• এসএম জামাল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, কুষ্টিয়া
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

আমাদের আবার মে দিবস! কাজে আসলে কাজ শেষে ট্যাকা (টাকা) পাই, আবার কাজে না আসলে ট্যাকা নাই। আমরা অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে থাকলেও কেউ দেখে না, খবরও নেয় না। ইটভাটা মালিকও খবর নেয় না। এই আমাদের কষ্টের জীবনে আবার মে দিবস। এসব দিবস-টিবস আমরা বুঝি না।

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মশান এলাকার ইটভাটা শ্রমিক মহিন উদ্দিন। তার বাড়ি মিরপুর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে।

বিজ্ঞাপন

বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করেন তিনি। আগে ইট মাথায় করে আনা নেওয়ার কাজ করতেন, এখন ইট তৈরিতে পারদর্শী তিনি। প্রতি হাজার ইট তৈরি করলে পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন ৮শ' টাকা। এক্ষেত্রে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আবার একটু বেশি পাওয়ার আশা রাত অবধি কাজ করেন তিনি। তাতে করে কোন কোন দিন এক হাজার টাকা আয় করে থাকেন।

আজ মহান মে দিবস। দিনটা শ্রমিকদের। ‘শ্রমিক-মালিক গড়বো দেশ; স্মার্ট হবে বাংলাদেশ’- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সারা দেশে পালিত হচ্ছে এই মে দিবস। কিন্তু সে হিসেব নেই গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর যারা সত্যিকার অর্থে শ্রমিক। এই বিশেষ দিনেও কাজ করেই যাচ্ছেন এসব ইটভাটা শ্রমিকরা।

বিজ্ঞাপন

তবে এই মে দিবস পালন কেবল জেলা ও উপজেলা শহরেই করে থাকে সংশ্লিষ্টরা। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা যখন ছুটিতে, তখন ইটভাটা শ্রমিকরা গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদের মধ্যে কাজ করে থাকেন। সকাল পেরিয়ে দুপুরের খরতাপে মাথা থেকে কপাল চুইয়ে মুখ গড়িয়ে পড়ছে ঘাম। সারা শরীর জবজবে ভেজা। জীর্ণশীর্ণ শরীরটা দেখলেই বোঝা যায় কেমন খাটুনি খাটতে হয় তাদের।

মঙ্গলবার দুপুরে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি ইটভাটায় গিয়ে শ্রমিকদের কর্মযজ্ঞের এমন চিত্রই দেখা গেল। তারা জানালেন, ইটভাটায় অমানবিক কষ্টের কাজেও এ হাসি-খুশিটাই তাদের জীবনকে সচল রেখেছে।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মুখে হাসি নিয়ে কাজ করলেও তাদের দুঃখের সীমা নেই। একে তো স্বল্প মজুরি, তার উপর বছরের অর্ধেকটা সময়ই কাজ থাকে না, বাকি সময়টা খুঁজতে হয় অন্য কাজ। তারপরও পেটের জ্বালায় বারবার ফিরে আসেন এই ঘাম ঝরানো শরীর পোড়ানো কাজে।

এসব শ্রমিকদের সাথে মে দিবস নিয়ে আলাপ করলে তারা জানান, মে দিবস কী? মে দিবসের ছুটির কথা শুনে তারা শুধু হাসেন। সমাজের অনেকে হাসতে না জানলেও খেটে খাওয়া এ শ্রমিকরা প্রাণ খুলে হাসতে জানে! তারা ইটভাটা শ্রমিক, মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরিতে দিনভর শ্রম দেন তারা। সবারই এক কথা কাজ করলেই টাকা কাজ না করলে টাকা নেই। তাই আমাদের এই মে দিবসেও ছুটি নেই।

ইটভাটা শ্রমিক মিনারুল ইসলাম বলেন, সকালে কাজ শুরু করি। শেষ করার কোনো সময় নেই। সর্দার যতক্ষণ মনে করেন কাজ করান। কিন্তু বেশি কাজ করলেও বেশি টাকা দেয় না। প্রতিবাদ করলেই বাদ দিয়ে দেয়। তাই দিনশেষে মজুরি ওই ৫০০ টাকাই। এ দিয়ে চাল-ডাল, তরি-তরকারি কিনতে গেলে পকেটে আর কিছু থাকে না। এভাবেই দিন যায়, বছর ঘুরে। বাজারে সব কিছুর দাম বাড়লেও, মজুরি বাড়ে না’।

শাহীনসহ আরও বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানান, বছরের ছয় মাস ইটভাটাগুলোতে পুরোদমে কাজের ব্যস্ততা থাকে। আর বাকি ছয় মাস কেউ ক্ষেতে-খামারে কাজ করেন। আবার কেউ বা রিকশা, ভ্যান, ভাড়ায় অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। আবার অনেকে বেছে নেন রাজমিস্ত্রি জোগালি কিংবা দিনমজুরির কাজ।

শ্রমিকরা জানান, বছরের নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ইট বানানোর কাজ করতে হয় তাদের। আর এই কাজটি চুক্তি ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এ কাজে আসতে হয় মাঝির (সর্দার) মাধ্যমে। পুরো ছয় মাসের জন্য মালিকের হয়ে মাঝিই শ্রমিকের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করেন।

ইট পোড়ানোর জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করছিলেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক। কথা হয় মানিক আলী নামের এক শ্রমিকের সঙ্গে। তার বাড়ি মিরপুর উপজেলা খন্দকবাড়ীয়া এলাকায়।

মজুরি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মানিক আলী বলেন, রোদে শুকানো ইটভাটার কাছ থেকে ক্লিনের ভেতর আনা এবং সারিবদ্ধ করে কাঁচা ইট সেটিং করা, সেই কাজে মজুরি প্রতি হাজার ইটে ১৫০ টাকা। প্রতি চেম্বার ১৫ হাজার ইট দিয়ে সাজানোর জন্য অন্তত ১০-১২ জন শ্রমিক দরকার হয়। দিনশেষে এসব শ্রমিকের আয় হয় ৪৫০-৫৫০ টাকা।

এভাবেই ধাপে ধাপে প্রক্রিয়া শেষ করে সেসব ইট পোড়ানোর পর তা বাজারজাতকরণ করা হয়ে থাকে। ট্রলিতে করে ইটভাটা থেকে এসব ইট বাড়ি পৌঁছানোর জন্য ট্রলি প্রতি হাজারে ৩৫০-৫০০ টাকা নিয়ে থাকেন ট্রলি চালকরা। প্রতি ট্রলিতে ২ হাজার ইট নেওয়া যায়।

ভাটার ইট ট্রলিতে করে ক্রেতার বাড়ি পৌঁছে দেন জসিম উদ্দিন। মিরপুর উপজেলার বলিদাপাড়া এলাকায় বাড়ি তার। তিনি জানান, আমি ট্রলিচালক। সাথে আরেকজনকে নিয়ে ট্রলিতে ইট উঠানো ও নামানোর কাজ করি। শ্রমিক দিবস কী জানি না। মাসে ১০-১২ হাজার টাকা আয় করি এবং আমার সাথে যে থাকে তারও আয় ৭ হাজার টাকা হয়। কাজ থাকলে ভোর ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ও কাজ করি। তখন বেশি টাকা পাই।

মেসার্স এমবিএ ব্রিকসের মালিক মুকুল বলেন, শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্দারের সঙ্গে চুক্তি করতে হয়। সর্দার প্রয়োজন অনুযায়ী শ্রমিক নিয়োগ করেন। শ্রমিকদের নিয়োগ, মজুরি, ছুটি সব সর্দারই দেখেন।’

এবি ব্রিকসের ম্যানেজার আজাদ জানান, গতবারের থেকে এ বছর ইটের দাম কম। গতবছর ১০ হাজার টাকা ইট বিক্রি হলেও এ বছর ৮ হাজার টাকা বিক্রি হচ্ছে। ফলে বেশ লোকসানে পড়তে হচ্ছে আমাদের।


তিনি বলেন, আগে শ্রমিকদের অল্প টাকা আয় হলেও এখন বেড়েছে। আগে যেসব শ্রমিক আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা উপার্জন করতো, এখন তারা ৬শ টাকা থেকে কেউ কেউ ১ হাজার টাকাও আয় করছে।

জাতীয় শ্রমিক লীগ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিকনেতা আমজাদ আলী খান বলেন, অনেক সংগঠন রয়েছে। তবে ইটভাটায় কর্মরত শ্রমিকদের কোন সংগঠন নেই। যদিওবা নির্মাণ শ্রমিক নামের একটা সংগঠন রয়েছে। তবে ইটভাটার শ্রম সংগঠন না থাকায় নির্যাতিত নিষ্পেষিত হতে হয় তাদের। যারা ঘাম ঝরিয়ে শ্রম দিয়ে যায় তারাই হলো শ্রমিক। মূলধারার শ্রমিকদের থেকে কোন অংশেই কম নয় এসব ইটভাটার শ্রমিক। আগামীতে তাদের নিয়েও পরিকল্পনা করা হবে। যাতে তারা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।

কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. এ এস এম মুসা কবির বলেন, যারা ইটের ভাটায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তাদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। দিনের বেলা রোদ উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে কাজ করতে হয় তাদের, রয়েছে কয়লা কিংবা কাঠের আগুনে ইট পোড়ার তীব্র তাপ। ইটভাটায় কাজ করা এসব শ্রমিকদের কোনো ভালো আবাসস্থল থাকে না। ইটভাটার পাশেই টিন দিয়ে ছাপরা ঘর তুলে কোনোমতে তাদের রাত পার করতে হয়। স্বাস্থ্য সচেতনতা না থাকায় তারা কিছুদিন পর পর অসুস্থ হয়ে পড়েন।

এই তীব্র গরমে আধা ঘণ্টা পরপর পানি পানের পরামর্শ এবং তপ্ত দুপুরে কাজ না করার পরামর্শ দেন তিনি।

আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, কুষ্টিয়ার উপ-পরিচালক মো. জহিরুল হোসেন বলেন, কুষ্টিয়াতে ইটভাটা শ্রমিক সংগঠন নেই। চাইলে যে কেউই ট্রেড বা শ্রমিক সংগঠন করতে পারে। ইটভাটায় শ্রমিকরা চরমভাবে ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হলেও শ্রমিকরা পেটের দায়ে রোদে পুড়ে এ কাজ করছে। তাদের নেই সাপ্তাহিক ছুটি, নেই কোনো নিয়োগপত্র, নেই কোনো কর্মঘণ্টা, শ্রমিক রেজিস্ট্রার নেই, নেই ছুটির রেজিস্ট্রার, নেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা উপকরণ। তারা এখনো জানে না মে দিবস কী।

সুনির্দিষ্ট শ্রম কাঠামোতে আনা হলে এসব শ্রমিক উপকৃত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার ৬টি উপজেলায় মোট ইটভাটার সংখ্যা ১৯১টি।