হীন রাজনীতির 'হিরোবাদে' পর্যুদস্ত উচ্চশিক্ষাঙ্গন
জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক ভবনগুলোর দরজায় তালা ঝুলছে। মেইন গেট বন্ধ। কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারায় টেবিল চেয়ার বেঞ্চে ধুলোবালির আস্তরণ। শিক্ষার্থীরা ভিসির বাসার সামনে বসে জটলা করছে। কেউবা সুর করে শ্লোগান তুলে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কেউ বলছেন, ভিসির পদত্যাগ চাই। কেউবা বহিষ্কার চাইছেন। কেউ আবার বলছেন বহিষ্কার করলে উনি চেয়ার ছাড়বেন না। কারণ ওনার চেয়ারে সুপার গ্লু ও ফেবিকল লাগানো আছে, উনি নিজে উঠতে চাইলেও উঠে দাঁড়াতে পারছেন না। চেয়ার তাকে ছাড়ছে না। উনি গ্যাঁড়াকলে আটকা পড়ে গেছেন, ইত্যাদি। তবে যে যেভাবেই বলুক না কেন- সবগুলোই ওই চেয়ারকে কেন্দ্র করেই বলা।
এদিকে জাবি ভিসির পদত্যাগের দাবীতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা হয়েছে বলে সংবাদে এসেছে। এর আগে ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে রাতভর অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছে আন্দোলনরত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। উপাচার্য অপসারণ মঞ্চ তৈরি হয়েছে এবং সেই মঞ্চ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনের মূল ফটকের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা ও ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’-এর আহ্বায়ক অধ্যাপক রায়হান রাইন ও নেতারা। তারা বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত উনি অপসারণ না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত অবরুদ্ধ থাকবেন।
এদিকে সামনে কবে কখন কী হবে কেউ তা জানে না। সবাই হতাশ। আমাদের দেশের একটি বৃহৎ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে সেখানকার ভিসির বিরুদ্ধে পদত্যাগের দাবী তুলে রাস্তায় নেমে পুলিশের গুঁতো খেতে হচ্ছে আর সরকারি দলের সহপাঠীদের সাথে মারামারি করে সময় পার করতে হচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার পড়াশুনা-গবেষণা লাটে উঠে ভেংচি কেটে সবাইকে পরিহাস করে চলেছে। আমরা সবাই লাজ-লজ্জা ফেলে যেন এসবের মজা দেখছি!
এ কোন দেশে বাস করছি আমরা? কারো কোনো দায় নেই! সব কিছুই যেন চোখ বুজে সয়ে যেতে হয়! কর্তৃপক্ষ এ ওকে দায় চাপিয়ে যাচ্ছে। ধিক্কার জানাই এই প্রহসনের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার অনিয়মগুলোকে।
মিডিয়ার কল্যাণে ও তড়িৎ প্রচারে দেশ-বিদেশের মানুষ খুব দ্রুত এসব সংবাদ জানতে পারছেন। ক’দিন ধরে বুয়েটের আবরার হত্যায় উত্তাল ছিল চারদিক। এরপর ক্যাসিনো, জুয়া, মদ, ইঁদুর, উইপোকা, ও সিলিন্ডার দুর্ঘটনার খবর বেশ বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে। বিশ্বসেরা ক্রিকেটার সাকিবের ইস্যুটি ক্রিকেটের জৌলুসে হঠাৎ হাহাকার নিয়ে আসে। টাইগারদের দিল্লী জয় ভক্তদের সেই হাহাকারকে কিছুটা লাঘব করে দিয়েছিল। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে দেশের নানামুখী সকল সমস্যা যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর এসে ভর করেছে। এর মূল কারণ ‘হীন রাজনীতির হিরোবাদ’ কায়েম করার প্রবণতা নিয়ে।
সুবিধাপ্রাপ্ত একদল ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্তদের চাঁদাবাজি ও বখরা পেতে লাগামহীন দৌরাত্ম্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চরম অশান্ত করে তুলেছে। সম্প্রতি দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের একটি সেকশন খুব বেপরোয়া। তারা শিক্ষকদের প্রতি খারাপ আচরণ করতে মোটেও কুণ্ঠিত হচ্ছে না। দুদিন আগে রাজশাহী পলিটেকনিকের প্রিন্সিপাল সাহেবকে সবার সামনে মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে চ্যাংদোলা করে পুকুরে নিক্ষেপ করেছিল ছাত্র নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত। ভাগ্যিস তিনি সাঁতার জানতেন। তা নাহলে ২০-২৫ ফুট পানিতে তলিয়ে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হতো!
আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীদের এই নৈতিক অধঃপতন কেন হলো-তা ভেবে দেখার বিষয়। এদের পেছনের শক্তি কি? কারা এদেরকে খারাপ হতে প্রলুব্ধ করছে? উন্নয়ন প্রকল্পের টেন্ডারবাজিতে ছাত্ররা নিষিদ্ধ হলেও তারপরও কেন জড়িত? শিক্ষকরা নিজ নিজ আদর্শ ফেলে ছাত্রদের সংগে ফুসফাস করে কোন স্বার্থে? আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা সবার রক্ষক। তারা কেন বাছবিচার করার আগেই একপক্ষকে মারে অন্যপক্ষকে হেনস্থা করে?
উন্নত বিশ্বের মেধাবীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে যায় নিজের প্রচেষ্টায়। তাদের সিংহভাগ শিক্ষার্থী নিজের আয় দিয়ে পড়াশুনার খরচ বহন করে। আজকেই আমাদের তথ্যমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন-তিনি বিদেশে পড়ার সময় রেস্টুরেন্টে একজন ওয়েটারগিরি করতেন। এরকম কাজ করেই তরুণ শিক্ষার্থীরা টিউশন ফি যোগাড় করে। আর আমরা দেশে বাবা মায়ের বোঝা হয়ে থাকি। এই বোঝা সংসারের অভাবের জন্য, এই বোঝা বেকারত্বের বোঝা। পাশাপাশি নৈতিকতার ধ্বস ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণহীনতা এর জন্য বহুলাংশে দায়ী। এটা কমানোর দায়িত্ব দেশের সরকারকে নিতে হবে। তা না হলে মেধাবী তরুণ শিক্ষার্থীরা হতাশা থেকে আবরারদেরকে মেরে ফেলার মতো ও প্রিন্সিপাল সাহেবকে ভরা পুকুরে নিক্ষেপ করার মতো ঘটনা আরো ঘটতে থাকবে।
এজন্য অ-রাজনীতিবিদ ও স্বার্থপর ব্যবসায়ীদেরকে ক্ষমতা দিয়ে বড় বড় দায়িত্ব দিলে চলবে না। পাশাপাশি শিক্ষা ও গবেষণার সঙ্গে সম্পর্কহীন, পেশা ও নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কহীন চাটুকারদেরকে ভিসি, ডিসি, প্রিন্সিপালের দায়িত্ব দিলেও চলবে না। ‘বানরের পলায় দিলে মুক্তার হার, ফল বলে দাঁতে কেটে করে চুরমার’ প্রবাদটি কি তবে এমনিতেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে?
আমাদের দেশের জন্য চিন্তাশীল ব্যক্তির দরকার। জাতির উন্নতির জন্য গবেষক দরকার। চিন্তা ও গবেষণা ছাড়া উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রগুলো অসাড় হয়ে পড়ছে। ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে ও ধাপ্পাবাজি করে তথ্য গোপন করে এমপিও বাগিয়ে নিয়ে এক রাতেই কলেজ তৈরি করার ঘটনাও ঘটে চলেছে এদেশে। তাই মেধাহীন শিক্ষকরা নতুন চিন্তা সৃষ্টি না করে দায়সারা নকল বিষয় দিয়ে পঠন-পাঠন চালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীরা সেটাকে পুঁজি করে বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
এদের ছাত্ররা স্ট্রেস নিতে শিখবে কীভাবে? চিন্তা ও গবেষণাহীন, নকল ও দায়সারা শিক্ষা লাভ করে এরা অল্পতেই হতাশ হয়ে পড়ে। এরা যেনতেন ভাবে একটি সার্টিফিকেট যোগাড় করে সবাই একটি তৈরি ক্ষমতা কাঠামোতে ঢুকতে চায়। কিন্তু সেই তৈরি ক্ষমতা কাঠামোতে সংকুলান হতে পারে ওদের সামান্য ক’জনেরই। যেমন, আমাদের মেধাবীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সবাই বিসিএস পাশ করতে চায়। সেজন্য ক্লাসের পড়া ছেড়ে দেয়। কিন্তু ফিবছর পদ সংকুলানের অভাবে শতকরা আশিভাগই হতাশ হয়ে পড়ে। এতে দেশ একদিকে মেধা হারায় অন্যদিকে এদের কর্মহীনতায় আমরা আরো দরিদ্র হয়ে পড়ি। কারণ, আমাদের তরুণরা অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে চরম হতাশ হয়ে পাড়ি জমায় বিদেশে অথবা জোত-জমি বিক্রি করে ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ইঁদুর ও উইপোকা হয়ে উন্নয়নকে খেয়ে ফেলার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যেটা ঘটেছে ব্যাপকভাবে।
আমরা দেখেছি উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব গবেষণা হয় সেগুলোই তাদের দেশজ উন্নয়ন পলিসিকে নির্দেশনা দেয়। তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ব্যক্তিরা অনেকে গবেষণায় নোবেল প্রাপ্ত ও শিক্ষার্থীরা বিশ্বকাপে স্বর্ণজয়ী। আর আমাদের ছাত্ররা ক্লাসে হাজির না থাকার কথা বললে রেগে গিয়ে প্রিন্সিপাল সাহেবকে সবার সামনে মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে চ্যাংদোলা করে পুকুরে নিক্ষেপ করে দেয়-মেরে ফেলার জন্য! হায়রে শিক্ষা, হায়রে শিক্ষকের নিয়তি!
