মিয়ানমার সীমান্তে সংঘর্ষ বন্ধ না হলে ব্যাহত হবে নিরাপত্তা-উন্নয়ন



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

২০২১ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বর্তমানে চরম সংকটময় সময় পার করছে। ২০২৩’র অক্টোবরের শেষভাগে জাতিগত সংখ্যালঘু তিনটি গোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) একত্রে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামে জোট গঠন করে জান্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত হামলা শুরু করে। এর পরপরই অক্টোবর মাস থেকে মিয়ানমার জুড়ে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সাথে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের তীব্রতা বেড়ে গেছে। বর্তমানে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ এক নতুন মাত্রা লাভ করেছে এবং সেনা-বিদ্রোহীদের সংঘর্ষে পিছু হঠতে শুরু করেছে জান্তা বাহিনী।

ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে তাদের এই অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ২৭ অক্টোবর চীনের সঙ্গে সীমান্তবর্তী শান রাজ্যে হামলা চালিয়ে কয়েকটি শহর ও শতাধিক সামরিক চৌকি দখল করে। ২৭ অক্টোবর চীন সীমান্তের কাছে উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের একটি অংশে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স যৌথ অভিযান চালিয়ে চীন-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্য নগরী হিসেবে পরিচিত চীন শওয়ে হাও শহর দখল করে নেয়। সেখানে কয়েকটি চীনা বাণিজ্যিক সংস্থার দফতরেও তারা হামলা চালায়। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স চীনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ বন্ধ করে দেয় এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ক্রসিং দখল করে।

২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর থেকে উত্তরাঞ্চলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সংঘর্ষের কারণে ৫০ হাজারেরও বেশি বেসামরিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মিয়ানমার-চীন সীমান্তের একটা বড় অংশ এখন বিদ্রোহীদের দখলে। মিয়ানমারে বিদ্রোহীরা শান প্রদেশে তাদের মূল ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। সেখানে তারা একের পর এক সামরিক ঘাঁটি দখল করছে। মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সেনাবাহিনী। বিমান হামলা চালিয়েও বিদ্রোহীদের অগ্রগতি ঠেকাতে পারছে না। চলমান সংঘর্ষে চীন সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মিয়ানমার-চীন সংযোগরক্ষাকারী সড়কও এখন বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। এমএনডিএএ অপারেশন ১০২৭ এর অংশ হিসেবে প্রথম ১৯ দিনে ১৪৪টি সরকারি ঘাঁটি দখল করে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স "অপারেশন ১০২৭" শুরু করার পর এপর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা নয়টি শহর হারিয়েছে। জান্তা উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের পাঁচটি শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।

বর্তমানে পশ্চিমের রাখাইন রাজ্য এবং চীন রাজ্যে নতুন করে আরো দুই জায়গায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সদস্য এএ রাখাইনের রাথেডাং এবং মিনবিয়ার মাঝামাঝি অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর কয়েকটি চৌকি দখল করে। এএ’র হামলায় জান্তা বাহিনী ও পুলিশ ৪০টি অবস্থান হারিয়েছে। নভেম্বরে ২০২২ থেকে চলমান অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে এএ রাখাইনের তিনটি জনপদের পাঁচটি স্থানে হামলা চালায়। বর্তমানে রাখাইনের রাজধানী সিটওয়েতে রাস্তায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। রাখাইনের রাথেডং, মংডু ও মিনবাইয়া শহরে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে এএ'র যোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়েছে। জান্তা সরকার ১৩ নভেম্বর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সিটওয়ে শহরে কারফিউ জারি করেছে। সেনাবাহিনী ও জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহীদের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষের পর জান্তা সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ও সামরিক বাহিনীর সংঘর্ষে দেশটির ভৌগোলিক অখণ্ডতা ঝুঁকিতে পড়েছে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন যে, বিদ্রোহ কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে মিয়ানমার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

ভারতের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের চীন রাজ্যে বিদ্রোহীরা দুটি সামরিক শিবিরে হামলা চালানোর পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ব্যাপক বিমান হামলা ও ভারী আর্টিলারি দিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়। এর ফলে সীমান্তবর্তী এলাকার পাঁচ হাজারের বেশি মিয়ানমারের নাগরিক নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য মিয়ানমার থেকে ভারতের মিজোরামে ঢুকে পড়ে। মিয়ানমারের পরিস্থিতি খারাপ হলে এই বিশাল সীমান্ত এলাকা অশান্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর মিয়ানমার থেকে প্রায় ৩২ হাজার মানুষ মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছে। অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও মিজোরামের সাথে মিয়ানমারের ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। ২০১৮ সালের মে মাসে, ভারত এবং মিয়ানমার সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘ফ্রি মুভমেন্ট’ চুক্তি অনুযায়ী, মিয়ানমার থেকে প্রায় বিনা বাধায় মিয়ানমারের নাগরিকেরা ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে ঢুকতে পারত। মণিপুরে গোষ্ঠী হিংসা ছড়িয়ে পড়ার পর ভারত এই ‘ফ্রি মুভমেন্ট’ চুক্তি স্থগিত রাখে। মিয়ানমার সামরিক সরকার বিদ্রোহীদের দমন করতে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত সীমান্তের কাছে বিদ্রোহীদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়। চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (সিএনএফ) ১২ নভেম্বর ফালাম টাউনশিপের ভারতীয় সীমান্ত শহর রেহ খাও দাহ শহরটি দখল করে। রেহ খাও দাহ উত্তর চিন রাজ্যে ভারতের প্রধান বাণিজ্য রুটে অবস্থিত। ভারতের একটি শরণার্থী শিবিরে মিয়ানমার থেকে আসা গোলার আঘাতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।

ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স থাই সীমান্তের পাশে পূর্ব কায়াহ রাজ্যের রাজধানীর কাছে সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করছে। ১৩ নভেম্বর, মন রাজ্যের কায়িকমায়াউ টাউনশিপে সংঘর্ষের পর ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স এখানকার পুলিশ স্টেশন ও সামরিক ফাঁড়ি দখল করে। সংঘর্ষস্থলের আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। ১২ নভেম্বর লাশিও জেলা জান্তা প্রশাসনের কার্যালয় কুনলং এর পতন ঘটে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স কর্তৃক দখল করা এই শহরটি ৭৫ বছর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ছিল। মিয়ানমার-চীন সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য নগরী মুসের কাছে নামখাম শহরটিও তাঁরা দখলে নিয়েছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স কিউগোক এবং উত্তর শান রাজ্যের কৌশলগত শহর সেনির প্রায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। মায়ানমার-চীনের দুটি প্রধান বাণিজ্য রুট - লাশিও-মিউজ এবং লাশিও-চিন শওয়ে হাউ - সেনিতে একত্রিত হয়েছে। ৩ নভেম্বর, পিডিএফ সহ একটি প্রতিরোধ জোট সাগাইং অঞ্চলের কাওলিন শহর দখল করে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের আক্রমণে ৭ নভেম্বর সাগাইংয়ের তামু জেলার কাম্পাটের পতন ঘটে। কায়াহ (কারেনি) রাজ্যে, কারেনি প্রতিরোধ বাহিনী লোইকাও নিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই করছে, যেখানে তারা জান্তার প্রায় নয়টি অবস্থান দখল করে।

