মিথ্যার প্রলেপে মোড়ানো মরণফাঁদ ‘ই-সিগারেট’

  • ফাওজিয়া ফারহাত অনীকা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইফস্টাইল
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ভ্যাপিংয়ের অভ্যাসটি মোটেও নিরাপদ নয়

ভ্যাপিংয়ের অভ্যাসটি মোটেও নিরাপদ নয়

ধূমপান করা স্বাস্থ্যের জন্য কতখানি ক্ষতিকর, সেটা নিয়ে এর আগেও বেশ কয়েকবার কথা বলা হয়েছে।

আলোচনা করা হয়েছে সিগারেট পানের বিভিন্ন নেতিবাচক দিক সম্পর্কে। মূলত সিগারেট থেকে দূরে থাকার জন্যেই বিগত কয়েক বছরে ই-সিগারেটের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে এখনকার তরুণসমাজ। কিন্তু তাই বলে ই-সিগারেট ব্যবহার বা ভ্যাপিংকে নিরাপদ বলে ধরে নেওয়ার কোন অবকাশ নেই মোটেও। বরং ধূমপানের মতই ক্ষতিকর ও বিপদজনক বলা হচ্ছে ভ্যাপিংকেও।

ই-সিগারেট ও ভ্যাপিং কী?

vaping

বিজ্ঞাপন

ভ্যাপোরাইজার থেকেই ভ্যাপ বা ভ্যাপিং শব্দটির উৎপত্তি। বিশেষভাবে তৈরিকৃত যন্ত্রের সাহায্যে কোন সল্যুশন বা জ্যুসকে তাপের সাহায্যে অ্যারোসলাইজ করার প্রক্রিয়া হলো ভ্যাপিং। আর এই যন্ত্রটি হলো ই-সিগারেট। এতে প্রধানত নিকোটিন বেসড সল্যুশন ব্যবহার করা হয়।

ভ্যাপিং ডিভাইসটিই যেখানে আলাদাভাবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, সেখানে এতে ব্যবহৃত ভ্যাপ সল্যুশন আরও বেশি ক্ষতিকর উপাদান হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের কার্ডিওলজিস্ট তামান্না সিং জানান, ই-সিগারেটে ব্যবহৃত উপাদানের সাথে কার্ডিওপালমোনারি টক্সিসিটি ও ক্যানসারের সংযোগ রয়েছে। এছাড়াও এই সল্যুশনে নিকোটিন উপস্থিত থাকে, যা অতি উচ্চমাত্রায় আসক্তি তৈরি করে।

বিজ্ঞাপন

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ড্রাগ অ্যাবিউজের তথ্য মতে, ভ্যাপিংয়ের ফলে ডোপামিন নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং যা মস্তিষ্কের কাছে প্রশান্তিদায়ক অনুভূতি পৌঁছে দেয়। এতে করে খুব সহজেই মস্তিষ্ক ভ্যাপরকে তার প্রশান্তিদায়ক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করে ফেলে এবং তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে।

মানুষ কেন ই-সিগারেটের প্রতি ঝুঁকছে?

vaping

এখানে খুব সহজভাবে শুধু একটি কথাই বলতে হয়- মার্কেটিং। ই-সিগারেট বাজারজাতের শুরু থেকেই একে নিরাপদ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। সিগারেট ও ধূমপানের ক্ষতিকর বিষয়গুলো সবার কাছেই প্রকাশ্য ছিল এবং সকলেই এই বিষয়ে অবগত ছিল। সেখানে ই-সিগারেটকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় স্বাস্থ্যকর অপশন হিসেবে, যা সিগারেটের আসক্তিকে দূর করতেও সাহায্য করবে।

ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের পালমোনলোজিস্ট (বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ) জন কার্ল ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ভ্যাপিংকে ধূমপান থেকে নিবৃতিমূলক বিষয় হিসেবে দেখানো হয়। দেখানো হয় যে ভ্যাপিং এর ফলে কত ধরনের উপকার পাওয়া সম্ভব।’

এটা সত্য যে প্রতি বছর ধূমপানের কারণে ৪৮০,০০০ মানুষ মারা যাচ্ছে। এই সংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে ও ধূমপান বিমুখ করতেই ই-সিগারেটের উদ্ভাবন। যেটা কিনা তুলনামূলক কম ক্ষতিকর। কিন্তু কতটা কম ক্ষতিকর সেটা নিশ্চিতভাবে জানাতে পারেনি কেউ।

