগুলো কোথায় আছে, কেমন আছে, তা জানা, এ দৃষ্টিভঙ্গিতে আগালে আমরা নদী বাঁচাতে পারবো বলে মনে করেন তিনি।
নদী সুরক্ষায় যুক্ত আন্দোলনকর্মীদের দুই বছরের (২০২৪-২৬) একটি রোডম্যাপ তুলে ধরে বেলা’র প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নদীর অর্থনৈতিক গুরুত্বকে আমরা প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে নিয়ে এসেছি নানাভাবে দখল-দূষণ, বালু-পাথর উত্তোলন করে।
এ সময় দখল-দূষণকারীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা জনসম্মুখে প্রকাশ করার দাবি করেন তিনি।
এছাড়াও, বালু-পাথর উত্তোলনের রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর গবেষণা করা এবং নদীর উন্নয়নে জনসংযোগ বৃদ্ধি, নদীবিষয়ক ডাটাবেজ তৈরি, অ্যাডভোকেসি ও আইনি উদ্যোগ, নদীর ‘স্বাস্থ্য কার্ড’-এর রূপরেখা প্রণয়ন (শিল্পদূষণ, গৃহস্থালি বর্জ্য, এন্টিবায়োটিক পলি, রাসায়নিক কীটনাশক ও সারের প্রভাব); নদী সংবাদকর্মী প্ল্যাটফর্ম গঠনসহ বেশ কিছু কর্মসূচি তিনি তার রোডম্যাপে উল্লেখ করেন।
এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, নদীর যত দখল, দূষণ এর সবকিছুর সঙ্গে ব্যবসায়ী মহল এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা যুক্ত। নদী নিয়ে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে।
এজন্য তিনি সরকারিভাবে 'নদী সপ্তাহ' ঘোষণার আহ্বান জানান।
মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির বলেন, সবার মধ্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পাশাপাশি দায়িত্বশীলতা আনতে হবে। বর্তমানে সব জায়গায় দায়িত্বহীনতা চরমভাবে বিরাজ করছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ মো. শরীফ উদ্দিন, এনডিসি বলেন, আমাদের অনেক ভৌত উন্নয়ন হয়েছে। এখন প্রয়োজন নৈতিক উন্নয়ন। আমাদের নৈতিক চরিত্র পথ দেখাবে আলোর দিকে। নৈতিক চরিত্র উন্নয়ন হলে কেউ আর অন্যায়ভাবে নদী দখল, দূষণ করবে না।
নদী সম্মেলনের সমাপনী দিনের সভাপতি ড. আইনুন নিশাত বলেন, আমাদের দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ পলি পরিবাহিত হয়ে আসে, বাজেট সীমাবদ্ধতার কারণে তা দীর্ঘকাল ধরে আর পরিমাপ করা হচ্ছে না। আমাদের বালু উত্তোলন প্রয়োজন কিন্তু তা পরিকল্পিতভাবে হতে হবে এবং যথাযথ মনিটরিং করতে হবে। নদী সম্পর্কে বেসিক ডাটা নেই। স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন অঞ্চলে এরকম সম্মেলন হলে আরো বিস্তারিত আলোচনা হয়।
প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন রংপুর কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মো. এজাজ, নদী পরিব্রাজক দল-এর মো. মনির হোসেন এবং সিসিডিবি’র নির্বাহী পরিচালক জুলিয়েট কেয়া মালাকার।
এছাড়াও দেশের ৮টি বিভাগ থেকে ৮ জন নদী আন্দোলনের সাথে যুক্ত প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন।
অংশীজনদের নিয়ে সম্মিলিতভাবে অতিবিপন্ন নদীগুলোকে কীভাবে রক্ষা করা যায়, সে বিষয়ে বিশদ নাগরিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের ৮ বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ১শ নদী আন্দোলনকর্মী যোগদান করেন।