দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান
ফুলবানু মারা গেলে আবুল খায়ের দ্বিতীয় দ্বার পরিগ্রহ করে। তাতে করে অনেকেরই সে চক্ষুশূলে পরিণত হয়। কেননা, দ্বিতীয় জন জান্নাতুন্নেসা তার নাম, যথার্থ সুন্দরী ও অল্পবয়েসী। লোকে বলে, বেআক্কেল মাইয়া মানুষ, দোজবরে বিয়া র্কলি, তা-ও যদি জামাই দেখতে সুন্দর হইতো! ওদেরই কারো-কারো ধারণা, জান্নাত আসলে আবুল খায়েরের সম্পত্তিকেই বিয়ে করেছে। অবশ্য তার পক্ষেও ছিল লোক। বউ মারা গেলে খায়ের তো আবার বিয়ে করবেই এবং নিজে সে দেখতে বিশ্রী বলেই তো সুশ্রী মেয়েকে বিয়ে করবে। নইলে দুই বিশ্রী মিলে তারা তো সুশ্রী সন্তানের জন্ম দিতে পারবে না। এসব কথা আড়ালে-আবডালে লোকেরা বললেও জান্নাতের কানে আসে। ফলে তার মন-খারাপ হয়। আর মন-খারাপের পরিণামে প্রায়ই সে উদাস দুপুরে কি মরা বিকেলে আবুল খায়েরের ঘরের সামনেকার ডোবার দিকে তাকিয়ে থাকতে শুরু করে। তার বিষণ্নতামণ্ডিত গতিক দেখে অনেকেই একে গর্ভধারণের প্রথমাবস্থা বলে চিহ্নিত করে। কিন্তু জান্নাত তার গর্ভ সম্পর্কে নয় চিন্তান্বিত ছিল তার স্বামী খায়ের সম্পর্কে লোকপ্রচলিত মতামত নিয়ে। দুপুরের পর-পর খায়েরের দিবানিদ্রার অভ্যেস। জান্নাত দরজার চৌকাঠে বসে অদূরের ডোবার মত জায়গাটার দিকে দৃষ্টি মেলে দেয়। একটি মাছরাঙ্গা কিছুক্ষণ পর-পর উড়ে এসে সঙ্গ দিয়ে যায় তাকে। মাছরাঙ্গাটার একনাগাড়ে বসে না-থাকাটাকে জান্নাত ডোবায় মৎস্যস্বল্পতার প্রমাণ হিসেবে চিহ্নিত করতে গিয়েই বলা যায় একটি অনন্য আবিষ্কারের গৌরবে অভিষিক্ত হয়ে গেল।
আরও পড়ুন: দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান (পর্ব-১)
তখন মাছরাঙ্গাটা উড়ে চলে গেছে। ডোবাটা যেখানে শেষ এবং কিনারা যেখানে শুরু সেখানটায় একট ক্রমাগত বুদ্বুদ তার চোখে পড়ে। হতে পারে মাছ। কিন্তু সেই বুদ্বুদ জলের অভ্যন্তর হতে এমন ছন্দিতভাবে পাক খেতে-খেতে উঠে আসতে থাকে দেখে মনে হয় কোন সুনিপুণ শিল্পীই হয়তো সেই বুদ্বুদের নির্মাতা। মাছ কিংবা সাপ হলে এমন ছন্দময় ও নিয়মিত হওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। থেমে-থেমে নয় সেই চক্র অবিরাম আবর্তনশীল। দৃষ্টি আরও গভীরতায় খনন করে জান্নাত ডোবার কাছে গেলে কেবল বুদ্বুদ নয় তার সঙ্গে একটা শব্দও সে পায়। সেদ্ধ ভাতে বলক উঠবার সময় যে বুদ্-বুদ্ শব্দ হয় অনেকটা সেরকম। সে নিশ্চিত হয়, মাছ, সাপ বা জলজ কোন প্রাণী নয়, এর নিশ্চয়ই অন্য মর্ম থাকা সম্ভব। কাঁচাঘুম থেকে জাগিয়ে তোলায় প্রথমটায় খায়েরের মৃদু রাগ হয় বউয়ের ওপর কিন্তু ঘুমজড়ানো চোখে সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর অনুপম মুখটি সামনে পড়তেই তার রাগ জল হয়ে যায় এবং সে শুনতে পায় জান্নাতের হতচকিত কণ্ঠ- ডোবার কাছে চলো, ডোবার কাছে চলো। তারা দু’জনেই যায় ডোবার কাছে। অনবরত বুদ্-বুদ্ ধরনের একটা শব্দ হয়েই চলেছে। শুধু তা-ই নয়, ডোবার কিনারা এবং ডোবাসংলগ্ন জলীয় ভাবযুক্ত মাটিতেও একটা উদ্গীরণের আবহাওয়া বিরাজ করছে। আবুল খায়েরের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে। হয়তো ধূমপায়ী হওয়ার কারণে এই চিন্তাটাই তার প্রথম জাগে। কিংবা খানিকটা বিজ্ঞানসচেতনতার জন্যে খায়েরের মনে এমন ভাবনার উদ্রেক। দৌড়ে গিয়ে সে ম্যাচবক্সটা আনে। ফস করে একটা কাঠি জ্বালে ডোবার কিনার ঘেঁষে কাদামাটির ওপরকার বুদ্-বুদ্ শব্দ-করা জায়গাটাতে। শব্দস্থলের ঠিক বিঘৎখানেক ওপরে সে ধরে রাখে প্রজ্জ্বলন্ত কাঠিটা। আগুনের আঁচ পেয়েই দুম্ করে আগুন জ্বলে ওঠে এবং বুদ্বুদের ওপরকার বায়ুতে আগুনের শিখা দপদপ করে শব্দ করতে থাকে। ভয়ে খানিকটা পিছিয়ে গিয়ে খায়ের তার বউ জান্নাতকে কিংবা জান্নাত তার স্বামী খায়েরকে জড়িয়ে ধরে। পিছিয়ে দাঁড়িয়ে সিঁটিয়ে থাকা অবস্থায় তারা দু’জনে দেখতে পায়, বুদ্বুদের পরিবর্তে হাল্কা একটা দপ্দপে শব্দ হয়েই চলেছে এবং আগুনও আর নিভছে না। যদিও আগুনের শিখার উচ্চতা এক ফুটের অধিক নয় তবু এমন অগ্নিস্পৃষ্ট হয়ে থাকাটা তাদের মনে ভীতিপ্রদ ভাব জাগিয়ে তোলে। ভয় পেয়ে জান্নাত তার স্বামীকে বলে,
: ওমা, কী আজব কা-, আগুন-ইনা জ্বলে দেখতাছি, ভূতের আগুন না তো!
