সমাজে অপ্রয়োজনীয় ঋণের প্রভাব চিন্তা যখন ‘অপয়া কিস্তি’
গেল বছরগুলোতে কিছু মানুষের আয় বেড়েছে। কিন্তু নানা কারণে সিংহভাগ মানুষের আয় কমে গছে। পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যস্ফীতি অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। আয় কমলেও মানুষের ভোগের চিন্তা ও চাহিদার ব্যাপক প্রসার হয়েছে। তার কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে মানুষের ও তার সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের ব্যাপক প্রচার। এখন মানুষের হাতে হাতে ডিভাইস ও সেটা খুললেই দেশ-বিদেশের সব খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও উপভোগ্যপণ্যের ছবি ও ভিডিওর দেখা মেলে।
ইন্টারনেটে সকল হাট-বাজারের বাহারী পণ্য চোখের পর্দায় ভেসে উঠে। বিজ্ঞাপণের প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে সময়ের অপ্রধান, অপ্রয়োজনীয় পণ্যটিও অনুভূত প্রয়োজনের তালিকায় এক নম্বরে উঠে গিয়ে একসময় কিনতে মন চায়। এজন্য কারো হাতে আজকাল জমানো টাকার প্রয়োজন হয় না। ডিজিটাল লেন-দেনের ব্যাপক প্রসার শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে ‘হঠাৎ খরচ করে ফেলা’ বিষয়টি নতুন অনুষঙ্গ ও উপসর্গ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
হঠাৎ বায়নাও বেড়ে গেছে পরিবারগুলোতে প্রিয়জনদের মধ্যে। এতে অনেকের মধ্যে বিপত্তি শুরু হয়েছে ব্যাংকে থাকা অথবা নিজের হাতে জমানো অর্থ নিশেষত: হয়ে যাওয়া নিয়ে। তাতেও ক্ষান্ত নেই। হাতে নগদ টাকা না থাকলে সমস্যা নেই। কারণ, আজকাল ধার দেনা নিয়ে হাজির হচ্ছে নানা অতি মুনাফালোভী ব্যক্তিরা। শুধু ব্যক্তিই নয়- আজকাল চড়া সুদে দ্রুত টাকা ঋণ পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। এটাতে আরো বেশি বিপত্তি বেঁধেছে হঠাৎ বিপুল পরিমাণে ঋণের বোঝা নিয়ে। কিস্তিতে ঋণ দেওয়ার প্রতিষ্ঠান নেহাৎ কম নয়। তবে এসব ঋণ নিলেই গ্রহীতার ভেতরে দেনাদার হবার দহন সৃষ্টি হয় এবং মনে চিন্তু শুরু হয়ে যায় ঋণ শোধ দেওয়া নিয়ে।
আমাদের দেশে কিস্তিতে এই ঋণ নেবার প্রবণতা অতিদরিদ্র মানুষ থেকে অতি ধনী সবার মধ্যে বিরাজমান। দিনমজুর, অতিদরিদ্র মানুষ চড়া সুদে মহাজনের নিকট থেকে ধার, দাদন, মুলি ইত্যাদি নিয়ে থাকেন পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য। এসব ঋণের সুদের হার ভয়ংকর রকম বেশি।
মধ্যবিত্তের মধ্যে আরেকটি বিষয় হলো ভোগ্যপণ্যের পাশাপাশি কিস্তিতে বিলাসী দ্রব্য কেনার জন্য ঋণ। বিভিন্ন তৈজসপত্র যেমন, মোটরসাইকেল, এলইডি টিভি, ফ্রিজ, ওভেন, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, সিসি টিভি ইত্যাদি। করোনাকালীন সময়ে এই শ্রেণির অধিকাংশ তরুণরা এন্ড্রয়েড মোবাইল ফোন সেট কিনেছিল কিস্তিতে এবং অস্বচ্ছল অভিভাবক পরিবারের অনেকে অনলাইন পড়াশুনার খরচের টাকা যোগাতে অপারগ হওয়ায় ঋণ করেছিল কিস্তিতে শোধ দেওয়ার অঙ্গিকারে।
আরো বড় করে দেখলে বিত্তশালীদের মাঝে বিনোদন পার্ক, মাছের ঘের, একাধিক জমির প্লট, ফ্লাটবাড়ি, বিলাসবহুল কার, শিল্প প্রতিষ্ঠান তৈরি, বিদেশে জমি-বাড়ির মালিক হওয়া ইত্যাদির জন্য অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ ঋণ লেনদেন করা হচ্ছে। যত বড় মাপের মানুষ তত বেশি ঋণ দেয়া ও গ্রহণের নজিরও আছে। এখানেও কিস্তির ব্যাপার আছে। কিন্তু এই শ্রেণিতে ঋণের কিস্তির অর্থ ঠিকমতো ফেরত দেওয়ার নজির কম।