মিয়ানমারের সামরিক শাসক সকল সরকারি কর্মী এবং সামরিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জরুরি পরিস্থিতিতে কাজ করার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছে এবং প্রয়োজনে এ ধরনের ইউনিটকে বাইরে গিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নিরাপত্তার জন্য কাজ করতে হতে পারে বলে নির্দেশ দিয়েছে। চলমান সেনা-বিদ্রোহী সংঘর্ষের জেরে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস 'মিয়ানমারে সংঘাতের বিস্তারে' গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।

মিয়ানমারের সংঘাতময় অঞ্চল আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ ও বাণিজ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এই সীমান্ত অঞ্চলে সমস্যা যত বাড়বে এই অঞ্চলের দেশগুলোর উন্নয়ন ততই ধীরগতিতে হবে। গ্লোবাল সাউথের অন্তর্গত দ্রুত উদিয়মান এই অঞ্চলের উন্নয়নে এ ধরনের সংঘাত নিরসন ও শান্তিপ্রতিষ্ঠা জরুরী। এর ফলে প্রতিটি দেশের নিজস্ব উন্নয়নের পাশাপাশি আঞ্চলিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং সার্বিক ভাবে বিশ্বপরিমণ্ডলে নতুন আঙ্গিকে এই অঞ্চল নিজেকে উপস্থাপনে সক্ষম হবে। মিয়ানমার, দুটি আঞ্চলিক শক্তি চীন ও ভারতের সাথে যোগাযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি, পুরো দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে নিবিড় সংযোগ ও উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। এই অঞ্চল ঐক্যবদ্ধ ভাবে যে কোন সমস্যা মোকাবেলা করে উন্নয়ন ও সফলতা অর্জনে সক্ষম হবে। ক্ষুদ্র স্বার্থ গুলো দূরে রেখে বৃহত্তর ঐক্য ও উৎকর্ষ অর্জনে এটা অপরিহার্য।

চলমান এই সংঘর্ষের মধ্যেও চীনের মধ্যস্থতায় পাইলট প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। এর ধারাবাহিকতায় ৩১ অক্টোবর, ৩২ সদস্যের মিয়ানমার প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গাদের সাথে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মতবিনিময় করতে টেকনাফে আসে। প্রতিনিধি দলটি ১৮০ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে আলোচনা করে। রোহিঙ্গা নেতারা জানায় যে, রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনভাবে বসবাসের নিরাপত্তা ও সুযোগ দেওয়া হলে তাঁরা ফিরে যেতে রাজি তবে রাখাইন রাজ্যের আশ্রয়শিবিরে থাকতে হলে তাঁরা ফিরবে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে চীনের রাষ্ট্রদূত জানায় যে, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে কিছু রোহিঙ্গাকে পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে মিয়ানমারের রাখাইনে পাঠানোর মধ্য দিয়ে প্রত্যাবাসন শুরু করা হবে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া তবে কাজে অনেক অগ্রগতি হয়েছে বলে চীন মনে করে ও তাঁরা এর সফলতার বিষয়ে আশাবাদী। চীনের উদ্দেশ্য হলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। ১৫ নভেম্বর, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার নিয়ে ওআইসি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) উত্থাপিত প্রস্তাবটি জাতিসংঘে গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে ১১৪টি দেশ সমর্থন দিয়েছে। প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারের উদারতা ও মানবিক সহায়তার ভূয়সী প্রশংসা করা হয়।

বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে আসিয়ানের পাঁচ দফা ঐক্যমতের দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়, সব সদস্য দেশকে বাংলাদেশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে এবং বাংলাদেশের ওপর আসা চাপকে ভাগ করে নিতে হবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে থেকে পর্যাপ্ত অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ এবং আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানানো হয়।

যতদিন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকটের পূর্ণাঙ্গ সমাধান না হবে ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের ও আন্তর্জাতিক সব মাধ্যমে এই সমস্যার অগ্রগতি ও উদ্যোগগুলো তুলে ধরে সমাধানের প্রচেষ্টা চালু রাখতে হবে। এশিয়ার দেশগুলোর সামগ্রিক উন্নয়নে এই অঞ্চলের জনগণকেই ভুমিকা রাখতে হবে, বাইরের কেউ এসে এখানকার উন্নয়ন নিশ্চিত করবে না। ইউরোপীয় দেশগুলোর উন্নয়নে এই বোধ প্রাধান্য পাওয়াতে তাঁরা নিজেদের মধ্যকার যুগযুগ ধরে চলার বিভেদ ও সংঘাত থামিয়ে উন্নত হয়েছে এবং বিশ্বে তাদের জোরালো ভুমিকা রাখছে। এই অঞ্চলের নেতৃত্বও একত্রে এ ধরনের চিন্তা চেতনার বাস্তবায়ন করলে উন্নয়ন অধরা থাকবে না।

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

   

কিসিঞ্জার পাঠ ও মূল্যায়ন যথার্থ হচ্ছে কি?



কাজল রশীদ শাহীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

 

হেনরি কিসিঞ্জার, শতায়ু পেরিয়ে ইহলোককে বিদায় জানিয়ে পাড়ি জমালেন অনন্তলোকে। একশ বছরের পার্থিব জীবনের পঞ্চাশ বছরই তিনি আলোচিত-সমালোচিত ও বিতর্কিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও জেরাল্ড ফোর্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কাজ করার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী তিনি। অধ্যাপক, গবেষকের অভিজ্ঞতা থাকলেও একজন কূটনীতিক হিসেবে তিনি কেবল মার্কিন মূলুকে নয়, বিশ্বব্যাপী রেখেছেন নানামুখী অবদান। যা ক্ষেত্রবিশেষে ভয়ংকর রকমের প্রাণহানি, ক্ষয়ক্ষতি ও সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়য়েছে।

বাংলাদেশের মানুষেরা এই ব্যক্তিটিকে অন্যরকমভাবে চেনেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উনার ভূমিকার প্রশ্নে এবং ‘বটমলেস বাস্কেট’ উক্তির কারণে। সেই থেকে মৃত্যুাবধি-এমনকি মৃ্ত্যুর পরও উনার প্রতি প্রচ্ছন্ন নয় প্রকাশ্য বিরাগও প্রদর্শিত করেন বহু মানুষ। ব্যাপারটা দুই-দশজনের মধ্যে কিংবা বিশেষ কোন বর্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে-ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের ব্যতিক্রম বাদে সকলেই বিষয়টা সম্পর্কে অবগত।  কারণ সেটা মিথ, কিংবদন্তি বা বাগধারার পর্যায়ে পৌঁছেছে। এখানে কেউ যদি বেশি চালাকি করে। বুদ্ধি খাটিয়ে কাউকে ধোঁকা দেয়। কৌশলে কোন মুস্কিলের আসান করে তাহলে এদেরকে একবাক্যে ‘কিসিঞ্জার’ বলে। এই এই ধরনের বুদ্ধিকে, ‘কিসিঞ্জারি বুদ্ধি’ বা ‘কিসিঞ্জারি প্যাঁচ’ জ্ঞান করা হয়। ব্যাপারটার মধ্যে ঠাট্টা, বিদ্রুপ বা রসিকতা হয়তো রয়েছে। কিন্তু বিষয়টাকে হালকাভাবে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। নেয়াটা যৌক্তিকও নয়।

