‘রাশিয়া নিয়ে বিএনপি’র বক্তব্য যথেষ্ট সুচিন্তিত নয়’
৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের অভিযোগ ও এর প্রেক্ষিতে দেশটির রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কির মন্তব্য নিয়ে দেশের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে নানা চর্চা চলছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাশিয়ান দূত বিএনপির অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের ভোটেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয় পেয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। এরই প্রেক্ষিতে ফের বিএনপি’র পক্ষ থেকে বিবৃতি পাঠিয়ে রাশিয়ার দূতের মন্তব্যকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’এবং ‘বাংলাদেশের জনগণের অনুভূতিতে’ আঘাত বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রসঙ্গকে কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে টেনে আনার প্রবণতা কতখানি যৌক্তিক এ নিয়ে বার্তা২৪.কম’র সঙ্গে কথা বলেছেন ইনাম আহমেদ চৌধুরী। একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান (প্রতিমন্ত্রী) ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম এই সদস্য রাজনীতিবিদদের কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলা, বাংলাদেশের বৈশ্বিক বলয়ের ভূমিকাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পরিকল্পনা সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম।
বার্তা২৪.কম: সদ্য অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিএনপি’র অন্যদেশকে জড়ানো নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, আপনি একে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ইনাম আহমেদ চৌধুরী: রাশিয়ার দূত সত্যিকারের কথাই তো বলেছেন। এটি রাশিয়া বা ভারতের সরকার কি করে হবে? যে তিনটি দেশের কথা বলা হচ্ছে, তাদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাতও আছে। তিন দেশ যে এক পন্থী তাও তো নয়। তাদের সুস্পষ্ট মতপার্থক্যও আছে। বিএনপির এই মন্তব্যটা খুব সুচিন্তিত মন্তব্য বলে মনে হয় না। রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ঠিকই বলেছেন, তার দেশের সরকার এটি নয়। আমার মনে হয় অন্যান্য যে ২টি দেশের কথা বলেছেন তারাও একই কথা বলবেন যদি তাদের দূতকে এই প্রশ্ন করা হয়। সুতরাং এটা নিয়ে কোন বাহাস বা বিতর্কের কোন অবকাশ আছে বলে তো মনে হয় না। যদি বলা হয় দেশগুলোর মতামতে এখানকার নির্বাচন প্রভাবিত হয়েছে, তাও একইভাবে বলা যাবে না।
বার্তা২৪.কম: বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থানটি কি তা তো আমাদের রাজনীতিবিদরা অবগত। তাহলে কেন অযাচিতভাবে অন্য দেশকে টেনে আনা?
ইনাম আহমেদ চৌধুরী: নিশ্চয়ই, অন্য কোন দেশকে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিতভাবে টেনে আনা অনভিপ্রেত। আমার মনে হয় না বিএনপি নেতারা যথেষ্ট সুচিন্তিত মন্তব্য করেছেন। অন্যদেশকে টেনে আনারও কোন যৌক্তিকতা নেই। অনেক সময় বলা হয়ে থাকে অমুক ওই দেশের অনুচর বা অমুক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বা রাশিয়ার বা চীনের! কিন্তু এসব যে খুব ভাবনা চিন্তা করে বলা তা নয়। তবে তিনটি দেশের কথা যদি বলা হয়ে থাকে তাহলে বলা যাবে-প্রথমত তা খুব সুচিন্তিত নয়; দ্বিতীয়ত কোন দেশকে টেনে নিয়ে আসা অনভিপ্রেত এবং দাবিকারীদের জন্যও কোন ভালো ফল বয়ে আনে না এই মন্তব্য। তখন রাষ্ট্রদূতকেও তর্কে জড়িয়ে পড়তে হয়, বলতে হয় যে ‘না, আমরা তা নই’। এটা অনেকটা হাস্যকরও।
বার্তা২৪.কম: সদ্য দায়িত্ব নেওয়া সরকার বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে অভিনন্দনবার্তা পাচ্ছে। সমালোচকদের থেকে যে ধারণাটি করা হচ্ছিল নির্বাচন পরবর্তীতে বাংলাদেশ বৈশ্বিক স্তরে ক্রমেই বন্ধুহীন হয়ে পড়বে। সেই আশঙ্কাটি কি কাটিয়ে উঠা গেছে বলে আপনি মনে করেন…
ইনাম আহমেদ চৌধুরী: হ্যা, অবশ্যই সেই আশঙ্কা কাটিয়ে উঠা গেছে। এনিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সবাই বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চাইছে। সহযোগিতা করতে চাইছে। বিভিন্ন দেশ থেকে …আমেরিকা, রাশিয়া, চায়না বলছে তারা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চায়। আমরা জানলাম ভিয়েতনামে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। তাদের সমর্থনটাও প্রণিধানযোগ্য। দেশের যে উন্নয়ন হয়েছে, ডিজিটাল-স্মার্ট যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ, এগিয়ে যেতে চাইছে-এক্ষেত্রে বহির্বিশ্বও সহযোগিতা করতে চাইবে। এটা যথেষ্ট স্বস্থিদায়ক খবর আমাদের পক্ষে। এটা আমাদের আশ্বস্ত করতে পারে। বহির্বিশ্বের এই সমর্থন ও সহযোগিতার আশ্বাস বাংলাদেশের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টার প্রতি আস্থারই সূচক।
বার্তা২৪.কম: সারাবিশ্বেই এখন একটা টানাপোড়েন, যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে আছে। এই অবস্থায় বিশ্বের সঙ্গে আমাদের কূটনীতি কেমন হওয়া উচিত?
