চেতনা ও সংঘবদ্ধতা জরুরি

  • সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

দেশে হত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ আমরা দেখছি, মন্তব্যও করছি, এবং যথারীতি বিষন্ন হচ্ছি। আইন আছে, তবে বোঝাই যাচ্ছে যে, আইন দিয়ে কুলাচ্ছে না। গোটা ব্যবস্থাটাই নারীর প্রতি বিরূপ। আগেও তা-ই ছিল; এখন কমেনি, বরং বেড়েছে। মেয়েদেরকে নিরাপদ রাখা যাচ্ছে না। একাত্তরে হানাদার পাকিস্তানি দস্যুরা যা করতো, এখন স্বদেশি যুবকরা সেই একই কাজ করছে। একাত্তরে আমরা লড়ছিলাম দস্যুদের তাড়াতে; ভরসা ছিল তারা পালাবে। এখন তো সেই ভরসাটা আর নেই; এখন তো স্বদেশিরাই ঘাতক।

তা স্বাধীনতা পেয়ে আমরা অবশ্যই অনেক দূর এগোলাম; মেয়েরাও এগিয়েছে। সর্বক্ষেত্রেই, বলা যাবে। যে চারজন নারী ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকার মদের দোকানের সামনে মদ্যপ অবস্থায় মারামারি করেছেন, চুলোচুলিতেও থামেননি, পরস্পরকে বিবস্ত্র করার উদ্যোগ নিয়েছেন, একাত্তরের আগে তাঁরা যে অতটা স্বাধীনতা ভোগ করতেন এমনটা অবশ্যই বলা যাবে না; কিন্তু ওই যে বললাম মেয়েদের নিরাপত্তার খবর কী? যৌন হয়রানি বাড়লো না কমলো? বোরখা ও হিজাবের ব্যবহার তো স্বাধীনতার আগে অতটা দেখা যায়নি, এখন যতোটা দেখা যাচ্ছে। এসবের ব্যাখ্যা কী? ব্যাখ্যা একটাই, এবং সেটা বেশ সরল। ব্যাখ্যা হলো উন্নতি অবশ্যই ঘটেছে, তবে সেটা পুঁজিবাদী লাইনে। পুঁজিবাদী উন্নয়ন পিতৃতান্ত্রিক এবং বৈষম্যমূলক। সে-উন্নয়ন সবলকে প্রবল করে, দুর্বলকে করে দুর্বল। সকল ক্ষেত্রেই সেটা সত্য, বিশেষ ভাবে সত্য মেয়েদের বেলাতে।

বিজ্ঞাপন

নারীর নিরাপত্তাহীনতার কাহিনী শেষ হবার নয়। লেখাটি শেষ করবার আগেই জানা গেল যে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকাতে সংঘবদ্ধ একটি ডাকাত দল গভীর রাতে একটি গৃহে প্রবেশ করে। সেখানে ঘুমাচ্ছিলেন এক মা ও তার কন্যা। ডাকাতরা যথারীতি তাঁদের হাত পা বেঁধে জিনিসপত্র খুঁজতে থাকে। মূল্যবান কিছু না পেয়ে তারা ক্রুদ্ধ হয়; এবং কিশোরী কন্যাটিকে পার্শ্ববর্তী ঝোপে নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে ধর্ষণ করে।

জানা গেছে যে ডাকাত দলের সর্দার স্থানীয় একটি সুতার কলে কাজ করতো। কাজ ছেড়ে দিয়ে সে এখন পেশাদার ডাকাত হয়েছে; এবং ১০-১২ জনের একটি দল গড়েছে [খবরের কাগজ, ২১ মে]। আরও একটি খবর : চট্টগ্রাম থেকে : ডেকে নিল পুলিশ, নিয়ে গেল র‌্যাব, পরে পাওয়া গেল লাশ, একজন মহিলার [আজকের পত্রিকা, ১৯ এপ্রিল]। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায় এক মহিলাকে শেকলে বেঁধে দলবদ্ধ ভাবে ধর্ষণের খবরও বের হয়েছে কয়েকটি পত্রিকাতে। নাকি তাঁকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছিল প্রবাসী এক ব্যারিস্টারের নির্দেশে। কারণ পারিবারিক কলহ।

বিজ্ঞাপন

ওদিকে মেয়েরাও যে বেপরোয়া হতে পারে তার নজিরও একেবারে বিরল নয়। যেমন এই খবরটা বলছে যে মেয়ে তার মা’কে হত্যা করেছে, মা তার বিয়ে দিচ্ছেন না বলে [প্রতিদিনের বাংলাদেশ, ২৯ এপ্রিল]। গাজীপুরে দু’জন পোশাক-কর্মী গেছিলেন বৈশাখী মেলায়। একজন পুরুষ সহকর্মী ছিলেন তাঁদের সঙ্গে। সন্ধ্যার পরে স্থানীয় কয়েকজন যুবক তাদেরকে ধরে নিয়ে যায় স্থানীয় একটি ক্লাবে। পুরুষটিকে আটক করে রেখে মহিলাদেরকে নিকটবর্তী এক জঙ্গলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ভাবে ধর্ষণ করে [ডেইলি স্টার, ১৯ এপ্রিল]। ব্রিটিশ আমলে অনেক ক্লাব বিপ্লবীরা শরীর চর্চার জন্য ব্যবহার করতেন; পাকিস্তান আমলেও ক্লাব ছিল খেলাধুলার জায়গা; এখন সেখনে কাজকর্ম হয় ভিন্ন ধরনেরও।

২.
এই যে ছোট ছোট সব গল্প, এগুলো তো আসলে বড় একটা গল্পেরই অংশ। সে গল্পটা উন্নতির। উন্নতি ঘটছে-সবেগে এবং সশব্দে। সভ্যতার ওপরের দিকে ওঠার ব্যাপারে বিশ্ব জুড়েই এখন কোনো বিরাম নেই। প্রকৃতি জয়ের তেমন কিছু আর বাকি আছে বলেও তো মনে হয় না। মহাকাশে মানুষের যাতায়াত যে শুধু শুরু হয়েছে তা-ই নয়, সেখানে রেস্তোরাঁ পর্যন্ত চালু হতে যাচ্ছে, বিনোদনের জন্য। আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তো দরজায় টোকা দেওয়া শেষ করে এখন ধাক্কা দেবার জন্য অস্থির হয়ে রয়েছে।

কিন্তু গল্পটা তো একথাও বলছে যে, এই উন্নতি মানুষকে অবনত করে দিচ্ছে। মানুষ আত্মকেন্দ্রিক, মুনাফালিপ্সু ও ভোগবাদী হয়ে উঠছে। মানুষের মানুষ্যত্ব খর্ব করার সব রকমের বন্দোবস্তই পাকাপোক্ত করা হয়ে গেছে। যে কোনো ঘটনা থেকেই এটা টের পাওয়া যায়।

গল্প নয়, সম্পূর্ণ বাস্তবিক একটি ঘটনার দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। উন্মুক্ত কয়লাখনি তৈরির সর্বনাশা উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের এক সমাবেশে ফুলবাড়ীতে গিয়েছিলেন; ফেরার পথে ট্রেন থেকে নামার সময় তাঁর এক পা আটকে যায় ট্রেনের চাকার নিচে, তাঁর সঙ্গে একজন সহকর্মী ছিলেন, তিনি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে না দিলে যা ঘটেছে তার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে পারতো। আহত হয়ে আনু মুহাম্মদ যখন পড়ে গেছেন উপস্থিত লোকজনের মধ্যে তখন দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।

অধিকাংশই ভূমিকা নিয়েছেন দর্শকের; কিন্তু দর্শকদের ভেতরও ইতরবিশেষ ছিল। কোনো কোনো দর্শক ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন মোবাইলে ছবি তোলাতে। একজন নাকি ভিডিও ক্যামেরাও ব্যবহার করছিলেন। একটি উল্লেখযোগ্য একটি দৃশ্য, সব সময় পাওয়া যায় না। উপভোগ্য, ফেসবুকে তুলে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করার মতো। বলা যাবে নিজের সচক্ষে দেখেছি। কিন্তু অন্তত একজন মানুষ ছিলেন, যিনি ওই ট্রেন থেকে নেমেছেন, এবং ভিড় ঠেলে অতিদ্রুত এগিয়ে এসেছেন আহত অধ্যাপককে সাহায্য করতে।

এগিয়ে গিয়ে তিনি আনু মুহাম্মদের সঙ্গীর সঙ্গে মিলে রক্তাক্ত মানুষটিকে ধরাধরি করে সিএনজিতে তুলেছেন, এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি বিভাগে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর সহায়তা না পেলে ভীষণভাবে আহত ও অসহ্য যন্ত্রণায়-কাতর মানুষটির পক্ষে অবশ্যম্ভাবী বিলম্ব ঘটতো হাসপাতালে পৌঁছতে। আনু মুহাম্মদের সঙ্গে কিন্তু ওই মানুষটির কোনো পরিচয় ছিল না, জানতেন না তিনি আনু মুহাম্মদ কে। তিনি দেখেছেন একজন মানুষ আহত হয়েছে, দেখে ভেতর থেকে তাগিদ অনুভব করেছেন তাঁকে সাহায্য করতে। তাই এগিয়ে গেছেন।

পরে খবরের কাগজ পড়ে তিনি অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের পরিচয় জেনেছেন। জানতে পেরে মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে খোঁজ নিয়েছেন, এবং রোগী বার্ন ইউনিটে রয়েছেন জেনে সেখানে গেছেন জানতে আনু মুহাম্মদ কেমন আছেন। নিজের পরিচয় দিয়েছেন এই পুরাতন ঢাকার একজন বাসিন্দা বলে। মসলার ব্যবসা করেন। এ রকমের মানুষ কিন্তু সমাজে অনেক আছেন।

এই লেখাটি লেখার সময়েই তো কলেজের এক শিক্ষার্থীর খবর পড়লাম, যে তার প্রাণ দিয়েছে একটি শিশুকে বাঁচাতে গিয়ে। গাইবান্ধাতে। সেটাও ট্রেনেরই ঘটনা। মা তাঁর দেড় বছর বয়স্ক শিশু সন্তানটিকে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিলেন, আত্মহত্যা করবেন বলে। শিক্ষার্থীটি ছুটে গেছে তাদেরকে বাঁচাতে। শিশুটিকে বাঁচাতে পেরেছে, মা’কে বাঁচাতে পারেনি; বাঁচাতে পারেনি সে নিজেকেও [সমকাল, ২ এপ্রিল]। এরকমের ভালো মানুষরা আছেন বলেই বিপন্ন সমাজ এখনও টিকে আছে। তবে তারা বিচ্ছিন্ন, তাই ক্ষমতাহীন। ক্ষমতাবানরা তাঁদেরকে পীড়ন করে, এবং পীড়নের আদর্শ চাপিয়ে দেয় সমাজের কাঁধে ও মস্তিষ্কে। তারা ছবি তোলে, সাহায্য করে না।

এই যে বৈপরীত্য এটাও বাস্তবতা। তবে শেষ ভরসা কিন্তু ওই অচেনা অজানা মানুষেরাই। আরও স্পষ্ট বলা চলে ভরসা এঁদের মনুষ্যত্বই, যে মানুষ্যত্বকে অবদমিত, পারলে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সব রকমের চেষ্টায় পুঁজিবাদী উন্নয়নের ধারাটি সর্বদা ব্যস্ত রয়েছে। ভালো মানুষেরা আছেন, এবং তাঁদের সংখ্যাই অধিক; তাঁরা একত্র হলে সমাজে বিপ্লব ঘটবেÑকোনো এক দেশে নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই।

কিন্তু তাঁদের একত্র হবার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংগঠন। এবং প্রয়োজন বঞ্চিত মানুষের ভেতর এই বোধের সক্রিয় সঞ্চার যে বিদ্যমান ব্যবস্থাটা কোনো মতোই গ্রহণযোগ্য নয়, একে বদলানো দরকার; এবং বদলানো সম্ভব। প্রতিপক্ষের ক্ষমতা আছে, কিন্তু মানুষের জাগরণ ঘটলে সেই ক্ষমতা তৃণকূটার মতো ভেসে যেতে বাধ্য। তবে এটা অত্যন্ত সত্য যে, বঞ্চিত মানুষ মাত্রেই বিপ্লবী নয়, বঞ্চিতরা হতাশার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে, এবং করেও। তাদের জন্য এমনকি ভিক্ষুকে পরিণত হওয়াটাও কোনো কঠিন কাজ নয়। বঞ্চিত মানুষেরা বিপ্লবী হবে না যদি না বিপ্লবী চেতনায় শক্তিশালী হয়ে ওঠে; এবং সংঘবদ্ধ হয়।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়