বাঙালি কাব্যচেতনায় মারমা নৃ-প্রপঞ্চ: মহীবুল আজিজের ‘গঙখাঙ রেগেখ্যঙ’

  ‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’


ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলা ভাষার জয়ধ্বনিতে মুখর একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা ‘তাহাদের কথা’ বিস্মৃত হই! তারা হলেন- বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহ। বাংলার সমান্তরালে তাদের রয়েছে, নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, আত্মপরিচিতি।

প্রথমবারের মতো বাঙালি কাব্যচেতনায় তেমনই এক জনজাতি মারমাদের নৃ-প্রপঞ্চ উপস্থাপন করেছেন কবি ও কথাশিল্পী ড. মহীবুল আজিজ তাঁর ‘গঙখাঙ রেগেখ্যঙ’ কাব্যগ্রন্থে।

বার্তা২৪.কম’র অ্যাসোসিয়েট এডিটর ড. মাহফুজ পারভেজের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি জানিয়েছেন কাব্যের পটভূমি, মারমা ভাষাবৈশিষ্ট্য ও কবিতার বিষয়বস্তু সম্পর্কে।

মাহফুজ পারভেজ: কেন মারমা নিয়ে আগ্রহী হলেন?

মহীবুল আজিজ: ১৯৬৬ সালে আমার বাবা মোহাম্মদ আজিজউল্লাহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের জনপদ দোহাজারি’তে কৃষিব্যাংকের ম্যানেজার পদে নিযুক্তি পেলে আমাদের ঠিকানা হলো সেখানকার জামিজুরি এলাকা। এটাই দোহাজারির কেন্দ্রীয় জায়গা। বাজারের একেবারে মধ্যমণি ব্যাংকভবনটা।

বাজার ঘেঁষে একটা বড় পুকুর। পুকুরের অন্য পাড়ে আমরা থাকি ভাড়া বাসায়। সেই বাসার মালিক ভগীরথ হাজারী। আমাদের প্রতিবেশী ছিল, একটি বৌদ্ধ পরিবার। চন্দা বড়ুয়া নামে একটি মেয়ে ছিল আমার খেলার সাথী। ওদের বাসায় গেলে শোলা’র, পাথরের, ধাতুর ছোট-বড় বুদ্ধমূর্তিগুলো চোখে পড়তো। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। তারপর আমাদের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন বাজারে চেম্বার-অলা ডা. আশীষ বড়ুয়া। একবার অনেক রাতে আমার মুখ দিয়ে বিরাটাকার কৃমি বেরিয়ে এসেছিল, যেন মরণদশা হয়েছিল। মৃত্যুমুখ থেকে আমাকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। তো! একবার সম্ভবত প্রবারণা বা বুদ্ধপূর্ণিমার দিনে বাবা আমাদের দুইভাইকে নিয়ে ছুটির অবকাশে চলে গেলেন বান্দরবান।

সেটা ১৯৬৭ সাল। আমার বয়স পাঁচ বছর মাত্র এবং তখন রাস্তাগুলো আজকের মতো এতটা সুগম ও সুবিন্যস্ত ছিল না। মনে পড়ে, অফিসের সবুজ রঙের জিপগাড়িতে করে আমরা আমিরাবাদ, সাতকানিয়া, বাজালিয়া এইসব পেরিয়ে বান্দরবান পৌঁছেছিলাম।
সে যে কী আনন্দ আর একটা অকহতব্য উত্তেজনা! একটা নতুন জগতে ঢুকে পড়বার উচ্ছ্বাস। সেখানকার একজন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সদস্য আমাদের অভ্যর্থনা জানান, আপ্যায়নও করেন। কেবল একটা স্মৃতি বেশ জ্বলজ্বলে থাকে। বড় শক্ত মোটা বাঁশের মধ্যে বসানো দই খেতে দেওয়া হয়েছিল।

সারাদিন পাহাড়ে কাটিয়ে একটা অদ্ভুত রহস্যময় অজানার মধ্যে নিজেকে নিহিত দেখে খানিকটা বোঝা-না-বোঝার বৃত্তে অতিবাহিত করে যখন সন্ধ্যায় ফের দোহাজারি ফিরে আসি তখন অনেক ফানুস উড়তে শুরু করেছিল আকাশে।

ডা. আশীষ বড়ুয়াই বাবাকে বলেছিলেন, বান্দরবানে আমাদের বেড়াতে নিয়ে যেতে। তাছাড়া চন্দাদের বাসায় দেখা বুদ্ধের ছবি-মূর্তি, ডা. আশীষের চেম্বারে টাঙানো ক্যালেন্ডারে গৌতম বুদ্ধের ছবি এবং বান্দরবানে মারমা ঘরের বেড়ায় আঁটা বুদ্ধের চিত্র সব একটা সমাপতনে মনের মধ্যে কেমন একটা অনির্দেশ্য কৌতূহল জাগিয়ে রাখে!

সেটাই শুরু। তারপর আর যাওয়া হয় না। তখন তো অল্প বয়স। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা মণিপুরি সবই একইরকম মনে হতো। বয়োপ্রাপ্ত হতে হতে বুঝতে পারি, না, সব এক নয়! তবে পাহাড়ি জীবনের প্রতি একটা দারুণ কৌতূহল মনের মধ্যে কোথাও জেগে উঠেছিল এবং উঠেছিল নিভে যাওয়ার জন্য নয়, সেটা টের পাই।

পরে জানলাম, বান্দরবান মূলত মারমা জন-অধ্যূষিত অঞ্চল যেমন, রাঙামাটি চাকমাপ্রধান কিংবা সিলেট মণিপুরিপ্রধান বা কোথাও রয়েছে জৈন্তিয়া বা খাসিয়া।

বলা যায়, আশির দশকে আমার বন্ধু কবি হাফিজ রশিদ খান এবং আমাদের পরম সুহৃদ, যাকে আমরা ‘পাহাড়-সমতলের দূত’ বলতাম, চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া এই দুই উদাত্ত প্রাণের আহ্বানে সাড়া দিতেই আমার বান্দরবানের জনজীবনে প্রবেশ এবং সেখানে সুদীর্ঘকালের যাতায়াত। তখন কিন্তু পার্বত্যচুক্তি ছিল না।

সেইসব দিনে পাহাড়ে ঢোকা এবং বেরিয়ে আসার নির্দিষ্ট সময় বাঁধা ছিল। হাফিজ রশিদ খান, চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া এবং শৈ অং প্রু এঁরা মিলে পাহাড়-সমতলের অংশীদারিত্ব বিষয়ক অসাধারণ একটি গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেন। সেখানে আমি একটি গল্প দিই, যেটি বান্দরবানের জনজীবনাশ্রিত ‘মঙ চিঙের অলৌকিক অভিজ্ঞতা’।

এখানে বলে রাখি, সম্মান শ্রেণিতে আমার সহপাঠীরা যখন বাংলা ব্যাকরণ বেছে নেয়, আমি সেটির বিকল্প হিসেবে নিই পালি। একটা নতুন বিষয় পড়বার আগ্রহেই আমার পালি নেওয়া। পাঠ্য হিসেবে পড়তে হয়, মখাদেব জাতক, গাথাসত্তসই, মিলিন্দপঞহো, বুদ্ধের জীবনী। অশ-- ঘোষের বুদ্ধচরিত তখনই পড়ি। আরো সব বই। বান্দরবানের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীজীবন, আবার বৌদ্ধজীবন ও দর্শন এবং সেই সঙ্গে সাহিত্যপাঠের হেতু প্রকৃতির অনুষঙ্গ আমার মনে পাহাড়ি জীবনের প্রতি একটা অদ্ভুত ভালোলাগার বোধ তৈরি করে। এখনও সেই বোধ আমার ভেতরে বিদ্যমান। দীর্ঘদিন য়ুরোপে কাটিয়ে আসবার পরেও সেই আকর্ষণ ম্লান হয় না আমার!