এদেশের মানুষেরা কিসিঞ্জারি বুদ্ধিকে দু’রকমভাবে দেখে- এক. বুদ্ধি খাটিয়েও সফল না হওয়া বা, বেশি চালাকি করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়া। দুই. অনেক চেষ্টা তদবির করে সফল না হওয়ায় হেয় করা বা বাজে ও অযৌক্তিক মন্তব্য করা। এখন আসা যাক, প্রথম প্রসঙ্গ। কেনো কিসিঞ্জারি বুদ্ধিকে এভাবে দেখা হয়। এর কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কিসিঞ্জারের হিংসাত্মক মনোভাব ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে যেন জয়ী হতে না পারে তার জন্য কিসিঞ্জার এমন কোন চেষ্টা বা পদক্ষেপ নেই তিনি করেননি।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। এই সহযোগিতায় ভারতকে বিরত রাখতে কিসিঞ্জার আগ্রাসী কূটনীতির আশ্রয় নেয়। উনার কারণেই মার্কিন জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকলেও ক্ষমতাসীন প্রশাসন বিপরীত মেরুতে অবস্থান নেয় এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বকেও তাদের পক্ষে নেয়ার কূটনীতি শুরু করে। এই কূটনীতির স্রষ্টা হল হেনরি কিসিঞ্জার। যার অংশ হিসেবে তিনি চীনকেও তাদের পক্ষে নেয়। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ককে আর বেশি গাঢ় করে তোলেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে নানাভাবে নিজেদের মতে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনভাবেই যখন উনাকে পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব না হওয়ায় কিসিঞ্জার অভ্যাসবশত ইন্দিরাকে নিয়ে বাজে মন্তব্যও করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন যে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল, যা বঙ্গোপসাগর অবধি এসেও ছিল। কিসিঞ্জারের কূটনীতির কারণেই এসব হয়েছিল।

যতভাবে ও যতপ্রকারে সম্ভব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের দাবিকে পরাভূত ও পরাজিত করতে যা যা করণীয়, তার সবটাই করেছিল মার্কিন প্রশাসন-যার কূটনৈতিক মন্ত্রদাতা ছিলেন কিসিঞ্জার। কিন্তু কোন চেষ্টায় সফল হয় বাঙালির লড়াকু মনোভাব ও ভারত-রাশিয়ার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো আমাদের পাশে থাকার জন্য। এতে এটাও প্রমাণিত হয়েছিল যে, যতই ষড়যন্ত্র করা হোক না কেন এবং ষড়যন্ত্রকারী যতই শক্তিধর হোক না কেন, ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায্যতাভিত্তিক কোন দাবিকেই ‘দাবায়ে’ রাখা যায় না। এ কারণেই বাংলাদেশের মানুষ আজও কেউ যখন অন্যায়ভাবে কিছু করে, তাকে কিসিঞ্জার বলে এবং এধরণের বুদ্ধিধরদের কিসিঞ্জারি বুদ্ধি বলে চিহ্নিত করে।

কিসিঞ্জারের মৃত্যুর পর যত লেখা প্রকাশিত হয়েছে দেশে এবং বিদেশে। তার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পড়ার সুযোগ হয়েছে। এর মধ্যে আমাদের দেশের গুণীজনরা যেমন রয়েছেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্নরাও উপস্থিত আছেন। গার্ডিয়ান, ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের মতো আন্তর্জাতিক প্রভাবশারী দৈনিকের লেখাও এই বিবেচনার মধ্যে পড়ে। সবগুলো লেখারই মৌল স্বর এক ও অভিন্ন। প্রশ্ন হল, কিসিঞ্জারের সমালোচনা করতে গিয়ে আমরা কি উনার বুদ্ধিমত্তা ও কূটনীতিক ক্ষমতার কথা ভুলে গেছি? কূটনীতি দিয়ে তিনি ক্ষেত্র বিশেষে কিছু জায়গায় কিংবা বেশীরভাগ জায়গায় শঠতার পরিচিয় দিয়েছেন । যা অনেক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে দেশে বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে উনার বিচারের দাবি উঠেছে। কিন্তু কিসিঞ্জারের কুটনীতির পাল্টা পাঠ মেলেনি। কূটনৈতিক কিসিঞ্জারকে কূটনীতি দিয়ে মোকাবেলা করার চেষ্টা দেখা যায়নি।

এ লেখায় আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কিসিঞ্জার নামটা শুনলেই বা উচ্চারিত হওয়া মাত্র বহুল উচ্চারিত সেই বাক্যটাই সামনেই আসে, ‘বটমলেস বাস্কেট’। কোন প্রেক্ষাপটে কী বিবেচনায় তিনি এ কথা বলেছিলেন তা নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেলের বাস্তবতাকে ঘিরে তিনি ওকথা বলেছিলেন। হ্যাঁ, ওই কথার মধ্যে-বিদ্রুপ, শ্লেষ, অবমাননা সবই ছিল। যা মেনে নেয়া বা সহ্য করা কোন দেশপ্রেমিকের পক্ষেই সম্ভব নয়।

কিসিঞ্জার যা সেদিন বলেছিল, আজ তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রমাণ করে দেখিয়েছে সে বটমলেস বাস্কেট নয়। এখন এই প্রসঙ্গ আমরা যদি একটু উদারভাবে দেখার চেষ্টা করি, তাহলে কোন্ সত্যে আমরা হাজির হব। সত্যিই কি সেদিনের বাংলাদেশ বটমলেস বাস্কেট ছিল না? যদি তাই-ই না হবে তাহলে আজকের অবস্থানে আসতে আমাদের এত সময় কেন লাগলো? আবার এই প্রশ্ন ওঠা কি সঙ্গত নয়, পঞ্চাশ বছরে একটা স্বাধীন দেশের যে অবস্থায় যাওয়ার কথা ছিল সেখানে কি পৌঁছানো সম্ভব হল? গণতান্ত্রিক পরিবেশের নিশ্চয়তায়, বাক্ স্বাধীনতার চর্চায়, সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণের প্রশ্নে, নীতি ও ন্যায্যতাসম্পন্ন রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকারে আমরা কি আদৌ কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতে পারলাম?

আমরা সকলেই জানি, আমেরিকা-চীনের সম্পর্ক মোটেই বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, বৈরিতায় ভরা। তারপরও কিসিঞ্জার নিজস্ব কূটনীতি দিয়ে সেই সম্পর্ক এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছেন যা, দুইদেশের কাছে প্রশংসনীয়। চীনের কাছে সবচেয়ে প্রিয় যে আমেরিকান তিনি হলেন কিসিঞ্জার। উনার শতবর্ষের জয়ন্তী যখন আমেরিকায় উদযাপিত হয়, তখন চীনেও তার ছোঁয়া লাগে। চীনারাও নিজেদের মধ্যে আয়োজন করেন একজন আমেরিকানের জন্মদিন। যখন ‍দুটো দেশ একে অপরের প্রতি উষ্মা প্রকাশে সিদ্ধ ও রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তখন এ ধরনের আয়োজন বিস্ময়ের শুধু নয়, একজন কূটনীতিকের সুদূরপ্রসারী সাফল্যেরও অংশ।

