রাজনৈতিক দলে নেই জনগণের গণতন্ত্র

  • সায়েম খান, লেখক ও কলামিষ্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সায়েম খান, লেখক ও কলামিষ্ট

ছবি: সায়েম খান, লেখক ও কলামিষ্ট

বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় রাজনীতির মাঠে বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড খানিকটা নিস্পৃহ। এদের দলীয় কর্মকাণ্ড দেখলে মাঝে মাঝে মনে হয় বিরোধী দল সরকার নিয়ন্ত্রিত। ক্ষমতাসীনদের চাপে কোনঠাসা হয়ে এরা ক্ষয়িষ্ণ হতে হতে বিলুপ্তির পথে চলছে। যে দল সরকারে থাকবে সে ক্ষমতার প্রভাবে আধিপত্য বিস্তার করবে এটা একটি স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।বিরোধী দলের সরকারের প্রতি একটি প্রচলিত অভিযোগ হচ্ছে সরকার বিভিন্ন মামলা হামলার মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যহত করছে। কিন্তু বিরোধী দল কি তাদের নিজেদের সমস্যার মূল উদঘাটন করে তার কোন সমাধানের পথে এগিয়েছেন? দলের প্রতিটি স্তরে নেতাকর্মীরা সুসংগঠিত না হওয়া, দলের সকল কমিটি উপকমিটিগুলোতে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব-বিরোধ, দলীয় নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনায় দলের সহযোগিতার সীমাবদ্ধতা, হাজার হাজার নেতাকর্মীদের দলছুট হওয়ার প্রবণতা, দলের উচ্চপর্যায়ের নেতৃত্বে সিদ্ধান্তহীনতা ইত্যাদি বিএনপিকে ক্রমশ একটি ভঙ্গুর রাজনৈতিক দলে পরিণত করছে।

আপাতঃদৃষ্টিতে বিএনপি'র এই দৈন্যদশায় সরকার একটি নির্দিষ্ট সময়কাল পর্যন্ত কমফোর্ট জোনে অবস্থান করলেও দেশ ও জাতি গণতান্ত্রিক সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি দেশের বিরোধী দল শ্যাডো গভঃমেন্ট বা ছায়া সরকার হিসাবে বিবেচিত। কিন্তু বর্তমান সময়কালে বাংলাদেশের সার্বিক গণতান্ত্রিক ধারায় বিরোধী দলের অবস্থান নিস্ক্রিয়। দেশ গঠনে সরকার ও বিরোধীদলের যে স্ব স্ব অবস্থান থাকা উচিত, সেই জায়গা থেকে আমরা দেখি তার উল্টো চিত্র। সরকারের যেকোন জাতীয় সিদ্ধান্ত ও আইন প্রণয়নে বিরোধী দলের গঠনমূলক আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা থাকা বাঞ্চনীয়। সরকার পক্ষের সংসদে যেকোন বিল উপস্থাপন, আইন প্রণয়ন কিংবা জাতীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে বিরোধী দলের সাথে হবে সরকার দলের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, গঠনমূলক সমালোচনায় মুখরিত থাকতে পারত জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের গ্যালারী। আওয়ামীলীগ সরকারের আমলের বেশিরভাগ সময়ই কেটেছে বিরোধী দলবিহীন সংসদ। বিএনপি'র আওয়ামীলীগের প্রতি বিভিন্ন কারণে অনাস্থা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে দেখেছি বিগত কয়েকটি সংসদ নির্বাচনে। আসলে জনগণ কি চায় তা আমার মনে হয় কোন রাজনৈতিক দলই বুঝতে চায় না কিংবা বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকে। দেশের সাধারণ জনগণ চায় সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন ও সুষ্ঠু ধারার রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। সর্বদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি দেশের উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

বিজ্ঞাপন

আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক এই দুটি দলের গণতান্ত্রিক কর্মপন্থা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই, সরকারে বা বিরোধী পক্ষে যে দলই থাকুক না কেন, তারা জাতীয় স্বার্থে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অবস্থান করে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেই কোন জাতীয় ঐক্য। জাতীয় যেকোন বড় সাফল্যে কিংবা ব্যর্থতায় আমরা দলমত ভূলে একীভূত হতে পারি না। বিশ্ব দরবারে আমরা গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্লেকার্ড ঝুলালেও আমাদের গণতান্ত্রিক চর্চা খুব সংকীর্ণ। গণতন্ত্রকে রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবহার করে নিজেদের দলীয় স্বার্থে। সাধারণ জনগণের আশা-আকাংখার সঠিক প্রকাশ ঘটে না এসব কারণে। যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে বঙ্গবন্ধু এদেশ স্বাধীন করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর সেই রাজনৈতিক দর্শন কি বর্তমান আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে দেখতে পাই? গণতন্ত্র আমাদের সমাজ সংস্কারের রাজনীতি করতে বলে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনেও তিনি সমাজ সংস্কারের পাশাপাশি জনগণের অধিকারের কথা বলেছেন।

সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবনধারার পরিবর্তন ঘটলেও সাধারণ মানুষের মনে রাজনীতি নিয়ে এখনও বিরুপ প্রতিক্রিয়া কাজ করে। কারণ বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতার অর্ধ-শতাব্দী সময় পার করেও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চার পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে শাষকশ্রনীর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এই ক্ষমতা লাভের আশায় হত্যা, ক্যু, দুর্নীতি সহ নানাবিধ নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে বিভিন্ন আমলে ক্ষমতায় আসা শাষক শ্রেনী।

বিজ্ঞাপন

এদেশের জনগণ নানা সময়ে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রাপ্তিলাভ করেছে। কিন্তু জনগণের সেই কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে সুসংহত রাখতে পারেনি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৬৯'র গণ অভ্যোত্থান, ৭১'র মুক্তিযুদ্ধ, ৯০'র গণ অভ্যুত্থান - প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে গণতন্ত্র পূণঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এবং এর জন্য বাংলাদেশের জনগণের বিলিয়ে দিতে হয়েছে বুকের তাজা রক্ত। জনগণের সেই রক্তের সঠিক মুল্যায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো। দ্বিধাবিভক্ত এদেশের মানুষ জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে হয়তো আবারও প্রয়োজনের তাগিদে গণতন্ত্রিক দাবি আদায়ের জন্য লড়াই করবে, কিন্তু এর সুফল ভোগ করবে কে?