পাহাড়ি জীবনের সারল্য নিরাভরণ সৌন্দর্য এবং আয়ত দৃষ্টি, যা আমরা নগরে বা সমতলে দুর্লভ মনে করি, হয়ত তারই সন্ধানে আমার পাহাড়ের সন্নিধান। সন্ধানের সেই উৎসাহ নানাভাবে নানা মাত্রিকতায় আমার মধ্যে সক্রিয়। ফলে, পাহাড়ের সঙ্গে সংযোগ আমি হারাই না। যথাসম্ভব বজায় রাখি। পাহাড়ি বন্ধুবান্ধব সেই সংযোগের সেতু কিংবা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যাঁরা পাহাড়-সমতলের সেতুবন্ধনের উপলব্ধি আজও জাগিয়ে রেখেছে মনে, তাদের আগ্রহে কখনও কখনও চলে যাই বান্দরবানে। অবারিত জীবনের প্রবাহে স্নাত হয়ে ফিরি। তাছাড়া পাহাড়ি কবি-লেখকদের রচনা পাঠ করবার মাধ্যমেও সংযোগ রক্ষা করা যায়। যদিও যতটা প্রত্যাশা ততটা অনুবাদ হয় না, কিন্তু হয়। আমি কেবল মারমা জীবনের কথাই বলছি না, আমাদের পাহাড়ে বসবাসরত যতগুলো নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে, সবগুলিই আমার মনোযোগের বিষয় কিন্তু জীবনে প্রথম বান্দরবান যাওয়ার কারণে এবং পরবর্তীতে সেই যাতায়াতের ধারাটা ধারাবাহিত থাকবার ফলে মারমাসংলগ্নতাই আমার ঘটে বহুল পরিমাণে। হয়ত সামনের দিনে বান্দরবানের জনজীবন নিয়ে আরও লিখবো।

মাহফুজ পারভেজ: বাংলার চেয়ে মারমা ভাষার বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য কী?

মহীবুল আজিজ: বাংলাভাষাভাষী হিসেবে কিংবা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের মানুষ হিসেবে ভাষাসংক্রান্ত কিছু হদিস হয়ত আমাদের জানা কিন্তু তা দিয়ে ঠিক বিশেষজ্ঞতার দাবি করা সম্ভব নয়। তবে বান্দরবানে যাওয়া-আসার মাধ্যমে সেখানকার মানুষদের কথাবার্তার ধরনধারণ দেখে-বুঝে এবং খানিকটা বিচার বিশ্লেষণ করে কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা বলা যায়। এখানে এটিও বলা দরকার, বান্দরবানে মারমা ছাড়াও আরও নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের বসবাস এবং প্রত্যেকেরই রয়েছে স্বতন্ত্র প্রণালী ও প্রকাশ। বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচ্য শাখার অন্তর্গত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা।

তাছাড়া বিপুলসংখ্যক মানুষের ভাষিকতার কারণে এটি আরো গুরুত্ব অর্জন করেছে বিশেষ। প্রথমত বর্ণের কথা যদি বলি, অবয়বগত বিচারে মারমা বর্ণ মায়ানমারি ভাষার বর্ণের আদলের সঙ্গে মেলে। আবার কখনও কখনও মনে হয়, দেখতে মারমা বর্ণ তামিল, তেলেগু, কন্নড়ি এইসব বর্ণের মতোই। তবে মারমা ভাষার বর্ণ সেগুলোর চাইতে খানিকটা পরে এসে সুনির্দিষ্ট লিখিত রূপ পেতে শুরু করে। একাদশ-দ্বাদশ শতকের দিকে মারমা বর্ণমালার প্রাচীন রূপটি গড়ে উঠেছিল। মারমা ভাষায় রয়েছে, ৩৩টি ব্যঞ্জনবর্ণ, ৪টি মৌলিক যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনি, ১২টি স্বরবর্ণ এবং ১০টি স্বরধ্বনি বিলুপ্তকারী ব্যঞ্জনবর্ণ।

মারমা ভাষার উৎস কিন্তু বাংলার মতোই ব্রাহ্মী লিপি। বাংলার মতোই স্পৃষ্ট ও নাসিক্য ধ্বনির স্বাতন্ত্র্য মারমা ভাষায় সুস্পষ্ট। বর্গীয় বর্ণবিচারে বাংলা ও মারমার মধ্যে সাদৃশ্য যথেষ্ট। ‘ক’ ব্যঞ্জববর্ণ বাংলার মতোই মগ, মারমা, রাখাইন এবং বার্মিজ বর্ণমালার প্রথম বর্ণ। অনুস্বার এবং বিসর্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বর্ণ মারমা ভাষায়। মাং মানে এবং যা অব্যয়, কিন্তু মাং মানে আবার রাজা-ও। মাংগ্রী মানে জ্যাঠা বা বড় মামা। মাংক্যোয়েঁ মানে গৃহকর্তা। মাংক্যোয়েমাঁ-র অর্থ গৃহকর্তার স্ত্রী বা গৃহকর্ত্রী।

এছাড়া ঞ, ফ, চ, ছ, হ্ল, থ, চ¦, ত্ব এসব বর্ণ মারমা ভাষায় প্রভাবক ভূমিকা রাখে। স্বরের ক্ষেত্রে বলা যায়, চিনা ভাষায় যেমন বর্ণে প্রযুক্ত উচ্চ ও দীর্ঘ স্বর শব্দের অর্থের তারতম্য ঘটায়। মারমা ভাষাতেও সেরকম ব্যাপার লক্ষ করা যায়। চিনা ‘চা’ (হ্রস্ব স্বর) মানে হলো, একটি পানীয় যা আমরা পান করি। আবার ‘চাআআ’ (স্বরবর্ণের প্রলম্বনযুক্ত) মানে হলো গাড়ি, অর্থাৎ মূল ব্যঞ্জন অবিকৃত রেখে কেবল স্বরের হ্রস্ব ও দীর্ঘত্বের দ্বারা শব্দার্থের পরিবর্তন করা হয়। মারমা ভাষাতেও হ্রস্ব ও দীর্ঘস্বরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাকরণগত দিক থেকে বলা যায়, লিখিত বাংলা এবং মারমা ভাষার গাঠনিক কাঠামো এক নয়। ভারতবর্ষের প্রায় সব প্রধান ভাষা পাণিনি’র ব্যাকরণানুসারী। কিন্তু মারমা ভাষা তা নয়। এতে বরং প্রাচীনতাবাহিত কথকতার ভঙ্গিটি আভাসিত।

কারক, বিভক্তি, বাক্যে পদের সংস্থাপন এসবের ক্ষেত্রে মারমা ভাষার স্বাতন্ত্র্য রয়েছে অবশ্যই। বিজ্ঞানসম্মতভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষাবিষয়ক গবেষণা করা গেলে মারমা ও অন্যান্য ভাষার স্বরূপ উদ্ঘাটন সম্ভব। এটা হতে পারে যোগ্যতাসম্পন্ন ও বিষয়পারদর্শী মারমাভাষীদের দ্বারা কিংবা মারমা ও বাঙালির যৌথ গবেষণার মাধ্যমে। তখন হয়ত আরো অনেক নতুনদিক বা অজানা দিক জানা সম্ভব হবে আমাদের পক্ষে। শব্দের সংখ্যার বিচারে কিন্তু মারমা ভাষার সমৃদ্ধি অনস্বীকার্য। কাজেই এ-বিষয়ে ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।

মাহফুজ পারভেজ: আপনার এই কাব্যে কী বলতে চেষ্টা করেছেন?

মহীবুল আজিজ: আমার সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ যেটির প্রকাশক ‘চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন’ গঙখাঙ রেগেখ্যঙ। এর সহজ অর্থ হলো- আকাশ ও শঙ্খনদী। রেগে অর্থাৎ বৃহৎ/বড় খ্যঙ মানে নদী বড় নদী, মারমাদের নিকটে শঙ্খ হলো বড় নদী রেগেখ্যঙ। আর ছোট নদী মানে রিনিখ্যঙ।

নামের মাহাত্ম্যের কথা বলতে গেলে বলবো, আসলে বাংলাভাষী কারো কাব্যের শিরোনামটাই পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর ভাষাশ্রিত হতে পারে, সেটা আমার ধারণাতে ছিল না। মারমা জনপদ ও জীবনের প্রতি আশৈশব আকৃষ্ট আমি বেশকিছু কবিতা লিখি মারমাদের মূল ভৌগোলিক সংস্থান বান্দরবানের প্রেক্ষাপটে। এটি আমার ২১শ কাব্যগ্রন্থ।

বইয়ের পাণ্ডলিপি তৈরি করতে গিয়ে দেখলাম, আশি শতাংশ কবিতাই বান্দরবানের প্রকৃতি মানুষ খাবার পোশাক সংস্কৃতি এসবকে ধারণ করেছে। এমনকী সমতলের নরনারীর প্রেমের পরিপ্রেক্ষিতও পাহাড়ি প্রকৃতি ও প্রেক্ষাপট। কাজেই তখন একটা সুযোগ এলো বইয়ের শিরোনামেই যদি সেই মুখ্যতাকে ফুটিয়ে তোলা যায়, তাহলে সেটা কেমন হয়!

আমার বন্ধু কবি হাফিজ রশিদ খান বললো, হ্যাঁ, ধারণাটা ভালোই হয়। হাফিজ পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর ভাষা-সাহিত্য-সমাজ এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ। দীর্ঘদিন কর্মসূত্রেও কাটিয়েছে বান্দরবানে। ফলে, ওর পরামর্শ আমার আত্মবিশ্বাস খানিকটা বাড়িয়ে দেয়। বস্তুত এ-বই এক অর্থে পাহাড়ি জনজীবনের প্রতি মুগ্ধতার প্রামাণ্য কাব্যিক প্রতিবেদন। আবার, অন্যভাবে বলতে পারি, এতে একটা সমন্বয়চেতনারও প্রকাশ আছে। পাহাড়ের প্রকৃতি জীবন এসবের প্রতি আমাদের আবেগ ও মুগ্ধতার নানামাত্রিক প্রকাশ আমরা লক্ষ করে থাকি। কিন্তু পাহাড়ি জীবন ও সংস্কৃতির মধ্যে ক্ষণকালীন আনন্দ অন্বেষণের বিষয়টাই আমাদের মধ্যে মুখ্য! আমরা পাহাড়ি নৃগোষ্ঠীর জীবনের সংস্কৃতি বা জীবনের মৌল ধর্ম এসব বিষয়ে ততটা উৎসুক নই।

পাহাড়ের মানুষদের জীবন সমাজ ও সংস্কৃতির যে স্বাতন্ত্র্য কিংবা তাদের জীবনের অভাব দীনতা বা চাহিদা ইত্যাদি নিয়ে আমরা তত আগ্রহী নই। আমরা পাহাড়কে ততটাই ভালোবাসি, যতটা পাহাড় আমাদের ক্ষণকালীন আনন্দের জন্য আরামের জন্য প্রয়োজন। পাহাড় কেবল প্রকৃতিই নয়, অরণ্যঘেরা সৌন্দর্যকেন্দ্রই নয়, সেখানেও জীবন আছে যে-জীবন শত-শত বছরের অবিরাম চক্রায়ণের মধ্য দিয়ে আজও প্রবহমান। সে-জীবন আমরা চাই বা না-চাই, বদলেছেও যথেষ্ট।

কিন্তু সেই প্রবহমানতা সেই বিবর্তনের ব্যাকরণ কি আমরা পাঠে আগ্রহী, এইসব প্রশ্নই আমার মধ্যে ঘুরপাক খায় কিন্তু আমি একজন অতি সাধারণ মানুষ, যার সেরকম কোনো ক্ষমতা নেই কিন্তু হ্যাঁ, আমার শব্দের সাম্রাজ্যের সৃষ্টিকর্তা তো আমিই। তাই ভাবলাম আমার একজনের প্রচেষ্টার মধ্যে, হোক সে সংখ্যায় ন্যূনতমই, তবু সেই একক প্রচেষ্টার আয়তনে দুই মেরুর দূরত্বকে কিছুটা সময়ের জন্য ঘুচিয়ে দিয়ে পাশাপাশি আনা যাকই না কেন। পাশাপাশিই তো আমরা। দীর্ঘকালের ইতিহাস আমাদের এই প্রতিবেশিত্বের। প্রতিবেশীরাই তো পরস্পর পরস্পরের নিকটজন। কাজেই নৈকট্যকে আত্মস্থ করবার একটা দায়ও তো থেকে যায়।

পাহাড়ি জীবন ও সমাজের বিষয়াবলি আজ আর দূরতর বা অচেনা উৎসের উপাদান নয়, বরং তা একটি সমান্তরাল অভিযাত্রারই বাস্তবতা। সেই বাস্তবতাকে আমি চেষ্টা করেছি, আমার পক্ষে সবচাইতে সহজ উপায় ও উদ্ভাবনা দিয়ে প্রকাশ করতে।

আমার কবিতা থেকে কিছু প্রসঙ্গ সংক্ষেপে তুলে ধরা যেতে পারে, যেখানে মারমা জীবন ও প্রকৃতি কিংবা বৃহত্তর অর্থে পাহাড়ের অনুষঙ্গ যেভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, তার কিছুটা অনুভব করা যাবে।

কবিতাটার শিরোনাম ‘শোনো সখি’ “শোনো সখি, পাহাড়েও ঢের বিচিত্রতা আছে,/ এলে দেখবে একই সবুজের নানা মাত্রায় তারা বাঁচে।/ চাকমা মারমা তঞ্চঙ্গ্যা ও বম মুরং বা ..,/ বনের আড়াল থেকে চমকে দেবে তোমায়.. হাই ব্রো!/ ঐ যে পাহাড়ি ধেয়ে যায় নদী জল স্বচ্ছতোয়া,/ তারই তীরে বসে কেশবিন্যাসে এক রমণি পাংখোয়া।/ স্বামী তার চিং থোয়াই, শ্রমে চাষ কওে জুম-টিলা,/ সন্তর্পণে শোনো গান…/ নি পোয়েইটি লেহাং তোং তিলা।”

এরকম সব উপমা, চিত্র, দৃশ্যকল্প যেখানে মানবিক কিংবা সাংস্কৃতিক প্রতিভাসের অন্বেষণ চলেছে কিংবা ধরুন ‘পাহাড়ে হেলান দিয়ে’ কবিতায় প্রকৃতিঘেরা জীবনের ঐশ্বয্যও যে কম নয় বরং সুন্দরতামণ্ডিত সেটা বলবার চেষ্টা আছে “পাহাড়ে হেলান দিয়ে আজ তুমি আমায় ভালোবাসো,/ খেতে দেবো তোমায় থানচি পাহাড়ের মুরগির লাক্সো।/ আঠালো চালের উপাদেয় খাদ্য এনেছি এ মুড়ি,/ বিনি চাল থেকে নিকষিত বারি বানিয়েছে শুনি।” নিশ্চয়ই মনে পড়বে সেই চর্যাপদের যুগের সিদ্ধাচার্যদের উচ্চারণে “এক সে শু-িণী দুই ঘরে সান্ধই,/ বিঅন বাকলত্ বারুণি বান্ধই।” উৎসব আনন্দ সংস্কৃতি সব মিলেমিশে যায় পাহাড়ি জীবনের আয়তনে ‘দাঁড়াও তুমিও’ কবিতাটি বারো পংক্তির, শেষের স্তবকটাই উদ্ধৃত করা গেল “পি- নিয়ে খাড়া বুদ্ধানুসারীরা সূর্য পাহারায়,/ প্রস্তুত শ্রমণ কঠিন চীবর নব উত্তরীয়।/ উর্ধ্ব থেকে নেমে গেরুয়া আলোক নিসর্গে গড়ায়,/ দাঁড়াও তুমিও, পেম্মং শরণং সম্বোধি হে প্রিয়।”

এরকম সব পংক্তি রয়েছে এ বইতে এ বইয়ের অনেকগুলো কবিতাতেই। তাই পাঠকের পক্ষে বোঝা সম্ভব, বইয়ের রচয়িতা পাহাড়ি জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু এই গ্রন্থনা কিংবা এই বিম্বনের অভিমুখ অবশ্যই সমন্বয়ধর্মী ও ইতিবাচক। আপনি নিশ্চয়ই পল গগ্যাঁ’র কথা জানেন, যিনি তাহিতি দ্বীপকে অমর করে রেখে গেছেন তাঁর চিত্রশিল্পে।

ফরাসি গগ্যাঁ তাহিতিতে জীবন কাটাতে গেছেন প্রথমত জীবনের অন্বেষণে এবং পরত জীবনকে শিল্পে রূপান্তরের অধ্যবসায়ে। আমার একক ও ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে আমি চেষ্টা করেছি আমাদের এই দেশেও যদি সঠিক সন্ধান করি জীবনের বিচিত্র বিচিত্রতর রূপ ছড়ানো রয়েছে। জীবন তো আর নিজে থেকে আমাদের নিকটে আসবে না, আমাদেরই যেতে হবে জীবনের নিকটে। আর এই যাওয়াটা খুব সহজ বা চকিত অন্বেষণের ব্যাপার নয়, এর জন্য লাগে আবেগ মানসিকতা ও জীবনবোধ। আমি সেটি অর্জন করবার চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত।

মহীবুল আজিজ, ‘গঙখাঙ রেগেখ্যঙ’, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন, ২০২৪.

   

তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা



ড. মিল্টন বিশ্বাস
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

  • Font increase
  • Font Decrease

‌‌আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,
বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।
তরঙ্গ মিলায়ে যায় তরঙ্গ উঠে,
কুসুম ঝরিয়া পড়ে কুসুম ফুটে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে।'

আজ ২৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। দুর্যোগময় পৃথিবীতে তাঁর জন্মদিন ভিন্নতর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। কারণ রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিত্যসঙ্গী, বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্তম্ভ। তাঁকে কেন্দ্র করে কেবল পাকিস্তানি সরকারের বিতর্কিত ভূমিকা নয় ১৯৭১ এর আগে থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হয়েছে তাঁর মাধ্যমে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহানপুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর অন্যতম অনুঘটক। তাঁর দীর্ঘ কারাজীবনের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘গীতবিতান’। লেখাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের ভক্ত বঙ্গবন্ধুই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’কে সংবিধানভুক্ত করেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার শিল্পীগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাঁকে দেওয়া এক সংবর্ধনার ভাষণে রবীন্দ্রনাথের কথা এভাবেই বলেছিলেন তিনি- Go to anywhere in the world and tell them that you have come from the country of Tagore, they will respect you.

বিশ্বকবির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বকবির ভাষাপ্রেম এদেশের মানুষকে ভাষা সংরক্ষণের সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর কবিতা ও গান একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর সঙ্গে বাংলা ও বাঙালির হৃদয়ের সম্পর্ক এবং সংকট-মুহূর্তে তাঁর সাহিত্য-সংগীতের দ্বারা উজ্জীবিত হওয়া সাধারণ একটি ঘটনা। মনে রাখতে হবে পাকিস্তানিদের চেয়ে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বারবারই সামনে এনেছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন- ‘সাত কোটি বাঙালিকে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি- ‘কবিগুরু, তোমার উক্তি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। দেখে যাও তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে।’ জীবদ্দশায় কবিগুরু দেখেছেন যুদ্ধ-বিপর্যস্ত পৃথিবীতে মহাবিপর্যয়ের ত্রাস। মারণব্যাধির মহামারি, দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে মানবসভ্যতার পরাজয়ের ভয়ঙ্কর ও বিব্রতকর চিত্র। তবু তিনি মানুষকে আশ্বাস দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন ‘দুঃসময়’ (কল্পনা)-এর মতো আরো অনেক কবিতা-গানে।

লিখেছেন-দিক-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা-/তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।’ (দুঃসময়) রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে-পরে বিশেষত ১৮১৭ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত একশ বছরে সাতবারের কলেরা মহামারিতে ভারতবর্ষে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। ১৮৯৬ সালের প্লেগ মহামারি, ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্প অথবা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে বিপুল সংখ্যক মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ভূমিকম্পে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কয়েকটি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। দুর্যোগের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংক্রামক ব্যাধি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মনীতি বিশ্বকবির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

২.
‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থের ‘সমবায়ে ম্যালেরিয়া-নিবারণ’ (ভাদ্র, ১৩৩০) এবং ‘ম্যালেরিয়া’ (জ্যৈষ্ঠ, ১৩৩১) প্রবন্ধ ছাড়াও সমাজ ও রাষ্ট্রের নানান প্রসঙ্গে তিনি মানবজীবন থেকে ব্যাধি নিবারণের কথা বারবার বলে গেছেন। একটি উদ্ধৃতি- ‘একটা কথা মনে রাখতে হবে, দুর্গতির কারণ সব দেশেই আছে। কিন্তু মানুষের মনুষ্যত্ব কী। না, সেই দুর্গতির কারণকে অনিবার্য বলে মনে না করে, যখন যাতে কষ্ট পাচ্ছি চেষ্টা-দ্বারা তাকে দূর করতে পারি, এ অভিমান মনে রাখা। আমরা এতদিন পর্যন্ত বলেছি, ম্যালেরিয়া দেশব্যাপী, তার সঙ্গে কী করে লড়াই করব, লক্ষ লক্ষ মশা রয়েছে তাদের তাড়াব কী করে, গভর্মেণ্ট আছে সে কিছু করবে না... আমরা কী করব! সে কথা বললে চলবে না। যখন আমরা মরছি, লক্ষ লক্ষ মরছি... কত লক্ষ না মরেও মরে রয়েছে...যে করেই হোক এর যদি প্রতিকার না করতে পারি আমাদের কিছুতেই পরিত্রাণ নেই। ম্যালেরিয়া অন্য ব্যাধির আকর। ম্যালেরিয়া থেকে যক্ষ্মা অজীর্ণ প্রভৃতি নানারকম ব্যামো সৃষ্টি হয়। একটা বড়ো দ্বার খোলা পেলে যমদূতেরা হুড়্ হুড়্ করে ঢুকে পড়ে, কী করে পারব তাদের সঙ্গে লড়াই করতে। গোড়াতে দরজা বন্ধ করা চাই, তবে যদি বাঙালি জাতিকে আমরা বাঁচাতে পারি।’ আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগে সম্মিলিতভাবে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ব্যাধি বিস্তার রোধ করার উপায় বলেছিলেন কবি।

আরো এক জায়গায় তিনি লিখেছেন- ‘আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবন্মৃত করে রাখে। এ দেশে অনেক জিনিস হয় না; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই...পরীক্ষা করলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে। চেষ্টা করবার ইচ্ছাও হয় না।’ অর্থাৎ রোগের প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ছিল স্পষ্ট ধারণা। তাছাড়া তখন বিশ্বভারতীর একটা ব্যবস্থা ছিল- শান্তিনিকেতনের চারিদিকে যে-সমস্ত পল্লিবসতি দেখা যেত সেগুলিকে তিনি নীরোগ রাখার জন্য বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন।

৩.
বিশ্বকবি লিখেছেন- ‘সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।/সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ/মুক্তো করো ভয়/আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ বিভিন্ন সংকটে ও দুর্যোগে আমরা ‘ম্রিয়মাণ’ কিন্তু ভয়-মুক্ত হওয়ার জন্য যাঁর কাছে মানসিক শক্তি পেতে পারি তিনি আমাদের জীবনে আবির্ভূত সংকট নিবারণের বাঞ্চিত সঙ্গী। তিনি নিজেও আশি বছর বয়স পর্যন্ত নিজের স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয়দের মৃত্যুর করালগ্রাসে হারিয়ে যেতে দেখেছেন; তবে বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের গভীর বেদনাকে অন্তরে ধারণ করে নিজের শক্তিতে জয়ী হয়েছেন। তাঁর দু কন্যা মাধুরীলতা ও রেণুকা দেবীর হয়েছিল যক্ষ্মাতে মৃত্যু এবং ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিল কলেরায়। অন্য কন্যা মীরাদেবীর পুত্র নীতীন্দ্রনাথের অকাল প্রয়াণও তাঁকে মর্মদাহিক বেদনায় দিশেহারা করেছিল।

তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পিতৃস্মৃতি’তে লিখেছেন- ‘ভাগ্যের উত্থান-পতন, দুঃখ কিংবা ক্লেশ কোনো কিছুই অবশ্য বাবার চিত্তের প্রশান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারত না। মহর্ষির মতই তিনিও সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকতেন। বেদনা যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন, তা তাঁর ভিতরের শান্তিকে নষ্ট করতে পারত না। সবচেয়ে দুঃখের দুর্ভাগ্যকে সইবার মত এক অতিমানবিক শক্তি ছিল তাঁর।’

এর কারণ হলো তিনি ছিলেন বিশ্বের তাবৎ মানুষের ঐক্যবদ্ধতায় বিশ্বাসী। তিনি ভেবেছেন- ‘মানুষের মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ নেই, সমস্ত মানুষ এক। মানুষের সমাজে একজনের পাপের ফলভোগ সকলকেই ভাগ করে নিতে হয়; কারণ, অতীতে ভবিষ্যতে, দূরে দূরান্তে, হৃদয়ে হৃদয়ে, মানুষ যে পরস্পর গাঁথা হয়ে আছে।...যে পাপের ভার এতদিন নানা স্থানে নানা জনে জমাইয়া তুলিতেছিল, তাহারই আঘাতে রুদ্র আজ জাগ্রত হইয়াছেন-দেবতার ও মানবতার অপমান তিনি সহ্য করিতে পারিতেছেন না।’

রুদ্রের রোষেই আজ করোনা মহামারিতে এত মৃত্যু, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা; এই মৃত্যু মানবেরই পাপের প্রায়শ্চিত্ত। তাই নতুন বন্দরে নোঙর করতে হলে সে মৃত্যুকেও বরণ করতে হবে; সে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অকম্পিত বুকে বলতে হবে- ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।/তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা,/বসন্ত নিকুঞ্জে আসে বিচিত্র রাগে।/...নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ।’

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে একদিকে যুদ্ধের মৃত্যুভীতি অন্যদিকে উষ্ণ প্রকৃতির অসহনীয়তার পর সতেজ ও অবিনশ্বরতায় প্রাণের নিত্যধারা প্রবহমান। এই কঠিন ও সহজ সময়ে আনন্দ-বেদনা, মিলন-বিরহ, আগমন-বিদায় আর পুনরাগমন-পুনর্মিলনের খণ্ডাংশের যাপিত-জীবনে এসেছে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী- যা উজ্জ্বলতর মুহূর্তগুলোর একটি। আর দুর্যোগ, দুর্বিপাকে তাঁকে স্মরণ করেই আমাদের শান্তি ও আনন্দ লাভ সম্ভব।

