কোলাজ মন্তাজ

শিল্পসাহিত্যে ‘স্বাধীনতা’



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

নিজের মত প্রকাশ করে সক্রেটিসকে পান করতে হয়েছিল হেমলক, রাশিয়ায় বরিস পাস্তেরনাকসহ অনেক লেখককে হতে হয়েছিল নির্বাসিত, হুমায়ুন আজাদ হয়েছিলেন হামলার শিকার, তসলিমা নাসরিন, দাউদ হায়দার হয়েছেন নির্বাসিত। এমন অজস্র উদাহরণ দুনিয়া জুড়ে। কথা হচ্ছে ‘কতটুকু স্বাধীনতা আপনি পেতে চান?’ এ প্রশ্ন ছিল ডিডোডাসের—প্লেটোর কাছে। প্লেটো উত্তরে বলেছিলেন, “যতটুকুর দায় মানুষকে ভালোবেসে নেওয়া যায় ততটুকু।”

কিন্তু তার উত্তরে আমরা পরিষ্কার নই ‘দায়’টা কতটুকু? আর ‘ভালোবাসাবোধ’ তো ব্যক্তি, মতাদর্শ বিশেষে আলাদা। ঢাকা শহরে কি চাইব পূজা বেদির মতো নেকেড হয়ে কোনো সুস্থ মানুষ হেঁটে যাক? এ বিষয়ে উত্তর খোঁজার আগে দেখা দরকার ঠিক এখন বিশ্বে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কেমন? দেখা যাচ্ছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার ইউরোপের দেশ জার্মানিতে লেখকদের স্বাধীনতাই ‘হুমকির’ মুখে। কখনো সরাসরি, কখনো সামাজিক মাধ্যমে আক্রমণ ও হুমকির ফলে অনেক ক্ষেত্রে অনেক কিছু লিখতেও ভয় পাচ্ছেন লেখকরা।

২০১৮ সালে জার্মানির পেন সেন্টার এক গবেষণায় প্রকাশ করেছে এমন ‘ভয়াবহ’ তথ্য।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী কাজ করা পেন ইন্টারন্যাশনালের সদস্য জার্মানির পেন সেন্টার। ‘ফ্রি স্পিচ আন্ডার প্রেশার’ বা ‘চাপের মুখে মতপ্রকাশ’ শীর্ষক এই গবেষণায় সহযোগী ছিল উত্তরপূর্ব জার্মানির রোস্টোক ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর মিডিয়া রিসার্চ। গবেষকদের দাবি, এটিই জার্মানিতে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে করা প্রথম পূর্ণাঙ্গ গবেষণা। গবেষণার আগে এক জরিপের মাধ্যমে লেখকদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। শুধু জার্মান রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদেরই এই জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ তাদের কাছে অনলাইনে একটি ফরম পাঠানো হয়, সেখানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে তারা তাদের অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত আক্রমণের ঘটনা ও কিভাবে এমন ঘটনা তাদের কাজকে প্রভাবিত করেছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।

কোন দেশে গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন বা পরাধীন, তা মূল্যায়ন করে প্রকাশিত এ বার্ষিক প্রতিবেদনে তুরস্ককে উল্লেখ করা হয়েছে ‘সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় জেল’ হিসেবে। ২০১৬ সালের কথিত ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর থেকে সে দেশে অনেক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করেছে এরদোয়ান সরকার। প্রতিবেদনে তুরস্ক আছে ১৫৭ নম্বরে।

৫২৬ অংশগ্রহণকারীর মধ্যে প্রতি চার জনে তিন জন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ৬০ শতাংশ লেখক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাঁদের লেখার স্বাধীনতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করেন।

প্রতি দুইজনে একজন নিজের বা বন্ধুদের ওপর ব্যক্তিগত আক্রমণ ও সহিংসতার শিকার হওয়ার ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে ৩৭ শতাংশ ব্যক্তিগত আক্রমণ করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, ৩১ শতাংশ করা হয়েছে সরাসরি মৌখিকভাবে৷ অবশ্য শারীরিক সহিংসতার কথা বলেছেন কেবল ২ শতাংশ লেখক।