নোবেল কমিটি কিসিঞ্জারকে শান্তিতে নোবেল দিয়েছেন। বলা হয়, নোবেলের ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত পুরস্কার ছিল এটি। কমিটির দু’জন সদস্য প্রতিবাদে পদত্যাগও করেন। ভিয়েতনাম-মার্কিন যুদ্ধ অবসানে পদক্ষেপ নেয়ায় তিনি নোবেল পান ১৯৭৩ সালে। এরপর আরও দু’বছর লেগে যায় যুদ্ধ নিরসনে। প্রশ্ন হল, কিসিঞ্জারের ওই উদ্যোগ কি ভুল ছিল। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ের কোন মার্কিন রাষ্টপতিকে নোবেল না দিয়ে কেন উনাকে দেয়া হল? উনি কি সত্যিই কোন পদক্ষেপ রাখেননি যুদ্ধ বন্ধে? এসব পশ্নের যৌক্তিক উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।

বলা হয়, কিসিঞ্জারের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে যুদ্ধ বেধেছে। আবার একথাও সত্য যে, তিনি কোনো কোনো যুদ্ধ বন্ধেও সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কিসিঞ্জারের যত দোষ-ত্রুটি ধরা হয়, একজন আমেরিকানের কাছে কিন্তু তিনি এসবের ঊর্ধ্বে। সকল মার্কিনীদের কাছে তিনি বন্দিত। উনার কূটনীতির তারিফ করেন সবাই, তা তিনি ডেমোক্রেট হোক অথব রিপাবলিক। এখানেই কিসিঞ্জারকে বিবেচনায় নিয়ে সমালোচনা করা উচিৎ। তিনি হয়তো আন্তর্জাতিকতাবাদী হয়ে উঠতে পারেননি, কিন্তু দেশপ্রেমিক হিসেবে, একজন আমেরিকান হিসেবে কি অনন্য নন?

কিসিঞ্জারের সমালোচনা যতটা করা হয়, বিদ্রুপবাণে বিদ্ধ করা হয়, সেভাবে উনার কূটনীতির প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বি কিন্তু সেভাবে দেখা যায় না, নেই বললেই চলে। সমালোচনা করা সহজ। প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বি হওয়া কঠিন। কিসিঞ্জার প্রশ্নে আমরা কি সহজ পথটাই বেছে নেয়নি? আমেরিকার মোকাবেলা যেমন আমেরিকার মতো হয়েই করতে হবে, তার জন্য নিরন্তর চেষ্টা জারি রাখতে হবে। তেমনি কিসিঞ্জারের যা কিছু অপছন্দ, যা কিছু ঘৃণা ও বিবমিষার তার মোকাবেলা করতে হবে প্রতিযোগী বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিয়ে-তাকে ছাড়িয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে। কেবল বিদ্রুপ, সমালোচনা আর কটুকথা দিয়ে কোন অর্জন হয় না, বরং আরও শক্তিধর করে তোলা হয়। কিসিঞ্জারের মূল্যায়নে-কিসিঞ্জারে পাঠে আমরা কোনটা করছি, সেটা কি একবার ভেবে দেখছি?

লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক

[email protected]

;

ওই জিনিসটাই নেই- সেটা নৈতিক মূল্যবাধ!



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সেদিন একটি বিতর্ক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। পক্ষে-বিপক্ষে বক্তাদের বিতর্ক শুনে সবাই অনেকটা বিমোহিত। আমিও কিছুটা অবাক হয়েছি উভয় দলের তার্কিকদের ভাষা ও বচনভঙ্গি শুনে। বিতর্ক শেষে নির্বাচিত আলোচকবৃন্দ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির উপর বক্তব্য দিলেন। দশ-বারটি সুপারিশ উঠে এলো। কিন্তু একজন ক্ষুদে বক্তা কিছু সময়য়ের জন্য তাকে বিতর্কের বাইরে আরো কিছু বলার সুযোগ দিতে অনুরোধ করলো। সেটা শুনে উপস্থিত সবার চোখেমুখে ভিন্নকিছুর আভাস ফুটে উঠলো।

তার্কিক বললো, সবার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু সবারটা মানতে চেয়েও পারছি না। কারণ, সবাই একটি কথা বলতে গিয়েও অস্পষ্টভাবে বলছেন কেন তা বোধগম্য নয়। এই অস্পষ্টতার আড়ালে যেটা চাপা পড়ে যাচ্ছে তা হলোওই জিনিসটা। আর ওই জিনিসটার বড় আকাল লেগেছে। শুনতে চান আপনারা- ওই জিনিসটা কি? আমাদের মধ্যে ওই জিনিসটাই নেই- সেটা ওপেন সিক্রেট, সবার জানা গোপন কথা। তা হলো সততা-নৈতিকতা! ওর সুস্পষ্ট কথায় বলিষ্ঠ সুর শুনে সবাই ভিমড়ি খাবার যোগাড়।

এবার তার বক্তব্য আরো বেগবান হলে সে গড় গড় করে বলতে লাগলো- আমরা ছোট মানুষ। আমাদেরকে গণমাধ্যমে কেন বিতর্কের নামে বড়দের ঝগড়া, খারাপ কথা শুনতে হয়? বর্তমানে দেশে আগামী নির্বাচন নিয়ে যে বাকযুদ্ধ ও শক্তিপ্রয়োগের মহড়া শুরু হয়েছে তার মূল কারণ হলো- ‘নিশীথের ভোট’যেটা বহুবার বহু জায়গায় বলা হয়েছে, লেখা হয়েছে, ছাপা হয়েছে। এমনকি এজন্য দেশ ছাপিয়ে বিদেশের মাটিতেও তোলপাড় হয়েছে। মামলা-হামলা হয়েছে, কারাবরণ হয়েছে এবং সেগুলো চলছে। কিন্তু সেই কারণগুলোর তদন্ত হয়নি, নিষ্পত্তি হয়নি। এখন ভাবনা হচ্ছে, ‘আমি আছি থাকবো, যেভাবেই হোক নির্বাচন হবে।’এজন্য ‘নিজের পরীক্ষায় নিজে নিয়ন্ত্রক হবার অপবাদ ও  গ্লানিটুকুও কাউকে স্পর্শ করে না। ফলত: সেগুলোর পৌণ:পুনিক আশঙ্কা থেকেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে আয়োজনের সুষ্ঠুতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা জটিলতা তৈরী হয়েছে।’

সেদিন একটি বৃহৎ মহাসমাবেশ ভন্ডুল করার উদাহরণ দিয়ে সে বলতে চেষ্টা করলো- ‘এতবড় জনসমাবেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে আয়োজনের ঘাটতি ছিল না। মহাসমাবেশ শেষ না হতে মাঝপথে হঠাৎ বিকট সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ এবং টিয়ার গ্যাসের শেল ছুঁড়ে কেন আতঙ্ক তৈরী করা হয়েছিল? সমস্যা সেখান থেকেই নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছে বলে মনে হয়। সেই শব্দ ও গ্যাস ছোঁড়া না হয়ে জনসভাটি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হবার সুযোগ পেত এবং সেখানে কোনরুপ গোলযোগ হতো না। একজন নিরীহ পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। হাজারো গ্রেনেড, গুলি, গ্যাস শেল ছুঁড়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার কি দরকার ছিল?’

