ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত:

সুতোয় ঝুলেছে আইসিসির বিশ্বাসযোগ্যতা

  • মুনসেফ খানী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

-লেবাননে বর্বর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞ ফিলিস্তিনের গাজা নগরীর আরেক প্রতিচ্ছবি। ছবি: সংগৃহীত

-লেবাননে বর্বর ইসরায়েলের সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞ ফিলিস্তিনের গাজা নগরীর আরেক প্রতিচ্ছবি। ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) যদি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি না করে, তবে আদালতটির যে সামান্য গ্রহণযোগ্যতা ছিল তাও হারাবে। ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সংবিধি কার্যকর হওয়ার পরে, একটি স্পষ্ট আশা জাগিয়েছিল যে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যার জন্য দায়মুক্তির যুগ শেষ হয়ে আসছে।

২২ বছর পরে, আন্তর্জাতিক আদালতের বৈধতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে, কারণ গাজায় গণহত্যার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানকে তারা উপেক্ষা করছে। মে মাসে, আইসিসির প্রসিকিউটর করিম খান ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট সহ হামাসের তিন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার জন্য আদালতকে অনুরোধ করেছিলেন। ইসরায়েলের ক্রমাগত গণহত্যামূলক সহিংসতার মধ্যে গাজায় ক্রমবর্ধমান হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ সত্ত্বেও আইসিসি এখনও সেই সিদ্ধান্ত নেয়নি।

বিজ্ঞাপন

যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের ধারণা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিজয়ী শক্তির আইনি বৃত্তে আবির্ভূত হয়েছিল, কিন্তু কখনই তা বাস্তবায়িত হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, যা আনুমানিক ৭৫-৮০ মিলিয়ন মানুষকে হত্যার পর ‘ন্যায়বিচার’ প্রশ্নে বিভিন্ন ধারণার উদ্ভব হয়।

১৯৪৩ সালের তেহরান সম্মেলনে, যে সময় ইউএসএসআর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং গ্রেট ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধানরা যুদ্ধের কৌশল নিয়ে আলোচনা করার জন্য মিলিত হয়েছিলেন, সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্ট্যালিন পরামর্শ দিয়েছিলেন, কমপক্ষে ৫০,০০০ জার্মান কমান্ডিং স্টাফকে অবশ্যই নির্মূল করতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট রসিকতা করে নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, ৪৯, ০০০ জনকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত! যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল তাদের ব্যক্তিগত দায়িত্বের জন্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

অবশেষে, মিত্ররা নুরেমবার্গ এবং টোকিও সামরিক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে, যা যথাক্রমে ২৪ জার্মান এবং ২৮ জন জাপানি সামরিক ও বেসামরিক নেতাকে অভিযুক্ত করে। কিন্তু এটি ছিল, মূলত, বিজয়ীদের ন্যায়বিচার; কারণ মিত্রশক্তির কোনো নেতা বা সামরিক কমান্ডারকে তাদের যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার করা হয়নি। শেষ পর্যন্ত, এই ট্রাইব্যুনালগুলি ছিল, তর্কাতীতভাবে, আগ্রাসন এবং গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে বিচার করার একটি প্রতীকী প্রচেষ্টা মাত্র।

পরবর্তী দশকগুলোতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য এমন কোনো আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা করা হয়নি। এইভাবে, উদাহরণস্বরূপ, ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জেগে উঠা জনগণের গণহত্যাকারীরা কখনও বিচারের মুখোমুখি হয়নি।

১৯৯০-এর দশকে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের ধারণা পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল, যখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৯১-১৯৯৫ এবং ১৯৯৮-১৯৯৯-এ যুদ্ধের সময় প্রাক্তন যুগোস্লাভিয়া এবং ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা গণহত্যার সময় সংঘটিত অপরাধের বিচারের জন্য দুটি অ্যাডহক ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে এবং এই ট্রাইব্যুনালগুলি তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করেছিল। কেউ কেউ তাদের কার্যকারিতা, আর্থিক খরচ এবং স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তারা আধিপত্যবাদী পশ্চিমা শক্তি দ্বারা নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়।

বিজয়ীদের ‘ন্যায়বিচার’ ধারণাটি বিশেষত যুগোস্লাভিয়া ট্রাইব্যুনালের ক্ষেত্রে আবর্তিত হতে দেখা যায়। যদি বিচারের প্রশ্ন আসে, তবে দেখা যাবে-১৯৯৯ সালে ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটো কর্মকর্তারাদের সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বোমা হামলার ঘটনার কোন তদন্তই হয়নি। রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালে ১৯৪৮ সালের কনভেনশন অনুসারে পশ্চিমা শক্তির যোগসাজশে কোন তদন্ত না করেই গণহত্যা প্রতিরোধ ও শাস্তি সংক্রান্ত বিচার করা হয়। এমন পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৯৮ সালে রোম সংবিধি স্বাক্ষরিত হয়, যা কার্যকর হয় ২০০২ সালে। এটি সবার মাঝে আশা জাগিয়েছিল যে যারা যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং গণহত্যা করেছে তারা যে পক্ষই থাকুক না কেন নতুন আদালতে তাদের বিচার করা হবে।

২০১৮ সালে, আগ্রাসনের অপরাধ, যার মধ্যে আগ্রাসনের পরিকল্পনা, প্রস্তুতি বা সম্পাদন ইত্যাদি আদালতের এখতিয়ারে যুক্ত করা হয়। আগ্রাসনের এই সংজ্ঞায় অপরাধ যে মাত্রারই হোক না কেন তা জাতিসংঘের সনদের লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হবে। কিন্তু আইসিসির উচ্চাশা হতাশায় পর্যবশিত হতে বেশি সময় লাগেনি। রোম সংবিধির কিছু স্বাক্ষরকারী দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে যে তারা আর এই দলে (আগ্রাসন বিরোধী আইনের প্রতিপালনে) থাকতে আগ্রহী নয়। তাদের মধ্যে ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ান ফেডারেশন ছিল। চীন ও ভারতের মতো অন্যান্য বড় শক্তিও এই আইনে স্বাক্ষর করেনি।

এটি আইসিসির বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে কারণ আদালতটি যাত্রা শুরুর প্রথম ২০ বছরে ৪৬ জন সন্দেহভাজনদের বিচার করতে চেয়েছিল, যারা সবাই আফ্রিকান, এবং তাদের মধ্যে ক্ষমতাশীল রাষ্ট্রপ্রধানও ছিলেন।

তবে এই প্যাটার্নটি ২০২২ সালের জুনে প্রথমবারের মতো ভাঙা হয়েছিল, যখন আদালত দক্ষিণ ওসেটিয়ার বিচ্ছিন্ন অঞ্চলের তিনজন রুশপন্থী কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করেছিল। যারা ২০০৮ সালের রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত ছিলেন। এক বছর পরে, ২০২৩ সালের মার্চ মাসে এই আদালত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার জন্য চাঞ্চল্যকর পদক্ষেপ নেয়, তাও আবার প্রধান প্রসিকিউটরের চাওয়ার ঠিক ২৯ দিন পরেই!

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলার রিপোর্ট হওয়া সত্ত্বেও, ‘বেআইনি নির্বাসন (শিশু) এবং শিশুদের বেআইনি স্থানান্তরের জন্য পুতিনের কথিত ‘ব্যক্তিগত অপরাধমূলক দায়’ এর জন্য ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যের (রাশিয়া) একজন বর্তমান প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা আইসিসির স্বাধীনতা ইঙ্গিত দিতে পারে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্যে প্রকট মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে, কেউ কেউ আদালতের সিদ্ধান্তকে তার পশ্চিমাদের প্রভাবের প্রমাণ হিসাবে দেখেছেন। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল কর্তৃক সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অকাট্য প্রমাণকে অনুসরণ করে এই আদালত একই স্বাধীন অবস্থান প্রমাণ করতে পারলে সেই ধারণাটি প্রশমিত হতে পারত।

২০১৮ সালে, ফিলিস্তিন আইসিসির কাছে একটি রেফারেল জমা দেয়, ‘আদালতের এখতিয়ারের মধ্যে প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডের সমস্ত অংশে অতীত, চলমান এবং ভবিষ্যতে সংঘটিত অপরাধ তদন্তের জন্য।’

পাঁচ বছর পর, ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আদালত ‘ফিলিস্তিন পরিস্থিতির তদন্ত’ শুরু করা যেতে পারে বলে সিদ্ধান্তে পৌছায়। ২০২৩ সালের নভেম্বরে, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অন্য পাঁচটি স্বাক্ষরকারী আইসিসির কাছে আরেকটি রেফারেল জমা দেয়, যার পরে আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর নিশ্চিত করেন যে ২০২৩ সালে শুরু হওয়া তদন্ত “চলমান রয়েছে এবং ৭ অক্টোবরে সংঘটিত হামলার পর থেকে শত্রুতা ও সহিংসতা প্রসারিত হয়েছে।’

অথচ গাজায় সংঘটিত যুদ্ধাপরাধে ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতার যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার জন্য আদালতের প্রাক-বিচার চেম্বারে সুপারিশ করতে প্রধান প্রসিকিউটরের সাত মাসের মতো সময় লেগে যায়! তিনি হামাসের তিন নেতার প্রতিও একই সুপারিশ করেছিলেন, যাদের মধ্যে দুজনকে পরবর্তীতে ইসরায়েল হত্যা করে।

নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, যে দেশের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের সমর্থন ও বিদেশে হত্যাকাণ্ড পরিচালনায় দক্ষ মোসাদের মতো কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা আছে তাদের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তার করতে সময় এবং সাহসের প্রয়োজন ছিল বৈকি! তবে আদালতকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে যে নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে আরও বিলম্ব হলে আইসিসির বিশ্বাসযোগ্যতাও সুতোয় ঝুলে থাকবে। যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, গণহত্যা এবং আগ্রাসনের অপরাধের এমন জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত সত্ত্বেও তারা যদি তাদের দায়িত্ব থেকে পলায়ন করে তবে আইসিসির মৃত্যুঘণ্টা বেজে উঠবে।

লেখক: জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা

আল-জাজিরা থেকে ভাষান্তর (ঈষৎ সংক্ষেপিত): আশরাফুল ইসলাম