জার্মান পেনের মহাসচিব কার্লোস কলাডো সাইডেল এক বিবৃতিতে বলেছেন, “একটি স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশে এমন ফল ভয়াবহ।” তারমানে রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ তার স্বার্থে আঘাত লাগলেই টেনে ধরবে আপনার টুটি। তাহলে সক্রেটিসের হেমলক পানের সমাজ থেকে আমরা কতদূর এগুলাম? একসময় গ্রিসীয়রা মনে করতেন, কবি ও কবিতা একটা দৈবসত্তা এবং তা সব কিছুর ঊর্ধ্বে—যা ছিল প্লেটোর স্বাধীন চিন্তার বিরোধী। একজন স্বাধীন চিন্তার মানুষের কাছে কোনো কিছুই যুক্তি-তর্কের উপরে নয়। প্লেটো নিশ্চয়ই স্বীকার করতে চাইবেন না যে, কবির কোনো কবিতা আলোচনা সাপেক্ষ নয়। এবং সেটিই শেষ কথা। গ্রিক মহান কবি হোমার নিঃসন্দেহে কালোত্তীর্ণ কবি। কিন্তু তাই বলে তার কবিতা সব কিছুর ঊর্ধ্বে এমন ভাবা প্লেটোর পক্ষে সঙ্গত ছিল না। তাই তিনি তার আদর্শ রাষ্ট্রে সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন দার্শনিক রাজাকে। যিনি একদিকে হবেন প্রচুর জ্ঞানী অন্যদিকে হবেন প্রখর নেতা। প্লেটো মনে করতেন, স্বাধীনতা যেন স্বেচ্ছাচারিতার রূপ না নেয়। কিন্তু তিনিও স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে নোবেল, প্রত্যাখ্যান ও কেড়ে নেওয়ার গল্প

তার অনেক অনেক পরে নাইজেরিয়ায় ১৯৫৯ সালে জন্ম নেওয়া বুকার পুরস্কার পাওয়া বেন ওকরি নতুনভাবে প্রশ্ন তুলেছেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে। তিনি মূলত উত্তারধুনিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের শক্তিশালী লেখক হিসেবে সারা দুনিয়াতেই ব্যাপক পরিচিত। তিনি বলছেন, নিঃশর্ত স্বাধীনতা ছাড়া একটি রাষ্ট্রের জনগণ ভালো বা পরিপূর্ণ হতে পারে না। এটি ব্যতীত সাহিত্যও ভালো হতে পারে না। সাহিত্যের পূর্বশর্ত হলো স্বাধীনতা। জন বেভেরলি রবিনসনের বক্তব্যও তাই। মাত্র দেড় পৃষ্ঠার একটা প্রবন্ধ আছে তাঁর। প্রবন্ধটা লিখেছিলেন ১৮৯৪ সালে। নাম ‘হোয়াট ইজ ফ্রিডম?’ এ প্রবন্ধ পড়ে ভেবেছি এত আগে জন্মানো মানুষ এত দূরের চিন্তা কিভাবে করেছিলেন। রবিনসনের জন্ম ১৮৫৩ সালে এবং মারা যান ১৯২৩ সালে। তিনি একজন individualist anarchist লেখক। লেখক freedom এবং liberty দুটো শব্দ বারেবারে ব্যবহার করছিলেন। ফলে অনুবাদের সময় যাতে বিভ্রান্তি তৈয়ার না হয় করা হয় সেজন্যে ‘স্বাধীনতা’ই রাখা হলো।

হোয়াট ইজ ফ্রিডম (মূল প্রবন্ধ)

‘আপনার কি মনে হয় স্বাধীনতা সবার জন্যে মঙ্গলজনক?’ এক মেধাবী নারী আমার কাছে জানতে চাইলেন ‘লাগামহীন ক্ষমতার নানা উদাহরণ যদি ধরুন, যেমন রোমান সম্রাটেরা, তাদের তো নিশ্চয়ই স্বাধীনতা ছিল, কিন্তু, সেটা থাকা কি ভালো ছিল?’তাই স্বাধীনতার সম্পূর্ণ ধারণা মনে জায়গা করে নেয়ার আগে মানুষ তা নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করে। যে চুরি করে সে কি স্বাধীন নয়? যে বউ পিটায়, সে কি স্বাধীন নয়?

এসময় আমরাও পাল্টা জানতে চাই, ‘যখন রোমান সম্রাটরা শাসন করেছিলেন, তারা হয়তোবা স্বাধীন ছিলেন, কিন্তু, শাসিতরা কি স্বাধীন ছিল? চোর হয়তোবা স্বাধীন হতে পারে, কিন্তু যাকে চুরি করছে সে যে নিগৃহীত হচ্ছে তাতে তো কোন সন্দেহ নাই। যে তার বউকে পেটাচ্ছে, সে হয়তোবা তার শারীরিক শক্তির জোরে বউ পিটাতে স্বাধীন, কিন্তু বউ কি স্বাধীন? স্বাধীনতা মানে আরেকজনের মাথায় মুগুর মারার স্বাধীনতা নয়।’

বুঝলাম এখানেও আপনার আপত্তি রয়েছে। আপনি হয়তোবা বললেন, ‘ধরুন, দুজন ব্যক্তি একই কাজ করতে চায়, এক্ষেত্রে তারা সমঝোতায় আসবে কিভাবে? মনে করুন, আমি একটা নির্দিষ্ট জমিতে একটা বাড়ি তৈরি করতে চাই এবং অন্য আরেকজনও একই জমিতে তার বাড়ি তৈরি করতে চায়। এক্ষেত্রে কিভাবে আমরা দুজনেই নিজেদের খুশিমতো কাজ করার স্বাধীনতা পেতে পারি?’

