কোটা আন্দোলন: চেতনার থেকে চেতনা-নাশকের প্রভাব অধিক হবার ফল

  • অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান, লেখক ও গবেষক
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান

ছবি: অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান

গত কয়েকদিন ধরে আমার পরিচিত সুধীমহল ক্রমাগত আমাকে অনুরোধ করে যাচ্ছে, আমি যেন কোটা এবং কোটা আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে একটা লেখা প্রকাশ করি। কোটা এখন ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’, এমন একটা আলোচ্য বিষয় নিয়ে কেনইবা লিখছি না, সেটাও তাদের উৎসুক প্রশ্ন। এ বিষয়ে যদিও আমি একটা দায়সারা গোছের লেখা প্রকাশ করেছি কিন্তু সেটা নাকি আমার মানের হয়নি এবং তাদের মনও ভরেনি। তাদের মতে- আমার লেখা মানেই প্রথাবিরোধী, ব্যতিক্রমী, যৌক্তিক এবং তথ্যবহুল- সুতরাং এ বিষয় নিয়ে আমাকে লিখতেই হবে। আমি আমার সুহৃদদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে বলছি- কোটা এবং কোটা আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে আমি লিখব না। এই কঠিন সময়ে বরং আসেন হালকা টপিক, কবিতা নিয়ে আলাপ করি।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ও সুরারোপিত ‘সন্ধ্যা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ‘নতুনের গান’ নামক দাদরা তালের গানটি, বাংলা ১৩৩৫ সনে শিখা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই সংগীতটিকে ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশের রণ-সংগীত হিসেবে নির্বাচন করা হয়। বাংলাদেশের যে-কোনো সামরিক অনুষ্ঠানে গানটির ২১ লাইন যন্ত্রসংগীতে বাজানো হয়। ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার জরিপে গানটি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিশটি বাংলা গানের মধ্যে ১৮তম স্থান অধিকার করে। পুরো গানটিই তরুণদের উদ্দেশ্যে, তারুণ্যের অপরিমেয় শক্তিকে আহ্বান করে লেখা। আমি মাত্র কয়টি লাইন নিয়ে লিখব।

বিজ্ঞাপন

চলরে নও-জোয়ান,
শোনরে পাতিয়া কান-
মৃত্যু-তোরণ-দুয়ারে-দুয়ারে
জীবনের আহ্বান।
ভাঙরে ভাঙ আগল,
চলরে চলরে চল।
চল চল চল।

ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতবর্ষের প্রতিটি ক্ষেত্র ছিল মৃত্যুফাঁদ, যে দরোজা দিয়ে, যে সেক্টরের, যেখানেই প্রবেশ করা হোক-না-কেন, সেটাই ছিল প্রাণনাশী দরজা অর্থাৎ মৃত্যু-তোরণ। ওই মৃত্যু-তোরণকে পরিবর্তন করে জীবনের আহ্বান জানানো তোরণে পরিণত করে, সমস্ত অন্যায্য বাধাবিপত্তি বা আগলকে ভেঙেচুরে দুমড়ে-মুচড়ে দৃঢ় প্রত্যয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার জন্য কবি তারুণ্যকে উদ্দীপ্তভাবে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। যেহেতু এটিকে জাতীয় রণ-সংগীত করা হয়েছে সুতরাং এই গানে যে আহ্বান জানানো হয়েছে বাঙালি জাতি তা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর ও অঙ্গীকারবদ্ধ বলেই করা হয়েছে। অর্থাৎ জাতি হিসেবে আমরা কবির এই আহ্বানের সাথে সম্পূর্ণ একমত।

বিজ্ঞাপন

দুই. ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ইংরেজি ডিসেম্বর মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩২৮ সালের অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র ২২ বৎসর ৬ মাস বয়সে আড্ডার ফাঁকে একটুখানি সময়ের মধ্যে ‘ভাঙার গান’ শিরোনামে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ কবিতাটি গানের সুরে রচনা করেন। 'ভাঙার গান' শিরোনামেই কবিতাটি 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকার ২০ জানুয়ারি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ অনুযায়ী বাংলা পৌষ-মাঘ ১৩২৮ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতা হলেও এটি ছিল মূলত একটি বিদ্রোহাত্মক গান।

