বাঙালি কাব্যচেতনায় মারমা নৃ-প্রপঞ্চ: মহীবুল আজিজের ‘গঙখাঙ রেগেখ্যঙ’
‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’বাংলা ভাষার জয়ধ্বনিতে মুখর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা ‘তাহাদের কথা’ বিস্মৃত হই! তারা হলেন- বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ। বাংলার সমান্তরালে তাদের রয়েছে, নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আত্মপরিচিতি।
প্রথমবারের মতো বাঙালি কাব্যচেতনায় তেমনই এক জনজাতি মারমাদের নৃ-প্রপঞ্চ উপস্থাপন করেছেন কবি ও কথাশিল্পী ড. মহীবুল আজিজ তাঁর ‘গঙখাঙ রেগেখ্যঙ’ কাব্যগ্রন্থে।
বার্তা২৪.কম’র অ্যাসোসিয়েট এডিটর ড. মাহফুজ পারভেজের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি জানিয়েছেন কাব্যের পটভূমি, মারমা ভাষাবৈশিষ্ট্য ও কবিতার বিষয়বস্তু সম্পর্কে।
মাহফুজ পারভেজ: কেন মারমা নিয়ে আগ্রহী হলেন?
মহীবুল আজিজ: ১৯৬৬ সালে আমার বাবা মোহাম্মদ আজিজউল্লাহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের জনপদ দোহাজারি’তে কৃষিব্যাংকের ম্যানেজার পদে নিযুক্তি পেলে আমাদের ঠিকানা হলো সেখানকার জামিজুরি এলাকা। এটাই দোহাজারির কেন্দ্রীয় জায়গা। বাজারের একেবারে মধ্যমণি ব্যাংকভবনটা।
বাজার ঘেঁষে একটা বড় পুকুর। পুকুরের অন্য পাড়ে আমরা থাকি ভাড়া বাসায়। সেই বাসার মালিক ভগীরথ হাজারী। আমাদের প্রতিবেশী ছিল, একটি বৌদ্ধ পরিবার। চন্দা বড়ুয়া নামে একটি মেয়ে ছিল আমার খেলার সাথী। ওদের বাসায় গেলে শোলা’র, পাথরের, ধাতুর ছোট-বড় বুদ্ধমূর্তিগুলো চোখে পড়তো। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। তারপর আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন বাজারে চেম্বার-অলা ডা. আশীষ বড়ুয়া। একবার অনেক রাতে আমার মুখ দিয়ে বিরাটাকার কৃমি বেরিয়ে এসেছিল, যেন মরণদশা হয়েছিল। মৃত্যুমুখ থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। তো! একবার সম্ভবত প্রবারণা বা বুদ্ধপূর্ণিমার দিনে বাবা আমাদের দুইভাইকে নিয়ে ছুটির অবকাশে চলে গেলেন বান্দরবান।
সেটা ১৯৬৭ সাল। আমার বয়স পাঁচ বছর মাত্র এবং তখন রাস্তাগুলো আজকের মতো এতটা সুগম ও সুবিন্যস্ত ছিল না। মনে পড়ে, অফিসের সবুজ রঙের জিপগাড়িতে করে আমরা আমিরাবাদ, সাতকানিয়া, বাজালিয়া এইসব পেরিয়ে বান্দরবান পৌঁছেছিলাম।
সে যে কী আনন্দ আর একটা অকহতব্য উত্তেজনা! একটা নতুন জগতে ঢুকে পড়বার উচ্ছ্বাস। সেখানকার একজন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সদস্য আমাদের অভ্যর্থনা জানান, আপ্যায়নও করেন। কেবল একটা স্মৃতি বেশ জ্বলজ্বলে থাকে। বড় শক্ত মোটা বাঁশের মধ্যে বসানো দই খেতে দেওয়া হয়েছিল।
সারাদিন পাহাড়ে কাটিয়ে একটা অদ্ভুত রহস্যময় অজানার মধ্যে নিজেকে নিহিত দেখে খানিকটা বোঝা-না-বোঝার বৃত্তে অতিবাহিত করে যখন সন্ধ্যায় ফের দোহাজারি ফিরে আসি তখন অনেক ফানুস উড়তে শুরু করেছিল আকাশে।
ডা. আশীষ বড়ুয়াই বাবাকে বলেছিলেন, বান্দরবানে আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেতে। তাছাড়া চন্দাদের বাসায় দেখা বুদ্ধের ছবি-মূর্তি, ডা. আশীষের চেম্বারে টাঙানো ক্যালেন্ডারে গৌতম বুদ্ধের ছবি এবং বান্দরবানে মারমা ঘরের বেড়ায় আঁটা বুদ্ধের চিত্র সব একটা সমাপতনে মনের মধ্যে কেমন একটা অনির্দেশ্য কৌতূহল জাগিয়ে রাখে!
সেটাই শুরু। তারপর আর যাওয়া হয় না। তখন তো অল্প বয়স। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা মণিপুরি সবই একইরকম মনে হতো। বয়োপ্রাপ্ত হতে হতে বুঝতে পারি, না, সব এক নয়! তবে পাহাড়ি জীবনের প্রতি একটা দারুণ কৌতূহল মনের মধ্যে কোথাও জেগে উঠেছিল এবং উঠেছিল নিভে যাওয়ার জন্য নয়, সেটা টের পাই।
পরে জানলাম, বান্দরবান মূলত মারমা জন-অধ্যূষিত অঞ্চল যেমন, রাঙামাটি চাকমাপ্রধান কিংবা সিলেট মণিপুরিপ্রধান বা কোথাও রয়েছে জৈন্তিয়া বা খাসিয়া।
বলা যায়, আশির দশকে আমার বন্ধু কবি হাফিজ রশিদ খান এবং আমাদের পরম সুহৃদ, যাকে আমরা ‘পাহাড়-সমতলের দূত’ বলতাম, চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া এই দুই উদাত্ত প্রাণের আহ্বানে সাড়া দিতেই আমার বান্দরবানের জনজীবনে প্রবেশ এবং সেখানে সুদীর্ঘকালের যাতায়াত। তখন কিন্তু পার্বত্যচুক্তি ছিল না।
সেইসব দিনে পাহাড়ে ঢোকা এবং বেরিয়ে আসার নির্দিষ্ট সময় বাঁধা ছিল। হাফিজ রশিদ খান, চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া এবং শৈ অং প্রু এঁরা মিলে পাহাড়-সমতলের অংশীদারিত্ব বিষয়ক অসাধারণ একটি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। সেখানে আমি একটি গল্প দিই, যেটি বান্দরবানের জনজীবনাশ্রিত ‘মঙ চিঙের অলৌকিক অভিজ্ঞতা’।
এখানে বলে রাখি, সম্মান শ্রেণিতে আমার সহপাঠীরা যখন বাংলা ব্যাকরণ বেছে নেয়, আমি সেটির বিকল্প হিসেবে নিই পালি। একটা নতুন বিষয় পড়বার আগ্রহেই আমার পালি নেওয়া। পাঠ্য হিসেবে পড়তে হয়, মখাদেব জাতক, গাথাসত্তসই, মিলিন্দপঞহো, বুদ্ধের জীবনী। অশ-- ঘোষের বুদ্ধচরিত তখনই পড়ি। আরো সব বই। বান্দরবানের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীজীবন, আবার বৌদ্ধজীবন ও দর্শন এবং সেই সঙ্গে সাহিত্যপাঠের হেতু প্রকৃতির অনুষঙ্গ আমার মনে পাহাড়ি জীবনের প্রতি একটা অদ্ভুত ভালোলাগার বোধ তৈরি করে। এখনও সেই বোধ আমার ভেতরে বিদ্যমান। দীর্ঘদিন য়ুরোপে কাটিয়ে আসবার পরেও সেই আকর্ষণ ম্লান হয় না আমার!
পাহাড়ি জীবনের সারল্য নিরাভরণ সৌন্দর্য এবং আয়ত দৃষ্টি, যা আমরা নগরে বা সমতলে দুর্লভ মনে করি, হয়ত তারই সন্ধানে আমার পাহাড়ের সন্নিধান। সন্ধানের সেই উৎসাহ নানাভাবে নানা মাত্রিকতায় আমার মধ্যে সক্রিয়। ফলে, পাহাড়ের সঙ্গে সংযোগ আমি হারাই না। যথাসম্ভব বজায় রাখি। পাহাড়ি বন্ধুবান্ধব সেই সংযোগের সেতু কিংবা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যাঁরা পাহাড়-সমতলের সেতুবন্ধনের উপলব্ধি আজও জাগিয়ে রেখেছে মনে, তাদের আগ্রহে কখনও কখনও চলে যাই বান্দরবানে। অবারিত জীবনের প্রবাহে স্নাত হয়ে ফিরি। তাছাড়া পাহাড়ি কবি-লেখকদের রচনা পাঠ করবার মাধ্যমেও সংযোগ রক্ষা করা যায়। যদিও যতটা প্রত্যাশা ততটা অনুবাদ হয় না, কিন্তু হয়। আমি কেবল মারমা জীবনের কথাই বলছি না, আমাদের পাহাড়ে বসবাসরত যতগুলো নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে, সবগুলিই আমার মনোযোগের বিষয় কিন্তু জীবনে প্রথম বান্দরবান যাওয়ার কারণে এবং পরবর্তীতে সেই যাতায়াতের ধারাটা ধারাবাহিত থাকবার ফলে মারমাসংলগ্নতাই আমার ঘটে বহুল পরিমাণে। হয়ত সামনের দিনে বান্দরবানের জনজীবন নিয়ে আরও লিখবো।
মাহফুজ পারভেজ: বাংলার চেয়ে মারমা ভাষার বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য কী?
মহীবুল আজিজ: বাংলাভাষাভাষী হিসেবে কিংবা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের মানুষ হিসেবে ভাষাসংক্রান্ত কিছু হদিস হয়ত আমাদের জানা কিন্তু তা দিয়ে ঠিক বিশেষজ্ঞতার দাবি করা সম্ভব নয়। তবে বান্দরবানে যাওয়া-আসার মাধ্যমে সেখানকার মানুষদের কথাবার্তার ধরনধারণ দেখে-বুঝে এবং খানিকটা বিচার বিশ্লেষণ করে কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা বলা যায়। এখানে এটিও বলা দরকার, বান্দরবানে মারমা ছাড়াও আরও নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস এবং প্রত্যেকেরই রয়েছে স্বতন্ত্র প্রণালী ও প্রকাশ। বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচ্য শাখার অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা।
তাছাড়া বিপুলসংখ্যক মানুষের ভাষিকতার কারণে এটি আরো গুরুত্ব অর্জন করেছে বিশেষ। প্রথমত বর্ণের কথা যদি বলি, অবয়বগত বিচারে মারমা বর্ণ মায়ানমারি ভাষার বর্ণের আদলের সঙ্গে মেলে। আবার কখনও কখনও মনে হয়, দেখতে মারমা বর্ণ তামিল, তেলেগু, কন্নড়ি এইসব বর্ণের মতোই। তবে মারমা ভাষার বর্ণ সেগুলোর চাইতে খানিকটা পরে এসে সুনির্দিষ্ট লিখিত রূপ পেতে শুরু করে। একাদশ-দ্বাদশ শতকের দিকে মারমা বর্ণমালার প্রাচীন রূপটি গড়ে উঠেছিল। মারমা ভাষায় রয়েছে, ৩৩টি ব্যঞ্জনবর্ণ, ৪টি মৌলিক যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি, ১২টি স্বরবর্ণ এবং ১০টি স্বরধ্বনি বিলুপ্তকারী ব্যঞ্জনবর্ণ।
মারমা ভাষার উৎস কিন্তু বাংলার মতোই ব্রাহ্মী লিপি। বাংলার মতোই স্পৃষ্ট ও নাসিক্য ধ্বনির স্বাতন্ত্র্য মারমা ভাষায় সুস্পষ্ট। বর্গীয় বর্ণবিচারে বাংলা ও মারমার মধ্যে সাদৃশ্য যথেষ্ট। ‘ক’ ব্যঞ্জববর্ণ বাংলার মতোই মগ, মারমা, রাখাইন এবং বার্মিজ বর্ণমালার প্রথম বর্ণ। অনুস্বার এবং বিসর্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বর্ণ মারমা ভাষায়। মাং মানে এবং যা অব্যয়, কিন্তু মাং মানে আবার রাজা-ও। মাংগ্রী মানে জ্যাঠা বা বড় মামা। মাংক্যোয়েঁ মানে গৃহকর্তা। মাংক্যোয়েমাঁ-র অর্থ গৃহকর্তার স্ত্রী বা গৃহকর্ত্রী।
এছাড়া ঞ, ফ, চ, ছ, হ্ল, থ, চ¦, ত্ব এসব বর্ণ মারমা ভাষায় প্রভাবক ভূমিকা রাখে। স্বরের ক্ষেত্রে বলা যায়, চিনা ভাষায় যেমন বর্ণে প্রযুক্ত উচ্চ ও দীর্ঘ স্বর শব্দের অর্থের তারতম্য ঘটায়। মারমা ভাষাতেও সেরকম ব্যাপার লক্ষ করা যায়। চিনা ‘চা’ (হ্রস্ব স্বর) মানে হলো, একটি পানীয় যা আমরা পান করি। আবার ‘চাআআ’ (স্বরবর্ণের প্রলম্বনযুক্ত) মানে হলো গাড়ি, অর্থাৎ মূল ব্যঞ্জন অবিকৃত রেখে কেবল স্বরের হ্রস্ব ও দীর্ঘত্বের দ্বারা শব্দার্থের পরিবর্তন করা হয়। মারমা ভাষাতেও হ্রস্ব ও দীর্ঘস্বরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাকরণগত দিক থেকে বলা যায়, লিখিত বাংলা এবং মারমা ভাষার গাঠনিক কাঠামো এক নয়। ভারতবর্ষের প্রায় সব প্রধান ভাষা পাণিনি’র ব্যাকরণানুসারী। কিন্তু মারমা ভাষা তা নয়। এতে বরং প্রাচীনতাবাহিত কথকতার ভঙ্গিটি আভাসিত।
কারক, বিভক্তি, বাক্যে পদের সংস্থাপন এসবের ক্ষেত্রে মারমা ভাষার স্বাতন্ত্র্য রয়েছে অবশ্যই। বিজ্ঞানসম্মতভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাবিষয়ক গবেষণা করা গেলে মারমা ও অন্যান্য ভাষার স্বরূপ উদ্ঘাটন সম্ভব। এটা হতে পারে যোগ্যতাসম্পন্ন ও বিষয়পারদর্শী মারমাভাষীদের দ্বারা কিংবা মারমা ও বাঙালির যৌথ গবেষণার মাধ্যমে। তখন হয়ত আরো অনেক নতুনদিক বা অজানা দিক জানা সম্ভব হবে আমাদের পক্ষে। শব্দের সংখ্যার বিচারে কিন্তু মারমা ভাষার সমৃদ্ধি অনস্বীকার্য। কাজেই এ-বিষয়ে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
মাহফুজ পারভেজ: আপনার এই কাব্যে কী বলতে চেষ্টা করেছেন?
মহীবুল আজিজ: আমার সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ যেটির প্রকাশক ‘চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন’ গঙখাঙ রেগেখ্যঙ। এর সহজ অর্থ হলো- আকাশ ও শঙ্খনদী। রেগে অর্থাৎ বৃহৎ/বড় খ্যঙ মানে নদী বড় নদী, মারমাদের নিকটে শঙ্খ হলো বড় নদী রেগেখ্যঙ। আর ছোট নদী মানে রিনিখ্যঙ।
নামের মাহাত্ম্যের কথা বলতে গেলে বলবো, আসলে বাংলাভাষী কারো কাব্যের শিরোনামটাই পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর ভাষাশ্রিত হতে পারে, সেটা আমার ধারণাতে ছিল না। মারমা জনপদ ও জীবনের প্রতি আশৈশব আকৃষ্ট আমি বেশকিছু কবিতা লিখি মারমাদের মূল ভৌগোলিক সংস্থান বান্দরবানের প্রেক্ষাপটে। এটি আমার ২১শ কাব্যগ্রন্থ।
বইয়ের পাণ্ডলিপি তৈরি করতে গিয়ে দেখলাম, আশি শতাংশ কবিতাই বান্দরবানের প্রকৃতি মানুষ খাবার পোশাক সংস্কৃতি এসবকে ধারণ করেছে। এমনকী সমতলের নরনারীর প্রেমের পরিপ্রেক্ষিতও পাহাড়ি প্রকৃতি ও প্রেক্ষাপট। কাজেই তখন একটা সুযোগ এলো বইয়ের শিরোনামেই যদি সেই মুখ্যতাকে ফুটিয়ে তোলা যায়, তাহলে সেটা কেমন হয়!
আমার বন্ধু কবি হাফিজ রশিদ খান বললো, হ্যাঁ, ধারণাটা ভালোই হয়। হাফিজ পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর ভাষা-সাহিত্য-সমাজ এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ। দীর্ঘদিন কর্মসূত্রেও কাটিয়েছে বান্দরবানে। ফলে, ওর পরামর্শ আমার আত্মবিশ্বাস খানিকটা বাড়িয়ে দেয়। বস্তুত এ-বই এক অর্থে পাহাড়ি জনজীবনের প্রতি মুগ্ধতার প্রামাণ্য কাব্যিক প্রতিবেদন। আবার, অন্যভাবে বলতে পারি, এতে একটা সমন্বয়চেতনারও প্রকাশ আছে। পাহাড়ের প্রকৃতি জীবন এসবের প্রতি আমাদের আবেগ ও মুগ্ধতার নানামাত্রিক প্রকাশ আমরা লক্ষ করে থাকি। কিন্তু পাহাড়ি জীবন ও সংস্কৃতির মধ্যে ক্ষণকালীন আনন্দ অন্বেষণের বিষয়টাই আমাদের মধ্যে মুখ্য! আমরা পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর জীবনের সংস্কৃতি বা জীবনের মৌল ধর্ম এসব বিষয়ে ততটা উৎসুক নই।
পাহাড়ের মানুষদের জীবন সমাজ ও সংস্কৃতির যে স্বাতন্ত্র্য কিংবা তাদের জীবনের অভাব দীনতা বা চাহিদা ইত্যাদি নিয়ে আমরা তত আগ্রহী নই। আমরা পাহাড়কে ততটাই ভালোবাসি, যতটা পাহাড় আমাদের ক্ষণকালীন আনন্দের জন্য আরামের জন্য প্রয়োজন। পাহাড় কেবল প্রকৃতিই নয়, অরণ্যঘেরা সৌন্দর্যকেন্দ্রই নয়, সেখানেও জীবন আছে যে-জীবন শত-শত বছরের অবিরাম চক্রায়ণের মধ্য দিয়ে আজও প্রবহমান। সে-জীবন আমরা চাই বা না-চাই, বদলেছেও যথেষ্ট।
কিন্তু সেই প্রবহমানতা সেই বিবর্তনের ব্যাকরণ কি আমরা পাঠে আগ্রহী, এইসব প্রশ্নই আমার মধ্যে ঘুরপাক খায় কিন্তু আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ, যার সেরকম কোনো ক্ষমতা নেই কিন্তু হ্যাঁ, আমার শব্দের সাম্রাজ্যের সৃষ্টিকর্তা তো আমিই। তাই ভাবলাম আমার একজনের প্রচেষ্টার মধ্যে, হোক সে সংখ্যায় ন্যূনতমই, তবু সেই একক প্রচেষ্টার আয়তনে দুই মেরুর দূরত্বকে কিছুটা সময়ের জন্য ঘুচিয়ে দিয়ে পাশাপাশি আনা যাকই না কেন। পাশাপাশিই তো আমরা। দীর্ঘকালের ইতিহাস আমাদের এই প্রতিবেশিত্বের। প্রতিবেশীরাই তো পরস্পর পরস্পরের নিকটজন। কাজেই নৈকট্যকে আত্মস্থ করবার একটা দায়ও তো থেকে যায়।
পাহাড়ি জীবন ও সমাজের বিষয়াবলি আজ আর দূরতর বা অচেনা উৎসের উপাদান নয়, বরং তা একটি সমান্তরাল অভিযাত্রারই বাস্তবতা। সেই বাস্তবতাকে আমি চেষ্টা করেছি, আমার পক্ষে সবচাইতে সহজ উপায় ও উদ্ভাবনা দিয়ে প্রকাশ করতে।
আমার কবিতা থেকে কিছু প্রসঙ্গ সংক্ষেপে তুলে ধরা যেতে পারে, যেখানে মারমা জীবন ও প্রকৃতি কিংবা বৃহত্তর অর্থে পাহাড়ের অনুষঙ্গ যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তার কিছুটা অনুভব করা যাবে।
