বইমেলায় এক সন্ধ্যা
‘এসো মিলি প্রাণের মেলায়’মিসবাহ জামিল ভীষণ সিদ্ধান্তহীনতায়। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী, হাছন রাজা; অন্যদিকে পারিবার। না, আদর্শিক ব্যাপার এখানে নাই; একদম নাই। ওসমানী-হাছন রাজার মোচ তাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে, আবার এই বয়সে মোচ নিয়ে তিনি অনেকটা বিপত্তিতেও। মানুষের মতো দেখতে ঠিকঠাক, কিন্তু পরিবারের দাবি তাকে ‘মানুষ’ হতে হবে। এবং মানুষ হওয়ার অন্যতম শর্ত মোচ কাটতে হবে!
তুমুল সিদ্ধান্তহীনতায় থাকা মিসবাহ জামিল এক রাতগভীরে ফেসবুকে লিখে ফেললেন, ‘‘ভাবছিলাম, দাড়ি মোচ শেভ করব। কিন্তু বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানীর গোঁফ দেখে মনে হচ্ছে মোচটা রাখা সুন্দর। কিন্তু কী করব, সামনে পারিবারিক একটা অনুষ্ঠান আছে। আমাকে যে 'মানুষ' সাজতে হবে!!’’ ভোরের আগে আমিও লিখে বসলাম সেখানে—‘‘পারিবারিক কোন অনুষ্ঠান থাকলেই কেবল আমি মোচ রাখি। এর পর পরই কেটে দিই। মোচওয়ালা কবির মানে সামনে-পিছে কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ’’। উদ্দেশ্য কৌতুক, সঙ্গে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর বটিকা। কাজ হয় কি, হয়নি—এনিয়ে আর ভাবিনি।
বইমেলায় ঢুকতেই হঠাৎই চোখে পড়ল মিসবাহ জামিলকে। 'মানুষ খাওয়ার পদ্ধতি' আর 'রাশেদা মোকাম' নামের দুইটা বই তার পড়েছি। ভালো কবিতা লিখেন। বয়স কম। তবে এই কম বয়সেও কবি-মহলে তার পরিচিতি বেশ। তাকে অবাক করে দিয়ে মোচ নিয়ে আঁতকা গল্প জুড়ে দিলাম। তিনি বুঝতে পারেননি কী কারণে হঠাৎ মোচ-প্রসঙ্গ আর আমার এমন আন্তরিকতা। একটা সময়ে ঠিক আমাকে চিনে ফেললেন। অনেক ‘মোটা’ হয়ে গেছি আমি। শুধরে দিয়ে বললাম মোটা নয়, বলো—‘বিশাল’। বিশাল মানে বিশাল। এই যেমন বিশাল কবির ভাই। বুনন সম্পাদক খালেদ উদ-দীনও একই কথা বললেন; উত্তরও আমার একই! ‘বিশাল’ কবির অথবা কবির ভাই কেন? বাক্যের প্যাঁচ ভাঙিয়ে দিয়ে বললাম—যে সমাজে যাবে সেখানে যদি বলো বিশাল কবির, তবে ওই সমাজের মানুষেরা আকৃতি নয়, অবস্থান দিয়ে মাপবে বিশালত্বের পরিধি। কবি-সমাজে বিশাল কবি, সাংবাদিক-সমাজে বিশাল সাংবাদিক; এমন। সিরিয়াস কথা নয় যদিও, তবু বলা!