১৯২৪ সালের আগস্ট মাস অনুযায়ী বাংলা ১৩৩১ সালে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার আষাঢ়-শ্রাবণ সংখ্যায় কবিতাটির সাথে আরও ১০টি কবিতা যোগ করে মোট ১১টি কবিতা নিয়ে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের দুই মাস পর ১১ নভেম্বর ১৯২৪ তারিখে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত শাসনাধীন বঙ্গীয় সরকার গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। ব্রিটিশ সরকার আর কখনো এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি। ফলে পরাধীন ব্রিটিশ-ভারতে গ্রন্থটি আর প্রকাশিত হতে পারেনি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর ১৯৪৯ সালে স্বাধীন ভারতে ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। আমি এখানে কবিতাটির কয়েকটি লাইন আলোচনা করছি।

ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদী।

ঈশান শব্দের অর্থ শিব, মহাদেব, মহেশ্বর। এর আরেকটা অর্থ উত্তরপূর্ব কোণ। হিন্দুমতে শিব প্রলয়ের দেবতা এবং ধ্বংসের রাজা বা নটরাজ। এখানে কবি ‘তরুণ ঈশান’ বলতে শিবশক্তির প্রলয়ের সাথে তুলনীয় পরাধীন ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামী তরুণ বীর সন্তান ও বিপ্লবীদের বুঝিয়েছেন। ‘প্রলয়’ অর্থ ধ্বংস, ‘বিষাণ’ শব্দের অর্থ শিঙা। ইসলামি মতে ইসরাফিল শিঙায় ফু দিলে পৃথিবীর প্রলয় বা ধ্বংস শুরু হবে। কবি পরাধীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে তাদের ‘প্রলয় বিষাণ’ বাজানোর আহ্বান জানিয়ে সকল অন্যায়-অনাচার, পরাধীনতার শৃঙ্খলকে ভেঙেচুরে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন।

‘নিশান’ মানে পতাকা,‘ধ্বংস নিশান’ মানে যে পতাকা ধ্বংসের প্রতীক, ধ্বংসের নির্দেশনা দেয়। ‘প্রাচীর’ অর্থ দেওয়াল, ‘ভেদী’ মানে ভেদ করা বা ভেঙে-ফুড়ে বেরিয়ে আসা। কবি স্বাধীনতাকামী তরুণ বীর সন্তানদেরকে এমনভাবে ‘ধ্বংস নিশান’ বা ধ্বংসের পতাকা ওড়াতে বলেছেন যেন তা স্বাধীনতাকামী সূর্যসন্তানদেরকে যে বদ্ধ কারাগারে আটক রেখেছে, সে কারাগারের পরাধীনতার প্রাচীর ভেদ করে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসে। সে পতাকা দেখে যেন সমগ্র পরাধীন ভারতবাসী মুক্ত-স্বাধীন হবার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ হয়।

মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সাহস যোগাতে, দেশবাসীর মনোবলকে চাঙ্গা রাখতে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অসংখ্যবার এই গানটি বাজানো হয়েছে। আমাদের জাতীয় ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলিতে গানটির কদর আজো আকাশছোঁয়া। গানটির মর্মবাণী আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার এবং সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য।

তিন. ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথের কাব্যগ্রন্থ ‘বলাকা’। এই কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলির মধ্যে একটি হলো ‘সবুজের অভিযান’। কবিতাটি একসময়ে স্কুলের টেক্সটবুকে ছিল। এখনকার অতিপ্রত্যাশি, উচ্চাকাঙ্ক্ষী, বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যহীন, হাইব্রিড, কাউয়া কারিকুলামে আছে কিনা জানি না। কারিকুলামে থাকা মনেই হলো, আমরা আমাদের শিশুদেরকে যেভাবে মানুষ করতে চাই, তাদেরকে যেভাবে দেখতে চাই, সেই ধরনের কন্টেন্ট ওই কবিতাটিতে আছে। আমি ‘সবুজের অভিযান’ কবিতার কয়েকটি লাইন আলোচনা করছি।

ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ,
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।

বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ,
দেখে না যে বাণ ডেকেছে
জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।

চলতে ওরা চায় না মাটির ছেলে
মাটির 'পরে চরণ ফেলে ফেলে,
আছে অচল আসনখানা মেলে
যে যার আপন উচ্চ বাঁশের মাচায়,
আয় অশান্ত, আয় রে আমার কাঁচা।

