আমি রাজাকার: মুখের কথা শুনেছ দেবতা, মনের কথা শোনোনি জননীর

  • অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান

অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান

আলাপ-আলোচনার স্পিরিট অনুযায়ী আমাদের সমগ্র ছাত্রজীবন কেটেছে রাজাকারবৃত্তের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের ‘সোল এজেন্টের’ দাবিদাররা তখন রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল না। এমনকি শেখ পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের অনেকেই তখন বাংলাদেশের মধ্যে ছিল না। তারা আসতে পারেনি, তাদের আসতে দেওয়া হয়নি, আসার পরিবেশও ছিল না। তাদের জন্য পাতা ছিল মৃত্যুফাঁদ।

তারা যখন ছিল না তখন আওয়ামী লীগ ছিল। তারা যখন থাকবে না, তখনো আওয়ামী লীগ থাকবে। আওয়ামী লীগ একটা রাজনৈতিক দল। ফলে এখনকার মানুষগুলো একসময়ে থাকবে না কিন্তু দলটি থেকে যাবে। এই নেতৃত্ব আগামীতে থাকবে না, নতুন নেতৃত্ব এসে দলের হাল ধরবে। ফলে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার বা কোনো ব্যক্তির দল নয়, আওয়ামী লীগ জনমানুষের দল।

বিজ্ঞাপন

আমাদের সময়ে মোবাইল আবিষ্কার হয়নি, ইন্টারনেট বলে কোনো শব্দ তখন আমরা শুনিনি। রেডিও-টিভিও পর্যাপ্ত ছিল না। ছাত্রজীবনের শেষদিকে এসে হোস্টেলে টিভি দিয়েছিল। সেখানে এখনকার মতো এভাবে মুক্তিযুদ্ধের কথা, স্বাধীনতার কথা বলা হতো না। যা বলা হতো তা খণ্ডিত, বিকৃত ইতিহাস। আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, শেখ মুজিবের নাম উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ।

তখন পেপার-পত্রিকা তেমন ছিল না। যা-ও ছিল তা কেনার পয়সা আমাদের ছিল না। একদিনের পত্রিকা অনেকসময়ে পরেরদিন আসতো। পত্র-পত্রিকায়ও মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার কথা উপেক্ষিত ছিল, খণ্ডিত ছিল, বিকৃত ছিল। রাজাকার, আলবদর, আলশামস শব্দগুলি লেখা নিষিদ্ধ ছিল।

বিজ্ঞাপন

তখনকার বইপত্রে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীনতার কথা এখনকার মতো এতো ব্যাপকভাবে উল্লেখ ছিল না। যা ছিল তাও ছিল বিকৃত-খণ্ডিত।

সেই অবস্থার মধ্যে আমরা ছাত্ররাজনীতি করেছি। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ স্লোগান দিয়েছি, জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়েছি। “রাজাকার-আলবদর - এবার তোদের দেবো কবর”, “জামাত-শিবির, রাজাকার – এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়”, জামাত-শিবির, মৌলবাদ -ধর্মের নামে পুঁজিবাদ” স্লোগান দিয়ে ক্যাম্পাস-রাজপথ দাপিয়েছি, কাঁপিয়েছি।

আমরা স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের ছাত্র রাজনীতিকদের এড়িয়ে চলেছি। তাদের সাথে পারতপক্ষে এক রুমে থাকিনি। তাদের সাথে একত্রে কোনো কাজ করা থেকে পারতপক্ষে বিরত থেকেছি। আমাদের বন্ধুমহল ভিন্ন ছিল। একই ধারার ছাত্র রাজনীতিকদের সাথেই ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির সাথে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা ছিল কম। তাদেরকে কোনোকিছুতে ছাড় দিতাম না।

সেই রাজনৈতিক বিরূপ অবস্থায় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো দৃঢ় মানসিক শক্তি ও বোধ আমরা কোথা থেকে পেয়েছি? সহজ উত্তর- কঠিন রাজনৈতিক অধ্যবসায়ের মাধ্যমে অর্জিত আদর্শিক চর্চা, ত্যাগ ও পূর্বপুরুষের রক্ত ত্যাগের অগ্নি-চেতনা থেকে। সুন্দর দেশ গড়ার একটা স্বপ্ন থেকে।