আজকাল কাজের বুয়া মাসের এক তারিখের আগেই বেতন পাবার জন্য বায়না ধরে। কারণ তার বাড়িতে ঘর বানানোর জন্য নেওয়া ঋণের টাকার কিস্তি এখনও শোধ হয়নি। প্রতিমাসে তাকে হাজার হাজার টাকার কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। একদিন দেরি করলেই প্রতিদিন নির্দিষ্ট হারে সুদের জরিমানা গুণতে হয়। সেই জরিমানার টাকা বা ক্ষতির পরিমাণ ভয়ংকর রকমের প্রতারণার শামিল! মজার ব্যাপার হলো এসব শ্রেণি-পেশার মানুষেরা কেউ কেউ মাসে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা আয় করে ঋণের কিস্তি দেয় পুরোটাই।
বেতন বাদে তারা কাজের জায়গায় যে দুবেলা খাবার পায় সেটা দিয়ে কোনরকমে চালিয়ে নেয়। তবুও তাদের প্রয়োজন ঋণ করে একটি মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করে নেয়া। সেজন্য নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে তাদের মধ্যে ভীষণ উৎকন্ঠা কাজ করে থাকে। অথচ আমাদের দেশে অনেক বড় বড় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে তারা মিলিয়ন টাকা ঋণ নিয়েও নিয়মিত কিস্তি প্রদান বা পরিশোধের বিষয় নিয়ে মাথা ঘামান না। তারা প্রায়শই: ঋণ খেলাপি হয়েও আইনের চোখে ধুলো দিয়ে ঘুরে বেড়ান।
ঘন ঘন সাহায্য চাইতে আসা এক ভিক্ষুকের নিকট জানা গেছে, সে তার ভিক্ষার টাকা জামাইকে দেয়। জামাই মাদকের ব্যবসা করে ধরা পড়ে জেল খেটে বের হয়েছে। কিন্তু জামিন পেতে অনেক টাকা ধার করেছে সুদের বিনিময়ে। সেখানে কিস্তিতে ধারের টাকা শোধ দেবার জন্য মেয়ের মাধ্যমে চাপ দিয়েছে তা-না হলে মেয়েকে তাড়িয়ে দেবার ভয় দেখিয়েছে। একজন ফেরিওয়ালার চিন্তা তার মেয়ে-জামাই ঋণগ্রস্থ হয়ে কিস্তির টাকা জমা দিতে না পেরে পুনরায় যৌতুক চেয়ে মেয়ের জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে। জামাইয়ের কিস্তি শোধ দিতে না পারার অক্ষমতা এখন তার মতো শ্বশুরের মাথায় যন্ত্রণা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আরেক বেকার যবুক চাকরি পাবার আশায় সামান্য পৈত্রিক জমি বন্দক রেখে বাবার নিকট থেকে টাকা নিয়েছে। সে বলেছিল চাকরি পেলে টাকা ফেরত দিবে। কিন্তু আরও অনেক বেশি টাকা ছাড়া চাকরি হচ্ছে না। তাই একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছে। সেই ঋণের কিস্তি জমা দেবার জন্য হেনস্থা হতে হচ্ছে। এগুলো এই সময়ের বহুমুখী প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ গ্রহণের কুফল হিসেবে জনজীবনকে নাজেহাল করে তুলেছে- সেকথা অনেকের নিকট অজানা।
আজকাল ঘরে বসে দামি খাবার অর্ডার দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে বহুগুণ। বিলাসী দ্রব্য ঘরে বসে কেনাকাটা করা হচ্ছে। এসব করতে গিয়ে অনেকে বেহিসেবী ঋণ করে ফতুর হয়ে যাচ্ছেন। ঋণ করে ঘি খাবার কথা বাঙালির স্বভাব। এই স্বভাব এত বাস্তবতায় এত যন্ত্রণাদায়ক সমস্যা হিসেবে গোটা সমাজে বিস্তার লাভ করেছে তা- নতুন করে গবেষণার বিষয় হিসেবে গ্রহণের জন্য ভাবিয়ে তুলেছে।
ইন্টারনেটে বিচরণ করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে ভোগের চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। রান্নাবান্না শেখানো এবং বিলাসী দ্রব্যের বিজ্ঞাপণের বাহার দেখে মানুষের খাবার ও পোশাকের প্রতি আগ্রহ বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে নিজের ভোক্তার পকেটে অর্থ ঘাটতি থাকলে সেটা পুষিয়ে নেবার জন্য ঋণ গ্রহণ করছে। ঋণে ঋণে যন্ত্রনার ভারে ‘অপয়া কিস্তি’একটা চরম ভীতির বিষয় হিসেবে তাদের জীবনকে জর্জরিত করে তুলেছে।
