শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কতদিন অচল থাকবে শিক্ষাঙ্গন?

  • কবির য়াহমদ অ্যাসিস্ট্যান্ট, এডিটর বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কতদিন অচল থাকবে শিক্ষাঙ্গন

ছবি: শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কতদিন অচল থাকবে শিক্ষাঙ্গন

কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর আগে থেকেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর আন্দোলনে অস্থির দেশের শিক্ষাঙ্গন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বেগ পাওয়ায় আলোচনা থেকে সরে গেছে সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ নামক স্কিম নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষাঙ্গন সংশ্লিষ্টদের আন্দোলন। পেনশন নিয়ে এই আন্দোলন আলোচনার বাইরে গেলেও এখনো এটা চলমান। সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রত্যয় প্রত্যাহারের দাবিতে ১ জুলাই থেকে ধর্মঘটে রয়েছেন শিক্ষক ও শিক্ষাঙ্গন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলনে থাকার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন তারা।

আগে থেকেই অচল দেশের শিক্ষাঙ্গন। এবার যোগ হয়েছে কোটা আন্দোলন। এই আন্দোলন শিক্ষা বিষয়ক নয়, শিক্ষা শেষে চাকরির। আন্দোলনরতদের দাবি সম-সুযোগ, সম-অধিকারের। তারা কোটা নয়, মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরির সুবিধা চায়। তাদের দৃষ্টিতে এ দাবি অন্যায্য নয় যদিও, যদিও ‘ন্যায্য দাবি’ করতে গিয়ে তারা অন্যায়ভাবে দেশের সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে প্রশ্নের মুখে তুলে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কটাক্ষ করতে উঠেপড়ে লেগেছে অনেকেই। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পর মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণের কারণকে উপহাস করছেন অনেকে। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত, এবং হওয়া উচিত আইনি প্রতিকারের বিষয়। ‘হলোকস্ট ডিনাইয়াল অ্যাক্ট’ অনুসরণে দেশে ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন’ প্রণয়নের যে দাবি দীর্ঘদিনের, সেটা যদি প্রণয়ন হতো, তবে সময়ে-সময়ে নানা ছুতোয় মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এমন অপমানের মুখে পড়তে হতো না।

বিজ্ঞাপন

এটা সকলের জানা যে, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর সরকার কোটা ব্যবস্থা তুলে দেয়। ওই বছরের ৪ অক্টোবর জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, ৯ম (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০ম থেকে ১৩ তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হবে। ৯ম গ্রেড (পূর্বতন প্রথম শ্রেণি) এবং ১০ম থেকে ১৩ তম গ্রেডের (পূর্বতন দ্বিতীয় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হলো। সরকারের ওই পরিপত্রের পর এটা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন ৭ শিক্ষার্থী। গত মাসের ৫ তারিখ হাইকোর্ট ওই পরিপত্র বাতিল করে রায় দেন। এরপর ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ১০ জুলাই আপিলের রায়ে আদালত হাইকোর্টের রায়ের ওপর স্থিতাবস্থা দিয়ে চার সপ্তাহ পর বিষয়টির পরবর্তী শুনানি করার দিন নির্ধারণ করেন।

আন্দোলনের শুরু থেকেই সরকার বলছে, কোটা নিয়ে নিষ্পত্তি করবে আদালত। শিক্ষার্থীরা বলছেন, সরকারকে নিতে হবে সিদ্ধান্ত। এমন অবস্থায় ১১ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণার সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ করেন। প্রকাশিত সংক্ষিপ্ত এ রায়ে বলা হয়, সরকার প্রয়োজনে কোটার অনুপাত পরিবর্তন, হ্রাস বা বৃদ্ধি করতে পারবে। আর এই রায় সরকারের ওপর কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না। কোনো পাবলিক পরীক্ষায় কোটা পূরণ না হলে সরকার সাধারণ মেধা তালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণ করতে পারবে। রায়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি–নাতনিদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, উপজাতি–ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটা বজায় রাখতে বলা হয়। রায় পাওয়ার ৩ মাসের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হাইকোর্টের আংশিক রায়ে বলা হয়।

বিজ্ঞাপন

আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থার রায়ের পর পর হাইকোর্টের আংশিক রায় প্রকাশিত হয়, যেখানে দেখা যাচ্ছে এটা এখন পুরোপুরি সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া। সরকার চাইলে কোটা নিয়ে নির্বাহী সিদ্ধান্ত জানাতে পারবে। স্থিতাবস্থার কারণে এই মধ্যবর্তী সময়ে ফিরে এসেছে মূলত ২০১৮ সালের কোটা নিয়ে সরকারের পরিপত্র। তবে বিষয়টি যেহেতু আপিল শুনানি এবং রায়ের জন্যে অপেক্ষমাণ তখন এটাকে প্রকৃত অর্থে সরকারের হাতেই যে রয়েছে সেটা বলা যাচ্ছে না। আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থায় হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা নাই; কার্যকারিতা নাই সব কোটা বহাল রেখে কোটার অনুপাত হ্রাস-বৃদ্ধির যে আদেশ সেটারও। রিটের নিষ্পত্তিতে হাইকোর্ট যখন একটা রায় দিয়েছে, সেই রায় আবার যখন আপিল বিভাগ স্থগিত করেছে, তখন প্রকৃত অর্থে ২০১৮ সালের পরিপত্রও থাকছে আপিল বিভাগের বিচারাধীন বিষয়। এখানে তাই সরকার আন্দোলনকারী আশ্বস্ত করতে পারে কেবল, তবে আগের পরিপত্র কিংবা হাইকোর্টের রায়ের (আপিলে স্থগিত) আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।

কোটা ব্যবস্থা, হাইকোর্টের রায়, আপিলে স্থগিতাদেশ—পুরো বিষয়টি কি তবে আইনি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং অপেক্ষার মধ্যে পড়ে গেল না? এখন কোটা বাতিলের আন্দোলন, নতুন সিদ্ধান্তের জন্যে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের বিষয়গুলো বিচারাধীন বিষয় হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কোন পথে যাওয়া উচিত? আন্দোলন থেকে সরে না দাঁড়ালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে অগ্রাহ্য করা হবে তাদের, পড়তে পারে তারা আদালত অবমাননার দায়ে; আবার আন্দোলনকারীদের শান্ত করতে সরকারের কোটা নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত দেওয়াও একইভাবে হতে পারে আদালতকে অগ্রাহ্য করারই নামান্তর। তাছাড়া সরকার ও আদালত যখন বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে শুরু করেছে, তখন কেবল রাজপথেই এর নিষ্পত্তি হওয়ার সুযোগ নেই।

আপিল বিভাগের স্থিতাবস্থার পর ফিরে এসেছে কোটা নিয়ে সরকারের ২০১৮ সালের পরিপত্র। শুনানি শেষে আপিলের রায়ের আগ পর্যন্ত সরকার সেই পরিপত্র প্রতিপালন করতে পারবে, তবে এখানে হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে নতুন কিছু করতে পারবে না। যদিও হাইকোর্টের প্রকাশিত আংশিক রায়ে বলা হচ্ছিল হ্রাস-বৃদ্ধির কথা। তবে পরিপত্র বাতিলের রায়ের সঙ্গে এই হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টিও আপিলে স্থগিত। সুতরাং এই মধ্যবর্তী সময়ে আগের পরিপত্রের হুবহু প্রতিপালন ছাড়া কম-বেশি অন্য কিছু করা সমীচীন নয়। আপিলের রায়ে যদি সরকারকে হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়, বা অন্য কিছু নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তখন সেটাই হবে পরবর্তী প্রতিপালনীয় অধ্যায়। এই মধ্যবর্তী সময়ে তাই আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করতে পারে সরকার, অপেক্ষা করতে বলতে পারে আন্দোলনকারীদের। আন্দোলনকারীদের সুযোগ আছে আদালতে তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের। আদালত নিশ্চয় সবার বক্তব্য শুনে পরবর্তী নির্দেশনা দেবেন।

কোটা নিয়ে আন্দোলন না হয় একটা সময়ে নিষ্পত্তি হবে। আশা করতে চাই সকল পক্ষের জন্যে সম্মানজনক কিছু আসবে আদালত এবং সরকারের কাছ থেকে। এরবাইরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে আন্দোলন তার কী হবে? বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের আন্দোলনে অচল দেশের শিক্ষাঙ্গন। তারা সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিমের প্রত্যাহার চাইছেন। তাদের এই দাবি যৌক্তিক, নাকি অযৌক্তিক সে আলোচনায় না গিয়ে বলছি, এর কি কোন সমাধান নাই? শিক্ষক নেতাদের দাবি তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না, তারা তাদের বক্তব্য সরকারের নীতিনির্ধারকদের জানাতে পারছেন না। অর্থাৎ সরকার পাত্তাই দিচ্ছে না এই আন্দোলনকে। বিবিধ ব্যস্ততায় তারা না হয় প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাচ্ছেন না, কিন্তু এত বড় বিষয় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী কেন উদ্যোগ নিচ্ছেন না? শিক্ষাঙ্গনের এই অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা নিরসনে ভূমিকা রাখা তো তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

কোটা হোক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী হোক, যেকোনো পর্যায়ে যে কারো যৌক্তিক স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকারের। এই স্বার্থ রক্ষায় কেউ যৌক্তিক দাবি করতে পারে, কেউ অযৌক্তিক দাবি করতে পারে; তবে সকল দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত সরকারের। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট দাবি গ্রহণ করবে সরকার, জনস্বার্থের পরিপন্থী কিছু হলে সেটা গ্রহণ করবে না—এটাই তো সংগত। কিন্তু পূর্ব-ধারণাজাত সিদ্ধান্তে সবকিছু অগ্রাহ্য করার মানসিকতা সমস্যার সমাধান করবে না, বরং ছোট সমস্যাকে বিশাল করে তুলবে। শিক্ষক আন্দোলন নাড়া দেওয়ার সময়ে শিক্ষার্থী আন্দোলনে দেশ কেঁপেছে বলে পেনশন নিয়ে শিক্ষকদের এই আন্দোলনকে হালকা ভাবে দেখার অবকাশ নাই। কারণ এই পেনশন আন্দোলন আগে থেকেই অচল করে রেখেছে দেশের শিক্ষাঙ্গনকে।

দেশে নানামুখী সমস্যা থাকবে, কিন্তু সঙ্গে থাকতে হবে সমাধানের উদ্যোগ। কোটা আন্দোলনের সঙ্গে তাই সম-গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে পেনশন নিয়ে আন্দোলনকেও। তা না হলে অচল শিক্ষাঙ্গন সচল হবে না।