করোনার দিনগুলোতে নির্বাচন

  বাংলাদেশে করোনাভাইরাস
  • প্রভাষ আমিন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

করোনা আতঙ্কে গোটা বিশ্ব এখন জবুথবু। একটু দেরিতে হলেও বাংলাদেশও এখন নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে আগেই। এখন সারাদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সব ধরনের জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ওয়াজ মাহফিল, তীর্থযাত্রা সব বন্ধ। সব ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ, খেলা বন্ধ, বেড়ানোর জায়গা বন্ধ, সমুদ্র সৈকত নিষিদ্ধ, সব পর্যটন কেন্দ্র স্থবির, মাদারিপুরের শিবচর উপজেলা লকডডাউন। অনেক বেসরকারি অফিস বন্ধ করে বাসায় বসে কাজ করছে।

সংক্ষেপে এই যখন অবস্থা, তখন মহাসমারোহে দেশের তিন এলাকায় তিনটি উপনির্বাচনে ভোটগ্রহণ হবে শনিবার। আসনগুলো হলো ঢাকা-১০, গাইবান্ধা-৩ ও বাগেরহাট-৪। সত্যি বলতে কি, করোনা আমাদের সবাইকে এমনভাবে গ্রাস করে রেখেছে, দেশে যে কোথাও কোনো নির্বাচন হচ্ছে; সেটাই মাথায় ছিল না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তো বটেই, এমনকি অধিকাংশ গণমাধ্যমেও এই উপনির্বাচনের খবর আড়ালে পড়ে গেছে। অনেকের ধারণা ছিল, শেষ মুহূর্তে হলেও নির্বাচন পিছিয়ে যাবে। কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলে কমিশন বৈঠক শেষে সচিব মো. আলমগীর জানিয়ে দিয়েছেন, উপনির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে। কমিশনের এই ঘোষণার পর সবার টনক নড়েছে, আরে তাই তো দেশে তো তিনটি উপনির্বাচন আছে!

বিজ্ঞাপন

পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, কমিশনের বৈঠকে মাহবুব তালুকদার, কবিতা খানম ও শাহাদত হোসেন চৌধুরী করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নির্বাচন স্থগিত রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিইসি কে এম নুরুল হুদা এবং অপর কমিশনার রফিকুল ইসলাম নির্ধারিত সময় ভোট গ্রহণের ব্যাপারে অনড় থাকেন। অনেকেই অবাক হয়েছেন। আমি একটুও হইনি। কে এম নুরুল হুদা তো এ যুগের নীরো। চারদিকে যখন আতঙ্কের আগুন, তিনি তো তখন নির্বাচনের বাঁশিই বাজাবেন। নির্বাচন চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ইসি সচিব কমিশনের বৈঠকের রেফারেন্স দিয়ে কিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন।

প্রথম কথা হলো, নির্বাচন কমিশন বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব একটা স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখছে না। স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে নাকি নেই; সেটা কী দিয়ে মেপেছে কমিশন? কে এম নুরুল হুদা ক্লাউন হতে পারেন ডাক্তার তো নন। আমার ধারণা সিইসি টিনের চশমা পড়ে থাকেন, তাই স্বাস্থ্যঝুঁকিটা তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। এখন যদি ঝুঁকি না থাকে, তাহলে আর কখন থাকবে। সচিব বলেছেন, কমিশন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা, প্রার্থীদের চাওয়া এবং অপচয় রোধে নির্ধারিত দিনেই ভোটগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে জানি, কিন্তু সংবিধান তো মানুষের জীবনের চেয়ে বড় নয়। আর 'দৈবদুর্বিপাকে' নির্বাচন পেছানোর ক্ষমতা কমিশনেরই আছে। অতীতে এই 'দৈবদুর্বিপাকের' অপব্যবহারের অপপ্রয়োগও দেখেছি আমরা। আর এবার হলো সত্যিকারের দুর্বিপাক। আর করোনার চেয়ে বড় দুর্বিপাক মানব সভ্যতার ইতিহাসেই খুব বেশি আসেনি। আর হঠাৎ করে নির্বাচন কমিশন 'প্রার্থীদের চাওয়া'কে এত গুরুত্ব দিচ্ছে কেন, সেটা আমার মাথায় ঢুকছে না। এরপর দেখলাম নির্বাচন কমিশন আবার অপচয় নিয়েও খুব চিন্তিত। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, নুরুল হুদা ওনার বাপের জমি বিক্রি করে সেই টাকায় নির্বাচন করছেন। আরে ভাই, জনগণের টাকায় আপনারা যেই মার্কা নির্বাচন করছেন, গত কয়েকবছর ধরে; তার পুরোটাই তো অপচয়। এখন হঠাৎ তিনটি উপনির্বাচনের সম্ভাব্য অপচয় নিয়ে উতলা হয়ে গেলে চলবে। আর জনগণের টাকার প্রতি কমিশনের যে কত মায়া, সেটা আমরা জানি। যারা গত নির্বাচনের আগে প্রশিক্ষণ না দিয়েই টাকা লোপাট করে দিয়েছিল, তাদের মুখে এখন অপচয়ের কথা আর ভূতের মুখে রাম নাম একইরকম লাগে।