হ্যাঁ, আগুনকেই জান্নাত আগুন বলে। খায়ের প্রায় মিনিটপাঁচেক সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে আগুনের স্বভাব দেখে। জান্নাতের মত ভয় না পেলেও একটা উত্তেজনা আর উৎসাহের প্রাবল্য মুহূর্তের জন্যে তার মধ্যে অস্থিরতা আনে। একবার সে দৌড়ে গিয়ে একটা প্লাস্টিকের মগ এনে ডোবা থেকে পানি ভরে ছুঁড়ে দেয় আগুনের দিকে কিন্তু আগুনের শিখা একটু কেঁপে একটু বাঁকা হয়ে ফের জ¦লতে থাকে, নেভে না। জান্নাতের ভয় আরও বাড়ে- ওমা, আগুন দেহি নিভে না! ভয়ে সে প্রায় কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেলে খায়ের উল্টো হো-হো করে হেসে ওঠে। হাসতে-হাসতে সে তার স্ত্রীকে বলে,
: হোনো বউ এইডা হইলো গ্যাস। শহরের মাইন্ষে গ্যাসের চুলা জ্বালাইয়া রান্নাবান্না করে, হোনো নাই? এই গ্যাস এই যে জ্বইল্যা উঠলো আর নিভবো না। যতদিন পর্যন্ত না গ্যাস শেষ অয় ততদিন পর্যন্ত এই গ্যাস জ্বলতেই থাকবো। জ্বইল্যা-জ্বইল্যা তয় গ্যাস শেষ অয়। বুঝতে পারছো?
হা-মুখ জান্নাত তাকিয়ে থাকে স্বামীর দিকে যেন রূপকথা শোনে। তারপরের ঘটনা প্রকৃতই চমকপ্রদ। সুবর্ণদ্বীপে পাড়ি জমাবার আগে খায়ের ছিল নির্মাণ-শ্রমিক। ফলে একটা সাংগঠনিক প্রতিভা তার সহজাত। আশপাশ থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে কিছু পাথর জড়ো করে সে প্রথমে ডোবার কিনারা থেকে হাতপাঁচেক দূরে বুদ্বুদের জায়গাটাকে ব্যূহবন্দি করে। তারপর বুদ্বুদের উৎপত্তিস্থলের যেখানটায় উদ্গত হয় মূল শিখা সেখানে পাথরঘেরা একটা চৌকো আয়তনের ঘের বানিয়ে তার ওপর বসিয়ে দিল একটা আধাআধি-ভরা ছোট্ট এ্যালুমিনিয়মের পাতিল। বিস্ফারিতচক্ষ’ জান্নাত আরও বিস্মিত হয়ে পড়ে খায়ের এবং আগুনের সম্মিলিত তৎপরতায়। একটুক্ষণের মধ্যে পানি ফুটতে শুরু করলে ফুটন্ত পানিতে খানিকটা পাউডার-দুধ ছিটিয়ে দেয় খায়ের। তারপর ফুটন্ত মিশ্রণে ছিটিয়ে দেয় কিছু চাপাতার গুঁড়ো। দুটো প্লাস্টিকের কাপ এনে ছেঁকে নিলে গরম-গরম চা হাতে পায় জান্নাত এবং বিস্ময়ে সে ভাব প্রকাশের ধরনও ভুলে যায়। পুরো ব্যাপারটা তার মনে হতে থাকে এক অপূর্ব তেলেসমাতির ফল। আবুল খায়ের কী তাহলে যাদুকর! চায়ে চুমুক দিতে-দিতে জান্নাতের হতবিহ্বলতা কাটিয়ে দেয় খায়ের-
: হোনো বউ, আইজ থেইক্যা আমাগো আর লাকড়ি লাগবো না রান্না করনের লাইগ্যা। বুঝছো? কেরোসিনও লাগবো না। তুমি হইল্যা আমার সৌভাগ্যবতী বউ। তুমিও ঘরে আইল্যা আর আমিও আগুন পাইলাম! আশ্চর্য ব্যাপার না!
আরও পড়ুন: দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-২)
দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান (পর্ব-৩)
দ্বীপ অথবা একটি আন্তমহাদেশীয় উপাখ্যান(পর্ব-৩)
চলবে...
৬ষ্ঠ পর্ব পড়ুন আগামী শুক্রবার