'নুন আনতে পান্তা ফুরায়' নারী শ্রমিক অঞ্জনা রাণীদের
‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’''নুন আনতে পান্তা ফুরায়' কিসের হামার (আমাদের) শ্রমিক দিবস। একদিন মাইনষের (মানুষের) জমিত কাজ না করলে নাখায়া (খেয়ে) থাকা নাগে (লাগে)। উঠবেলা-ডুববেলা (সকাল-সন্ধ্যা) কাজ করি যা পাই তা দিয়া সংসার চলে না। সমাজে নারীর শ্রমের কোন দাম নাই। তা না হলে পুরুষ মাইনষের সাথে সমান তালে কাজ করি তাদের চেয়ে অর্ধেক মজুরি পাই।'
বুধবার (১ মে) সকালে কথাগুলো বলছিলেন রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কান্দি ইউনিয়নের নিজ পাড়া গ্রামের একটি ধান ক্ষেতে কাজ করা নারী শ্রমিক অঞ্জনা রাণী্। ওই গ্রামের বাসিন্দা পঞ্চাশোর্ধ্ব অঞ্জনা রাণী স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করেন।
অঞ্জনা রাণী জানান, অসুস্থ স্বামী কাজ করতে অক্ষম। তাই স্বামীর চিকিৎসার খরচসহ সন্তানদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব তার উপর। কাজ করলে খাবার জোটে না হলে অনাহারে -অর্ধাহারে থাকতে হয়। পুরুষের মতো হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও সংসার চলে না। একজন পুরুষ যে মজুরি পায় তার অর্ধেক মজুরি দেয়া হয় নারী শ্রমিকদের। ফলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা।
শুধু অঞ্জনা রাণী নন, তার সঙ্গে কাজ করা অন্য নারী শ্রমিকদেরও একই কথা। কোন দিন তারা শোনেনি বা জানেন না মে দিবস কি। দিবসের তাৎপর্যই বা কি। তারা শুধু জানে 'মানুষের কাজ করে মজুরি পাওয়া যায় না করলে নাই।
মজুরি বৈষম্যের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে নারী শ্রমিকরা বলেন, আমরা চরে কৃষিকাজ করে থাকি। চরে ধান, গম, ভুট্টা ও আলুসহ নানা ফসল উৎপাদন হয়। এসব ফসলি জমিতে চারা রোপন থেকে উত্তোলন পর্যন্ত সবকাজ নারীরা করেন। এসব ফসলি জমিতে পুরুষ কাজ করলে যে পরিমাণ মজুরি পায় নারী শ্রমিকরা কাজ করলে তার অর্ধেক মজুরি পান। এটা এক ধরনের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলা তিস্তা নদী বেষ্টিত। শুষ্ক মৌসমে কয়েক হাজার হেক্টর জমি চর জাগে। এসব জমিতে বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হয়। চরের জমিতে চাষাবাদের জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। এসময় নারী শ্রমিকের চাহিদা চোখে পড়ার মত। স্বল্প মজুরিতে নারী শ্রমিক পাওয়ায় জমির মালিকেরা নারী শ্রমিকদের কাজে ডাকেন বেশি। ফলে প্রতি বছর তিন থেকে চার হাজার নারী শ্রমিককে চরের জমিতে কাজ করতে দেখা যায়।
নারী শ্রমিক আনোয়ারা বেগম বলেন, 'আমার স্বাস্থ্য ও শক্তি ভাল ছিলো। নিজ এলাকা বাদে পাশের এলাকা থেকে কাজের ডাক আসতো। দীর্ঘ ৫-৬ বছর ধরে শ্রমিকের কাজ করি।' সংসারে অসুস্থ্য স্বামীসহ ৩ সন্তানের ভরণ পোষণের দায়িত্ব এখন তার উপর। তাই একদিন কর্ম না করলে অর্ধাহারে অনাহারে থাকতে হয়। ফলে কর্ম এখন আনোয়ারা বেগমের নিত্য দিনের সঙ্গী। অন্য ১০ জন পুরুষের মত পরিশ্রম করেও মজুরি বৈষম্যের শিকার হতে হয় । সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত পুরুষের সাথে কাজ করে মজুরী পাই অর্ধেক।
তিনি বলেন, 'বর্তমানে প্রতিটা পুরুষের সাথে সমান তালে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হয়। তা না হলে মালিক পক্ষ কাজে নিতে চায় না। মাটি কাটার কাজ করি, পুরুষ যে তালে কাজ করে আমাদেরকেও কাজ করতে হয় সেই তালে। কিন্তু মজুরি দেয়া হয় পুরুষের অর্ধেকেও একটু বেশি। এ সমাজে নারীদের কাজের কোন মূল্য নাই। এখন পুরুষ শ্রমিকদের ৬শ' টাকা মজুরি। কিন্তু আমরা পাই ৩শ' থেকে ৩৫০ টাকা। নিরুপায় হয়ে কাজে আসি। বাড়ির পুরুষ যে কাজ করতে অক্ষম। কাজ না করলে স্বামী, সন্তানদের নিয়ে না খেয়ে মরতে হবে। তাই মালিক যা দেয় তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।'
দলে কাজ করা নারী শ্রমিক জাহানারা বেগম বলেন, 'আমার স্বামী শ্রমিকের কাজ করত। অসুস্থতার কারণে দুই মাস ধরে বাড়িতে বসে আছে। অভাবের সংসার। স্বামী ও দুই মেয়ে এক ছেলে সন্তান নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটে। তাই শ্রমিকের কাজ করছি। কিন্তু যে মজুরি পাই তা দিয়ে সংসার চলে না। জিনিস পত্রের দাম বেশি। যে মজুরি পাই শুধু ভাতটুকু খেতে পারি। তাও আবার বুনো শাকসবজি দিয়ে খেতে হয়। সন্তানদের পাতে মাছ, মাংস দিতে পারি না।'
আরেক নারী শ্রমিক রেখা বেগম বলেন, 'হামার (আমাদের) কথা কেউ শোনে না। দিবস দিয়ে কি হইবে। কাজ হামাক (আমাদের) করি খাওয়া নাগবে। যামার দিবস তামরায় (তারাই) পালন করুক। এতো কাম (কাজ) করি কিন্তু টেকা (টাকা) পাই কম। এই অদৌত (রোদে) কাজ করলে মনে হয় জীবনটা বাইর (বের) হয়ে যায়। স্বামী, ছইল-পইলের (ছেলে-মেয়ের) মুখের দিকি দেখি কামত আসি। সারাদিন কাম করি যে টেকা পাই তা দিয়া সংসার চলে না।'