‘১৮ নভেম্বর শুক্রবার, ২০১৬ সাল। সকাল দশটার কিছু পর বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার মহাসচিব মাওলানা আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী ইন্তেকাল করেন। এর ঠিক তিনদিন পর (২১ নভেম্বর, সোমবার) হাটহাজারী মাদরাসায় বেফাকের কার্যনির্বাহী পরিষদের এক জরুরি সভা বসে। ওই সভায় বেফাকের গঠনতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে বেশকিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যার প্রেক্ষিতে বেফাকের প্রতি আলেম-উলামা ও ছাত্রদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে।’
এভাবেই রাজধানীর এক মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও বেফাকের উচ্চপদে আসীন এক আলেম বার্তা২৪.কম-এর চলমান সংকটের সূচনা সম্পর্কে কথা বলছিলেন।
আসলে কী কী হয়েছিলো সেদিন? উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমার মতে ওইদিন থেকেই শুরু হয় বেফাকে ক্ষমতা চর্চার পর্ব। মাওলানা আবদুল জাব্বারের ইন্তেকালের পর শুরু হয় বেফাকে মেরুকরণের নানা হিসাব। ওই হিসাব নিজেদের পক্ষে রাখতে সহকারী মহাসচিব প্যানেল থেকে কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে অর্থ সম্পাদক মাওলানা আবদুল কুদ্দুসকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। অথচ বিভিন্ন কমিটিতে সহ, সহকারী কিংবা সহযোগী পদগুলো রাখাই হয় ক্ষমতার ধারাবাহিকতা ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য। এক্ষেত্রে তা রক্ষা হয়নি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাটহাজারীর ওই বৈঠকে বেফাক পরিচালনার দায়িত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়। গঠনতন্ত্রে না থাকলেও গঠন করা হয় ১৩ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিশেষ কমিটি। কাউন্সিল ছাড়া শুধুমাত্র পক্ষ ভারী করার জন্য ৫ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে। ওই বৈঠকে সহ-সভাপতি পদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়- মাওলানা সাজেদুর রহমান, মাওলানা সফিউল্লাহ, মাওলানা নূরুল ইসলাম, মাওলানা আবদুল হামিদ মধুপুরের পীর, মাওলানা আবদুর রব (লালবাগ মাদরাসা) ও মাওলানা মোসলেহ উদ্দীন রাজুকে। তন্মধ্যে অধিকাংশই বেফাক সভাপতি আল্লামা শফীর খলিফা।
আর বেফাকের কার্যক্রম পরিচালনায় সহজতর করার লক্ষ্যে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির সদস্যরা হলেন- মাওলানা আশরাফ আলী রহ., মাওলানা আনোয়ার শাহ রহ., মুফতি ওয়াক্কাস, মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, মাওলানা আবদুল কুদ্দুস, মাওলানা নূরুল ইসলাম, মাওলানা সাজেদুর রহমান, মাওলানা মাহফুজুল হক, মাওলানা নূরুল আমীন, মাওলানা আবদুর রব, মাওলানা মুহাম্মদ আনাস মাদানী, মাওলানা মুসলেহ উদ্দীন রাজু ও মাওলানা মুনিরুজ্জামান।
এর পর ২০১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি বেফাকের দশম কাউন্সিলে নতুন কমিটি গঠন করা হয়, গঠনতন্ত্র সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু এখনও নতুন গঠনতন্ত্র অনুমোদন হয়নি। ফলে পুরোনো গঠনতন্ত্র মোতাবেক খাস কমিটি গঠন ও কার্যনির্বাহী কমিটির কলেবর বাড়ানো নিয়ে এক ধুম্রজাল রয়েছে। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।
এর পর চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারী মাদরাসায় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে বেফাকের মহাসচিব আবদুল কুদ্দসকে ভারপ্রাপ্ত সিনিয়র সহ-সভাপতি ও কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ অথরিটি ‘আল হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’-এর ভারপ্রাপ্ত কো-চেয়ারম্যান করা হয়। মাওলানা আবদুল কুদ্দুসকে এভাবে তিন তিনটি পদ দেওয়ায় বেফাকের নেতৃস্থানীয় আলেমদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