‘সেদিন নিযুক্ত হাজার হাজার নিরাপত্তাকর্মীর মধ্যে রহস্যজনকভাবে একজন সদস্যকে রেখে অন্য নিরাপত্তা সদস্যরা সবাই কেন দৌড়ে পালিয়ে গেলেন তাও বোধগম্য নয়। টিভিতে দেখা গেছে মোটামুটি ফাঁকা রাস্তার ফুটপাতে কতিপয় উচ্ছৃংখল জনতা তাকে পেটাচ্ছিল। নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র থাকা সত্বেও কেন তারা মাত্র একজন সহকর্মীকে ফেলে রেখে সবাই উধাও হয়ে গেলেন- সেসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? এমনকি সেই সদস্যের আহত হয়ে দীর্ঘক্ষণ রাজপথে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। তড়িৎ কোন এম্বুলেন্সও আসেনি তাঁকে উদ্ধার করতে। এরপরের ঘটনা তো আপনারা সবাই বেশ কদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করেই যাচ্ছেন। সেগুলো নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।’

তার দলের আরেক সদস্য তাকে সাপ্লিমেন্ট করার সুযোগ চেয়ে বলতে লাগলো- তবে এসব দেখে মনে হয় দেশের অর্থনীতির বড় ধরণের ক্ষতি করার জন্য এই হীন পরিকল্পনা অত্যন্ত সুকৌশলে সাজানো হয়েছে। যার প্রতিক্রিয়ায় সেদিনের ঘটনার ১২ দিন পর জানানো হচ্ছে- প্রতিদিন অবরোধে দেশের ৬.২ বিলিয়ন ডলার পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এর মূল কারণ রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে একটি মহাসমাবেশে আতঙ্ক তৈরী করে ‘মব’বা উচ্ছৃংখলতা সৃষ্টি করা। দেশে একটি ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট চলছে। রাজনৈতিক সমস্যার পুলিশি সমাধান কখনই শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।’

গেল অক্টোবরে ঢাকার কাওলায় এবং ১১ নভেম্বর ২০২৩ মাতারবাড়ির জনসভায় শোনা গেছে- ‘যেভাবেই হোক নির্বাচন এদেশে হবে।’গণমাধ্যমের কল্যাণে ‘যেভাবেই হোক নির্বাচন’নিয়ে উৎসাহ বেড়েছে। দ্য গার্ডিয়ান (১০.১১.২০২৩) এটাকে ‘প্রি ইলেকশান ব্রুটাল রিপ্রেশন... দেয়ার আর নো মোর রুম লেফ্ট ইন দা প্রিজনস’বলেছে। দেশ-বিদেশ ভেদে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সবার চাওয়া। মূল কথা হলো- জনগণ নির্বাচন চায়, কিন্তু যেনতেন নির্বাচন চায় না।’

‘এই অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে জনাতঙ্ক ও ভয়ংকর ভীতি সৃষ্টির দায়টা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে। এর সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ীদেরকে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কিন্তু এ ধরণের জনভোগান্তিমূলক অন্যায় কাজের জন্য রাষ্ট্র সবসময় তাদেরকে পুরস্কৃত করে থাকে।

অপরদিকে আগামী নির্বাচনের এখনও তপসিল ঘোষিত হয়নি অথচ রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য আয়োজিত নানা জনসভায় ক্ষমতাসীন দল একাই সাড়ম্বরে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় যানবাহন ব্যবহার করে অফিসিয়াল কাজের জন্য নির্মিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে তপসিল ঘোষণার আগে নির্বাচনের জন্য নিজের মার্কায় জোরগলায় ভোট চাওয়া নিশ্চয়ই ক্ষমতার অপব্যবহার ও নির্বাচনী আইনের লঙ্ঘন। নতজানু পরাধীন নির্বাচন কমিশন এখানে কিছুই বলার ক্ষমতা রাখেন না। এখানে কারুরই ওই জিনিসটা নেই। তাহলো- নৈতিকতা।’এথেকে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যা বুঝি তা স্বাথর্পরতা শেখাচ্ছে।

এভাবে দ্বিতীয় তার্কিকের বক্তব্য শুনতে শুনতে উপস্থিত সবাই খানিকটা চুপ হয়ে গেল। সেদিন কেউ তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো না।

বিষয়টা হলো একটি সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চ্চার পথে যেসব কন্টক ওঁৎপেতে থেকে জনগণের কন্ঠকে রোধ করতে সহায়তা করছে তার মধ্যে আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল বিভিন্ন শাখা বহুলাংশে দায়ী। সেসব দায়িত্বশীল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের হীন ভূমিকা আজকাল বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। তারা নিজস্ব পেশাদারিত্বের বাইরে গিয়ে দলীয় রাজনীতির তল্পিবাহক হয়ে নিজেদের লাভের অঙ্ক বাড়াতে গিয়ে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি শুরু করে দিয়েছে। এদের অনেকের মধ্যে দেশপ্রেমের ছিঁটেফোটাও নেই। এদের অনেকের ছাত্রজীবনের ইতিহাস থেকে জানা যায়- তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে হীন ছাত্ররাজনীতি করতো এবং হলের ডাইনিংরুমে ‘ফাও’খাওয়া দলের সদস্য ছিল। অনেকে ‘কালো বিড়াল’পদ্ধতিতে চাকুরী জুটিয়ে নেবার পর দুর্নীতির মামলা মাথায় নিয়ে দেশে-বিদেশে পালিয়ে বেড়াতো। এসব ‘বানরের গলে মুকুতার হার’জোটায় তারা দেশের কল্যাণের কথা মোটেও চিন্তা করে না। তারা অনেকই পরিবার দেশের বাইরে রাখা দ্বৈত নাগরিক। অথবা দেশের আপামর মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করার অর্ন্তর্নিহিত শক্তি তাদের মধ্যে নেই।

তাইতো আমাদের দেশের অদূরদর্শী, ব্যবসায়ী, লোভী রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের ফাঁদে জড়িয়ে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগকে আরো দীর্ঘায়িত করে তুলেছে। এউ উভয়বিধ শক্তি একসংগে মিলিত হয়ে দেশের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেবার নীলনক্সা তৈরী করেছে। এই নীলনক্সার ফাঁদে এখন বাংলাদেশের অসম উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোও চরমভাবে বাঁধাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। যার ফলশ্রুতিতে সাধারণ শ্রমিকদের কর্মহীনতা ও কর্মঅসন্তোয় শুরু হয়েছে। কারণ, শুধু কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে গাড়ি কিনলেই উন্নতি হয় না। সেই গাড়িতে চড়ার মতো ও গাড়ি মেইনটেইন করার মতো ও উপযুক্ত মানুষ তৈরী করতে হয়। যার ইতিবাচক প্রচেষ্টা নেই আমাদের দেশে। অগণতান্ত্রিক কূটকৌশলে দেশের ৭৫-৮০ ভাগ মানুষকে সেই সুবিধার বাইরে রেখে চলার চেষ্টার ফলে যে সামাজিক ভাঙ্গন শুরু হয়েছে তা রুখে দেবার মত সামাজিক শক্তি রাষ্ট্রের হাতে কোন দেশে কস্মিন কালেও ছিল না। বরং ইতিহাসে সেসব দেশে গণবিপ্লব ত্বরান্বিত হয়ে ভয়ংকর নাজুক পরিস্থিতিতে গণেশ উল্টে যেতে দেখা গেছে।

