শিক্ষকদের মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাবে কে?
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘‘...কার নিন্দা কর তুমি/...এ আমার এ তোমার পাপ’ । বিংশ শতাব্দির সমাজ বাস্তবতায় লেখা সেই কবিতার পঙতিতে সমকালীন বাস্তবতাও যে অতি স্পষ্ট ভাবে ধরা পড়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
গতকাল বাংলাদেশের অন্তবর্তী সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা এবং শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বর্তমান সমাজের এক চরম সত্যকে উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিটি ৪০০-৫০০ শিক্ষক; যারা সবাই উপাচার্য হতে চান! কেউ পড়াতে চান না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই প্রবৃত্তি যে আমাদের অজানা ছিল তা নয়। তবে সরকারের দায়িত্বশীল কোন ব্যক্তি যখন শিক্ষকদের সেই প্রবণতা প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন ক্ষোভের সঙ্গে, যিনি নিজেও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন-তখন বিষয়টি আরও একবার আমাদের ভাবিয়ে তুলে।
ঐতিহ্যিক পরম্পরায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বনাগরিক গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান হলেও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সেই ‘ঐতিহ্যে’ চিড় ধরেছে। চিড় ধরেছে তখনি যখন থেকে শিক্ষকরা বিষয়বুদ্ধিতে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠেন, বলা যায় বৈষয়িক আকাঙ্খায় নীতিজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শিক্ষা ও গবেষণা থেকে দূরে সরে যাওয়ার এই অভিযোগ উঠতে দেখেছি আমরা। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই এই অভিযোগের তীর ছোড়া হলেও এর দায় কি কেবল শিক্ষকদেরই ঘাড়েই বর্তায়-এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে। এর উত্তরও দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে আমাদের ‘রাজ’ নীতি কিংবা তাদের যে শিক্ষা ভাবনা, সেখানেই কি বড় ব্যত্যয় রয়ে যায়নি? হীন রাজনৈতিক স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত কি কারও অজানা?
রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়া শিক্ষকদের মাঝে ‘রাজনৈতিক অভিলাষ’ সৃষ্টি হওয়া যে অসম্ভব কিছু নয় তা বোধহয় কারও মানতে কষ্ট হবে না। কিন্তু এ কথাও তো বলা যায় যে, পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এক সময় গবেষণার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার, অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র মতো প্রাতঃস্মরণীয় গবেষকরা ঔপনিবেশিক যুগে অপ্রতুল গবেষণা বৃত্তি ও সীমিত সুবিধার গবেষণাগারে গবেষণা করেও আমাদের জন্য রেখে গেছেন অমূল্য সব গবেষণা সম্পদ।
এখনকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সেই পরাম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকতে পারতেন, আলোকিত করতে পারতেন বিদ্যাপীঠগুলোকে। আগামীর জন্য রেখে যেতে পারতেন অগণিত গবেষককে। কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের অনেককেই (সবাই নন, কেননা এখনও অনেক শিক্ষক আছেন যারা স্রোতের বিপেরীতে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন) পেয়ে বসেছে প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার মোহ। এই মোহ তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমনি অবজ্ঞার আসনে, যেখানে তাঁরা কেবল নিজেরাই ডুবছেন না আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও ডুবাচ্ছেন।
গতকাল একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, যিনি উদ্ভিদ রোগতত্ত্বের একজন শিক্ষক ও গবেষক। নাতিদীর্ঘ আলাপচারিতায় তাঁর কণ্ঠে ফুটে উঠে আক্ষেপের সুর! তিনি বলছিলেন, একটি পরিবর্তিত রাজনৈতিক আবহের মাঝেও যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শীর্ষপদে নিযুক্ত হলেন তারা কিভাবে কোন বিবেচনায় উপাচার্য, উপ-উপাচার্য কিংবা কোষাধ্যক্ষের মতো পদগুলোতে আসীন হয়েছেন তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে।
তিনি বিস্মিত, কারণ এসব পদে পদায়নের জন্য যে নীতিমালা রয়েছে কিংবা বিশ্বজুড়ে যে মানদণ্ড রয়েছে তা লঙ্ঘিত হয়েছে! তিনি স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেননি যে এইসব নিয়োগেও মেধা কিংবা গবেষণা সাফল্য নিয়োগের মানদণ্ড হয়নি। এমন শিক্ষকরাও উপ-উপাচার্য হয়ে গেছেন যারা আরও ১৫ বছর শিক্ষকতা করবেন।
উদ্ভিদ রোগতত্ত্বের ওই শিক্ষকের দাবির সঙ্গে পূর্বের পেশাগত অভিজ্ঞতাও মিলে যায়। বছর তিন আগে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগে অনিয়ম অনুসন্ধানে জানা গেল, পুলিশের একজন উচ্চ পদস্থ কর্তাব্যক্তি সরাসরি হস্তক্ষেপ করছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে।
এও জানা গেল যে, কোষাধ্যক্ষ পদপ্রত্যাশী একজনের আপন ভাই তিনি। আরও জানতে পারলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান বেশ কয়েটি প্রকল্পের ঠিকাদাররা অন্যায় সুবিধা নিয়ে সেই সময়ের দায়িত্বপালনরত উপাচার্যকেই স্বপদে টিকিয়ে রাখতে অন্ততঃ ৪-৫ কোটি টাকার তহবিল গড়েছেন, যা ইউজিসি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের কর্তাদের দেওয়ার হবে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকই এ সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য জানিয়েছিলেন। এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন যখন গণমাধ্যমে আসে তখন প্রতিবেদককে একজন সংসদ সদস্য ফোন করে ওই উপাচার্যের সঙ্গে সমঝোতার অনুরোধও করেছিলেন।
পূর্বাপর এমন অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা উপদেষ্টা ও স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে করা মন্তব্যকে সত্য ও সাহসী উচ্চারণ হিসেবেই মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে সৃষ্টি হওয়া এই অচলায়তন ভাঙবে কে? জাতির অন্ধকার দূর করে আলোর পথে আনবেন যে শিক্ষকরা তাদের মনের অন্ধকার প্রবণতা দূর করবে কে?
আমরা জানি, এ প্রশ্নের উত্তর বেশ কঠিন। তবে আপাতদৃষ্টিতে, আমরা ধারণা করতে পারি-রাষ্ট্রপরিচালনায় ভূমিকায় অবতীর্ণ রাজনৈতিক শক্তিকে শিক্ষকদের হাতিরয়ার করার প্রবণতা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে হবে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ইনস্টিটিউশনগুলো পরিচালনায় ডাইভার্সিটিকে (বৈচিত্র্য) যে গুরুত্ব দেওয়া হয়, আমাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও তা অনুসরণ করতে পারে।
পাশ্চাত্যের দেশগুলো উন্নতির যে শিখরে পৌছেছে তার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে এই বৈচিত্র্যকে ধারণ করার প্রবৃত্তি। সমমতের না হলেও যোগ্য ও কর্তব্যনিষ্ঠ শিক্ষাবিদদের যখন আমরা বেছে নিতে পারব তখন আমাদের বিদ্যাপীঠের নেতৃত্বে; তখনি হয়ত শিক্ষা ও গবেষণা ঐতিহ্যিক পরম্পরা ফিরবে তার আপন মহিমায়।