এক্ষেত্রে জন কার্ল পরামর্শ দেন, যারা ধূমপায়ী এবং এই অভ্যাস ত্যাগ করার চেষ্টা করছেন, তারা ভ্যাপিং শুরু করতে পারেন। কিন্তু শুধুমাত্র আধুনিকায়ন বা শখের বশে এই অভ্যাস একেবারেই শুরু করা যাবে না।

ভ্যাপিং থেকে ফুসফুসের ক্ষতি

vaping

যদিও ভ্যাপিংয়ের প্রচলনটি কিছুদিন হলো শুরু হয়েছে, তাই এক্ষেত্রে বড় ধরনের কোন গবেষণা নেই। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ভ্যাপিং এর ফলে ফুসফুসে প্রদাহ ও সমস্যা তৈরি হয় বলে জানিয়েছেন কার্ল। ভ্যাপিং এর ফলে খুব সুক্ষভাবে ফুসফুসের উপর নেতিবাচক প্রভাবের সৃষ্টি হয়। যা থেকে ইনফেকশনের সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি।

২০১৯ সালের একটি গবেষণার ফলাফল থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ভ্যাপিং থেকে শ্বাসকষ্টযুক্ত কাশি ও বক্ষব্যাধির নানা ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। অন্তত ৩০ হাজার নিয়মিত ই-সিগারেট ও ধূমপায়ীদের উপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, যারা ভ্যাপিং বা ধূমপান করে না, তাদের তুলনায় যারা করে তাদের ফুসফুসজনিত সমস্যাগুলো প্রকট।

ভ্যাপিং থেকে হৃদরোগের প্রাদুর্ভাব

vaping

প্রথমেই বলা হয়েছে ই-সিগারেটেও থাকে নিকোটিনের উপস্থিতি। যেহেতু ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা ধরেই নেয় এতে তাদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা অতিরিক্ত ভ্যাপিং করে। যা প্রবলভাবে হৃদযন্ত্রের উপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ডাঃ সিং জানাচ্ছে, হৃদযন্ত্রের উপর নিকোটিনের ক্ষতিকর ও নেতিবাচক প্রভাব নতুন কিছু নয়। হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও সাডেন কার্ডিয়াক ডেথের মতো গুরুতর সমস্যাও দেখা দিতে পারে ভ্যাপিং এর ফলে। তিনি আরও জানান, ভ্যাপিং থেকে নিঃসৃত নিকোটিন উচ্চ রক্তচাপ তৈরি করে ও কোলেস্টেরলের মাত্রায় অসামঞ্জস্যতা তৈরি করে। যা খুব সহজেই হৃদযন্ত্রকে নাজুক অবস্থায় ফেলে দেয়।

২০১৭ সালের ন্যাচার রিভিউ কার্ডিওলজির তথ্যানুসারে, সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত যতজন ই-সিগারেট ব্যবহারকারীরা হৃদরোগের বিষয়ে জানিয়েছে, পরীক্ষা করে দেখা গেছে সকল সমস্যা তৈরি হয়েছে নিকোটিন থেকে।

এছাড়া ২০১৯ সালের একটি গবেষণার তথ্য জার্নাল অব অ্যামেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজিতে প্রকাশ হয়। যেখানে জানানো হয়, ই-সিগারেটে ব্যবহৃত লিকুইড থেকে এন্ডোথেলাইয়াল সেল ডিসফাংশন তৈরি করে, যা থেকে হৃদরোগের সৃষ্টি হয়।

বিস্ফোরণ ঘটতে পারে ব্যবহারের সময়

যেখানে ই-সিগারেট ব্যবহারের হাজারো ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে, সেখানে আরও বড় ধরনের অভিযোগও রয়েছে ই-সিগারেট ব্যবহারে। ২০১৯ সালের জুনে মার্কিন যুক্তরাজ্যের ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরের ই-সিগারেট বিস্ফোরিত হয় ব্যবহারের সময়। ফলে তার মুখের নিচের অংশ তথা চোয়াল মারাত্মকভাবে জখম হয় এবং গালের মাংসল অংশ ভয়াবহ ক্ষত হয়। পড়ে পরীক্ষা করে দেখা যায়, অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে এমন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।

এখনও অনেকে ই-সিগারেট ও ভ্যাপিংকে নিরাপদ ভেবে ব্যবহার করে যাচ্ছে এবং এবং এটা ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী হচ্ছে। অথচ এর পেছনেও রয়েছে অসুস্থতা ও স্বাস্থ্যহানীর কালো ছায়া।

আরও পড়ুন: কতখানি নিকোটিন থাকে একটি সিগারেটে?

আরও পড়ুন: ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ছে প্রাত্যহিক যে সকল কাজে