৪.
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের সংকটে মৃত্যু, যন্ত্রণা ও দুঃখ-কষ্টে আমরা যেমন রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করছি তেমনি যারা মানবতার সেবায় নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন কিংবা মানুষের ধর্ম পালন করছেন তাদেরও সম্মান জানাচ্ছি বিশ্বকবির ভাবনা দিয়েই। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘যা আমাদের ত্যাগের দিকে, তপস্যার দিকে নিয়ে যায় তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম।’ ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-‘মানুষ বিষয়বুদ্ধি নিয়ে নিজের সিদ্ধি অন্বেষণ করে। সেখানে ব্যক্তিগত জীবনযাত্রানির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম, তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত।

সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায়। তাঁর আরো এবটি দিক আছে যেখানে ব্যক্তিগত বৈষয়িকতার বাইরে। সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে লাভ-ক্ষতির বিচার করে না বরং অনিশ্চিত কালের উদ্দেশে আত্মত্যাগ করতে চায়। সেখানে স্বার্থের প্রবর্তনা নেই। আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড়ো জীবন সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায়।’ রবীন্দ্রভাষ্য মতে, আত্মত্যাগী মানুষই মনুষ্যত্বের দিশারি। তারাই এই বিশ্বজগতকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারে। মহামারির সংকটে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

৫.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের প্রারম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলেন আধুনিক সভ্যতার দান হলো ইউরোপের অন্তরের সম্পদ। কিন্তু পৃথিবীর সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তূপ দেখে ৮০ বছর বয়সে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে যায় তাঁর। ‘তবু মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’ সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করে গেছেন তিনি। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে আশা করেছিলেন- ‘মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে।

আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবল প্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে...। ‘অপরাজিত মানুষে’র জয় আর ‘প্রবলপ্রতাপশালীর ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা’র অবসান যে সত্য হবে সে কথা মৃত্যুর ঠিক আগে বলে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রত্যাশা করেছিলেন ‘মানব-অভ্যুদয়ে’র মধ্য দিয়ে নতুন জীবনের। লিখেছেন- ‘অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত/ধূলিতলে হয়ে যাবে ভগ্ন।/ নবজীবনের আশ্বাসে।/ জয় হবে মানব-অভ্যুদয়।’

রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় মানবপীড়নের মহামারি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন মানুষে মানুষে যে সম্বন্ধ সবচেয়ে মূল্যবান এবং যাকে যথার্থ সভ্যতা বলা যেতে পারে তার কৃপণতা ভারতীয়দের উন্নতির পথ সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল। দেখেছিলেন পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর বর্বরতা জাগ্রত হয়ে উঠে মানবাত্মাকে অপমানে নিঃস্ব করে দেবার ঘটনাও। তিনি নিভৃতে সাহিত্যের রসসম্ভোগের উপকরণের বেষ্টন থেকে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষের জনসাধারণের নিদারুণ দারিদ্র্য সচক্ষে দেখেছেন। অন্ন-বস্ত্র-পানীয়- শিক্ষা-আরোগ্য প্রভৃতি মানুষের শরীরমনের পক্ষে যা-কিছু অত্যাবশ্যক তার নিরতিশয় অভাব দেখে তিনি আধুনিক-শাসনচালিত ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন।

জনসাধারণের প্রতি ব্রিটিশদের অপরিসীম অবজ্ঞাপূর্ণ ঔদাসীন্য ছিল বলেই বাংলায় সংক্রমিত কলেরা ও ম্যালেরিয়া মহামারিতে তাঁর ভূমিকা ও দিক-নির্দেশনা পূর্বে উল্লিখিত ‘পল্লীপ্রকৃতি’ গ্রন্থে যথার্থভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পরের সময়টিও ছিল মানবসভ্যতার এক সন্ধিক্ষণ। সেসময় মানবসভ্যতার পরিবর্তনের রূপ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কবি। সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পতন চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধোত্তর ধনতন্ত্র গণতন্ত্রের সঙ্গেই পথ ধরে চলেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কবির শঙ্কিত মন বারবারই বিশ্বের মানুষকে সচেতন করার জন্য উদগীব হয়েছে। এজন্যই ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ ও আত্মতৃপ্তির পরিধি থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন- ‘মানুষ আপন উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিসীমাকে পেরিয়ে বৃহৎমানুষ হয়ে উঠছে, তার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাধনা এই বৃহৎমানুষের সাধনা। এই বৃহৎমানুষ অন্তরের মানুষ। বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব। ইতিহাসে দেখা যায়, মানুষের আত্মোপলব্ধি বাহির থেকে অন্তরের দিকে আপনিই গিয়েছে, যে অন্তরের দিকে তার বিশ্বজনীনতা, যেখানে বস্তুর বেড়া পেরিয়ে সে পৌঁচেছে বিশ্বমানসলোকে।’

সংকীর্ণ মানসিকতা দিয়ে পৃথিবীর মঙ্গল করা যায় না। জীবনকে সার্থক করার জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনীন কর্মপ্রয়াস। সকল মানুষের মধ্যে ঐক্যসূত্র গাথাই হলো বিশ্বজনীনতা। মানুষ ব্যক্তিগত সীমাকে অতিক্রম করতে পারলেই তার বিশ্বমানব সত্তা চিহ্নিত হয়। ব্যক্তিগত মানুষ নয়, সে বিশ্বগত মানুষের একাত্ম। দেশকালগত সংকীর্ণ পার্থক্যের দিকে মনোযোগ না দিয়ে মানব সভ্যতার সমস্যাকে সমগ্র মানবের সত্য বলে জানতে হবে। চেষ্টা করতে হবে তা থেকে উদ্ধারের।

কবির মতে, ‘মানুষ আপনাকে জেনেছে অমৃতের সন্তান, বুঝেছে যে, তার দৃষ্টি, তার সৃষ্টি, তার চরিত্র, মৃত্যুকে পেরিয়ে। মৃত্যুর মধ্যে গিয়ে যাঁরা অমৃতকে প্রমাণ করেছেন তাঁদের দানেই দেশ রচিত। সব মানুষকে নিয়ে; সব মানুষকে অতিক্রম করে, সীমাবদ্ধ কালকে পার হয়ে এক-মানুষ বিরাজিত।’ এই যে দেশকালপাত্র ছাড়িয়ে মানুষের বিদ্যা, মানুষের সাধনা সত্য হয়ে ওঠা এখানেই মানবধর্মের সারকথা নিহিত। ‘মানুষ এক দিকে মৃত্যুর অধিকারে, আর-এক দিকে অমৃতে; এক দিকে সে ব্যক্তিগত সীমায়, আর-এক দিকে বিশ্বগত বিরাটে। এই দুয়ের কোনোটাকেই উপেক্ষা করা চলে না।’ তবে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষ কখনও বিশ্বজীবনের জন্য কিছু করতে পারে না। এজন্য দরকার আত্মত্যাগী মানুষ যার আত্মগৌরব নেই।

৬.
মূলত জলবায়ুর উষ্ণতা কিংবা যুদ্ধের মহামারিতে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও সভ্যতার বিপর্যয় মোকাবেলা করার জন্য আমরা বিশ্বকবির জন্মদিনে তাঁর রচনা থেকেই আতঙ্ক ও কষ্ট দূর করার রসদ পাচ্ছি। তিনি যেন এসব সংকটে ঠেলে ভাঙনের পথে এসেছেন পৃথিবীকে রক্ষা করতে। কারণ মৃত্যুভীতিতেও আমরা মনে করি তাঁর কথাই সত্য- ‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’… ‘আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।’