সময়মত ভোটগ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রকাশ্য যুক্তিগুলোর সাথে একমত না হলেও আমি কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের পক্ষে। আমিও চাই উপনির্বাচনগুলো সময়মত হয়ে যাক। সময়মত নির্বাচন অনুষ্ঠানের আসল যুক্তিটা কমিশন সম্ভবত চক্ষুলজ্জার কারণে বলতে পারেনি। করোনার মূল ঝুঁকি হলো লোকসমাগমে। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচনে এখন আর লোকসমাগম হয় না। ভোটাররা ভোট দেয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন অনেক আগেই। সম্প্রতি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে, এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থকরাও ভোট দিতে যায়নি। আপনারা যদি গ্যারান্টি দেন, করোনার পরে নির্বাচন হলে আপনারা ভোট কেন্দ্রে যাবেন; আমিও তখন নির্বাচন পেছানোর পক্ষে থাকবো। কিন্তু আপনারা যদি ভোট দিতে নাই যান, তাহলে আর করোনার বাহানায় সময় নষ্ট করে লাভ কী?

আপনারা যদি ভোট কেন্দ্রে না যান, তাহলে লোকসমাগম হবে না। আর লোকসমাগম না হলে তো ভোট নিতে কোরো স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকবেই না। তারওপর নির্বাচন কমিশন ভোট কেন্দ্রের বাইরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকবে। ভোট দিতে যাওয়ার সময় হাত ধুয়ে যাবেন, বেরিয়ে আবার ধোবেন। এই আকালের দিনে মুফতে হাত ধোয়ার এমন সুযোগ আর কোথায় পাবেন। সাংবাদিকদের প্রতি একটা অনুরোধ, কেন্দ্রে ভোটার নেই, কুকুর ঘুমাচ্ছে; এমন ছবি বা শিরোনাম দিয়ে আহাজারি তোলার চেষ্টা করবেন না। এটা তো সবাই জানে। যেটা সবাই জানে, সেটা নিয়ে অত হইচই করার কী আছে। আর রাতে নির্বাচন কমিশন ভোটের যা হার দেয়, বিনা প্রশ্নে তা মেনে নিয়েন। ভোটারের লাইন না থাকলেও এত ভোট কোত্থেকে এলো, এই প্রশ্ন তুলে কমিশনকে বিব্রত করবেন না। তাদের দোষ দিয়ে লাভ কি। নির্বাচনী ব্যবস্থাকে এমন হাস্যকর করে তোলার দায় তো তাদের একার না।

আরেকটা অনুরোধ, ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং বগুড়া-১ ও যশোর-৬ আসনের উপনির্বাচনের ভোটগ্রহণও যেন নির্ধারিত সময়েই সেরে ফেলা হয়। এমনিতে নির্বাচন নামের প্রহসন দেখতে রাগ লাগে, নির্বাচন পিছিয়ে দিলে সেই বিরক্তিটাও প্রলম্বিত হবে। আর পুরোটাই জনগণের অর্থের নিদারুণ অপচয়। যত কম হয়, ততই মঙ্গল।

তবে করোনা আতঙ্কের এই সময়ে নির্বাচন করায় বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের নাম বিশ্বের ইতিহাসে ঘৃণার অক্ষরে লেখা থাকবে।

প্রভাষ আমিন: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