কবিতাটার শিরোনাম ‘শোনো সখি’ “শোনো সখি, পাহাড়েও ঢের বিচিত্রতা আছে,/ এলে দেখবে একই সবুজের নানা মাত্রায় তারা বাঁচে।/ চাকমা মারমা তঞ্চঙ্গ্যা ও বম মুরং বা ..,/ বনের আড়াল থেকে চমকে দেবে তোমায়.. হাই ব্রো!/ ঐ যে পাহাড়ি ধেয়ে যায় নদী জল স্বচ্ছতোয়া,/ তারই তীরে বসে কেশবিন্যাসে এক রমণি পাংখোয়া।/ স্বামী তার চিং থোয়াই, শ্রমে চাষ কওে জুম-টিলা,/ সন্তর্পণে শোনো গান…/ নি পোয়েইটি লেহাং তোং তিলা।”
এরকম সব উপমা, চিত্র, দৃশ্যকল্প যেখানে মানবিক কিংবা সাংস্কৃতিক প্রতিভাসের অন্বেষণ চলেছে কিংবা ধরুন ‘পাহাড়ে হেলান দিয়ে’ কবিতায় প্রকৃতিঘেরা জীবনের ঐশ্বয্যও যে কম নয় বরং সুন্দরতামণ্ডিত সেটা বলবার চেষ্টা আছে “পাহাড়ে হেলান দিয়ে আজ তুমি আমায় ভালোবাসো,/ খেতে দেবো তোমায় থানচি পাহাড়ের মুরগির লাক্সো।/ আঠালো চালের উপাদেয় খাদ্য এনেছি এ মুড়ি,/ বিনি চাল থেকে নিকষিত বারি বানিয়েছে শুনি।” নিশ্চয়ই মনে পড়বে সেই চর্যাপদের যুগের সিদ্ধাচার্যদের উচ্চারণে “এক সে শু-িণী দুই ঘরে সান্ধই,/ বিঅন বাকলত্ বারুণি বান্ধই।” উৎসব আনন্দ সংস্কৃতি সব মিলেমিশে যায় পাহাড়ি জীবনের আয়তনে ‘দাঁড়াও তুমিও’ কবিতাটি বারো পংক্তির, শেষের স্তবকটাই উদ্ধৃত করা গেল “পি- নিয়ে খাড়া বুদ্ধানুসারীরা সূর্য পাহারায়,/ প্রস্তুত শ্রমণ কঠিন চীবর নব উত্তরীয়।/ উর্ধ্ব থেকে নেমে গেরুয়া আলোক নিসর্গে গড়ায়,/ দাঁড়াও তুমিও, পেম্মং শরণং সম্বোধি হে প্রিয়।”
এরকম সব পংক্তি রয়েছে এ বইতে এ বইয়ের অনেকগুলো কবিতাতেই। তাই পাঠকের পক্ষে বোঝা সম্ভব, বইয়ের রচয়িতা পাহাড়ি জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু এই গ্রন্থনা কিংবা এই বিম্বনের অভিমুখ অবশ্যই সমন্বয়ধর্মী ও ইতিবাচক। আপনি নিশ্চয়ই পল গগ্যাঁ’র কথা জানেন, যিনি তাহিতি দ্বীপকে অমর করে রেখে গেছেন তাঁর চিত্রশিল্পে।
ফরাসি গগ্যাঁ তাহিতিতে জীবন কাটাতে গেছেন প্রথমত জীবনের অন্বেষণে এবং পরত জীবনকে শিল্পে রূপান্তরের অধ্যবসায়ে। আমার একক ও ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে আমি চেষ্টা করেছি আমাদের এই দেশেও যদি সঠিক সন্ধান করি জীবনের বিচিত্র বিচিত্রতর রূপ ছড়ানো রয়েছে। জীবন তো আর নিজে থেকে আমাদের নিকটে আসবে না, আমাদেরই যেতে হবে জীবনের নিকটে। আর এই যাওয়াটা খুব সহজ বা চকিত অন্বেষণের ব্যাপার নয়, এর জন্য লাগে আবেগ মানসিকতা ও জীবনবোধ। আমি সেটি অর্জন করবার চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।
মহীবুল আজিজ, ‘গঙখাঙ রেগেখ্যঙ’, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন, ২০২৪.