মারণঘাতি ভাইরাসের মধ্যে তাঁর প্রকাশ সূর্যের মতো কুহেলিকা উদঘাটন করছে। ভয়কে জয় করার জন্য রিক্ত, ব্যর্থ, শূন্য মানুষকে বিস্ময়ে তিনিই উজ্জীবিত করছেন আজও। ২৫ বৈশাখে লেখা তাঁর নিজের কবিতাতেও সেই অভিব্যক্তি- ‘তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন/সূর্যের মতন।/ রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।/ ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,/ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।’ অসীমের চিরবিস্ময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজকের পৃথিবীতেও স্মরণীয়।

লেখক: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email: [email protected]

  ‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’

;

ফেরদৌস আরার প্রবন্ধের আলপথ বেয়ে পাঠক চলে যান জ্ঞানের সমুদ্রদর্শনে



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘লেখকের প্রচুর অধ্যয়ন, পাঠগভীরতা, নিবিড় অনুসন্ধিৎসা, ঘোরলাগা শব্দপুঞ্জে, ভাষার শিল্পিত সুষমায় লেখাগুলি প্রাণ পেয়েছে। তাই গ্রন্থের তথ্যসমৃদ্ধ বারোটি প্রবন্ধই সুখপাঠ্য শুধু নয়, নতুন চিন্তার খোরাক জোগাবে, জানার তাগাদা তৈরি করবে—বোধে, তৃষ্ণায়, জীবনজিজ্ঞাসায়। নিজের কথাই বলি, ফেরদৌস আরা আলীমের চোখ দিয়ে পড়তে পড়তে আমি নিজে প্রায় তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠেছি আফরোজা বুলবুল কিংবা প্রতিভা মোদক (‘যে জীবন শিল্পের, যে শিল্প জীবনের’), করুণা বন্দোপাধ্যায়, রবিশংকর বলকে (‘চন্দ্রগ্রস্ত পাঠঘোর’) পড়ার জন্য। একই সঙ্গে আস্বাদ করি সময়-পরিক্রমায় লেখক ফেরদৌস আরা আলীমের কলমের ক্ষুরধার ক্রমমুগ্ধকর সৌন্দর্য।’

শনিবার (৪ মে নভেম্বর) বিকেলে চট্টগ্রাম নগরীর কদম মোবারক গলিতে অবস্থিত মাসিক নারীকণ্ঠ পত্রিকা-আয়োজিত ‘বই আলোচনা’-অনুষ্ঠানে ফেরদৌস আরা আলীমের প্রবন্ধের আলপথে শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের মূল আলোচকের আলোচনায় তহুরীন সবুর ডালিয়া এসব কথা বলেন। বইটি নিয়ে বিশেষ আলোচনায় আরও অংশ নেন নারীকণ্ঠের উপদেষ্টা জিনাত আজম, সালমা রহমান ও মাধুরী ব্যানার্জী।

নারীকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আহমেদ মনসুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীকণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক শাহরিয়ার ফারজানা। শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতারী ইসলাম বলেন, ‘নানা বিষয়ে ফেরদৌস আরা আলীমের পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা পড়ে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ। সহজভাবে তিনি আমাদের সমাজবাস্তবতার যে-চিত্র আঁকেন তা মনের গভীরে সাড়া জাগায়। তার লেখা পড়ে এটুকু বলতে পারি যে, তার লেখা আমাদের জন্য গবেষণা ও আত্মপরিচয়ের মূল্যবান আকর।’

প্রবন্ধের আলপথে বইয়ের প্রকাশক, কবি ও খড়িমাটি-সম্পাদক মনিরুল মনির বলেন, ‘নারীমুক্তি বিষয়ে এ-বইয়ে দুটি তথ্যনির্ভর গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ রয়েছে। ভবিষ্যতে এ-বিষয়ে আরও কাজ করার জন্য গবেষকদের জন্য অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রকাশিত বই নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ফেরদৌস আরা আলীম বলেন, ‘বড় কিছু হওয়ার কথা ভেবে লিখিনি, মনের আনন্দেই গোপনে গল্প-কবিতা লিখেছি। এমন একসময়ে আমরা লিখতাম, লেখা প্রকাশ করতে খুব লজ্জাবোধ করতাম। অবশ্য লিখতে গিয়ে তেমন কঠিন বাধা আমাকে ডিঙোতে হয়নি। একালের চেয়ে আমাদের সময়টা ছিল অনেক সুন্দর ও ভালো। মেয়েদের নিরাপত্তা ছিল সমাজে। গণ্ডগ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ট্রেনে চড়ে ঢাকা গিয়েছি একা-একা, কোনওদিন সমস্যা হয়নি। মা-বাবারাও নিশ্চিন্ত থাকতেন। আজকাল মেয়েরা পদে-পদে বাধা ও নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। এর জন্য দায়ী মূলত আমাদের কলুষিত সমাজব্যবস্থা ও নষ্ট রাজনীতি।’ সাহিত্যচর্চার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘লেখালেখির ক্ষেত্রে প্রশংসার ভূমিকা কম নয়। একজন লেখক তাঁর নিজের লেখা সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য পেলে অনুপ্রাণিত হন যা তাকে সামনে এগিয়ে নিতে শক্তি জোগায়।’

অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নারীকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা ও সদস্য রোকসানা বন্যা, মহুয়া চৌধুরী, রেহানা আকতার, সাহানা আখতার বীথি, কানিজ ফাতেমা লিমা, বিচিত্রা সেন, শর্মিষ্ঠা চৌধুরী, চম্পা চক্রবর্ত্তী, প্রচার ব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম জয়, কবি মেরুন হরিয়াল ও কবি মুয়িন পারভেজ প্রমুখ।

  ‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’

;

নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক—এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

‘নারীর পোশাক, নারীর ইচ্ছে হয়ে থাক- এই ভাবনায় ১৩ লেখিকার বই ‘শাড়ি’

  • Font increase
  • Font Decrease

চারপাশে এত কিছু ঘটে যে চিন্তা ও উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো বিষয়ের অভাব নেই। তবে এর মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর চিন্তাভাবনার একটি জায়গায় আটকে আছে; আর তা হলো নারীর পোশাক। নারী কী পোশাক পরল, কেমন পোশাক পরল, কেন পরল ও এমন পোশাক পরা উচিত ছিল না; ইত্যাদি নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত। আর এমন জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বেড়েই চলছে। নানা সময়ে এ নিয়ে তর্ক বিতর্কে মেতে উঠে বাঙালি। নারীর পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যায় সমালোচনাকারীরা।

বিভিন্ন সময় নারী দেহে আঁচলের বিশেষ অবস্থান দেখে ‘ভালো মেয়ে’, ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞা নির্ধারণ পদ্ধতি স্থির করে দিতে চাওয়া হয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতার আড়ালে। আর এর প্রতিবাদ- প্রতিরোধ উঠে এসেছে সমাজের নানা স্তর থেকে। কেউ কেউ বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।

নারী পোশাক নিয়ে ভাবনা ও মতামত ইতিহাসের দলিল রূপে প্রকাশ করার জন্য উদ্যোগে নিয়েছে কলকাতার ঋত প্রকাশনী। আগামী ১১ মে বিকেল সাড়ে ৫টায় অভিযান বুক ক্যাফে-তে প্রকাশিত হতে চলেছে ‘শাড়ি’ নামের এই বইটি।

বইটি বের করার পরিকল্পনা, সম্পাদনা ও নিমার্ণের দায়িত্বের রয়েছেন তানিয়া চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ ও চিত্রের দায়িত্বে রয়েছেন অংশুমান।


সংকলনটিতে অলংকরণ ও লেখার মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে আবহমানকাল জুড়ে পোশাককে কেন্দ্র করে বাঙালি মেয়েদের আহত দেহ ও মনের দিকে। সোচ্চারে উচ্চারণ করা হয়েছে সেই ইতিহাস যা অনুচ্চারিত থেকে যায় সামাজিক বিধি নিষেধেরে আড়ালে।

বইটির মাধ্যমে বিতর্ক সৃষ্টি নয়, অস্তিত্বের সন্ধানে বের হয়েছেন তেরোজন লেখক। যারা হলেন- জিনাত রেহেনা ইসলাম, যশোধরা রায়চৌধুরী, মধুজা ব্যানার্জি, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়, রোহিণী ধর্মপাল, সেবন্তী ঘোষ, মিতুল দত্ত, অমৃতা ভট্টাচার্য, রত্নদীপা দে ঘোষ, অদিতি বসু রায়, দেবাবৃতা বসু, শ্রুতকীর্তি দত্ত ও তানিয়া চক্রবর্তী।

দৃশ্য বা শব্দের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ভাইরাল হওয়া নয়, সংকলনটির উদ্দেশ্য একটি প্রলেপ সৃষ্টি যা আগামী প্রজন্মের মাথায় ছায়া দেবে। মেনে নেওয়া নয়, প্রশ্ন করার সাহস জোগাবে নতুন করে নয়।

এ প্রসঙ্গে তানিয়া চক্রবর্তী বলেন, ‘শাড়ি’ নিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নারীদের পোশাক নিয়ে ভারতে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। আমি মনে করি, ২০২৪ সালে এসে নারীর পোশাক নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। মেয়েরা যা ইচ্ছা তাই পরতে পারে। তাদের বুদ্ধি, কর্ম ও অভিব্যক্তি বিষয়টিই আসল। এ বিষয়গুলো বইটিতে স্থান পেয়েছে।

  ‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’

;

৩ গুণী পাচ্ছেন বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার



স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

-অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা, অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী ও অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

  • Font increase
  • Font Decrease

রবীন্দ্র ও নজরুল সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলা একাডেমির রবীন্দ্র ও নজরুল পুরস্কার পাচ্ছেন ৩ গুণী গবেষক।

মঙ্গলবার (৩০ এপ্রিল) বাংলা একাডেমির জনসংযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের পরিচালক সমীর কুমার সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলা একাডেমি রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষণায় অবদানের জন্য এবার রবীন্দ্র পুরস্কার ২০২৪ পাচ্ছেন অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা। অন্যদিকে, বাংলা একাডেমি নজরুল-সাহিত্যে গবেষণায় অবদানের জন্য অধ্যাপক রাজিয়া সুলতানা পাচ্ছেন নজরুল পুরস্কার ২০২৪।

আগামী ২৫শে বৈশাখ ১৪৩১/৮ মে ২০২৪ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে রবীন্দ্র পুরস্কার-২০২৪ ও আগামী ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১/২৩ মে ২০২৪ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে নজরুল পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হবে।

অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানা 

খ্যাতিমান নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. রাজিয়া সুলতানার জন্ম ২৫শে জুলাই ১৯৩৭। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় ১৯৫৮ সালে স্নাতক (সম্মান) এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি এইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের পাণ্ডুলিপি ও সাহিত্য বিষয়ে প্রথম গবেষক। ১৯৮৩ সালে তিনি ফারসি ভাষায় ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রণীত মধ্যযুগের সাহিত্য-সম্পাদনা-গ্রন্থ 'নওয়াজিশ খান বিরচিত গুলে-বকাওলী কাব্য। পরে প্রকাশিত হয় তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘আবদুল হাকিম : কবি ও কাব্য (১৯৮৭)। অপর সাহিত্য সম্পাদনা-গ্রন্থ 'আবদুল হাকিম রচনাবলী' (১৯৮৯)।

কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ড. রাজিয়া সুলতানার গবেষণাগ্রন্থ 'কথাশিল্পী নজরুল (১৯৭৫), 'নজরুল (১৯৮৮), অন্বেষা' (২০০১) এবং 'সাহিত্য-বীক্ষণ' (১৯৮৮)। ড. রাজিয়া সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ইতোপূর্বে তিনি বিভিন্ন সরকারি কলেজে ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।

অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের বিশিষ্ট সাহিত্য-সমালোচক ভীষ্মদেব চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৭ সনের ৩০শে নভেম্বর সিলেট শহরে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা। ২০০০ সনে তিনি অধ্যাপক হিসেবে উন্নীত হন। বাংলা উপন্যাস, রবীন্দ্র ছোটগল্প এবং বাংলাদেশের সাহিত্য তাঁর অনুধ্যান ও মূল্যায়নের কেন্দ্রীয় বিষয়। ভীষ্মদেব চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : জগদীশ গুপ্তের গল্প : পঙ্ক ও পঙ্কজ (১৯৮৮); মিরজা আবদুল হাই (১৯৮৯); বাংলাদেশের সাহিত্যগবেষণা ও অন্যান্য (দ্বি সংস্করণ ২০০৪); সৈয়দ মুজতবা আলীর পত্রগুচ্ছ (সম্পা. ১৯৯৩); তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস : সমাজ ও রাজনীতি (১৯৯৮); তারাশঙ্কর স্মারকগ্রন্থ (সম্পা. ২০০১); দু-চারটি অশ্রুজল : রবীন্দ্রগল্পের ভিন্নপাঠ (২০০৫); কথাশিল্পের কথামালা : শরৎচন্দ্র ও তারাশঙ্কর (২০০৭); সাহিত্য-সাধনায় ঢাকার নারী (২০১১); প্রভাতসূর্য :রবীন্দ্রনাথ সার্ধশত জন্মবর্ষ স্মরণ (সম্পা. ২০১১)।

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা

অধ্যাপক লাইসা আহমদ লিসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও সাধারণ সম্পাদক। গুণী এই শিল্পীর জন্ম রাজশাহীতে। বাবা অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের শিক্ষক ও মা খানম মমতাজ আহমদ। রবীন্দ্রনাথের গানসহ সুস্থধারার সংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত থেকেও তিনি দেশজুড়ে শুদ্ধ সঙ্গীতের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখছেন। 

  ‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’

;