এসময় ভোগবাদীতা বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে পড়ায় মানুষের মধ্যে সবকিছুর চাহিদা বেড়ে গেছে। আজকাল বাজারে নিত্যপণ্য সংকটের পিছনে মানুষের ভোগপ্রবণতা বেড়ে যাওয়াকেও দাবি করছেন কেউ কেউ।
এসময়ের ধনী-গরিব সব ধরণের ঋণ গ্রহীতাদের মনে-প্রাণে কিস্তির টাকা জমা দেওয়া নিয়ে চিন্তার জ্বালা বিরাজ করে। বিশেষ করে ২০২৩ সালে নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিতে নিম্ন আয়ের মানুষ ছাড়াও ফিক্সড আয়ের উচ্চ লেভেলের চাকরিজীবী পরিবারগুলোর মধ্যে অর্থাভাব দেখা দিয়েছে। তারা নিজেদের সঞ্চয় ভেঙে খরচের সংকুলান করতে না পেরে অনেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন এবং কিস্তির মাধ্যমে নিয়মিত ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েছেন। মাস পেরুলেই কিস্তির টাকা জমা দিতে হবে ভেবে অনেকে দারুণভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন।
বিশেষ করে যারা ফ্লাট বা গাড়ি কেনার জন্য লোন নিয়েছেন তারা সেই ঋণের টাকার কিস্তি দিতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছেন। এজন্য সংসারের খাবারের বাজেট কাঁটছাট করেও কোন সুরাহা হবার জো নেই। ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসা সামাল দেওয়ার জন্য দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। অনেক অসৎ কর্মজীবী চাকরিতে দুর্নীতি করে অর্থ হাতিয়ে নিয়ে নিজেকে সামাল দিচ্ছেন। বেঁচে থাকার জন্য এসব ধরণের প্রচেষ্টাই সামাজিক অনাচার সৃষ্টি করছে। কিন্তু স্বল্পআয়ের সৎ মানুষেরা বড়ই বিপাকে পড়ে গেছেন। তারা ‘না পারছেন সইতে, না পারছেন কইতে’- অবস্থার মধ্যে নিষ্পেষিত হয়ে কোনরকমে কালাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন। এদের মধ্যে কেউ আছেন যারা ঋণ নিয়ে কিস্তিতে পরিশোধ করার কথা ভেবে মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করেছেন তাদের অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
বৈদেশিক ঋণের বোঝা দেশের ওপর, আর দেশীয় জিও-এনজিও দের ঋণের বোঝা দেশের মানুষের ওপর জেঁকে বসেছে। অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদহার এত বেশি যা ঋণগ্রহীতাকে স্বর্বস্বান্ত করে তুলছে ! এত ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের এত বিজ্ঞাপণ, এত ঋণদানের হিড়িক, এত গ্রাহক তাদের সিংহভাগ শুধু যেন কংক্রীটের বাড়ি ও ফসিল ফুয়েল পোড়ানোর মহাযজ্ঞ চালানোর জন্য। দেশে লাখ লাখ বেকার পথে পথে হতাশ হয়ে কাজের আশায় ঘুরছে। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার এখন শতকরা ৪২ ভাগ।
অথচ তাদের কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য উল্লেখযোগ্য কোন বিনিয়োগ নেই। তাদের কাজের অভাব দূরীকরণে উদ্যোগ বড় নাই।
মানুষ নিজের উপার্জিত আয়ের মাধ্যমে বাড়ি গাড়ি কিনতে চায়। উচ্চসুদে নেওয়া ঋণের টাকায় নয়। নাগরিকদের উচ্চসুদে নেওয়া ঋণের টাকা টেকসই কাজে বিনিয়োগের সুযোগহীনতায় ঋণ গ্রহীতাদেরকে আরও পরনির্ভরশীল করছে। বাড়ছে ঋণ খেলাপিদের সংখ্যা ও দুর্বৃত্তপরায়ণতা।
এভাবে চড়াসুদে ঋণের টাকা নেওয়ার ‘অপয়া কিস্তি’শোধ দিতে না পারা হতাশ মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে সেটা আমাদের আরও চরম অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করবে যা সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্ট করবে এবং সামাজিক ও মানসিক ভাঙন তৈরি করে একটি পরনির্ভরশীল, মানসিকভাবে পঙ্গু সমাজ ও জাতি উপহার দিতে থাকবে বৈ-কি?
লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।