কবিতাটি, বয়সে অগ্রগামী কিন্তু প্রাচীনপন্থী জড়-চিন্তার মানুষদের কঠিন সমালোচনা করেছে এবং তরুণ প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত হবার গুরুত্বপূর্ণ আস্থা দিয়েছে। প্রাচীনপন্থী জড়-চিন্তার সুবিধাভোগী মানুষদেরকে কবি বলছেন ‘আধমরা’ এবং তাদেরকে ঘা মেরে বাঁচানোর জন্য তরুণ প্রজন্মকে আহ্বান জানিয়েছেন। এর পরেই কবি সুবিধার মোড়কে মোড়ানো ওই আধমরাদের উদ্দেশ্যে বলছেন- ওরা বাহিরপানে তাকায় না, অর্থাৎ পৃথিবী যে এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকে এদের খেয়াল নাই। পরিবর্তিত পৃথিবীর যুতসই পরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবে নেবার যোগ্যতাও এদের নাই।

ওরা মাটির ছেলে অর্থাৎ দেশের জলবায়ু, কৃষ্টি-সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে উঠলেও, মুখে মুখে দেশ-জাতির মূল্যবোধের বুলি ছড়ালেও ওরা এগুলো কেয়ার করে না। এরা উচ্চ বাঁশের মাচায় এক অচল আসনে বসে আছে, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে এক অধরা, সুনিশ্চিত, সুরক্ষিত অবস্থান দখল করে এরা সুখের ঢেকুর তুলে জীবনযাপন করছে। এরা আত্মমগ্ন, দুনিয়ার কোনোদিকে এদের খেয়াল নাই। বড়ো বড়ো বুলি আওড়ানো ছাড়া কোনোকিছুর প্রতি এদের কোনো দায়বোধ নাই। অশান্ত, কাঁচা, তরুণ প্রজন্মকে কবি আহ্বান করছেন তারা যেন তাদের তারুণ্যের দীপ্ত দিয়ে এই অযোগ্য, অপদার্থ, আধমরাদের উৎখাত করে সুন্দর পৃথিবী গড়তে ব্রতী হয়।

চার. সারাবিশ্বের তরুণ সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে, তারা তাদের মেধার প্রতিফলন ঘটিয়ে তাদের দেশকে পাল্টে দিচ্ছে। তাদের দেশ তাদের মেধা বিকাশের সেই সুযোগ দিয়েছে। তাদের দেশের রাষ্ট্র পরিকল্পনা, তাদের মেধা বিকাশের জন্য সহায়ক। তাদের মেধা বিকাশের জন্য জীবনের নির্ভরতা, নিশ্চয়তা, আস্থা সবকিছুর জন্য তাদের দেশ তাদেরকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। শুধু তাদের জন্যই নয়, আমাদের দেশের মেধাবীরাও দেশে মেধার যথাযথ প্রয়োগ ও কাঙ্ক্ষিত সম্মান ও সম্মানী না পেয়ে ওইসব দেশে চলে যাচ্ছে এবং মেধার বিনিময়ে সেই পরবাসে থেকে যাচ্ছে। নিজের দেশের চেয়ে সে দেশে তারা বেশি মূল্যায়িত হচ্ছে।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পেরিয়ে গেছে, আমরা আমাদের শিক্ষিত তরুণ সমাজের ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠার জন্য কী নিশ্চয়তা দিতে পেরেছি? তার মন-মানসিকতার বিকাশ ঘটিয়ে মন প্রশস্ত করতে কী উদাহরণ সামনে রেখেছি? প্রতিদিন মিডিয়াতে সে কী দেখছে, যাতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে দেশের প্রতি তার কমিটমেন্ট বাড়বে? রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত, আলয়-আগার কোথায় গেলে সে প্রমিত ও অনুকরণীয় চর্চা দেখছে যা তাকে আস্থা দেবে, তাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে? শুধু এই দেশে জন্মেছে বলে? এই দেশের আলো-ছায়া-মাটিতে বড়ো হয়েছে বলে? তাহলে এই দেশের জড়পদার্থের সাথেই তার আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হবে, মানুষের সাথে নয়।

যে তরুণ আজ প্রশস্ত মনের অধিকারী হবে, শিক্ষা-গবেষণা, উন্নয়নের নতুন নতুন দিক উন্মোচনের চিন্তা করবে- সেই তরুণটিকে কেন আজ সামান্য একটা চাকরির নিশ্চয়তার জন্য আন্দোলন করতে হবে? কেন তাকে রাস্তা বন্ধ করে তার মূল্যবান সময় নষ্ট করতে হবে? পৃথিবীর সব চিন্তা ভুলে, দেশ, সমাজ, জাতি বাদ দিয়ে কেন তার ধ্যান, জ্ঞান, চিন্তা সবকিছু আজ একটা চাকরিকেন্দ্রিক হবে? তরুণদের কথা না হয় বাদই দিলাম, এই তরুণদের অভিভাবকদেরকে এই দেশ তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎকে নির্ভয় করতে কতটুকু অভয় দিচ্ছে? অভিভাবকরা কতটুকু আস্থা ও নির্ভরতার যায়গায় আছে?

যদি বলেন, এই তরুণ প্রজন্ম অযোগ্য, অপদার্থ, লোভী, আত্মকেন্দ্রিক, অজ্ঞানী- তাহলে এর বিপরীতে প্রশ্ন আসে, কেন? এতো বড়ো একটা প্রজন্ম কেন এমন হয়ে গেলো? দেশের সার্বিক পরিকল্পনা, কাঠামো ও বাস্তবায়নের কোথায় ভুল ছিল? রাষ্ট্রের কোন ব্যর্থতার কারণে এতো বড়ো প্রজন্মকে আজ দায়-দায়িত্বহীন, অপদার্থ হতে হলো? বিগত ৫৩ বছর ধরে যারা দেশের নেতৃত্ব দিয়েছে, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে এর জন্য কি তাদের কোনোই দায়ই নাই? এই ব্যর্থতা কি তাদের নয়? মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ বখে গেলে তার দায় হয়তো ব্যক্তির উপরে বর্তায় কিন্তু একটা প্রজন্মের অধিকাংশ তরুণ বখে যাবার দায় তো ব্যক্তির উপরে চাপানোর সুযোগ নাই! এ দায় রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র কোনোভাবেই এ দায় এড়াতে পারে না। ফলে তরুণদের গালি দেবার আগে নিজেদেরকে গালি দিন। ওদের বখে যাবার দায় আপনার।

এতো বড়ো সমস্যার রুট খুঁজে দেখুন, দায়িত্বশীল পদে থেকে ইফেক্ট দেখে ভাসা ভাসা মন্তব্য করে নিজেদের আর সঙ বানাবেন না।

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন রিপোর্ট ২০২০-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩৫ থেকে ৩৯ এই ৫টা বিসিএস পরীক্ষায় মোট নিয়োগ পেয়েছে ১৪ হাজার ৮১৩ জন। বছরে গড়ে ৩ হাজার জনেরও কম! প্রায় ১৭ কোটি মানুষের দেশে বছরে মাত্র ৩ হাজার! বছরে কতজন তরুণ শিক্ষা সমাপ্ত করে বের হচ্ছে আর কতজনের জন্য কর্মের সুযোগ তৈরি হচ্ছে? এই তরুণদের সমালোচনা করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করে জানার চেষ্টা করুন, ওদের আশঙ্কা ও অনাস্থার জায়গাটা কোথায়?

আপনি-আমি কর্মঠ, দায়িত্বশীল, বিনয়ের অবতার, ফেরেশতা বা দেবতা ছিলাম আর ওরা সব হয়েছে শয়তান! কেন হয়েছে? আপনি-আমি দেবতা, ও শয়তান- তাহলে আপনি-আমি কী করেছি? আপনার আমার মতো আদর্শ দেবতারাই আজ আবেদ আলী, বেনজীর। আপনার কয় টাকা বেতন আর কেমনে জীবনযাপন করেন তা ওরা বোঝে। আদর্শ দেখে তৈরি হয়, ওরা যা দেখছে তাই শিখছে।

উল্লিখিত ৫টি বিসিএস পরীক্ষায় পিএসসির বিদ্যমান পদ্ধতিতে মেধায় নিয়োগ হবার কথা ৪৪% এবং কোটায় ৫৬%। কিন্তু কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী না থাকায় মেধায় নিয়োগ হয়েছে ৬৬.২% এবং কোটায় পেয়েছে ৩৩.৮%। অর্থাৎ কোটা থাকলেই যে সেখানে অযোগ্য প্রার্থী নিয়োগ পেয়ে যাবে বিষয়টা তেমন নয়। কোটায় বিবেচনাকারী পরীক্ষার্থীকেও প্রিলিমিনারি, রিটেন, ভাইবা, মানসিক স্বাস্থ্য, শারীরিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি পরীক্ষার ধাপ যোগ্যতাবলে পেরিয়েই কোয়ালিফাই হতে হয়। কারণ, একেবারে সর্বশেষ ধাপে, নিয়োগের আগে গিয়ে তবেই কোটার সুবিধা বিবেচনা করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০% বরাদ্দ থাকলেও উল্লিখিত ৫টি বিসিএস পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পেয়েছে মোট ১ হাজার ২৯৮ জন, যা বরাদ্দকৃত কোটার মাত্র ৮.৭%। অর্থাৎ উপযুক্ত যোগ্যতা না থাকলে কাউকে কোটার জন্য এমনকি মুক্তিযোদ্ধা কোটার জন্যও বিবেচনা করা হয় না। যারা মনে করছেন মুক্তিযোদ্ধা কোটায় অমেধাবীরা চাকরি পেয়ে যাচ্ছে তারা পুরোপুরি ঠিক ভাবছেন বলে মনে হয় না।

কোটা থাকবে, কোটা থাকার যৌক্তিকতা আছে এবং এ কারণে পৃথিবীর বহু দেশেই কোটা আছে। কিন্তু কোটা হতে হবে যৌক্তিক। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উল্লিখিত ৫টি বিসিএস-এর গড় ৮.৭%, তাহলে এই কোটায় কেন ৩০% রাখা হয়েছে সেটি আমি জানি না। তবে আমি বিষয়টাকে একটু ভিন্নভাবে দেখি।

দেশের ক্ষমতায় থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলকে কেন আজ মুক্তিযোদ্ধার কোটা বেশি রেখে মুক্তিযুদ্ধপ্রীতির প্রমাণ দিতে হবে? কেন তাদের এই কোটার বরাদ্দকে জোরেশোরে প্রচার করে দেখানোর প্রয়োজন পড়বে? তারা যদি সত্যিই মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ করতো তবে তো দেশের এই হতাশাজনক অবস্থা হতো না! একটা চাকরির জন্য আজ এভাবে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন করার প্রয়োজন পড়তো না। সরকারি চাকরি লোভনীয় হয়ে উঠত না। কোনো ভালো বিকল্প নাই বলে, কোনো ভালো বিকল্প তৈরি করা হয়নি বলে, দেশের মানুষের জীবন আজ ওষ্ঠাগত বলে, অনিয়ম-ঘুষ-দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গিয়ে সমস্ত জায়গায় আস্থার ভয়াবহ সঙ্কট তৈরি হয়েছে বলে- এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

দেশে কতজন পিকে হালদার, আফজাল হোসেন, লোকমান হোসেন, বনখেকো ওসমান গণি, মোশাররফ হোসেন, বেনজীর, আবেদ আলী, মতিউর প্রমুখ তৈরি করেছেন এবং এর বিপরীতে কতজন প্রখ্যাত গবেষক, বিজ্ঞানী, কবি-লেখক, সাংবাদিক ইত্যাদি তৈরি করেছেন?

যে প্রযুক্তি দিয়ে বর্তমান পৃথিবী চলছে, আমাদের দেশ চলছে তার একটি প্রযুক্তিও আমাদের তৈরি নয়। এই পৃথিবী, এই দেশ চলার জন্য যা কিছু আছে তার কোনো মৌলিক ভিত্তি তৈরিতে আমাদের কোনো অবদান নাই। আমরা সবকিছুতে পরনির্ভরশীল। কাকের পিছনে পুচ্ছ লাগানো ময়ূর। এতেই আমাদের গর্ব ও অহংকারের কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। গর্বে আমাদের মাটিতে পা পড়ে না।

পৃথিবীর বুদ্ধিবৃত্তিক ইনডেক্সে আমাদের জাতির জ্ঞান পৃথিবীর গড় ইনডেক্সেরও নিচে। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও আমরা একটা পঙ্গু জাতি। মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা যেখানে নাই, বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সে জাতির তো পঙ্গুই থাকার কথা।