তাদের হীন পরিকল্পনার জন্য জনগণ শুধু বিব্রতই নয়- বড় নাজেহাল হয়ে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। এসব হীনতা, দীনতা, নিচতা শুধু বইয়ের কথা নয়। এগুলোর সংগে চরম বাস্তবতা জড়িত। এই বাস্তবতাকে যারা দু’একবার অস্বীকার করে এবং সঠিক পথে ফিরে আসে তারা রক্ষা পায়। আর যারা ক্রমাগত এসব বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে আরো এগিয়ে বেপরোয়া গতিতে চলতে চায় তারা চরমভাবে হোঁচট খায় ও ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। যুগে যুগে এটাই সঠিক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।

আলোচ্য বিতর্ক অনুষ্ঠানের কিশোর তার্কিকদের মুখ থেকে উচ্চারিত বক্তব্য সেদিন উপস্থিত সদস্যরা এবং গণমাধ্যমের কল্যাণে যারা পরবর্তীতেও শুনেছেন তাদের কপালের মধ্যে নিশ্চয়ই একটা চিন্তার বলিরেখা ভেসে উঠেছে। আমাদের দেশে চারদিকে অনৈতকতার চর্চ্চা এবং এর প্রভাবে যেসব অনাচার, দুর্নীতি, অসততা ও জনভোগান্তির ক্ষেত্র তৈরী হয়েছে তা থেকে মুক্তি পাওয়া অতি সহজ ব্যাপার নয়।

তাই সেই কিশোর তার্কিকদের মতো মনে রাখতে হবে, আপনি যাই বলুন না কেন- যাই করুন না কেন সেখানে সবার আগে অপরের অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে কি-না সবাইকে সেটি মনে রাখা। কারণ, আমরা এমন একটি সমাজের মধ্যে বাস করছি সেখানে মুখের কথায় সবার সবকিছু আছে বলে ফুলঝুরি তোলা হলেও অনেক দায়িত্বশীল মহারথীদেরও শুধু ‘ওই জিনিসটাই থাকে না, তা হলো-  নৈতিক মূল্যবোধ।’

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।

E-mail: [email protected]

;

ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো সতর্কবার্তা



শরিফুল হাসান সুমন
ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো সতর্কবার্তা

ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো সতর্কবার্তা

  • Font increase
  • Font Decrease

গত ২০ নভেম্বর ওয়াশিংটনের বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠির বিষয় ছিল—‘বিশ্বব্যাপী কর্মী, ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং উচ্চ শ্রমের মান উন্নয়নে রাষ্ট্রপতির স্মারকলিপি’ বিষয়ে সংকলিত প্রতিবেদন। যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রতিবেদন যদিও সারাবিশ্বের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য, তারপরেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ এই স্মারকলিপির লক্ষ্য হতে পারে। বাংলাদেশের শ্রম ইস্যু (গার্মেন্টস কর্মীর মৃত্যু) উল্লেখ করেছেন সেক্রেটারি অব স্টেটস উনার স্মারকলিপি প্রকাশ অনুষ্ঠানের বক্তব্যে। এই নীতি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র শ্রম ইস্যুতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজস্ব কূটনীতিক বা মিশন প্রধানেরা যে কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে উৎসাহিত করবে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে ব্যক্তি, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের উপর এই নীতি আরোপ হতে পারে, যেখানে শ্রমিকদের অধিকার হরণ হচ্ছে।

এই নীতির অনেক রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা আছে যা বিপদ সংকেত এর কারণ হতে পারে। এই নীতির পেছনের কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক অভিলাষ, এবং যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে এটার ব্যবহার করতে পারে। এই নীতি বাংলাদেশের জন্য একটা সতর্কবার্তা যে যুক্তরাষ্ট্র শ্রম অধিকার ইস্যুতে কী কী করতে পারে। এই নীতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এবং এটি অবশ্যই বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের বিবেচনায় রাখা উচিত।

এই ছিল ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে প্রেরিত চিঠির সারসংক্ষেপ। গত ১৬ নভেম্বর সান ফ্রান্সিসকোতে এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশনের (এপিইসি) একটি আয়োজনে ওই স্মারকের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন। শ্রম অধিকার হরণ করে এমন কার্যক্রমের জন্য বিশ্বব্যাপী নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ঘোষিত শ্রমনীতির প্রেক্ষিতে প্রতিটা দেশের রাষ্ট্রদূতই সম্ভবত নিজ নিজ দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এমন সতর্কবার্তা পাঠিয়ে থাকে।

কী ছিল মার্কিন প্রশাসনের ঘোষিত শ্রমনীতিতে?
১. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শ্রম অধিকারের প্রতি সম্মান রক্ষা ও প্রচারের জন্য আমরা সারা বিশ্বে সরকার, শ্রমিক, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি খাতকে যুক্ত করব। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের সমস্ত রাষ্ট্রদূত, সমস্ত লোক যারা বিশ্বজুড়ে আমাদের দূতাবাস চালাচ্ছেন, শ্রমিকদের সঙ্গে, ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে জড়িত থাকবেন যাতে তাদের কণ্ঠস্বর আমরা যা কিছু করি তাতে প্রতিফলিত হয়।

২. যারা হুমকি দেয়, যারা ভয় দেখায়, যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রম অধিকার রক্ষাকারী, শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে—নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্য জরিমানা, ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো জিনিস ব্যবহার করে, আমাদের এখতিয়ারের সবকিছু প্রয়োগ করে আমরা জবাবদিহি করতে বাধ্য করব।

৩. আমরা শ্রম দক্ষতা সম্পন্ন কর্মচারীদের জন্য বৃহত্তর কাজের সুযোগকে অগ্রাধিকার দিয়ে, শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কে জানার জন্য, অপব্যবহার খোঁজা এবং প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে কর্মীদের অধিকারকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ফেডারেল সরকারের ক্ষমতাকে শক্তিশালী করব।

৪. আমরা শ্রম অধিকার এবং মান উন্নীত করার জন্য সরকার এবং জাতিসংঘের মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান, জি-২০ এর সাথে কাজ করব। এটি সেই কাজের অংশ হবে যা আমরা এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে করি, যেখানে অনেকগুলো নিয়ম সেট করা আছে।

৫. আমাদের নিজস্ব বাণিজ্য চুক্তি, সরবরাহ চেইন, শ্রমিকদের সুরক্ষা এবং আমরা জোরপূর্বক শ্রম দিয়ে তৈরি পণ্য আমদানি করছি না—তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা আমাদের যথাযথ পরিশ্রম এবং প্রয়োগের ব্যবস্থা করব।

সংবাদপত্রের বিভ্রান্তিমূলক ব্যাখ্যা

১৬ নভেম্বর এই শ্রমনীতি ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই প্রায় প্রতি সংবাদপত্র একের পর এক স্যাংশনের ভয় দেখিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে। তারা এমনভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দিছে যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক শিল্পের উপর যেন বিশাল কোন দুর্যোগ নেমে আসতে যাচ্ছে, যা সর্বৈব মিথ্যা ও মানুষকে বিভ্রান্ত করার একটা ষড়যন্ত্র বা অল্প জানার কুফল।

ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের দূতাবাস কর্তৃক প্রেরিত রাষ্ট্রীয় গোপনীয় নথি প্রকাশ করে সেটার ভুল ব্যাখ্যা করেও মানুষকে বিভ্রান্ত করে চলছে শিক্ষিত ও স্মার্ট সাংবাদিকরা। ভিসা স্যাংশনের পর যে শুরু হয়েছে আমেরিকার স্যাংসনের জুজু, সেই জুজু দেখিয়ে বর্তমান সরকারের উপর অনাস্থা সৃষ্টি করতে এই প্রতিবেদনগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে টুইস্ট করে প্রচারিত হচ্ছে। নির্বাচন পূর্ব সংবাদমাধ্যমের রাজনীতির এই খেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ, আর ভয়ার্ত অবস্থা বিরাজ করছে তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের মধ্যে।

তৈরি পোশাকশিল্প কি পশ্চিমা শ্রমনীতির বাইরে?

