মক্কার মিসফালাহ'র আফগান-উজবেক কাবাব

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মক্কার জমজমাট আফগান রেস্টুরেন্ট, ছবি: বার্তা২৪

মক্কার জমজমাট আফগান রেস্টুরেন্ট, ছবি: বার্তা২৪

মক্কা (সৌদি আরব) থেকে: গনগনে আগুনে গ্রিল হচ্ছে শত শত মুরগী। চুল্লিতে জ্বলছে বার-বি-কিউ। উনুনে ঝলসে তৈরি হচ্ছে বাহারি কাবাব। সুগন্ধে চারপাশ মাতোয়ারা।

দরজায় দাঁড়ানো দশাসই আবুল খায়ের। কাউন্টারে বোরহানউদ্দিন শশব্যস্ত। সারি সারি কাবাবের পাশে বিশাল আকারের রুটির স্তূপ। লাইনে ভিড় করে প্যাকেট ভরে নানা দেশের মানুষ কিনে নিচ্ছে খাবার। কাবাব বানানোর কাজে আর কাস্টমার সামলাতে ১০/১২ জন সুঠামদেহী কর্মচারির হিমসিম অবস্থা।

বিজ্ঞাপন

মক্কার মিসফালাহ এলাকার ইবরাহিম খলিল রোডের শেষ মাথা থেকে হারাম শরীফের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেলে হাতের ডান পাশে ফজর আল বাদই ও ইয়াজিদ হোটেলের নিচে জমজামাট 'আফগান রেস্টুরেন্ট' সবাই চেনেন। এই এলাকায় আফগান হোটেল একটিই। বাংলাদেশি, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি, তুর্কি খাবারের অনেকগুলো হোটেলের ভিড়ে একমাত্র আফগান রেস্টুরেন্টটি যেন সবার সঙ্গে একাই পাল্লা দিচ্ছে।

আমার দিক থেকে আফগান হোটেল বেছে নেওয়ার একটি কারণ আছে। একবার কাঠমাণ্ডুর এক তারকা হোটেলে কনফারেন্স শেষে বার-বি- কিউ পার্টিতে নেপালি কাবাব খেতে খেতে বিরক্ত আফগান বন্ধু ফিরিশতা আহরার বলেছিলেন, 'বেস্ট কাবাব খেতে হলে যেতে হবে কাবুল।'

বিজ্ঞাপন

কথাটি সত্য। আফগানিস্তান এবং বৃহত্তর অর্থে কাবাবের স্বর্গরাজ্য হলো মধ্য এশিয়া। কাজকিস্তান, তাজাকিস্তান, উজবেকিস্তানের কাবাব দুনিয়ার সেরা। সমরখন্দ, বোখারা, ফারগানা, গজনি, কাবুল, কান্দাহারের কাবার জগতময় মশহুর।

মক্কায় হাতের কাছে আফগান রেস্টুরেন্ট পেয়ে হানা দিয়ে অবাক হলাম। ভেতরে-বাইরে কাবাবের বিপুল ছড়াছড়ি। দাম খুবই সাশ্রয়ী। ৮/১০ রিয়াল দামে হাফ মুরগি ও বিরাট রুটি দিয়ে দু'জন লোক দিব্যি খেতে পারবে। ১৫/২০ টাকার ভেতর নানা পদের কাবাব দেদার বিক্রি হচ্ছে।

আফগানরা মূলত পশতু ভাষায় কথা বলেন। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের পাঠান-আফগানিরা বলেন হিংকো ভাষায়। পশ্চিম-উত্তর আফগানিস্তানের ইরান সীমান্তবর্তী আফগানদের ভাষা ফারসি। মজার ব্যাপার হলো, মক্কার মিসফালাহ'র আফগান রেস্টুরেন্টের কেউই এসব ভাষা জানেন না। মূল আফগানিস্তান সম্পর্কেও তাদের ধারণা অত্যল্প।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Dec/23/1545557584317.jpg

আলাপ করে জানা গেলো, এরা মূল আফগানিস্তানের দূরবর্তী চীনা তুর্কিস্তান সীমান্তের বদখশান এলাকার অধিবাসী। জাতিতে উজবেক। পাশের উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানে তাদের জাতি গোষ্ঠী বসবাস করে। রাজনৈতিক সীমানা ভাগাভাগিতে এরা পড়েছেন আফগানিস্তানে। আফগানিস্তানে এরা সংখ্যালঘু।

মক্কার আফগান হোটেলের আবুল খায়ের, বোরহান ভালো আরবি জানেন। কাজ চালানোর মতো ইংরেজি ও উর্দু তাদের জানা।

হাসিখুশি, সদালাপী উজবেক-আফগানরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। চাচা, ভাতিজা, ভাই, বেরাদার মিলে সামলাচ্ছেন দোকান। দেশ থেকে সক্ষম আত্মীয়দেরও নিয়ে আসেন প্রয়োজন হলে। 'হাজিদের খেদমতের সু্যোগ কাজে লাগাতে চেষ্টা করি। ব্যবসা বড় কথা নয় আমাদের কাছে,' বললেন বোরহান।

গরম গরম রুটি ও কাবাব তুলনামূলক সস্তায় পাওয়া যাওয়ায় আফগান রেস্টুরেন্টে বেজায় ভিড়। উপমহাদেশের লোকজন ছাড়াও আরবি, তুর্কি, ইরানি, মালয়েশিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান এবং বিশ্বের নানা জাতি উপচে পড়ে এ হোটেলে।

আফগান নামটি ব্যবহার করলেও তারা যে উজবেক তা কথা না বললে জানাই সম্ভব নয়। আলাপে আলাপে বোরহান, খায়ের সমরখন্দ, বোখারার কথা টেনে আনেন। চীনা উরঘুই মুসলিম, কাশগড় এলাকার কথা বলেন। তুঘতাই তুর্কিরা তাদের এলাকার প্রতিবেশি, সে কথাও বলেন।

মুঘলদের সঙ্গে এদের আত্মীয়তা আছে। উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের শরীরে উজবেক রক্তের অংশ রয়েছে। এদের ইতিহাসে আরো রয়েছে মধ্য এশিয়ার উলুগ বেগ, তৈমুর, চেঙ্গিসের ঐতিহ্য। সব কিছু একাকার হয়ে মধ্য এশিয়ার কাবাব শিল্প এদের হাতে বিকশিত হচ্ছে সুদূর মধ্যপ্রাচ্যের আরব ভূমির পবিত্র মক্কা নগরীতে।