যুগে যুগে আমাদের ভিসি-প্রিন্সিপালরা যেন হয়েছেন সরকারের তাবেদার ও সেটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য দলবদ্ধ তরুণদের বানাচ্ছেন চৌকিদার। এরা ক্লাস ফাঁকি দেয়, নকল করে, ড্রপ-আউট হয়। এসব চৌকিদারদের স্বার্থে সামান্য টান পড়লেই বাসা ঘেরাও অথবা পুকুরে নিক্ষেপ করার মত জঘন্য ঘটনা ঘটছে।
কর্মচারীরা যদি লোভ ও ঘুষের কাছে নতজানু হয়ে নিজেদেরকে বিকিয়ে দেয়, শিক্ষক যদি সামান্য পদের জন্য ছাত্রদের কাছে দুর্বল হয়, তাহলে দেশের মেরুদণ্ড সোজা হবে কীভাবে?
তাই দেশের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে শুধু জি-হুজুর মার্কা প্রার্থী নিয়োগ বন্ধ করুন। অতিদলপ্রীতি ও সন্দেহজনক অপার আনুগত্য না দেখে উচ্চমার্গের একাডেমিক পারফর্মেন্স আছে কি-না তা যাচাই করে প্রচলিত অধ্যাদেশ বা আইন মেনে গণতান্ত্রিক নিয়োগদান ব্যবস্থায় ফিরে আসা উচিত।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাবলিক-প্রাইভেট সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাঁচাতে হলে দল-মত হিসেব না করে হীন রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। এক্ষেত্রে একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে বিশেষ গুণাবলী চিহ্নিত করে সেগুলোর ওপর ওপেন ক্রেডিটপয়েন্ট দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দান করা উচিত।
আর এসব ভালো মানের নিয়োগের জন্য যে সার্চ কমিটির প্রয়োজন সেটাকে নেতৃত্ব দিতে একজন ‘বিশ্ববিদ্যালয় মন্ত্রীর’ নিয়োগদান করা আশু প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা করা হয়ে থাকে। উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যে গবেষণা হয় বা দেশে যেসকল উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় সেগুলোর সাথে তাদের পারস্পরিক যোগাযোগ, সমন্বয় ও দায়বদ্ধতা থাকে। ফলে তাদের উন্নয়ন কাজে জবাবদিহিতা তৈরি হয় ও অপচয় কম হয়।
আর আমাদের দেশজ উন্নয়নে (ইনডিজিনাস ডেভেলপমেন্ট) এই যোগসূত্রতা অদ্যাবধি তৈরি হয়নি। এই যোগসূত্র তৈরি করা জরুরি। তবে একজন ‘বিশ্ববিদ্যালয় মন্ত্রীর’ গুণ হবে উপরে বর্ণিত সব যোগ্যতা ছাড়িয়ে, যিনি কোনোদিন দলকানা রোগে ভোগেননি ও লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করেননি। তা না হলে আমাদের উচ্চশিক্ষাঙ্গনে যে চরম পর্যুদস্তাবস্থা তৈরি হয়েছে তা দেশের সব অঙ্গনেই ছড়িয়ে যাবে অচিরেই। সে ঢেউ সামলানো দায় হতে পারে।
প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান।