বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২৪

কাউকে পেছনে রেখে নয়, সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে

  • ড. মতিউর রহমান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ড. মতিউর রহমান, ছবি: বার্তা২৪.কম

ড. মতিউর রহমান, ছবি: বার্তা২৪.কম

বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা সম্পর্কিত বিষয়গুলির প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হয়। জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই দিবসটি জনসংখ্যা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনার ওপর আলোকপাত করে। প্রজনন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, নারী অধিকার, এবং টেকসই উন্নয়নসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে আলোচিত হয়।

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের সূচনা ১৯৮৯ সালে, যখন বিশ্বের জনসংখ্যা ৫০০ কোটি পূর্ণ হয়েছিল। ১১ জুলাই ১৯৮৭ সালে বিশ্বব্যাংকের একজন সিনিয়র ডেমোগ্রাফার ড. কেসি জাচারিয়াহ এই দিনটি উদযাপনের প্রস্তাব দেন। এর পর থেকে, বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস জনসংখ্যার গতিবিধি এবং এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

বিজ্ঞাপন

২০২১ সালে বিশ্বের জনসংখ্যা প্রায় ৭.৯ বিলিয়ন এবং ২০৩০ সালে এটি প্রায় ৮.৫ বিলিয়ন, ২০৫০ সালে ৯.৭ বিলিয়ন এবং ২১০০ সালে ১০.৯ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই নাটকীয় বৃদ্ধি মূলত প্রজনন বয়সে পৌঁছানোয় মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এবং সঙ্গে সঙ্গে উর্বরতার হারে পরিবর্তন, নগরায়ন এবং দ্রুতগতিতে অভিবাসনের কারণে হয়েছে। এই প্রবণতাগুলি টেকসই উন্নয়নের জন্য চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা উভয়ই উত্থাপন করে।

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২৪ এর থিম "কাউকে পেছনে রেখে নয়, সবাইকে অর্ন্তভুক্ত করতে হবে" ("Leave no one behind, count everyone") জনসংখ্যা সম্পর্কিত বিষয়গুলি বোঝার জন্য তথ্য সংগ্রহের এবং বিশ্লেষণের গুরুত্বকে তুলে ধরে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, "এই বছরের থিমটি সমস্যাগুলি বোঝার জন্য তথ্য সংগ্রহের উপর গুরুত্ব দেয়, সমাধানগুলি প্রণয়ন করে এবং অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে।"

বিজ্ঞাপন

প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের আলোচনার মূল বিষয়। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)’র তথ্যানুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৪০% এরও বেশি নারী তাদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। অনেক নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে, মাত্র একজনের চারজন নারী তাদের কাঙ্ক্ষিত উর্বরতা অর্জন করতে পারে। প্রতি দুই মিনিটে একটি নারী গর্ভধারণ বা প্রসবের কারণে মারা যায়, এবং সংঘাতপূর্ণ এলাকায় এই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়।

নারী অধিকার এবং ক্ষমতায়ন বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মাত্র ছয়টি দেশে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি নারী সংসদে রয়েছেন এবং বিশ্বব্যাপী ৮০০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ যারা পড়তে পারেন না তারা নারী। শিক্ষার মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন করা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ প্রদান করা টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

নগরায়ন এবং অভিবাসন হল দুটি প্রধান জনসংখ্যাগত প্রবণতা যা বৈশ্বিক উন্নয়নকে প্রভাবিত করে। ২০০৭ সালে প্রথমবারের মতো, নগর এলাকায় বাস করা মানুষের সংখ্যা গ্রামাঞ্চলে বাস করা মানুষের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায়। ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় ৬৬ শতাংশ জনগণ শহরে বাস করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

জনসংখ্যা বিষয়গুলি বোঝার এবং সমাধান করার জন্য সঠিক তথ্য সংগ্রহ অপরিহার্য। গত তিন দশকে, তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং ব্যবহারে উন্নতি স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য সেবার প্রদানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। নতুন প্রযুক্তি মানুষের অভিজ্ঞতার আরও বিস্তারিত এবং সময়োপযোগী পরিমাপ সক্ষম করছে।