বিগত ৪ দশকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সার্বিক অবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। এখন বাংলাদেশের প্রতিটি গার্মেন্টস বিদেশি বায়ারের সকল নীতি, যেটাকে বলা হয় কমপ্লায়েন্স, সেটা মেনেই পোশাক প্রস্তুত করে। এছাড়া বড় বড় পোশাক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের অনেক নির্দেশনা থাকে তৈরি পোশাক নির্মাতাদের জন্য। এগুলোর মধ্যে কাজের পরিবেশ থেকে শুরু করে, পণ্যের মান, শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শ্রমিকদের বয়স, অধিকার, মানসিক স্বাস্থ্যসহ বিবিধ নির্দেশনা থাকে; এবং সেগুলো মেনে চলছে কিনা সেটা নিয়ে আবার প্রতিটা বায়ার নিজস্ব লোক দিয়ে প্রতিটা গার্মেন্টস পরিদর্শন করায়। এই সকল পরিদর্শন শেষে, ইতিবাচক প্রতিবেদন পেলেই সেই গার্মেন্টসে পণ্য প্রস্তুত করতে রাজি হয় পশ্চিমা বায়াররা। বাংলাদেশের কিছু কিছু গার্মেন্টস বৈশ্বিক জলবায়ুর প্রভাবে কথা মাথা রেখে গাছপালা আচ্ছাদিত সবুজ গার্মেন্টস (green factories) তৈরি করেছে। বর্তমানে বিশের সবচেয়ে বেশি সবুজ গার্মেন্টস এখন বাংলাদেশে অবস্থিত, এবং এই সংখ্যাটা ২০০’র উপর। আর এই নির্দেশনাগুলো মেনেই বাংলাদেশের গার্মেন্টস থেকে বিশ্ব নন্দিত ব্র্যান্ডগুলো পোশাক তৈরি করে নিয়ে যায়। এতদিন ধরে মেনে আসা OCS & RCS Certificate, WRAP Certificate, ACCORD Recognition, H&M Gold Supplier, ISO 9001:2015, Compliance Certificate-সহ সকল সার্টিফিকেশন আর শ্রমনীতি মেনেই বাংলাদেশে পণ্য প্রস্তুত হচ্ছে আর সেগুলো বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত শ্রমনীতি এর বাইরের কিছু না। এটা শুধুমাত্র একটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, যা যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োগ করতে পারে সেই সকল দেশের ওপর, বা প্রতিষ্ঠানের ওপর ব্যক্তির যারা উক্ত শ্রমনীতি অনুসরণ করছে না।

কাজেই যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত "বিশ্বব্যাপী কর্মী, ক্ষমতায়ন, অধিকার এবং উচ্চ শ্রমের মান উন্নয়নে রাষ্ট্রপতির স্মারকলিপি" নিয়ে নতুন করে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প আমূল বদলে গেছে। তবে ওয়াশিংটন দূতাবাস থেকে পাঠানো চিঠি অনুযায়ী একটু সতর্কতা অবলম্বন করা অবশ্যই জরুরি। কেননা এটা ইতিমধ্যে প্রতীয়মান হয়ে গেছে যে মার্কিন প্রশাসন বাংলাদেশকে নিয়ে একটা নোংরা খেলায় নেমেছে। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি এবং অনমনীয় নেতৃত্ব চক্ষুশূল হয়েছে আমেরিকার জন্য। তাই তারা যেমন ভিসা স্যাংশন আরোপ করেছে, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে, তেমনি তারা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উপর শ্রমিক অধিকারের দোহাই দিয়ে শাস্তি আরোপ করতেও পিছপা হবে না। তাই আমাদের সচেতন আর সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।

ভুল, মিথ্যা খণ্ডিত তথ্য প্রচার করে মানুষকে বিভ্রান্ত করা বা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার এই যে অসাধু প্রক্রিয়া চলমান, এতে দেশের কোন লাভ হবে না বা হচ্ছে না। এতে লাভবান হবে বাংলাদেশবিরোধী শত্রুরা, যাদের বাংলাদেশের উন্নয়ন আর সমৃদ্ধি সহ্য হয় না, যারা বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসাবে দেখতে চেয়েছিল!

;

মিয়ানমারে জান্তা শাসনে গৃহদাহ ও আঞ্চলিক বিপদ



ড. মাহফুজ পারভেজ
মিয়ানমারে জান্তা শাসনে গৃহদাহ ও আঞ্চলিক বিপদ

মিয়ানমারে জান্তা শাসনে গৃহদাহ ও আঞ্চলিক বিপদ

  • Font increase
  • Font Decrease

পাশের দেশ মিয়ানমারে কঠোর ও নিবর্তনমূলক সামরিক শাসনের বজ্রআঁটুনি ভেদ করে সব খবর বাইরের মুক্ত পৃথিবীতে আসতে পারেনা। প্রবল সেন্সরকৃত খবরের তলানি থেকে যতটুকু আঁচ করা যায়, তাতে দেশটির স্বৈরতন্ত্রী, অগণতন্ত্রী ও মানবাধিকার বিরোধী কুশাসনের রক্তরঞ্জিত মুখচ্ছবি বিশ্ববিবেককে আতঙ্কিত ও শিহরিত করে। শুধু মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীই নয়, জাতিগত ও ধর্মগত অপরাপর জনগোষ্ঠীকেও কচুকাটা করা হচ্ছে দেশটিতে। মিয়ানমারে গৃহদাহের আগুন প্রশমিত করতে সামরিক জান্তাকে অবশ্যই প্রতিপক্ষের সাথে আলোচনায় বসতে এবং ক্ষমতা থেকে সরতে হবে বলে প্রত্যাশা করা হলেও সেখানে সামরিক জান্তার বলদর্পিত নিপীড়নকারী আচরণ মোটেও কমছে না এবং আমজনতার অবর্ণনীয় দুর্দশারও অবসান ঘটছে না।

গত মাসের শেষের দিকে মিয়ানমারের বিভিন্ন অংশে সে দেশের উপজাতিগত জনগোষ্ঠী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে একযোগে প্রতিবাদ করে। এর থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, দেশটিতে সামরিক শাসকদের হাত ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে ও শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। সংখ্যালঘু উপজাতি গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত থ্রি ব্রাদারহুড নামের একটি সংগঠন চীন সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের একাধিক এলাকা দখল করেছে এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সেখানে নাকাল হয়েছে বলেও দাবি করা হচ্ছে।

একইভাবে, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত, অস্থিরতার পরিপূর্ণ রাখাইন স্টেট এবং চীন স্টেটেও সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানে পিছু হটতে বাধ্য হওয়ার পর সামরিক জান্তা এবার পাল্টা পদক্ষেপ হিসাবে যুদ্ধবিমান থেকে নিজদেশের জনগণের উপর নারকীয় হামলা চালাচ্ছে, যার ফলে প্রাণ হারাচ্ছেন বহু সাধারণ মানুষ।