খালেদ উদ-দীন বুনন নামের একটা সাহিত্যের ছোটকাগজ প্রকাশ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। সারাদেশে লিটলম্যাগ আন্দোলনে ভাটা পড়লেও খালেদ উদ-দীন এটা চালিয়ে যাচ্ছেন। এবারের বইমেলায় তিনি প্রকাশ করেছেন এর ‘যুদ্ধ ও আগ্রাসন-বিরোধী সংখ্যা’। পৃষ্ঠাসংখ্যা সহস্রাধিক। বিশাল কলেবরের এই সংখ্যায় যুদ্ধ ও আগ্রাসন নিয়ে অনেকগুলো লেখা স্থান পেয়েছে। এখানে আমারও একটি লেখা আছে। প্রুফরিডারের অতি-আগ্রহে আমার লেখাটি পরিচিতি হারিয়েছে বলে তিনি আমার হাতে প্রকাশিত সংখ্যাটি তোলে দিতে পারেননি। এনিয়ে তার খানিকটা দুঃখবোধ আমাকে পীড়িত করেছে বলে কথা বাড়াইনি। এরবাইরে জেনেছি, এবারের বইমেলায় তিনি তার মালিকানাধীন বুনন প্রকাশনী থেকে অনেকগুলো বই প্রকাশ করেছেন। প্রকাশনা সংস্থাটি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে বলে তার মাঝে সন্তুষ্টি আছে, এবং এই কাজকে তিনি অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতেও চান।
কথা হলো, সমসাময়িক কবি ও কবিতা নিয়ে। খালেদ উদ-দীন অনেকটাই হতাশ এই সময়ের কবি ও কবিতা নিয়ে। এ সময়ে ভালো লেখালেখি তেমন হচ্ছে না বলে মন্তব্য করলেন। জানালেন কারণও। বললেন—বেশিরভাগ কবির মধ্যে এখন আর দ্রোহ নেই, আছে আপোষকামি মনোভাব। তাই দ্রোহের কিছু বেরিয়ে আসছে না। ভালো কবিতাও হচ্ছে না। আমি-আমি আছে এখনো, কিন্তু এই আমি-আমি শেষ করে দিচ্ছে অনেককে, বললেন তিনি।
কথা বলছি, গান শুনছি। শুনছি আবৃত্তিও। গোলজার আহমদের আবৃত্তি অনেকদিন পর শোনা হলো। ব্যস্ত সাংবাদিক বলে আবৃত্তিতে মন থাকলেও সময় থাকে না এখন তার। শ-কয়েক দর্শকদের একাংশ যারা মঞ্চে মনোযোগী ছিল তারা গ্রহণ করল ভালোভাবেই। চোখে চোখ পড়ল মৃণাল কান্তি দাসের। দেখে মনে হলো অনেকক্ষণ ধরে আমার দিকেই চোখ তার। অপেক্ষার। বইমেলায় গেলে মৃণাল কান্তি দাসের সঙ্গে আমার দেখা হয় না, এমন কখনো হয়নি। এবারও বইমেলায় যাওয়ার সময়ে ভেবেছি আর যাই হোক মৃণালের সঙ্গে দেখা হবে আমার। আমার পছন্দের অন্যতম মানুষ। ভালো লেখালেখি করেন। তার অনেকগুলো বই আমি পড়েছি। মৃণাল কান্তি দাস প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মাছরাঙা প্রকাশনের কর্ণধার। থাকেন মৌলভীবাজারের বড়লেখায়। গণিতে স্নাতকোত্তর মৃণাল পেশাগত জীবনে স্কুল-শিক্ষক।
যতবার মৃণাল কান্তি দাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় ততবারই লেখালেখি নিয়ে আলাপ হয়। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। নিজে লেখক বলে অন্য সকলের লেখালেখি নিয়েও ব্যাপক আগ্রহ। এবারের বইমেলায় তার প্রকাশনী করেছে ৩৭টি বই। জানালেন এর ত্রিশের বেশি সিলেট বিভাগের বাইরের লেখকদের বই। বইয়ের বিষয়েও রয়েছে বৈচিত্র্য। আমার ছেলের বয়স দশে পড়েছে জেনে তার লেখা দুটো ছোটোদের বই দিয়ে বললেন—রাইআন বইগুলো পড়ে যেন বলে কেমন লাগল তার। ছোটোমানুষ তাই নির্মোহ মন্তব্য করবে। রাইআনকে বইগুলো দিলাম। সে খুশি হলো। তার পড়ার আগেই রাইআনের মা বই পড়ে ফেলেছেন।
মৃণাল কান্তি দাসের একটা বই ‘মহাকাশ বিজ্ঞানের গল্প—ছোটো মামার রহস্যময় এলিয়েন’। বইয়ের শুরুটা এভাবে—‘‘স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই মিতার মনটা আনন্দে নেচে উঠল। ছোটোমামা এসেছেন। ছোটোমামা বেড়াতে এলে একটা না একটা মজার ঘটনা ঘটবেই। গতবার যখন এসেছিলেন তিনি একটা ভুত ধরেছিলেন।’’ আগ্রহ-জাগানিয়া নিঃসন্দেহ। মৃণাল জানালেন, পাঠ্যবইয়ে মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কেও আছে। পাঠ্যবইয়ের বাইরে শিশুদের মহাকাশ সম্পর্কে জানাতে কল্পে-গল্পে তিনি বলতে চেয়েছেন। দেড় ফর্মার বইটিতে চমৎকার অলঙ্করণ শিশু ও অনতি-তরুণ পাঠকদের আকৃষ্ট করবে বলে আমার ধারণা জন্মেছে।
আয়াজ বাঙ্গালী নামের একজন লোকগান রচয়িতা রয়েছেন। তার বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখায়। জনপ্রিয় লোকগান শিল্পী আশিক আয়াজ বাঙ্গালীর ‘চৌদ্দ নম্বর বেয়াক্কল’ শিরোনামের একটা গান করেছেন। এই গানটি তুমুল জনপ্রিয়। চৌদ্দ ধরনের বেয়াক্কল নিয়ে এই গান। ‘চৌদ্দ নম্বর বেয়াক্কল’ শিরোনামে একটি বই গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন মৃণাল কান্তি দাস। বইটি হাতে নিতেই মৃণাল জানালেন, এক জনপ্রতিনিধি ফটোসেশনে এসে এই বই নিয়ে ছবি তুললেন। এরপর হঠাৎই বইয়ের শিরোনাম দেখে তৎক্ষণাৎ হাত থেকে বইটি রেখে দিলেন। বললেন, অন্য আরেকটি বই দিতে। তারা বই দিলেন, তিনিও ছবি তুলে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে অবশ্য যারা তার এবং ‘চৌদ্দ নম্বর বেয়াক্কল’ শিরোনামের বইয়ের ছবি তুলেছেন তাদেরকে ছবি মুছে দেওয়ার নির্দেশ কিংবা অনুরোধ করে যান। মৃণাল কান্তি দাসের মুখ থেকে এসব জেনে বইটি হাতে নিয়ে ছবি তোলার ইচ্ছা হলো। মনে হলো, লাইনে ১৪ জনকে দাঁড় করিয়ে নিজে ১৪ নম্বরে থেকে বইটি হাতে নিয়ে ছবি তুলি। সেটা হয়নি শেষমেশ; এত এত মানুষের ভিড়ে ঠিক ১৪ জনকে জোগাড় করা কঠিন বৈকি!
