বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাবদ বরাদ্দের স্পষ্টতা দরকার

  সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ
  • আব্দুল্লাহ নাদভী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

একটি দেশের অগ্রগতি সকল স্তরের নাগরিকেরই ভূমিকা বা অবদান থাকে। তবে এই অগ্রগতির অর্থনৈতিক সুফল সবাই সমানভাবে পান- এমন নয়। ফল স্বরূপ অর্থনীতি অনেকখানি এগিয়ে গেলেও কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারি নাগরিকেরা ভূ-প্রাকৃতিক কারণে কিংবা কিছু নির্দিষ্ট জাতি-গোষ্ঠির নাগরিকেরা সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণে পিছিয়ে থাকেন। অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুফল যেন এই ‘পিছিয়ে থাকা’ নাগরিকেরা পান, তারাও যেন নিজেদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন- সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সে দায়িত্বের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রের একটি অন্যতম প্রধান কৌশল হলো বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বা সোশ্যাল সেফটি নেট প্রোগ্রাম (এসএসএনপি) বাস্তবায়ন করা।

বাংলাদেশে এ ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের দীর্ঘ ইতিহাস ও সাফল্য রয়েছে। ভিজিডি, কাবিখা-এর মতো কিছু কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি তো প্রায় পাঁচ দশক ধরেই দেশের প্রান্তিক মানুষের সুরক্ষায় অবদান রেখে চলেছে। এছাড়াও নতুন নতুন কর্মসূচিও এক্ষেত্রে যুক্ত হয়েছে। টিসিবি কর্তৃপক্ষ ট্রাকে করে কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহের যে উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে, কিংবা এক কোটি পরিবারকে বিশেষ কার্ডের মাধ্যমে কম দামে নিত্যপণ্য সরবরাহের যে উদ্যোগগুলো ইদানিং বেশ আলোচিত হচ্ছে- এগুলোও সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিরই অংশ। প্রতি বছরই জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের আগে আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাবদ বরাদ্দগুলো কেমন হবে তা নিয়ে জনপরিসরে বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়।

বিজ্ঞাপন

যদিও বাজেটের সকল প্রস্তাবনার সাথেই দেশের জনগণের আর্থসামাজিক ভবিষ্যৎ ওতোপ্রোতভাবে জড়িত, তারপরও এই কর্মসূচিগুলোর সঙ্গে প্রান্তিক মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন সরাসরি সম্পৃক্ত বলেই হয়তো এগুলো নিয়ে বাজেটের মৌসুমে আলোচনা একটু বেশি হয়। এবারে সংসদের বাজেট অধিবেশনের আগে আগে এই আলোচনাগুলোই একটু বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। কেননা সামষ্টিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা বিশেষ করে লাগামহীন মূল্যস্ফীতির কারণে সর্বস্তরের নাগরিকেরাই বাড়তি চাপে আছেন। এ অবস্থায় দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষদের জন্য বাজেটের সামাজিক সুরক্ষা অংশে যথাযথ বরাদ্দ ও নীতি-নির্দেশনা বিশেষভাবে কাম্য।

শেষ পর্যন্ত আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে কতোটা বাড়তি বরাদ্দ দেয়া হবে, নতুন কি কি কর্মসূচি নেয়া হবে, কিংবা পুরোনো কর্মসূচিগুলোর পরিধি ও বরাদ্দ কতোটা বাড়বে- তা জানার জন্য সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বিগত ৫-১০ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মোট বাজেটের ১৫-১৭ শতাংশ পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ধারণা করা যায়- আসছে বছরের বাজেটে এ অনুপাত কমবে না। বরং মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা থেকে প্রান্তিক মানুষকে রক্ষার জায়গা থেকে কিছুটা বাড়তেও পারে।

বিজ্ঞাপন

জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে বরাদ্দ বিশ্লেষণের সময় যে বিষয়টির দিকে সবারই মনোযোগ থাকা দরকার তা হলো- এই বরাদ্দের পুরোটুকুই কিন্তু দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষকে সরাসরি সহায়তা দেয়ার জন্য নিয়মিত/স্থায়ি কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ নয়। এর মধ্যে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দও হিসেব করা হয়। এই উন্নয়ন প্রকল্গগুলোর আওতায় কখনো হয়তো কিছু প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, কখনো বা কিছু কর্মংস্থানের ব্যবস্থা হয়, এমন কি কখনো কখনো অবকাঠামো প্রকল্পকেও এই তালিকায় যুক্ত করা হয়। এসব উন্নয়ন প্রকল্প হয়তো সুনির্দিষ্টভাবে দরিদ্র্য ও প্রান্তিক মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত। তবুও শেষ বিচারে এগুলো সরকারের উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থায়িত প্রকল্পই। প্রকৃত অর্থে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি নয়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নিয়মিত চলতেই থাকে। আর উন্নয়ন প্রকল্প নির্দিষ্ট সময় পরে শেষ হয়ে যায়। চলতি বছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাবদ যে ১ লক্ষ ২৬ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ দেখানো হয়েছে তার ৮ শতাংশের মতোই গেছে এমন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য। সাম্প্রতিক সবগুলো অর্থবছরেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মোট বরাদ্দের ৮ থেকে ১২ শতাংশ বিনিয়োজিত হয়েছে এমন উন্নয়ন প্রকল্পে। ফলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে আমরা মোট যতো বরাদ্দ দিচ্ছি বলে ধরে নিচ্ছি, তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসলে যাচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পে।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নানা রকম বস্তুগত সহায়তা দেয়া হলেও নগদ সহায়তা দেয়াকেই সবচেয়ে কার্যকর হিসেবে বিবেচনা করেন অনেকে। বিশেষত ভুল মানুষের কাছে সহায়তা যাওয়া ঠেকানো এবং সহায়তা দেয়ার সময় অপচয় রোধের জন্য নগদ সহায়তাকেই তুলনামূলক কার্যকর মনে করা হয়। বাংলাদেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মোট বরাদ্দের সবচেয়ে বড় অংশটিই ব্যয়িত হয় এ রকম নগদ ভাতা কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাবদ বরাদ্দের মধ্যে ৩৪ শতাংশের বেশি (৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি) বরাদ্দ হয়েছে বিভিন্ন নগদ ভাতা কার্যক্রমের জন্য। তবে এই বরাদ্দের পুরোটুকু বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা ইত্যাদি কর্মসূচির জন্য বরাদ্দ হয়েছে ধরে নিলে ভুল হবে। কেননা এই ৪৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২৭ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ৬৩ শতাংশই আসলে যাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অবসর ভাতা তথা পেনশন বাবদ। এরা নিশ্চয়ই দরিদ্র বা প্রান্তিক মানুষ হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন না। কাজেই বাজেটে দরিদ্র-প্রন্তিক মানুষের জন্য নগদ ভাতা সহায়তার যে অঙ্কটি দেয়া রয়েছে তা বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে। এই বিভ্রান্তির শিকার হতে পারেন স্বয়ং আইনপ্রণেতারাও।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী বাবদ বাজেট বরাদ্দ নিয়ে আলাপ-আলোচনায় তৃতীয় যে বিষয়টির দিকে নজর দেয়া দরকার তা হলো- এসব কর্মসূচি বাবদ বরাদ্দ বাড়ানোর ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতিকে আদৌ বিচেনায় রাখা হচ্ছে কি-না। এ কথা বেশি প্রযোজ্য নগদ সহায়তা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে। উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিস্কার করা যায়। বিধবা ভাতা কার্যক্রমের বরাদ্দের কথা ধরা যাক। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিধবা ভাতা কার্যক্রমের জন্য ১,৭০০ কোটি টাকার মতো বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগের অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে আগের বছরের চেয়ে চলতি বছের বিধবা ভাতা কার্যক্রমে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ১৩ শতাংশের বেশি। কিন্তু আগের অর্থবছরে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের মতো। কাজেই মূল্যস্ফীতিকে যদি বিবেচনায় নেয়া হয় তাহলে দেখা যাবে প্রকৃত অর্থে চলতি অর্থবছরে বিধবা ভাতা কার্যক্রমে বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র (১৩ – ৯) = ৪ শতাংশ। আগের অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছরে এই বিধবা ভাতা কার্যক্রমের উপকারভোগির সংখ্যাও আসলে ৪ শতাংশ বেড়েছে। ফলে প্রকৃত হিসেবে দেখা যাচ্ছে এই কার্যক্রমের উপকারভোগিরা আগের পরিমাণেই ভাতা পাচ্ছেন। আসলে তাদের ভাতা বাড়েনি। কিন্তু মোটা দাগের হিসেবে অনেকেই ধরে নিবেন বিধবা ভাতা কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে।

জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির বরাদ্দ নিয়ে এই অস্পষ্টতা বা ভুল বোঝার সুযোগগুলো রাখা একেবারেই উচিৎ নয়। দাপ্তরিক জমা-খরচের হিসেবের জন্যই হয়তো বরাদ্দগুলো এভাবে বাজেটে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু এর ফলে আইন-প্রণেতা ও নীতি-নির্ধারক-সহ অন্যান্য অংশীজনদের পক্ষে প্রকৃত চিত্রটি বোঝা দুষ্কর হয়ে ওঠে। আর তাতে শেষ বিচারে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন দরিদ্র ও প্রান্তিক নাগরিকেরা। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটেও হয়তো এই তথ্যগুলো একইভাবে আবার উপস্থাপিত হবে। তবে জনপ্রতিনিধি, গবেষক, ও গণমাধ্যম-সহ অন্য যারাই এই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করবেন তাদেরকে এ বিষয়গুলো অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হবে। আর প্রত্যাশা থাকবে অদূর ভবিষ্যতে বাজেট উপস্থাপনের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ এই অস্পষ্টতাগুলো দূর করেই বাজেট ডক্যুমেন্টসগুলো তৈরি করবেন।

লেখক: উন্নয়ন সমন্বয়ের গবেষণা পরিচালক।