এহেন গৃহদাহের চ্যালেঞ্জের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন সেনা কর্তৃক নিয়োজিত প্রেসিডেন্ট মিন্ট সোয়ে। তিনি নিজেই বলেছেন, 'এই সমস্যাটি তথা প্রতিবাদকারীদের আন্দোলন ও তৎপরতা সাবধানতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।' মুখে বললেও কার্যক্ষেত্রে সামরিক জান্তা মানবাধিকারের বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন নয়। দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে যে নির্মমতার মাধ্যমে জাতিগত নিধনের মুখোমুখি করে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে, সেভাবেই অন্যান্য সংখ্যালঘু ও প্রতিবাদকারীদের নির্মূল করছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা।

মিয়ানমারে গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়ে সেনা কর্তারা যখন ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আং সান সুকির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়, তখন তাদের প্রথম পদক্ষেপ ছিল নিজেদের স্বৈরশাসন কায়েম করতে শক্তির অবাধ ব্যবহার করা। সেনা কর্মকর্তারা সু কি সহ অধিকাংশ গণতন্ত্রপন্থী রাজনীতিবিদদের কারাবন্দী করে এবং বিক্ষোভকারীদের উপর ব্যাপক বলপ্রয়োগ শুরু করে। তারপর থেকে সেনার আক্রমণে ৪,০০০-এরও বেশি নাগরিক এবং গণতন্ত্রপন্থী নেতার মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ২০,০০০ লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। নানা অ্যাডভোকেসি গ্রুপ এমনটাই দাবি করেছে। খোদ জাতিসংঘের অনুমান, মিয়ানমারে প্রায় ১.৭ মিলিয়ন মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন।

সামগ্রিক পরিস্থিতির বিবেচনায় এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, নিজেদের পক্ষে স্থিতিশীলতা ফেরাতে সামরিক জান্তার হিংসাত্মক পদক্ষেপ কোনও কাজে আসছে না। বরং আক্রমণের মুখে সাধারণ মানুষ, বিশেষত ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী আরও কোণঠাসা হয়ে মরিয়া মনোভাবে লড়ছে। অবশেষে সবাই সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে।

দেশ হিসেবে মিয়ানমারের ইতিহাস বড়ই রক্তরঞ্জিত। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরেই মিয়ানমারের সংখ্যালঘু উপজাতি সম্প্রদায় হিংসার মুখোমুখি। তবে অতীতে মূল জনগোষ্ঠী বার্মিজ সমাজের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সু কির নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রপন্থী শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এবার গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে সু কির শান্তিপূর্ণ বাধা প্রদানের উপায় খারিজ করা হয়। তার পরিবর্তে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড সরকার, সামরিক শাখা তৈরি করা হয় এবং তারা উপজাতিগত বিদ্রোহীদের সাথেও হাত মিলিয়েছে। এই পরিস্থিতি যে তৈরি হতে পারে, সামরিক শাসকরাও সেটা আগাম আন্দাজ করতে পারেননি। বিগত দুই বছর ধরে সেখানে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা দেখা দিয়েছে। বিদ্রোহীরা দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভুখণ্ডে নিজেদের শক্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। একাধিক ফ্রন্ট উন্মুক্ত রেখেছে, সামরিক জান্তার উপর সামরিক চাপ বজায় রেখেছে। ফলে প্রতিবেশী দেশগুলোর সংগঠন আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক ক্ষেত্রেও মিয়ানমারের সামরিক কর্মকর্তারা ক্রমশ সমালোচনার মুখে পড়ছেন। জেনারেল মিন আং লাইঙ্গের প্রশাসন যে ক্রমশ মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে, তা বিদ্রোহীদের নয়া আক্রমণ এবং ভুখণ্ড হাতছাড়া হওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।

সামরিক জান্তার হাতে কোনো সহজ বিকল্প নেই। সামরিক সমাধানের সম্ভাবনাও আর নেই। সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ আলোচনা উন্মুক্ত রয়েছে। তবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সে পথেও অগ্রসর হয়নি। যদিও বৈচিত্রপূর্ণ নয়া প্রজন্মের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীরা সামরিক কর্মকর্তাদেরকে রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে তারপর শান্তি ফেরাতে আলোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের দাবি, এমন একটি যুক্তরাষ্ট্রীয়, গণতান্ত্রিক সিস্টেম তৈরি করা, যেখানে সংখ্যালঘু উপজাতিদের আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন থাকবে।

কিন্তু যদি মিয়ানমারে শান্তি না এসে অব্যাহতভাবে হিংসা চলতে থাকে, বিশেষত ভারত এবং চীন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, তাহলে এর আঞ্চলিক প্রভাবও দেখা যাবে। আসিয়ান সহ অন্যান্য প্রধান আঞ্চলিক শক্তিগুলোরও তখন সংঘর্ষবিরতি আনতে, সেদেশে গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতে ফিরিয়ে আনতে অর্থপূর্ণ আলোচনার পথ সুগম করতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হবে।

এহেন সঙ্কুল পরিস্থিতিতে সরকারি টিভি চ্যানেল ‘গ্লোবাল নিউজ লাইট অব মিয়ানমার’-এ প্রচারিত এক খবরে বলা হয়েছে, চীন ও মিয়ানমারের বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, দু’দেশের জন্য লাভজনক যৌথ প্রকল্প বাস্তবায়ন, সীমান্তে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং আইনের শাসন বজায় রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৈঠকের বিষয়ে চীনা দূতাবাস বা সে দেশের সরকারি সংবাদ সংস্থার তরফে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে ‘স্থিতিশীলতা’ ফেরানোর অছিলায় মিয়ানমারে চীনা পিললস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) ঢুকতে পারে বলে মনে করছেন ভারতের অনেক সামরিক এবং কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ। তাঁদের মতে চাপে থাকা জান্তা সরকারের উপর প্রভাব খাটিয়ে মিয়ানমারকে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভ’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করতে পারে চীনের শি জিনপিং সরকার। যা নয়াদিল্লির পক্ষে অস্বস্তির কারণ হতে পারে। কেননা, ভবিষ্যতে ওই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি)-এর ধাঁচে রাখাইন প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ কিয়াউকফিউ বন্দর মারফত বঙ্গোপসাগরেরর ‘নাগাল’ পেয়ে যাবে চীনের লালফৌজ।

এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। কারণ, সীমান্ত পেরিয়ে মিজ়োরামেও মিয়ানমারের সমস্যার আঁচ লাগে প্রায়ই আর গৃহযুদ্ধের জেরে পাঁচ হাজারেরও বেশি মিয়ানমারের নাগরিক আশ্রয় নিয়েছেন মিজ়োরামে। অন্যদিকে, ইতিমধ্যেই মিয়ানমারের অন্তত পাঁচটি প্রদেশ দখল করেছে বিদ্রোহী জোট। চীনগামী মূল সড়কটিও তাদেরই দখলে। এর ফলে মিয়ানমারের সঙ্গে চীন ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক নিরাপত্তা, যোগাযোগ ও বাণিজ্য সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতএব, মিয়ানমারে জান্তা শাসনে সৃষ্ট গৃহদাহের বিপদ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ছড়িয়ে পড়ার আগেই সকলে মিলে থামানো দরকার। আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;