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২৪ সকল মানব বৈচিত্র্যকে ধারণ করে এমন তথ্য ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আহ্বান জানায়। অন্তর্ভুক্তিমূলক তথ্য ব্যবস্থা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলি অর্জনের জন্য অপরিহার্য। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, আয় বণ্টন, দারিদ্র্য এবং সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে সমস্যাগুলি সমাধানে ব্যাপক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালা প্রয়োজন। তথ্য সংগ্রহে বিনিয়োগ, লিঙ্গ সমতা প্রচার, এবং সকল ব্যক্তির মঙ্গল নিশ্চিত করার মাধ্যমে আমরা একটি টেকসই এবং ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যত তৈরি করতে পারি।

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২৪ জনসংখ্যা গতিবিধি সম্পর্কিত জটিল বিষয়গুলির উপর সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। আলোচনা এবং সক্রিয় পদক্ষেপের মাধ্যমে এই দিবসটি নিশ্চিত করতে চায় যে কাউকে পেছনে ফেলা হবে না। দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যার চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা মোকাবিলায় তথ্য বিনিয়োগ, লিঙ্গ সমতা প্রচার, এবং সকল ব্যক্তির মঙ্গল নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

বাংলাদেশ, একটি ছোট ভূখণ্ডে স্থাপিত একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, যেখানে প্রায় ১৮ কোটি মানুষ বসবাস করে। দেশের জনসংখ্যা প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জনসংখ্যাগত একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। উচ্চ জন্মহার এবং নিম্ন মৃত্যুহারের কারণে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বর্তমানে প্রায় ১.১%।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ বর্তমানে জনসংখ্যার লভ্যাংশ উপভোগ করছে। জনসংখ্যার লভ্যাংশ (Demographic Dividend) হলো সেই সময়কাল, যখন কোনো দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে। এটি সাধারণত ঘটে যখন দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ কর্মক্ষম বয়সে থাকে, অর্থাৎ ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সের মধ্যে। এই সময়কালে, দেশটির অর্থনীতি ত্বরান্বিত হতে পারে যদি সঠিক নীতিমালা এবং বিনিয়োগ করা হয়।

বাংলাদেশ বর্তমানে জনসংখ্যার লভ্যাংশের সুবিধা গ্রহণের সময়কালের মধ্যে রয়েছে। দেশের প্রায় ৬৩ শতাংশ জনগণ কর্মক্ষম বয়সে রয়েছে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে। এই জনসংখ্যার লভ্যাংশের সুবিধা গ্রহণের জন্য কয়েকটি মূল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিশেষ মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। দক্ষতা উন্নয়নের জন্য টেকনিক্যাল ও ভোকেশনাল শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি। এর ফলে যুব সমাজ কর্মক্ষম হয়ে উঠবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে পারবে।

স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন জনসংখ্যার লভ্যাংশের সুবিধা গ্রহণের জন্য অপরিহার্য। সুস্থ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।

নারীর ক্ষমতায়ন জনসংখ্যার লভ্যাংশের সুবিধা গ্রহণের জন্য অপরিহার্য। নারীশক্তিকে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত করা এবং তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রদান করার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ত্বরান্বিত করা সম্ভব। শিক্ষার মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন এবং তাদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি।

জনসংখ্যার লভ্যাংশের সম্পূর্ণ সুবিধা গ্রহণের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা অপরিহার্য। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। শিল্প, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি এবং সেবা খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।

বাংলাদেশে জনসংখ্যার লভ্যাংশের সময়কাল ২০৪৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এই সময়কালে সঠিক নীতিমালা এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা সম্ভব। তবে, সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এই সুযোগ হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা এবং জনসংখ্যার লভ্যাংশ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সঠিক নীতিমালা এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে এই সুযোগের সম্পূর্ণ সুবিধা গ্রহণ করা সম্ভব। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা একটি সমৃদ্ধ ও টেকসই ভবিষ্যত গড়তে পারি।

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২৪, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং এর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য একটি সুযোগ যা জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন স্বাস্থ্য, নারী অধিকার এবং শিক্ষার প্রসারের মাধ্যমে আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা মোকাবিলা করতে পারি। পৃথিবীর ভবিষ্যত আমাদের সকলের হাতে, এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী