লাগেজ- ট্রলির চাকায় ঘুরছে কুলিদের ভাগ্য
‘শ্রমিকের জয়গান কান পেতে শোন ঐ’ট্রেন আসার সঙ্গে সঙ্গে তাড়াহুড়ো শুরু হত। মানুষের ভিড় ঠেলে ট্রেনের দরজার পাশে অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন যাত্রী নামার। ট্রেন থেকে যাত্রীর নামতে ব্যাগ বস্তা মাথায় নিতে তোড়জোড় শুরু হত। এরপর এগিয়ে দিত স্টেশনের গেট পর্যন্ত। যাত্রীরাও খুশি হয়ে বকশিশ দিত তাদের।
বলছি, রেল স্টেশনের লাল রঙের হাফ হাতা শার্ট পরে ছোটাছুটি করা কুলিদের কথা। সময়ের পরিক্রমায় আগের মতোই সেই কদর নেই কুলিদের। আধুনিকতার চাকায় ভর করেই স্টেশনের গেটে পৌঁছে যায় যাত্রীদের ব্যাগ বস্তা। প্রতিদিন হাজারো যাত্রী কমলাপুর রেল স্টেশনে আসে-যায়। তবে কুলিদের ব্যস্ততা থমকে যায় ট্রেনের দরজায়।
কিন্তু সব কিছু থমকে গেলেও জীবন তো আর থমকে থাকে না। আধুনিক ব্যাগ, ব্যাগেজে দিন দিন আয়ের পথও সংকুচিত হচ্ছে কুলিদের। এখন চলন্ত ব্যাগ, লাগেজ আর ট্রলির চাকায় ঘুরছে লেবার শ্রমিকদের ভাগ্য। সংসার খরচ চালানো তো দূর, এখন নিজের পরিশ্রমের খাবার জোটানো দায় হয়ে পড়েছে কমলাপুর রেল স্টেশনের প্রায় আড়াই শত শ্রমিকের।
এমনই একজন শ্রমিক আনোয়ার হোসেন। ১০ বছর আগে দুলাভাইয়ের হাত ধরে কমলাপুরে লেবার শ্রমিকের পেশায় আসেন তিনি। এক দশক আগে লেবারের টাকায় নিজের গ্রামের ঋণ শোধ করেন। দৈন্যদশা অবস্থা কাটিয়ে পরিবারে কিছুটা স্বস্তি এনেছিলেন তিনি। কিন্তু সময়ের সাথে সে আয় থমকে গেছে। স্বপ্ন ভেঙে কুলি পেশার শিকলে বাঁধা পড়েছেন তিনি।
আনোয়ার বলেন, আগের মতো আর কাজ কাম হয় না। মানুষও ডাকে না। দিনে ৩০০-৪০০ টাকা আয় করি- ঘর ভাড়া বাচ্চাদের পড়াশুনা চালাতে পারি না।আমাগো অনেক সমস্যা হয়। কিন্তু আটকে গেছি একটা জালে। বাইরে যে অন্য কাজে যাব, কিন্তু কাজ পাই না। বাধ্য হয়ে এ কাজ ধরে আছি।
লেবারের আয়ের টাকায় সংসার চালানো কমলাপুর রেলস্টেশনের আড়াইশ’র বেশি লেবার শ্রমিকের জীবনের গল্প ঠিক আনোয়ারের মতোই । দীর্ঘদিন ধরে এক পেশায় থাকায় ছাড়তে পারেন না তারা। হতাশা আর তিক্ততার মাঝেও ঘাম ঝড়ান ভাগ্য বদলে। তবে ঘাম ঝড়িয়েও দৈন্যদশা থেকে মুক্তি মেলেনি হাজার বছরেও। হয়নি জীবন মানেরও উন্নয়ন।
লেবার শ্রমিকের সাথে জড়িতরা বলছেন, আধুনিক ব্যাগ ব্যাগেজ ব্যবহারে কাজের সুযোগ হারাচ্ছেন তারা। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনও পড়ে কুলিদের এড়িয়ে যাচ্ছেন অনেকে। তাই অর্থনৈতিক সংকটও বড় ভূমিকা রাখছে নিম্ন আয়ের এই মানুষগুলোর কাজের পরিধি কমাতে।
আব্দুর রাজ্জাক গাইবান্ধা থেকে কাছের এক আত্মীয়ের সাথে কমলাপুরে এসে ১২ বছর ধরে নিজের ভাগ্য বদলের চেষ্টা করে যাচ্ছেন তিনি। ভোর ৪ টা থেকে রাত ৮ পর্যন্ত স্টেশনের প্লাটফর্মে কাটালেও আয় হয় মাত্র ৪০০-৫০০ টাকা। খরচ বাদ দিয়ে পরিবারের জন্য থাকে মাত্র ১০০-২০০ টাকা।