মুক্তিযুদ্ধের কোটা কত বছর থাকবে সেটা নির্ধারণ করা উচিত। হতে পারে স্বাধীনতার হীরক জয়ন্তী বা ৬০ বছর, প্লাটিনাম জুবিলি বা ৭৫ বছর। অনন্ত কাল ধরে এটা চলতে পারে বলে মনে করি না। সব সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধার প্রজন্ম রাখতে চাইলে, সরাসরি স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা করে তাদের প্রজন্মকে ওই সময়ের জন্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া বন্ধ রাখুন। কিন্তু সে তালিকা তো নাই। নিজের ঘরে ঘোগের বাসা হলে ঘোগের তালিকা করা মুশকিলই বটে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এই প্রজন্মের আস্থা ও শ্রদ্ধা এমনিতে আসবে না। কোটা তৈরি করেও সেটা তৈরি করা যাবে না। তাদের আস্থা আসবে ক্ষমতায় থাকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের চর্চা দেখে। মুক্তিযুদ্ধের শক্তির ক্ষমতায় আসার প্রক্রিয়া এবং ক্ষমতায় থেকে সোনার বাংলা তৈরির সাধনা দেখে তারা শিখছে। কী শিখছে তা আমি জানি না। তবে যা দেখেছে তা শিখেছে এটা ধারণা করতে পারি।

পৃথিবী প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। ছয়মাস আগের টেকনোলজি পাল্টে নতুন টেকনোলজি আসছে। অথচ আমরা এখনো ঢাকঢোল পিটিয়ে মহাগৌরবে চার/পাঁচ দশক আগে বিগত হওয়া আমাদের প্রয়াত মহান নেতাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। কেন? এখন পৃথিবী যেখানে এসেছে চার/পাঁচ দশক আগে এগুলো ছিল স্বপ্নেরও অতীত। এখনকার জন্য যে উন্নয়ন দরকার সেই সময়ে এ স্বপ্ন দেখার সুযোগ ছিল না। দুনিয়া এতো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে যে, এখনকার স্বপ্ন তখন দেখার কথাও নয়।

আমি কোনো মহান নেতাকে অসম্মান করার জন্য বলছি না। কারণ, এখনকার দশ বছরের একটা বাচ্চাও বলতে পারবে, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে কিন্তু সক্রেটিস, এরিস্টটল, প্লেটোর মতো মহাজ্ঞানীরাও তাদের সময়ে একথা জানতো না। তারমানে এই নয় যে, এখনকার ওই দশ বছরের বাচ্চাটা তখনকার ওই মহাজ্ঞানীদের থেকেও বেশি জ্ঞানী। এটা যুগের পরিবর্তনের বিষয়। নেতাদের ক্ষেত্রেও তাই।

কেন যুগের লিজেন্ডারি নেতা তৈরি হচ্ছে না? হতে দেওয়া হচ্ছে না? জ্ঞানবুদ্ধির সীমাবদ্ধতার কারণে আপনারা লিজেন্ডারি নেতা হতে পারছেন না বলেই আপনাদেরকে এখনও আগের প্রজন্মের নেতাদের স্বপ্ন ফেরি করে যেতে হচ্ছে। পারিবারিক, পৈত্রিক সম্পত্তি না থাকলে নিজের যোগ্যতায় যার নিজের সংসার চালানোর ক্ষমতা নাই, সেরকম লোককে দেওয়া হয়েছে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হয়ে দেশ চালানোর দায়িত্ব। মাটি ও মানুষের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে, এলিট ধারায়, উচ্চ বাঁশের মাচায় বসে চলানো হচ্ছে দেশের রাজনীতি। দেশের সকল মানবিক উন্নয়নের চর্চা নিম্নমুখী। সরকারি কার্যালয়গুলোতে সাধারণ মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে অসম্মান করা, মানুষকে হয়রানি করে ঘুষ খাওয়া সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। চারিদিকে হতাশার কালো ছায়া। কেউ ভালো নাই।

এই সকল ব্যর্থতার ইমপ্যাক্টই তরুণদের বিপথগামী করেছে, দায়িত্বহীন করেছে। তাদের দৃষ্টি বিশ্বদৃষ্টি না হয়ে ক্ষুদ্র হয়ে চাকরিদৃষ্টিতে নিবদ্ধ হয়েছে। এর দায় এই রাষ্ট্রের।