এ প্রশ্নের জবাব হলো, ‘সকলের স্বাধীনতাই যৌক্তিক এই রীতি যদি আমরা মেনে নেই, তাহলে যে ঘটনাগুলো অন্যের স্বাধীনতা চর্চার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে, সেগুলোর সমাধান খুব সহজেই হয়ে যাবে। একই জমি নিয়ে সমস্যাটা সমাধান এভাবে করা যায় যিনি আগে দাবি করবেন তিনি ওই জমিতে বাড়ি বানাতে পারবেন।’
ধরেন, রাস্তায় হাঁটার স্বাধীনতা সবারই আছে, কিন্তু এর মানে এই না যে একে অন্যের গায়ে এসে পড়তে হবে।

কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, সাংঘর্ষিক কর্ম ও একে অন্যকে দখল করার মতো ঘটনা ব্যতীত যখন আমরা সবার জন্যেই স্বাধীনতা এই নীতি পরিত্যাগ করি; সে স্বাধীনতা যথেষ্ট নয়, কেউ না কেউ কাউকে না কাউকে দমন করবেই। এই দমন প্রক্রিয়ারও কোনো সীমানা নাই। যে ঘটনায় কর্মের সাথে কর্মের সংঘর্ষ হয় সেটা হতে শুরু করে একেবারে যেখানে সংঘর্ষ দূরে থাক, সবার সম্মতি আছে এমন ঘটনা পর্যন্তও সে (দমন প্রক্রিয়া) নিজেকে প্রসারিত করে থাকে। রোববারের আইন (Sunday laws), অন্যান্য দিনে স্বাধীনভাবেই যা কেনা যায় তা সপ্তাহের একদিন কিনতে নিষিদ্ধ করা, স্পষ্টতই জঘন্য। কেনাকাটার কর্ম যেখানে সপ্তাহের ছয়দিন অন্য কারো স্বাধীনতায় বাধা দেয় না, সেখানে সপ্তম দিন এটা বাধা দেবে তা চিন্তা করাই নির্বুদ্ধিতা। এই আইনগুলো প্রণীত হয় যারা এটাকে সমর্থন করে তাদের স্বাধীনতার জন্যে নয়, বরং, এই জন্যে যে তারা অন্যের ওপর তাদের চিন্তা ও কর্ম চাপিয়ে দিতে চায়, এবং সেটা অন্যদের স্বাধীনতার বিনিময়েই। তারা চান, এবং আমাদের প্রত্যেক আইন-প্রণেতারাই চান, সবার ওপর কিছু নির্দিষ্ট কর্ম চাপিয়ে দিতে, কারণ এগুলো ধর্ম অথবা প্রথা অথবা কুসংস্কার দ্বারা অনুমোদিত। প্রকৃতপক্ষে, এই হোয়াইট ক্যাপরা সাধারণত কমিউনিটিতে সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ, চার্চ ও রাষ্ট্রের স্তম্ভ।

একটা সময় ছিল যখন স্বাধীনতা বরাদ্দ ছিল মাত্র এক ব্যক্তির জন্যে, যার কাছে সবাই ছিল স্বেচ্ছাদাস। কিন্তু এখন ভিন্ন পরিস্থিতি। প্রচুর লোকের হাতে ক্ষমতা আছে এবং তা ব্যবহার করাও তারা শিখছে। মুষ্টিমেয় কিছু লোকের থেকে নিজেদের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যে সবাইকে তাগাদা দেওয়ার প্রয়োজন আর এখন নেই। বরং, আমাদের এখন এই প্রেরণা দিতে হবে যে, স্বাধীনতা মানে নিজের স্বাধীনতা চর্চার পাশাপাশি অন্যকে স্বাধীন হতে দেওয়া। তবে এর বিপরীতে দাসত্বের মনোভাব যা আমরা অতীত থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি, যা অন্যকে আমাদের পথে চলতে বাধ্য করে, তার ওপরেই বর্তমানের শাসন-ক্ষমতা নির্ভর করে। যারা মনে করে তা দিয়ে শাসন করবে তারা আসলে নিজেরাই দাসত্বকে কবুল করে।