ইনাম আহমেদ চৌধুরী: বঙ্গবন্ধুর যে কূটনীতি ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’-কারও কাছে এটি কথার কথা মনে হতে পারে কিন্তু আসলে এটি কথার কথা নয়। এর অনেক ইমপ্লিকেশনস আছে। সত্যিকারর্থেই আমরা তা দেখাতে পারছি বলেই মনে হচ্ছে। ধরুন প্যালেস্টাইন প্রশ্নে বাংলাদেশের যে স্ট্যান্ড রয়েছে, আমরা দেখলাম প্যালেস্টাইনের অ্যাম্বাসেডর রামদান বাংলাদেশের ভূমিকায় অত্যন্ত সন্তোষ জানিয়েছে। আমরা নীতিগতভাবে প্যালেস্টাইনের প্রতি এই অবস্থান নিতে পেরেছি, অন্যরা কি ভাবছে তা আমরা চিন্তা করছি না। এখানে আমেরিকা কি ভাবছে বা ইসরায়েল কি ভাবছে তা আমরা দেখছি না। প্যালেস্টাইনের ওপর যে বর্বরতা চালানো হচ্ছে, আমরা সাধ্যমতো সহযোগিতা পাঠিয়েছি। আমার মনে হয় এই জিনিসগুলো মানুষ লক্ষ্য করে। আজকে দেখুন সাউথ আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া কেস করে দিলো আমাদের রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে। অন্য দেশগুলো দেখছে আমরা নীতিগতভাবে চলছি। আমরা লাভ বা ক্ষতির চিন্তা করছি না। কূটনীতির এই চর্চা অব্যাহত রাখা উচিত। বিশ্বের প্রায় দেশই তাদের সমর্থন ও স্বীকৃতি জানাচ্ছে বাংলাদেশের নতুন সরকারকে। আমরা তো চাচ্ছি না, স্বপ্রণোদিত হয়েই তারা এই স্বীকৃতি জানাচ্ছে। এটি সত্যিই একটি ভালো দিক। আমার কাছে মনে হয়, এটি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর যে নীতি তার প্রতিই এক ধরণের সমর্থন ও আস্থা দেখাচ্ছে বিশ্ব। এটা প্রবাহমান রয়েছে। এই মুহূর্তে আমরা সবাই জানি আমেরিকার কি পজিশন, অনেকে খুশি করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তিনি (প্রধানমন্ত্রী) তা করেননি। তিনি বলেছেন সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে কিন্তু আমি নীতিভ্রষ্ট হব না। গত পরশু প্রধানমন্ত্রী প্যালেস্টাইনে হামলাকে বর্বরতা বলে উল্লেখ করেছেন। আমার মনে হয় সারাবিশ্বের শান্তিকামী যে মানুষ আছেন তারা শ্রদ্ধা জানাবেন প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থানকে। প্রশংসা পাওয়ার জন্য শুধু আমরা কিছু করব তা নয়, আমাদের নীতিবিচ্যুতি হওয়া উচিত নয়। প্যালেস্টাইন ইস্যুটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সময় থেকে বাংলাদেশ এই অবস্থান নিয়ে আসছে। আমরা পরম্পরাকে সমুন্নত রেখেছি। অনেকে প্যালেস্টাইন সংকটে সৌদি আরবের কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কিন্তু আজ আমাদের আনন্দ লাগছে শুনে প্যালেস্টাইনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘আমরা সন্তুষ্ট আছি।’
বার্তা২৪.কম: বিশ্বের অর্থনীতি ও ভূ-রাজনীতির ভরকেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে এশিয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বৈশ্বিক নতুন এই সমীকরণে বাংলাদেশের কি ধরণের চিন্তাভাবনা করা উচিত?
ইনাম আহমেদ চৌধুরী: বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে আমাদের শক্তি বা সামর্থ্য বাড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে, শিশুদের হৃদরোগ চিকিৎসায় আমরা বেশ সক্ষমতা অর্জন করেছি। এমন নানা ক্ষেত্রে আমাদের আরও সামর্থ্য অর্জন করা উচিত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শিল্প-সাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শুধুমাত্র এগিয়ে যাওয়া নয়, নেতৃত্ব দেওয়ার ইচ্ছাকেও প্রবল করতে হবে। এটিই যদি আমরা অব্যাহত রাখতে পারি তবে এক সময় আমরা অনেক ভালো করতে পারব। যেখানে আমরা আরও ভালো করতে পারি সেখানেই চেষ্টাকে প্রবল করতে হবে।
বার্তা২৪.কম: বাংলাদেশের এই প্রভূত অগ্রগতিতে ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার আশাবাদ কি?
ইনাম আহমেদ চৌধুরী: অনেক ভালো লাগছে এই ভেবে যে আমরা আরও এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা করতে পারছি। ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যে স্পৃহা বা অনুভূতি জাগছে এটাও অনেক বড় জিনিস। অনেকগুলো দেশ কিন্তু সেটি করতে পারছে না। অনেক বড় দেশও এই চিন্তাটি করতে পারছে না, আমরা যা করতে পারছি। মানুষ আশার ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। সব ইচ্ছে পূরণ হতে পারে না। তবুও এই এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে যদি বজায় থাকে একটি দেশকে কেন্দ্র করে তাহলে তা বড় অগ্রগতিতে পর্যবসিত হয়। আমরা একটি জিনিস লক্ষ্য করেছি, আমাদের মানুষরা কিন্তু সত্যি সত্যি দেশকে ভালোবাসতে শিখেছে। আমাদের দেশ অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করছে বিভিন্ন কারণে। যে সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা এসেছি, মানুষ এতে সম্পৃক্ত রয়েছে। এই যে ব্যতিক্রমী একটি অবস্থা রয়েছে আমাদের, এটা ভীষণভাবে ব্যবহার করা উচিত সবক্ষেত্রে। এই যে দেশপ্রেমকে সার্বিক করে তোলা হচ্ছে কম কথা নয়।