মাছরাঙা প্রকাশনের স্টলে বসে যখন আড্ডা দিচ্ছিলাম তখন শিশুদের নিয়ে একাধিক অভিভাবকের আগমন লক্ষ্য করলাম। নেড়েচেড়ে বই দেখলেন অনেকেই। বইও নিলেন কেউ কেউ। আমি তাকে বললাম, আপনি ছোটোদের নিয়েই লিখুন কেবল। কারণ এই শিশুসাহিত্যে আমাদের অপূর্ণতা অথবা বিষয়-বৈচিত্র্যের অভাব রয়েছে। মৃণাল জানালেন, বড়লেখার মতো প্রান্তিক অঞ্চলে তিনি একটা বইয়ের দোকান খুলেছেন। ঢাকায় যেমন পাঠক সমাবেশ কেন্দ্র তেমনই। উদ্দেশ্যও জানালেন। বললেন, প্রান্তিক অঞ্চলের লাইব্রেরিগুলোতে এখন আগের মতো বই পাওয়া যায় না। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নানা প্রতিযোগিতায় পুরস্কার হিসেবে খুব কমই বই দেওয়া হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বাজেটও থাকে কম। তিনি মূলত বইয়ের এই কেন্দ্র খুলেছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করে। কম দাম দিয়ে হলেও তিনি প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানে বই ছড়িয়ে দিতে চান। এখানে তিনি লাভ-ক্ষতির হিসাব কষছেন না।
মৃণাল বললেন, আমার একটা বই তিনি করতে চান। জানালাম, আমি বই করি না মূলত প্রকাশকের দিক চিন্তা করে। আমি যে ধারায় লেখালেখি করি সেটা জনপ্রিয় ধারার নয়। ২০১৪ সালের পর থেকে বই আমি করিনি। আমার ধারণা আমার লেখা বইয়ের ক্রেতা সংখ্যা কম; চাই না ক্ষতির মুখে ফেলতে কোন প্রকাশককে। মৃণালের কথা, লাভক্ষতির চিন্তা করছি না। আগামী বইমেলায় একটা বই তিনি আমার করবেনই। কথা ও-পর্যন্ত থাকল। এরই মধ্যে বার্তা২৪.কমের স্টাফ রিপোর্টার মশাহিদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ। চমৎকার মানুষ, শেখার প্রবল আগ্রহ। বয়সে তরুণ হলেও এই ছেলেদের এই আগ্রহকে কাজে লাগানো জরুরি বলে মনে হয়েছে। কিন্তু সমস্যার জায়গা একটাই সিলেটের মতো শহরে দিকনির্দেশনা এবং সার্বিক সহায়তার যে জায়গা সেটা অনেকেই পায় না। মশাহিদের সঙ্গে আলাপে মনে হয়েছে সুযোগ পেলে তার পক্ষে সম্ভব অনেক দূর যাওয়া।
ইয়াহইয়া মারুফ, মাসুদ আহমদ রনি, আনিস মাহমুদ, হয্রত বিনয় ভদ্র, সামসুল আমিন, গোলাম সোবহান চৌধুরী দীপন, রণদীপম বসু, তারেক অণু, নাবিল এইচ, শুভ, জফির সেতু, এনামুল কবির, মালেকুল হক, মোস্তাক আহমাদ দীন, রাজীব চৌধুরী, সুফি সুফিয়ান, অপূর্ব শর্মাসহ আরও অনেকের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর, আবার অনেকের সঙ্গে প্রথমবার সাক্ষাৎ হয়েছে। পরিব্রাজক তারেক অণুকে বললাম—আপনি বিশ্ব দেখেন, আর আমরা আপনাকে দেখি। রণদীপম দা সিলেট ফিরেছেন জেনে ভালো লেগেছে। জানালেন, আগের নাম্বারেই আছেন। তিনি অবাক হয়ে আছেন কীভাবে এতদিন ঢাকায় থাকলেন?
বলে রাখা দরকার এই বইমেলা বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৪ নয়, এটা সিলেটের বইমেলা। প্রথম আলো বন্ধুসভা কবছর ধরে সিলেটে নিয়মিতভাবে এই বইমেলার আয়োজন করছে। একটা পত্রিকার একটা পাঠক সংগঠনের আয়োজনে হলেও দিন দিন এ মেলার শ্রী বৃদ্ধি পাচ্ছে; আগ্রহী করছে পাঠককে-লেখককে।
যেখানে মানুষ, সেখানেই বই পৌঁছাক। ঘরে-ঘরে বই গেলে এ সময়ের পাঠক না হোক, কোন একটা সময়ের পাঠক সে বই পড়বেই!