এটা সত্য যে, সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে ক্ষমতা আছে, কিন্তু এর অন্ধ ব্যবহার সবসময়ই ব্যবহারকারীকে পাল্টা আঘাত করবে। এবং সেটা করবে অর্থনৈতিক দাসত্বের এই ব্যবস্থাকে সমর্থনের মাধ্যমে যা কিনা শাসক ও শাসিতকে সমানভাবেই পেষণ করে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠকে বুঝতে হবে যে, যা আমরা বোঝাতে চাচ্ছি একমাত্র স্বাধীনতা রক্ষার কাজে ক্ষমতাকে ব্যবহার করাটাই সবচেয়ে নিরাপদ ও যথার্থ।

এরমানে স্বাধীনতাকে কিভাবে আদায় করে নিতে হবে এটা বোঝা যায়। আরেকটি দিক রয়েছে সেটি হলো রাজনীতিকে বোঝার জন্যও লেখকদের স্বাধীনতা জরুরি। যেমন ধরুন আমরা জীবনানন্দ পড়ি ঘোরগ্রস্ত হওয়ার জন্যে। ফ্লাবার্ট পড়ি সৌন্দর্যের জন্য, জেমস জয়েস পড়ি হাওয়া ও আগুনের ভাষা বোঝার জন্য, কোয়েলহো পড়ি শিকার বোঝার জন্যে, পড়ি জেন অস্টেন তার মনস্তত্ত্বের জন্য। কিন্তু কালো এবং আফ্রিকান লেখকদের মাঝে কি পাই? পাই সেখানকার দাসত্ব, উপনিবেশিকতা, দারিদ্র্য, গৃহযুদ্ধ, বন্দিদশা, নারী হেনস্থা—এসব বোঝার জন্যে।

বেন ওকরি বলছেন, ‘দ্য ওয়ে টু ফ্রিডম’ প্রবন্ধে, “জেমস জয়েসের ‘দ্য ডেড’ মূলত একটি পার্টিকে ঘিরে রচিত যেটি এক শীতের রাতে ডাবলিন শহরের একটি পরিবারে অনুষ্ঠিত হয়। সেই পার্টিতে লোকজন কথা বলে, মিউজিক বাজতে থাকে এবং একজন মহিলা একজন তরুণের কথা স্মরণ করে যে বহু বছর আগে তার বিরহে মৃত্যুবরণ করে। আইরিশদের দুর্ভিক্ষ, আইরিশ জাতীয়তাবাদ অথবা সম্ভাব্য কোনো বিষয় এখানে বিষয়বস্তু নয়। মূল বিষয় হলো স্মৃতি, মিউজিক অথবা আয়ারল্যান্ডে তুষারপাত। গল্পের তাৎপর্য হলো মানব হৃদয়ের পরোক্ষ প্রকাশ, এবং হৃদয়ভঙ্গের কোনো গল্প, ছলাকলার কাহিনী এবং কোনো সুদৃশ্য সংক্ষেপে বর্ণনা করা। যদি তিনি আইরিশদের দুর্ভিক্ষ নিয়ে লিখতেন তাহলে তিনি আমাদেরকে ‘দ্য ডেড’র মতো কালোত্তীর্ণ একটি লেখা উপহার দিতে পারতেন না।

আমাদের সময়ে আমরা বিষয়বস্তুর প্রতি অন্ধ হয়ে আছি কেননা আমরা শিল্পের সত্যিকারের তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছি। যদি একটি উপন্যাস দাস ব্যবস্থা নিয়ে রচিত হয়, আমরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনে করি এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। একজন ছোকরা যে কিনা অত্যধিক পাম ওয়াইন পান করে তার থেকেও অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কালো এবং আফ্রিকান ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকা বিয়োগান্তর ( tragedies), অবিচার এবং নিরন্তর সংগ্রামের ঘটনাগুলো প্রকাশ করার জন্য আফ্রিকান লেখকদের মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আর এটি অন্যান্য সাহিত্যের তুলনায় এই আফ্রিকান সাহিত্যকে অনেক বেশি কমিটেড বা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করে তোলে। এই কারণে হয়তো এই সাহিত্য কম বৈচিত্র্যপূর্ণ, কম উপভোগ্য এবং স্বাভাবিকভাবে কম টেকসই।”

মানে যারা পলিটিক্যাল ইতিহাস পড়ার কারণে আফ্রিকান সাহিত্য পড়বেন বলছেন তাদের উত্তরটা দিলেন বেন ওকরি।

উত্তর তো দিলেন না, খোঁচা মারলেন। বুঝেছেন তো, নাকি?