ভাগ্যের উপর দোষ চাপিয়ে রাজ্জাক বলেন, আমাদের ২৫০ জনের বেশি মানুষ সবাই মুক্তি চায় কষ্ট থেকে। কিন্তু ভাগ্যের লেখন আর কি করমু। মানুষ তো না বুঝে অনেক অপবাদ দেয়। ছোটলোক বলে গালি দেয়। কিন্তু দুঃখ তো বোঝে না।
তিনি বলেন, বাড়িতে ১ মেয়ে দুই ছেলে পড়াশুনা করে। বাবা মা মিলে ৭ জনের সংসার। অল্প আয়ে চালাতে খুব কষ্ট হয়। কাজ না থাকলে আয় কেমনে হবে? মানুষ তো আর আমাদের ডাকে না।
সব পেশার মজুরির নির্দিষ্ট পরিমাণ থাকলেও এই লেবার শ্রমিকের নিদিষ্ট মজুরি নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের নিয়ে নানা আলোচনা হলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক এই শ্রমিকদের নিয়ে মাথা ব্যথা নেই কারো। শ্রমের ন্যায্য মজুরি টাও জোটে না এসব মানুষের ভাগ্যে। দৈন্যদশা থেকে মুক্তির স্বপ্নে দরিদ্রতার জালে আটকে যাচ্ছে তারা দিনের পর দিন।
কুলিদের জন্য সরকারের কাছে প্রণোদনা দাবি করেন কমলাপুর রেল স্টেশনে কুলিদের সর্দার মোবারক।
তিনি বলেন, আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য আমরা সব সময় চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে আমাদের বিতাড়িত করার ব্যর্থ চেষ্টা বার বার হয়েছে। আমরা এখন ট্রলি ব্যবহার করে মালামাল বহন করি। আমাদের মানুষ যা দেয় তা নেই। এখন আধুনিক ব্যাগ বের হয়েছে। অনেকে এই পেশা থেকে চলে যাচ্ছে। তবুও কেউ কেউ আঁকড়ে ধরে আছে। সরকার অন্যান্য পেশার মতো আমাদের জন্য যেন প্রণোদনার ব্যবস্থা করে।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়নের শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক ও জাতীয় শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজিকুল জামান রতন বলেন, দিন দিন শ্রমিকদের কাজের স্থান কমে আসছে। শ্রমিকের বিকল্পে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নানা যন্ত্র ও সরঞ্জাম তৈরি হয়েছে। যা কাজের পরিধিটা কমায় দিচ্ছে। আমরা সবাই প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের কথা বলি। কিন্তু অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক রয়েছে ৭০ শতাংশ। তাদের নিয়ে কেউ কথা বলে না।
তিনি মনে করেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক, কুলি, হকারসহ অন্যান্য শ্রমিক যারা আছেন তাদের অধিকার নয়ে কথা বলা জরুরি।
‘তাদের রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা জরুরি। এছাড়া তাদের কাজের স্থান নিরাপদ করতে না পারলে ভবিষ্যৎ আরও খারাপ হবে। তাই আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের পাশাপাশি নিম্ন আয়ের এসব মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করতে হবে। সরকারের উচিত তাদের দিকে তাকানো।’