মূলত বেফাকের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও পদাধিকার বলে হাইয়াতুল উলইয়ার কো-চেয়ারম্যান আল্লামা আশরাফ আলী এবং এক নম্বর সহ-সভাপতি আল্লামা আনোয়ার শাহের মৃত্যুর পর তাকে এভাবে পদায়ন করা হয়। এবারও মানা হয়নি গঠনতন্ত্র ও নিয়মতান্ত্রিকতা। কারণ সহ-সভাপতির প্যানেল থেকে কাউকে সিনিয়র সহ-সভাপতি না করে সেই মাওলানা আবদুল কুদ্দসকেই কেন দায়িত্ব দেওয়া হলো সেটা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। যেখানে বেফাকের সহ-সভাপতি রয়েছেন ত্রিশজনের বেশি। প্রয়োজনের সময় যদি সহ-সভাপতিদের দায়িত্বই না দেওয়া হয়, তাহলে এভাবে সহ-সভাপতির পদ দেওয়া কেন, এসব পদ কী শুধু অলঙ্কারিক? সেটাও নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু কোনো জবাব কেউ দেননি। শোনা যাচ্ছে, মাওলানা আবদুল কুদ্দুস আগামী কাউন্সিল পর্যন্ত এসব দায়িত্ব পালন করবেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বেফাক মহাসচিবসহ অন্যদের কিছু ফোনালাপ ফাঁস হয়। এর প্রেক্ষিত্রে বেফাকের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফসহ তিনজনকে বহিস্কার করা হয় এবং অভিযোগ সম্পর্কে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। নীতি-নৈতিকতা ও সম্মান রক্ষার কথা বলে বিভিন্নভাবে মাওলানা আবুদল কুদ্দুসকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। এরই মধ্যে বেফাকের সভাপতি আল্লামা আহমদ শফী মাওলানা আবদুল কুদ্দুসের বিষয়ে উঠা অভিযোগের বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়ে তাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে আখ্যা দেন। তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। এদিকে মুখ খুলেন অপসারিতরা। দাবি করেন, তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। এটা নিয়ে তারা শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রশ্ন তুলেছেন। অপসারিত তিন জনই আলাদা আলাদাভাবে তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার ও তাদের অপসারণের বিষয়টি সঠিক হয়নি বলে দাবি করেছেন।
তবে নেতৃস্থানীয় আলেমরা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য না করলেও, তারা স্পষ্টভাবে এটা বলছেন; বেফাক নিয়ে চলমান এসব অস্থিরতা এবং বেফাকের যাবতীয় অনিয়ম ও অন্যায়ের বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত, গঠনতান্ত্রিক উপায়ে বেফাকের পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য মজলিশে আমেলা ও মজলিশে শুরার বৈঠক ডাকা জরুরি। ওই বৈঠকে সার্বিক পরিস্থিতি উল্লেখপূর্বক সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত বেফাকের চলমান অস্থিরতা আরও বাড়বে।
প্রকাশ্যে না এলেও এটা স্পষ্ট যে, বেফাকে এখন কয়েকটি ধারা বিদ্যমান। একটি ধারা মাওলানা আবদুল কুদ্দসকে স্বপদে রাখতে চান, আরেকটি ধারা বেফাককে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে পরিচালনার কথা বলছেন। অন্য আরেকটি ধারা রয়েছে, যারা চুপ থেকে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছেন। তবে চলমান সঙ্কট সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল। এই বাস্তবতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে চলতে তুমুল বিতর্ক। বেফাক থেকে পরিস্থিতি ব্যক্তিগত পর্যায়ে চলে গেছে। প্রকাশ পাচ্ছে সত্য-মিথ্যার মিশেলে নানা পারিবারিক অনাকাঙ্খিত বিষয়, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এই পরিস্থিতিতে চারদিক থেকে দাবি উঠছে, চলমান সঙ্কট সমাধানে বিশেষ করে; বেফাকের নানা দুর্নীতি, অনিয়ম, প্রশ্নপত্র ফাঁস, মেধা তালিকায় জালিয়াতিসহ নানাবিধ স্বেচ্ছাচার বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার। সেই সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক বির্তক এড়িয়ে সৌজন্য ও শৃঙ্খলা রক্ষার। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের জেদ, ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা, হুমকি পাল্টা হুমকি যেমন কাম্য নয়, তেমনি চুপ থাকাও কোনো সমাধান নয়। তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল থেকে জটিলতর হবে।
বেফাকের চলমান সঙ্কট প্রসঙ্গে মিরপুরের স্বনামধন্য এক মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও বেফাকের নেতৃস্থানীয় একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বেফাকের চলমান সঙ্কট দূর করার একটাই উপায় তা হলো- বেফাকের সহ-সভাপতিদের এক হয়ে এগিয়ে আসা। সেই সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে মজলিশে আমেলা ও শুরার বৈঠক ডাকা। সেখানে বিষয়গুলো পর্যালোচনা সাপেক্ষে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। আরেকটি কথা, শুধুমাত্র পাল্লাভারী করার জন্য কোনো কমিটি না করা।’
তবে, তরুণ আলেমরা বলছেন, চলমান এই অস্থিরতা সমাধানের জন্য বেফাকের গঠনতন্ত্রের দিকে তাকালেই হয়। বেফাকের পরিচালনা এবং সার্বিক বিষয়ে যে গঠনতন্ত্র রয়েছে সে মোতাবেক সিদ্ধান্ত করে কাজ করলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। এক্ষেত্রে তরুণরা সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর গুরত্বারোপ করছেন।
বেফাকের চলমান অস্থিরতা ও অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে মাওলানা আবদুল কুদ্দসকে একাধিককার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
আরও পড়ুন:
কওমি অঙ্গনে ক্ষোভ দানা বাঁধছে ধীরে ধীরে
অনিয়মই নিয়ম বেফাকে, মানা হয় না গঠনতন্ত্র!
বেফাকের নিজস্ব তদন্তেও উঠে আসে অনিয়মের কথা
বেফাকের অনিয়মে অভিযুক্তদের শাস্তি চান তরুণ আলেমরা
বেফাকের গঠনতন্ত্রে সংশোধন জরুরি
অন্যদিকে মাওলানা আবদুল কুদ্দসের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত এক সহকারী মহাসচিব বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘বেফাকের ঝামেলা মিটে গেছে। অভিযুক্তদের বহিস্কার করা হয়েছে। আর মাওলানা আবদুল কুদ্দসের বিষয়ে আল্লামা আহমদ শফী সন্তোষ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন।’
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘এগুলো কওমি মাদরাসা, বেফাক ও হাইয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়। পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত থাকবে। কিন্তু নেতৃস্থানীয়দের মাঝে কোনো বিরোধ নেই। আর এসব বিষয়ে কথা বলার উপযুক্ত জায়গা ফেসবুক নয়। সুতরাং ফেসুবকে কে কী লিখছে না লিখছে সেটা নিয়ে আপাতত ভাবছি না। আমরা মাদরাসার কল্যাণে কাজ করছি। কাজ করতে যেয়ে যদি কোনো সমস্যা হয়, সেটা ঘরোয়া বৈঠকের মাধ্যমে এর সমাধান করে নেওয়া হয়, ভবিষ্যতেও হবে।’
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একত্রে হাইয়াতুল উলাইয়ার বৈঠকের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের মাঝে কোনো পক্ষ-বিপক্ষ নেই। সবাই আল্লামা শফীর নির্দেশে একত্রে কাজ করছি। গত পরশু দিনও তো একসাথে মিটিং করে করোনার পরিস্থিতির কারণে বন্ধ থাকা মাদরাসাগুলো ঈদের পর ৮ আগস্ট খুলেও দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেছেন হাইয়ার কো-চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) মাওলানা আবদুল কুদ্দুস।’