হেঁটে হেঁটে কলকাতা
কলকাতা থেকে ফিরে:
'এ কলকাতার মধ্যে আছে আরেকটা কলকাতা/ হেঁটে দেখতে শিখুন...।’ কবি শঙ্খ ঘোষের এই পঙক্তি তো অনেকেরই পড়া, কিন্তু সত্যিই কি আস্ত কলকাতা শহরটাকে হেঁটে দেখা সম্ভব?
হয়ত একদা সম্ভব ছিল। ৩০/৪০ বছর আগের প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা শিয়ালদা স্টেশনে নেমে হেঁটেই যাবতীয় কাজ সেরে আবার বাড়ি ফিরে গেছে। সেই কলকাতার চৌহদ্দি ছিল উত্তরে শ্যামবাজার থেকে দক্ষিণে গড়িয়াহাট।
হাতিবাজার ধরে হাঁটতে উত্তর কলকাতার পুরনো বাড়ি-ঘর, দোকানপাট দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, একটি শহরকে প্রকৃত দেখা পায়ে দলেই সম্ভব। কিন্তু এখন কলকাতার যে বিস্তৃতি, তা পদাতিকের আয়ত্তের বাইরে।
কলকাতার আয়তন এখন উত্তরে ব্যারাকপুর পেরিয়ে খড়দহে ঠেকেছে। দক্ষিণে গড়িয়া ছাড়িয়ে বারুইপুর। পূর্ব দিকে সল্টলেক, নিউটাউন হয়ে চব্বিশ পরগনায় পেটে ঢুকে গেছে। পশ্চিমে গঙ্গার অপারে হুগলীতে নতুন সচিবালয় 'নবান্ন' হওয়ায় ব্যাসার্ধ বেড়েছে মহানগরের। এই কলকাতাকে এখন ছুঁতে হয় বাহারি উড়ালপুল, মেট্টো, এসি বাস, ওলা, উবারে।
তারপরও কলকাতার কিছু কিছু জায়গা হাঁটাই উত্তম। দূর থেকে কোনও যানে চেপে এসে যানবাহন ছেড়ে কিছুটা সময় হেঁটে হেঁটে অতীত ও ইতিহাসময় প্রকৃতিগন্ধী হওয়া যেন কলকাতার রেস্ত। ময়দানে, পার্ক ও ঘাটগুলোতে হাঁটাই দস্তুরমাফিক কাজ মনে হয়।
ফোর্ট উইলিয়াম, ভিক্টোরিয়া, ইডেন, রাজভবন, জেমস প্রিন্সেপ ঘাট এলাকা হেঁটে হেঁটে যে আরাম ও নান্দনিকা, তা যানে চড়ে অসম্ভব। প্রিন্সেপ ঘাট থেকে আউটরামের ঘাট, বাবুঘাট, হাইকোর্ট হয়ে মিলেনিয়াম পার্ক ছুঁয়ে গঙ্গার তীর ধরে হাওড়া ব্রিজের তলদেশ পর্যন্ত চলে যাওয়ার আনন্দ আর কিছুতেই হতে পারে না। যেতে যেতে কুমারটুলি, পাইকারি ফুলের বাজার আর প্রাচীন কলকাতার হৃৎস্পন্দন শোনাও কম মহার্ঘ নয়।
একই অনুভূতি একদার সাহেব পাড়া, পার্কস্ট্রিট ও সংলগ্ন উপপথ হয়ে পার্ক সার্কাস অবধি হবে। প্রাচীরঘেরা প্রাচীন প্রতিষ্ঠান, বৃক্ষশোভিত এভিনিউ, খ্রিস্টান কবরগাহ গা ছমছম রোমাঞ্চ জাগাবেই। হঠাৎ থমকে যেতে হয় ইতিহাসের প্রচণ্ড অভিঘাতে। বাংলার নবজাগরণ হয়েছিল 'ইয়ং বেঙ্গল' গ্রুপের যে তরুণ বিদ্রোহীর হাতে, সেই ভিভিয়ান লুই ডিরোজিও'র সমাধিসৌধ দেখে চমকে যেতেই হয়। কিছুদূর গিয়ে মাইকেল মধুসূদনের কবরের কাছে দাঁড়িয়ে আবেগ থামানো সত্যিই কষ্টকর।
তিলোত্তমা ও উপভোগের শত উপাচারের পাশে নিরবধি ইতিহাসের কলকাতাও। বনেদি কলকাতার হৃদয় অস্পর্শে কিছুতেই প্রকৃত কলকাতা দর্শন হয় না। লুপ্তপ্রায় ঐতিহ্য নিয়ে অশ্রুবর্ষণ যদিও অনেকের উপজীব্য, হাহাকার অনেকেই কলকাতার তথাকথিত অন্ধকার নিয়ে, তথাপি ঐতিহাসিক আলোকমালার কলকাতাই শহরের আসল অস্তিত্ব।
হাঁটতে হাঁটতেই কলকাতার নানা পাড়ার বিচিত্র ল্যান্ডস্কেপ, অদ্ভুত সাউন্ডস্কেপ, মন্দিরের ঘণ্টা, আজানের ধ্বনি, বাসের হর্ন, মস্তানদের বিবর্তন, সাংকেতিক ভাষা, হরেক কিসিমের জুয়ো, দিনরাতের ময়দান, ‘এসকর্ট গার্ল’ থেকে রামবাগান-দর্জি পাড়ার লালবাতি এলাকা, পকেটমার, রাতের ফুটপাথ নিয়ে চলমান এক অদেখা কলকাতাকে দেখা সম্ভব। অন্যভাবে কিংবা অন্য যানবাহনে যার দেখা পাওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
কলকাতায় হাঁটতে হাঁটতে উঁকিঝুঁকি মেরে যায় সুমনের গান, হারিয়ে যাওয়া পাখপাখালি আর জীবজন্তু, মেলা আর হাটবাজার-বিপণি, শহরজোড়া ঢালাও খাবারের পসরায় সাজানো স্ট্রিটফুড আর সব শেষে চেনা হয়ে যায় শহরের ক’জন অচেনা মানুষও। পায়ে হেঁটেই স্মৃতির মণিকোঠায় জমে থাকে অন্তরঙ্গ কলকাতার নস্টালজিক ছবি।