তিনি ওই প্রবন্ধে বলছেন, “আপনি লেখকের স্বাধীনতা চান? স্বাধীনতা পেলে কী করছেন? ধরুন আপনি শেক্সপিয়রের লেখা থেকে সাধারণ মানুষের কঠিন জীবনযাপন সম্পর্কে ধারণাও করতে পারবেন না। তার নাটকগুলোতে আপনি কোথাও জানতে পারবেন না যে তার সময়ে লোকজন তাদের শৌচাগারের বালতিসমূহ জানালার বাইরে খালি করে রাখত এবং স্ট্রাটফোর্ড—আপন—এভন’র স্ট্রিটগুলো দুর্গন্ধে ভরে উঠত। তার সৃষ্টিকর্মগুলো স্থায়িত্ব লাভ করেছে। এই সাহিত্য অনবরত মানবাত্মাকে উদ্ভাসিত করে এবং মানব জগতের মহত্ত্ব এবং অদ্ভুতুড়ে বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের সজাগ করে।

আরো পড়ুন ➥ সৃষ্টিশীলদের খেয়ালিপনা

এখানে ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো Cervantes দাসত্ব সম্পর্কে জানতেন, মুরদের নির্বাসন সম্পর্কে জানতেন। তিনি লেপান্টের যুদ্ধে তার হাত হারিয়েছিলেন। তিনি স্পেনের নিষ্ঠুর ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন না। তারপরেও তিনি Don Quixote-এর তুলনায় আমাদের মানসপটে খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলতে পারেননি। Don Quixote এই উপন্যাসটি একজন মানুষকে ঘিরে যিনি অ্যাডভেঞ্চারের জীবন বেছে নেন।

হোমার একজন মানুষের অসন্তুষ্টি চিত্রায়নের মধ্য দিয়ে ট্রয় নগরীর পতনের কাহিনী বলেছেন। সফোক্লিস একজন রাজার নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডের ইতিহাস বলেছেন। তারা গ্রিক ইতিহাসের ভয়ংকর ঘটনার গল্প বলেননি। তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’-এ একটি মহৎ বিষয়বস্তু আছে। তবে এটি তার অন্তর্দৃষ্টি এবং তাঁর লেখনী এই বিষয়বস্তুকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছে। পুশকিন রাশিয়ার ভয়ানক এবং অসাধারণ ইতিহাসে মগ্ন থাকতেন। তিনি বয়ারের উৎপীড়ন সম্পর্কে জানতেন। ইভান দ্য টেরিবলের দীর্ঘ ছায়া, কৃষকগোষ্ঠীর মানবেতর জীবনযাপন সম্পর্কে জানতেন। তিনি নির্বাসন সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। তারপরেও তার বিখ্যাত Eugene Onegin যাকে রাশিয়ান সাহিত্যের উৎস বলে বিবেচনা করা হয়, রচিত হয়েছে নির্লিপ্ত অভিজাতবর্গদের নিয়ে এবং তার ছোট গল্প The Queen of Spades, অন্যতম সর্বশ্রেষ্ঠ ছোট গল্প; সেটিরও মূল বিষয় ছিল জুয়া খেলা।

এরমানে সেল্ফ সেন্সরশিপ থাকাটাও উচিত একজন স্বাধীনতাকামী লেখকের জগতে।এখনো মনে হয় ভলতেয়ারের সেই কথাটা প্রাসঙ্গিক। সেই যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমার মত মানি না, কিন্তু তুমি যাহাতে তোমার মতো অবাধে বলিতে পার, তাহার জন্য আমি নিজের প্রাণ অবধি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত।”

কিন্তু এখন আমরা যেন স্মরণে রাখি রবিনসনের সেই কথাও এক রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে আপনার পা যেন আমি মাড়িয়ে না দিই। ব্যঙ্গ কবিতা রচনার মাধ্যমেই ভলতেয়ার সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ করেন। খ্রিস্টান গির্জা ও তৎকালীন ফরাসি সামাজিক আচার ছিল তার ব্যঙ্গবিদ্রুপের লক্ষ্য। ভলতেয়ার তার সাহিত্যজীবনে সর্বোচ্চ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন একজন গদ্যলেখক হিসেবে। ভলতেয়ারের সাহিত্যকর্মের মধ্যে দু হাজার গ্রন্থ এবং ২০ হাজার চিঠি রয়েছে। ভলতেয়ারের আসল নাম ফ্রাঙ্কো ম্যারিক এ্যারোয়েট। একসময় এ্যারোয়েট অজ্ঞাত কারনে ভলতেয়ার নাম গ্রহণ করেন।

পরবর্তী জীবনে ভলতেয়ার ইতালীয়, স্পেনীয় ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। নাগরিক স্বাধীনতা, বিশেষত ধর্মের স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে তার অবস্থান ছিল অটল। সে সময় ফ্রান্সের কঠোর সেন্সর আইন উপেক্ষা করে সামাজিক সংস্কারের অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন ভলতেয়ার।