ওই সময়ে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি ও রাজাকার-শাসিত দেশেও সারাদেশের কোথাও কোনো শিক্ষার্থী, কোনো ছাত্রসংগঠন, কোনো ছাত্রজমায়েত কখনো নিজেকে ‘রাজাকার’ বলে স্বঘোষিত কোনো স্লোগান দেয়নি।

এখনকার সমস্ত ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া, পেপার মিডিয়া, অনলাইন মিডিয়া দিনরাত স্বাধীনতার কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা বিরামহীনভাবে বলে চলেছে।

এখনকার সকল বইপত্র-ক্রোড়পত্র, মানপত্র-দানপত্র, চুক্তিপত্র-ঋণপত্র, প্রেমপত্র-ছাড়পত্র স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর কথা ক্রমাগত বলে চলেছে।

স্বপক্ষ-বিপক্ষ, পুরুষপক্ষ-নারীপক্ষ, পাত্রপক্ষ-কন্যাপক্ষ সবাই স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে।

দেশের খালে, বিলে, নদীতে, সমুদ্রে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের জোয়ার চলছে। দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূখণ্ডে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চাষ চলছে। এর মধ্যে তবে আজ কেন শিক্ষাঙ্গনে ‘আমি রাজাকার’ স্লোগান উচ্চারিত হয়? যখন হওয়ার কথা ছিল, তখন তো হয়নি। এ ব্যর্থতা কার?

মুক্তিযুদ্ধ-স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রকৃত শুদ্ধচর্চা না করে, মিডিয়ায় অতিকথন হয়েছে। কথা ও কাজে এতোটাই ফারাক তৈরি হয়েছে যে, নিজেদের প্রচারটাই হয়েছে নিজেদের জন্য আত্মঘাতী। হরিষে বিষাদ।

অনুকরণীয় উদাহরণ তৈরি না করে, অসহনীয় পরিবেশ তৈরি করে মানুষকে এতোটাই জ্বালিয়েছেন যে, মানুষ আজ ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে এই স্লোগান উচ্চারণ করে? প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে সহজেই বোঝা যায়, এটা তাদের মনের কথা না, এটা আপনাদের প্রতি তাদের ধিক্কার, কটূক্তি, স্যাটায়ার। এটা শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া নয়, এটা তাদের সার্বিক অসন্তুষ্টির প্রতিক্রিয়া।

মুখে স্বাধীনতা-মুক্তিযুদ্ধ ও আদর্শের কথা বলে বলে আপনারা এতোটাই অনাদর্শিক কাজ করেছেন যে, একটা আদর্শিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আজকের এই স্লোগান সেই আদর্শিক শূন্যতার বাই-প্রোডাক্ট?

নীতি-নৈতিকতা, আদর্শের মানদণ্ডে কোথায় নিয়ে গেছেন দেশটাকে? আজকের এই স্লোগান বলে দেয়, স্বাধীনতাবিরোধীরা ক্ষমতায় থেকে দেশের তরুণ প্রজন্মের যে সর্বনাশ করতে পারেনি, সে সর্বনাশ আপনারা করে ফেলেছেন!

‘আমি রাজাকার’ শ্লোগানের মধ্যে ওদের কতোটা ক্ষোভ, দুঃখ, জ্বালা লুকিয়ে আছে সেটা পড়ার চেষ্টা করেছেন? না, করেননি। করলে নিজেদের রাজনৈতিক পরাজয় হবে? নিজের ব্যর্থতা প্রকটভাবে প্রকাশ পাবে? এ জন্য মর্মবাণী না পড়ে, উচ্চারিত বাণীর ভুল ধরে রাজনৈতিক বিজয় নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন? কোনোকিছুরই মূলে যাবেন না, সবসময় ইফেক্ট নিয়ে সস্তা বয়ান দিয়ে যাবেন? আর কতো?

তথ্যমতে ৬ জন তরুণকে লাশ বানিয়েছেন। সব মেরে ফেলবেন? বোঝাবেন না? বোঝাতে পারেন না? সরকারি চাকরি ছাড়া তরুণদের জন্য নিরাপদ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন না? অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন না?

ছাত্রলীগকে কেন মাঠে নামিয়েছেন? প্রশাসনিক ব্যাকআপ ছাড়া এখানে ছাত্রলীগই ‘নাই’ হয়ে যাবে। প্রোটেকশন ছাড়া বেরিয়ে দেখুন তো আপনাদের কী অবস্থা হয়? জনসমর্থন কোথায়, কোনদিকে টের পাবেন।

পৃথিবীর কোনো সংবাদপত্রে রোল মডেলের কথা আসেনি। গতকাল পর্যন্ত আলজাজিরা, রয়টার্স, এএফপি-সহ সারা পৃথিবীর বড়ো বড়ো সংবাদপত্রে কোটা সংস্কারের দাবিতে ৫ জন তরুণের হত্যার খবর আজ এসেছে। দেশের জন্য সুনাম বটে!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতা পড়েছেন? বিরক্ত হয়ে জননী সন্তানকে মৃত্যুর অভিশাপ দেবার পর দেবতা জননীকে তার সন্তান সমুদ্রে ফেলে দিয়ে প্রতিজ্ঞা রাখতে আহ্বান জানায়। জননী তখন কেঁদে বলে- মুখের কথা শুনেছ দেবতা, মনের কথা শোনোনি জননীর। ‘আমি রাজাকার’ স্লোগানের মধ্যেও সেই মর্মবাণী, সেই আক্ষেপ, ক্ষোভ, জ্বালা, ব্যথা, স্যাটায়ার লুকিয়ে আছে। উদার বুদ্ধি খাটিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখুন।

মোক্ষদা কহিল, "অতি মূর্খ নারী আমি,
কী বলেছি রোষবশে--ওগো অন্তর্যামী,
সেই সত্য হল? সে যে মিথ্যা কতদূর
তখনি শুনে কি তুমি বোঝনি ঠাকুর?
শুধু কি মুখের বাক্য শুনেছ দেবতা?
শোননি কি জননীর অন্তরের কথা?'

বিষয়টির যৌক্তিক ও সুষ্ঠু সমাধান করুন, নতুবা প্রজন্ম আজ যেটা স্যাটায়ার করছে আগামীতে সেটা তাদের বিশ্বাসে পরিণত হবে। এমন অবস্থা তৈরি হবে যে, একসময়ে বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হাসি-তামাশা হবে। দোহাই আপনাদের এভাবে বিভীষণের ভূমিকা নেবেন না। আপনারা একসময়ে আওয়ামী লীগে থাকবেন না, কিন্তু আওয়ামী লীগ থাকবে।

শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবাল স্যারকে বলব- গোস্বা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে না যাবার ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগকে খুশি করাটা আপনার জন্য জরুরি না, বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ওই তরুণদের ভুল ভাঙ্গানোটা আপনার জন্য বেশি জরুরি। ওদের বোঝানোটা জরুরি। ওরা আমাদের সন্তান, ওদেরকে সুপথে আনা আমাদের দায়িত্ব।

প্রধানমন্ত্রী রাজনীতি করেন, রাজনীতিক বিজয়ের জন্য তিনি এই বাচ্চাদের সাথে বাগযুদ্ধে নামতে পারেন, ঝগড়া করতে পারেন, পুলিশ দিয়ে মারতে পারেন, কিন্তু আপনি পারেন না। প্রধানমন্ত্রীদের উত্তরসূরি না থাকলে দেশের তেমন কিছু হয় না, কিন্তু জ্ঞানীদের উত্তরসূরি না থাকলে দেশের মস্ত বড় ক্ষতি হয়ে যায়।

এই ভূখণ্ডে মহাপ্রতাপশালী পাল বংশ, সেন বংশ, আর্য বংশ, মৌর্য বংশ, মোগল বংশ, খিলজি বংশ, বারো ভূঁইয়া সব শেষ হয়ে গেছে, তাদের কোনো উত্তরসূরি নাই। কিন্তু তখনকার জ্ঞানীদের উত্তরসূরি ঠিকই আছে। আপনি তাদের মহান উত্তরসূরি। এই দেশে অযোগ্য অপদার্থ রাজনীতিবিদদের উত্তরসূরির দরকার নাই কিন্তু আপনার মতো জ্ঞানী মানুষের উত্তরসূরির দরকার আছে। সন্তানদের ধারণ করুণ। ওরাই আমাদের ভবিষ্যৎ।

লেখক: গবেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