‘ছবি তুলে চলে যায়, বই কিনে না’
‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’সামনের টেবিলে থরে থরে সাজানো বই। কাব্যগ্রন্থ থেকে উপন্যাস, আত্মজীবনী থেকে অনুবাদ-কি নেই! বইয়ের প্রচারেও কোনো কমতি রাখেনি প্রকাশনা কর্তৃপক্ষ। সবখানেই ঝুলছে কি কি বই আসল, তারই বিবরণীর ব্যানার-ফেস্টুনে। কিন্তু সেই বই ছুঁয়ে দেখার, কেনার পাঠক কোথায়?
তাই কেমন সাড়া পাচ্ছেন, এমন প্রশ্নে কণ্ঠজুড়ে মন খারাপের সুর বিক্রয়কর্মী জান্নাতুল ফেরদৌস সোনিয়ার। একরাশ হতাশা নিয়ে বইয়ের ওপর জমে থাকা ধুলো মুছতে মুছতে এই তরুণী বললেন, ‘সবাই এসে ছবি তুলে চলে যায়। বই কিনে না। বইমেলা শেষের দিকে। কিন্তু আমাদের প্রত্যাশার অর্ধেকও এখনো পূরণ হয়নি।’
চট্টগ্রাম বইমেলার ‘গলুই’ নামের একটি প্রকাশনীর স্টলের এই নারী বিক্রয়কর্মীর হাহাকার যেন পুরো মেলারই প্রতিকী চিত্র। অথচ প্রতিদিন বিকেল গড়াতেই মেলায় ভিড় নামে দর্শনার্থীদের। সেই ভিড় লেগে থাকে রাত পর্যন্ত।
চট্টগ্রামে এই প্রথমবারের মতো নগরীর রেলওয়ে সেন্ট্রাল বিল্ডিংয়ের (সিআরবি) শিরিষতলায় বসেছে অমর একুশে বইমেলায়। এর আগে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে বসত এই বইমেলা। ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই বইমেলায় সহযোগিতা করছে চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, চট্টগ্রাম নাগরিক সমাজের সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন। বইমেলায় চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ সারা দেশের মোট ৯২টি প্রকাশনা সংস্থার স্টল রয়েছে। সবমিলিয়ে মেলায় ১৫৫টি স্টল রয়েছে।
সোমবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেল তিনটার দিকে বইমেলায় গিয়ে দেখা যায়, তখনো সেভাবে ভরে উঠেনি মেলা প্রাঙ্গণ। তবে সন্ধ্যার আগে দর্শনার্থীদের ভিড় বাড়ে। অধিকাংশ স্টল ঘুরে দেখা যায় ক্রেতার চেয়ে বই নিয়ে ছবি তোলার মানুষই বেশি।
চারুলিপি প্রকাশনী সংস্থার স্টলে কথা হয় বিক্রয়কর্মী মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে। জানতে চাইলে এই তরুণ বলেন, ‘এবার আমাদের প্রকাশনী সংস্থা ১৫টি নতুন বই এনেছে। আর সবমিলিয়ে ১০০ লেখকের বই আছে আমাদের স্টলে। কিন্তু তেমন সাড়া পাচ্ছি না। অন্যান্য বছরে এই সময়ের মধ্যে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকার বই বিক্রি হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাত্র ১ লাখ টাকার মতো বই বিক্রি হয়েছে।’
একই সুর অক্ষরবৃত্তের রাজেশ শীলের কণ্ঠেও। তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু লেখকের বই ভালোই বিক্রি হচ্ছে। সাড়াও পাচ্ছি এসব বই নিয়ে। কিন্তু সার্বিকভাবে বই বিক্রির হার হতাশাজনক। মানুষ আসছে, বই দেখছে কিন্তু কিনছে কম। আরও ভালো কিছু আশা করেছিলাম আমরা।’
হাওলাদার প্রকাশনী নামের আরেকটি প্রকাশনী সংস্থার স্টলে গিয়ে দেখা যায় দুই বিক্রয়কর্মী অবসর সময় পার করছেন। জানতে চাইলে তাঁদের একজন বললেন, ‘হতাশাজনক। বই বিক্রি নেই, বসে আছি।’
কেন সাড়া কম:
বই বিক্রি কম হওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার কর্মীদের সঙ্গে কথা হলে সবাই একটা কারণকে সামনে এনেছেন। তাঁরা বলেছেন, স্থান পরিবর্তনের কারণে সাড়া মিলছে কম। আগে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে মেলা হতো, সেখানে দর্শনার্থীদের ভিড়ও ছিল বেশি। কেননা এলাকাটি ছিল জনবহুল। অবশ্য সিআরবিতেও এখন মানুষের ভিড় থাকে, তবে সেখানে বেশিরভাগই মানুষ ঘুরতে-বেড়াতে যান। এ জন্য শুরুর দিকে প্রকাশনী সংস্থাগুলো এই জায়গায় মেলা করা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। তবে খেলার মাঠে মেলা নয়-জেলা প্রশাসনের এই নির্দেশনার কারণে তাঁদের সেই চাওয়া পূরণ হয়নি। এখন তাই বিক্রি কম হওয়ায় সেটি আবার সামনে আনছেন তাঁরা।
তবে প্রকাশনী সংস্থার এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে একটা অদ্ভূত কৌশলের বিষয় সামনে আনেন বইমেলার আহ্বায়ক ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু।
তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বই কম বিক্রি হচ্ছে, এমন দাবি তাঁদের একটা কৌশল হতে পারে। আমি অনেক ভেবে বুঝলাম অধিক বই বিক্রির কথা প্রচার হলে লেখকেরা বেশি রয়্যালিটি দাবি করতে পারেন। এখন কম বিক্রির কথা প্রচার হলে লেখকেরা সেই দাবি করতে পারবেন না। সেজন্য হয়তো বই বিক্রি কম হচ্ছে এমন কৌশল সামনে আনতে পারে তাঁরা।’