তিনি বলেছেন যেখানে ‘অজ্ঞতা যত বেশি’ সেখানে ‘অসহিষ্ণুতা এবং নিষ্ঠুরতা তত বেশি’... এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তাশক্তি বিকশিত না হওয়ার কারণেই সমাজে এইসব অন্যায় ঘটে থাকে। তিনি বলতেন শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞরাই অশুভ শক্তির পরিণতি সম্বন্ধে জানলে চলবে না, তাঁদের জানাতে হবে দেশের তরুণদের। তবেই তারা যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে একে প্রতিহত করতে পারবে।

ভলতেয়ার কারা অন্তরিন অবস্থায় মাত্র এগার মাসে ‘হেনরিয়ের্ডে’ নামে একটা মহাকাব্য রচনা করেন। কাব্যগ্রন্থটি পরর্বতীকালে তাঁকে প্রভূত খ্যাতি এনে দিয়েছিল। তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম বিবেচনা করা হয়। ১৭১৮ সালে ভলতেয়ার রচনা করেন ’ওয়েডিপে’ নামক এক ট্রাজিক নাটক। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের বিদগ্ধ সমাজ এই অসাধারণ কবিকে হোমার এবং ভার্জিলের সমকক্ষ বলে অভিনন্দিত করেছেন। তার মতোই ছিলেন ফ্রান্সের দেকার্ত।

১৫৯৬ সালের ৩১ মার্চ, ফ্রান্সের তোরাইন গ্রামে এক ধনাঢ্য পরিবারে রেনে দেকার্ত জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের বর্তমান নাম তার সম্মানে ‘দেকার্ত’ রাখা হয়েছে।

ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত একটা নতুন দর্শন দিতে ব্যস্ত না হয়ে দর্শন নির্মাণের জন্য একটা পদ্ধতি বের করতেই আগে মন দেন। তাঁর এই শুরুর রচনার নাম ‘মেডিটেশন্স্ অন ফার্স্ট ফিলোসফি’। এর প্রথম কথাই হচ্ছে, সন্দেহ করো, অস্বীকার করো। তার লেখালেখি জগতে আসার গল্পটা বেশ মজার। জার্মানির নিউবার্গ শহরে তখন কনকনে শীত। শীতে কাঁপতে কাঁপতে এসে নিজের রুমে ঢুকলেন ২৩ বছরের যুবক রেনে দেকার্ত। লিখতে শুরু করলেন দেবতার বাতলে দেওয়া উপায়সমূহ। তিনটি বিষয়ের ওপর কাজ করবার উপায় বলেছেন দেবতা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি আর দর্শন। সে রাতের প্রায় ১৮ বছর পর ১৬৩৭ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘ডিসকোর্স ডি লা মেথড’ (ডিসকাশন অব দ্য মেথড) এবং ‘লা জিওম্যাত্রি’ (জিওমেট্রি)। এই দুটি বই তাকে ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন দিয়েছে। দুটি বইয়ের মাঝেই তিনি উল্লেখ করেছেন ১০ নভেম্বরের সেই শীতের রাতের কথা।

আরো পড়ুন ➥ সাহিত্যে জেনারেশন

দেকার্ত মানুষের চিন্তা ও ধারণাকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন: ১) সৃষ্ট ধারণা যা মানুষ ভেবে-চিন্তে তৈরি করে, ২) অস্থানিক ধারণা, যা ভাববার প্রয়োজন হয় না; যেমন, গরম পানি হাতে পড়লে তৎক্ষণাৎ গরম লাগার কথা চিন্তা করবে মানুষ এবং ৩) সহজাত চিন্তা যা মানুষের মধ্যে সৃষ্টিকর্তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এগুলো চাইলেও পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, মানুষ চাইলেই একটি ত্রিকোণ বস্তুকে চতুষ্কোণ বলে ভাবতে পারে না। অন্যদিকে দেকার্তের দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ‘ডুয়েলিজম’ বা দ্বৈতবাদ। এই তত্ত্বের প্রধান কথা হচ্ছে, আমাদের দেহ এবং মন সম্পূর্ণ পৃথক দুটি সত্তা। তাই দেকার্তে লেখকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে বলেছেন, “স্বাধীনতা আপেক্ষিক। চূড়ান্ত স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। আর স্বাধীনতাকে বোঝার জন্য পরাধীনতাও অস্তিত্ব রয়েছে।” তিনি ভলতেয়ারের চেয়ে অন্য ঘরানার চিন্তা জগতে। তবে ভলতেয়ারের সঙ্গে মিল রয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে মন্টেস্কুর।

মন্টেস্কু তার বিখ্যাত ‘দ্য স্পিরিট অফ লজ’ (The Spirit of Laws)-এ রাজার দৈবস্বত্ব নীতির সমালোচনা করে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য আইন, শাসন ও বিচারবিভাগের পৃথকীকরণের কথা বলেন। মন্টেস্কুর আর-একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হলো ‘দ্য পার্সিয়ান লেটারস’ (The Persian Letters)। এই বইয়ে তিনি বিপ্লব-পূর্ব ফরাসি সমাজব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেন।

রানি মেরি অ্যান্টয়নেটের নিজস্ব সহচরীসংখ্যা ছিল ৫০০। রাজা, রানি, রাজকুমার ও রাজকুমারীদের প্রমোদভ্রমণের জন্য রাজদরবারে প্রায় দুই হাজার ঘোড়া ও ২০০ অশ্বশকট সব সময়ের জন্য প্রস্তুত থাকত। এসব বিষয় ফরাসি জনগণের মধ্যে দারুণ ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল। এতে রাজতন্ত্রের মর্যাদা ও ভাবমূর্তি একেবারেই বিনষ্ট হয়ে যায়। অবস্থা এমন হয়েছিল যে ৫ অক্টোবর প্যারিস থেকে মহিলাদের ভুখামিছিল বা হাঙ্গার মার্চ অব দ্য ওমেন ভার্সাই রাজপ্রাসাদের কাছে পৌঁছে রুটির দাম কমানোর দাবি জানায়। তখন রানি মেরি অ্যান্টয়নেট অবাক হয়ে মিছিলের দিকে তাকিয়ে জানতে চান, এরা কী চায়? তাঁর সহচরী উত্তর দেন, এরা রুটির দাম কমাতে বলছে, রুটি চায়। রানি অবাক হয়ে বললেন, রুটি কেন? এরা কেক খেতে পারে না! প্রকৃতপক্ষে রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে বিলাস ব্যসনে জীবনযাপন করে রানি অ্যান্টয়নেট নিজ দেশের সাধারণ মানুষের জীবন সম্পর্কে কিছুই জানতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে মন্টেস্কু বলেছেন, “বিক্ষোভ করা যেমন ন্যায্যত রানীর বিরুদ্ধে আবার রানীর প্রমোদ করারও পক্ষে আমি।”

কিন্তু ঠিক ভলতেয়ার, মন্টেস্কুর মতন এত উদার রেডিক্যাল না কবি আদোনিস। তার সাথে মিল রয়েছে বেন ওকরির। তারা স্বাধীনতা কারা হরণ কেন শোষকরা সে প্রশ্নও তুলেছেন। আদোনিসের জন্ম সিরিয়ায় ১৯৩০ সালে। জেল খেটেছেন। দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে প্রথমে লেবাননে পরে প্যারিসে বসবাস করছেন। তার সেরা কবিতার বইয়ের নাম ‘সংস অব মিহিয়ার অব দামাস্কাস’। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, “আগের আরব কবিরা ধর্মে আগ্রহী বা অনাগ্রহী যা-ই হয়ে হোন না কেন, ধর্মকে দেখেছেন খুবই ট্রিপিক্যালি। আরবের প্রখ্যাত কবি আবুল আলা ইমামি খুব সুন্দর করে বলেছিলেন, ‘মানুষ দুই রকমের। কারো ধর্ম আছে, যুক্তি নেই। কারো যুক্তি আছে, ধর্ম নেই।’ সংস অব মিহিয়ার-এ এই ধারণাটিকে আমি চূড়ান্তভাবে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছি। পরম বিচারে তো ধর্ম ব্যক্তির একান্ত উপাদান। সমাজকে গড়ে উঠতে হবে মূল্যবোধ, মানবাধিকার আর স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে। তাই সাহিত্য করার জন্য স্বাধীনতা জরুরি। ইসলামি সংস্কৃতির ভেতরে আমরা ইবনে রুশদের মতো ভাবুককে জন্ম দিয়েছি, পাশ্চাত্যের কাছেও যিনি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর চিন্তাধারা পড়ানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। ফলে ইউরোপে যে স্বাধীনতা আছে বলা হয় সেটি ‘খুবই স্থুল অর্থে দেখানো স্বাধীনতা’। আমাদের মতো দেশের কবিদের লড়তে হচ্ছে রক্ত ঝরিয়ে ঝরিয়ে। আমাদেরকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়তে হবে সব ধরনের ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের ওপর।”

আরো পড়ুন ➥ স্ট্রিট লিটারেচার

কিন্তু রাষ্ট্রেরও ধারণক্ষমতা রয়েছে তার চরিত্রানুযায়ী। লেখক তার দৃষ্টিকে কেবল সমকালেই সীমাবদ্ধ রাখেন না, সে যেমন অতীতকে অভিজ্ঞতা করে বর্তমানে দাঁড়িয়ে লেখে, লেখে বর্তমানের বিবর্তিত আগামীর রূপ, তখন তার বিষয়গুলোও রূপলাভে নতুন কাঠামো দাবি করে, তা পূরণে প্রয়োজন হয়ে পড়ে স্বাধীনতা, কিন্তু সমাজ-রাষ্ট্র তা দিতে অক্ষম। টলস্টয় তার ‘শিল্প কী’ বইয়ে শিল্পসাহিত্যকে গণমুখী করার কথা বলেছেন এবং সমাজচিত্রটি স্পষ্টতর করে সৃষ্টির পক্ষে থেকেছেন। সে কারণে স্বাধীনতা পেতে হলে মোহ ত্যাগ ও দলবাজি অবশ্যই পরিহার করতে বলেছেন।

শেকসপিয়র, গ্যাটে, সারভানতেস, বালজাক, পুশকিন এরকম আরো অনেকে যে সৃজনশীল কাজে সেরা হয়ে আছেন তা স্তুতির সাহিত্য বা শিল্পকর্মের জন্য নয়, তা ছিল সেসময়ের সামাজিক চাহিদাকে সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত করা, যেহেতু সমাজের বিবর্তনের রূপ বদল ঘটলেও বদল ঘটেনি সমাজ অস্তিত্বের মূল চেহারাটার। কিন্তু সৃজনসম্পৃক্তরা তার মৌলিক ধারাগুলো অনুধাবন না করে অস্থির প্রবণতাগুলোকে উপজীব্য করে সৃজনে সম্পৃক্ত রয়েছেন ফলে এক দিকে তাদের স্বাধীনতা যেমন তেমন কোনো দরকারি নয়, তেমনি তারা যে আবদ্ধতায় আছে তাও অনুধাবনে তারা সক্ষম নয়। অথচ একজন ভালো ঔপন্যাসিক যেমন সমাজচিত্র তৈরি করে নিখুঁতভাবে রাজনৈতিক চেহারাটার মুখোশ উন্মোচন করতে পারেন, তেমনি একজন রাজনীতিবিদও পারেন না। একজন সাহিত্যিক যেমন করে সমাজটা জানেন তেমন রাজনীতির কোনো ব্যক্তিও জানেন না। এই সত্য শিল্পী-সাহিত্যিকেরা উপলব্ধি করতে পারলে স্বাধীনতার প্রশ্নটি তার কাছেও পরিমাণগত ও গুণগতরূপে ধরা দেবে। তখন তিনি লিখবেন সেই বিষয়ের বাস্তবতা কিভাবে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে বা আবৃত রয়েছে নানা ষড়যন্ত্রকারী শক্তির কাছে এর বিরুদ্ধে। এ এক অন্যরকম লড়াই। একজন চে গুয়েভারা বিপ্লবী হয়ে ওঠেন পাবলো নেরুদাকে পড়েই। একজন চার্লি চ্যাপলিন কমিউনিস্ট হয়ে ওঠেন মহাত্মা কার্ল মার্কসের চিঠি পড়েই। নকশাল আন্দোলনই অমিয়ভুষন মজুমদারকে স্বাধীনতা প্রশ্নে এও ভাবতে শিখিয়েছে, প্রতিটি ইজমই কারাগার। যারা কোনো না কোনো ইজমে আস্থা রাখে তারা আসলে ওই কারাগারেই বাস করে।

শুরুর দিকে ‘হোয়ট ইজ ফ্রিডম’ দিয়ে শুরু হয়েছিল। তাই শেষটা করি এবছর সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী পিটার হান্ডেকে দিয়ে। তিনি বলেছেন, “মানুষ স্বাধীনতা চাইলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে পরাধীনই থাকতে পছন্দ করে। নাহলে বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ ইশ্বরের পরাধীনতা মেনে নিত না। আর ঈশ্বরকেও যারা অস্বীকার করে বিজ্ঞানবাদী হয়ে ওঠেন তারাও ‘বিজ্ঞান’কে ‘রিলিজিয়ন’ এই রূপ দেন। ফলে ‘ফ্রি উইল’ নেই। তাঁর ‘দ্য ফ্লাইট’ বইটি লেখার পর এ বিষয়ে গার্ডিয়ানকে সাক্ষাৎকারে এসব বিষয়ে বলেছিলেন। ফ্লাইট বইতে দেখা যায় অনিশ্চয়তার শিকার হওয়াই যেন মানুষের করুণ পরিণতি।

মানে জীবন ও জগতকে যদি কারাগার ভাবেন বা ভাবতে শেখেন তবেই আপনি সেই ফাঁদগুলো টপকে ধীরে ধীরে এগুতে থাকবেন ফানা হতে হতে নিঃসঙ্গ শেরপার মতো স্বাধীন সত্তার লড়াইয়ে। নাহলে? ঘুম আর স্বপ্ন। ঘুমের ভেতরই সব।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;